মন্দের ভাল শেষ পর্যন্ত অরুন্ধতী রায়ের ভাষণটি নিবন্ধিত শ্রোতারা শুনেছেন যদিও এর আগে জল অনেক ঘোলা করা হয়েছে। অনেক প্রাণী আছে স্বচ্ছ জল তাদের মুখ দিয়ে নামে না। ইচ্ছেমত ঘোলা করেই তবে গলধঃকরণ করে। আমাদের অতি উৎসাহী এবং রাজনীতি সচেতন পুলিশ সেই প্রাণীকুলকেই অনুসরণ করে কি না কে জানে। তবে অনুষ্ঠানটি হওয়া না হওয়ার নাটকের চেয়ে বরং পুলিশের দেয়া শর্তগুলো আমার কাছে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে। এতে চিন্তার গবেষণার এবং হাস্য-রসেরও অনেক উপাদান রয়েছে। তাহলে আসুন এক নজরে সেই শর্তগুলো দেখে নেয়া যাক।
শর্ত
১: স্থান ব্যবহারের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকতে হবে।
২: অনুষ্ঠানে আসা লোকজন যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে পারবেননা।
৩: নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে।
৪: আর্চওয়ে স্থাপন ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে আগতদের শরীর তল্লাশি করতে হবে।
৫: সিসি টিভি স্থাপন ও নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬: রাষ্ট্র বিরোধী উস্কানিমূলক বা প্ররোচনামূলক বক্তব্য প্রদান করা যাবেনা।
৭: স্বল্প আওয়াজ সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে।
৮: মাদক বা নেশা জাতীয় দ্রব্য ক্রয় বিক্রয় বা সেবন করা যাবেনা।
৯: অনুষ্ঠানস্থলে শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে আয়োজনকারীরা দায়ী থাকবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১০: অনুষ্ঠানের বিধি বিধান মেনে চলতে হবে।
১১: কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া কর্তৃপক্ষ এই অনুমতি আদেশ বাতিল করতে পারবে।
এবার আসুন শর্তগুলো নিয়ে একটু রসালাপ করি।
১নং শর্ত মনে হয় একটা স্বাভাবিক ফর্মালিটি। তবে অনুষ্ঠানের চরিত্রের সাথে শর্তটি যায়না। পুলিশের কেন মনে হলো আয়োজকরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই এতবড় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বসবে? দরজার তালা খুলতেও তো হল কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হতে হবে কারণ এর চাবিটি তাদেরই হাতে। তালা ভেঙ্গে বা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে হলে প্রবেশের অভিপ্রায় ক্ষমতা সাহস কোনোটি কি ‘ছবির হাট’ ওয়ালাদের আছে?
২নং শর্ত একটি মোক্ষম দাবি।এরসাথে একাত্ততা ঘোষণা করবেনা এমন লোক পাওয়া বিরল।শুনতেও কত মধুর লাগে।মনে হয় যান চলাচলে সুশৃংখল এমন একটি রম্য এবং স্বপ্নের শহরের গল্প আমরা শুনছি যেখানে মানুষের সময়ের মূল্য অপরিসীম।যে শহরে সব কিছু হয় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে।মানুষ তার কর্মস্থলে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে। যেখানে যানজট শব্দটির সাথেই মানুষের পরিচয় নেই কেবল পুলিশের আইনের খাতায় এর অস্থিত্ব বিদ্যমান।কিন্তু হায়, এ যে স্বপ্ন সম ভ্রম।এ যে বাস্তব নয় ইউটোপিয়া। বাস্তব এ শহরের মানুষগুলোর জীবনের একটি বড় অংশ কেটে যায় রাস্তায় যানবাহনের বদ্ধ গুমোট বাতাসে। প্রতিদিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনগুলো পুড়ছে শত শত ব্যারেল তরল সোনা, পুড়ছে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ, উৎকণ্ঠা বিষণ্নতায় নষ্ট হচ্ছে লক্ষ কোটি শ্রম ঘন্টা, দূষিত কার্বন গাঢ় করে চলছে ওজনস্তর নামের মারণ-আচ্ছাদনকে। মন্ত্রীর গাড়িবহর অন্য সকল যানবাহনকে চোখ রাঙ্গিয়ে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে ছুটে যায় উল্টো স্রোতে। ব্যস্ত রাস্তাকে অনড় করে দিয়ে জমে ওঠে জনসভা যেখানে জ্ঞান নেই আলো নেই আছে শুধু আত্নপ্রচারের কর্ণবিদারী ডুগডুগি বাজানো, পরনিন্দা উস্কানি আর অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়ানোর প্রচেষ্টা। যে শহরে একটি তোষামোদ মাহফিলের জন্য অথবা একটি ধর্মীয় জমায়েতের জন্য পিছিয়ে যায় বাচ্চাদের সারা বছরের প্রস্তুতি নেয়া পরীক্ষার তারিখ সেই শহরের পুলিশ যখন একটি সুধী সমাবেশ আয়োজকদের কাছ থেকে যান চলাচলে বিঘ্ন না ঘটানোর হলফনামা চেয়ে বসে তখন মনে হয় এটাই বুঝি পৃথিবীর সেরা কৌতুক।
৩নং শর্ত- নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শেষ করার তাৎপর্যও দুর্জ্ঞেয়।যেখানে পরবর্তী কয়েকটি শর্তে নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে আগতদের শরীর পরীক্ষা করা থেকে শুরু করে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব আয়োজকদের উপরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে এটিও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এর ব্যত্যয় হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে অর্থাৎ এতে পুলিশ কোনো দায় দায়িত্বই নিচ্ছেনা তাহলে অনুষ্ঠান শেষ করার ব্যাপারে তাদের এত মাথাবিষ কেন? এই টেনশনতো হল কর্তৃপক্ষের থাকার কথা। পুলিশ যদি এই সময় সচেতনাটুকু শীতকালের দিবারাত্রির ওয়াজ মাহফিলগুলোর উপর প্রয়োগ করতেন তবে মানুষতো বটেই শব্দ কাতর এই ধরণীও একটু শীতল হওয়ার অবকাশ পেত।
৬নং শর্ত- রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক এবং প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেয়া যাবেনা। একজন প্রখ্যাত লেখকের বক্তৃতার ব্যাপারে এ ধরণের শর্ত আরোপে যেন অনেকটা পাকিস্তান পাকিস্তান গন্ধ পাওয়া যায়। পাকিস্তান আমলে এ রকম শর্তের কথা অহরহ শুনা যেত। তবু পাকিস্তানীদের পক্ষে রাষ্ট্র বিরোধিতার গন্ধ আবিষ্কারের পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য গ্রাউন্ড ছিল।কিন্তু আমাদের এই স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রবিরোধী বলে কেউ আছে নাকি? উস্কানিমূলক বা প্ররোচনামূলক শব্দ দুটি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের স্মৃতি সঞ্জাত এটা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কথার মানে কী? তবে হাঁ, রাষ্ট্র বিরোধী বলতে ইসলামী চরমপন্থীদের বুঝালে মেনে নেয়া যেত কেননা এরা আমাদের সংবিধানই স্বীকার করেনা বরং রাষ্ট্রের খোল নলচে পাল্টে সৌদি মডেলের শরিয়াভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্রের খোয়াব দেখে। এখানে সম্ভবত সরকার বিরোধীতা আর রাষ্ট্রবিরোধীতাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। এবং সেটা প্রমাদবশতঃ নয় সচেতনভাবেই করা হয়েছে।
৭নং শর্ত-‘স্বল্প আওয়াজ সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে’এটি সবচেয়ে রমনীয় এবং উপাদেয় শর্ত যা পুরোই বিনোদনে ভরপুর। হলফনামার এই ধারা তৈরির সময় হয় পুলিশ কল্পনায় মুহুর্তের জন্য জুরিখ ভিয়েনা অসলো ইত্যাদি কোয়াইটেস্ট সিটিগুলোর কোনো একটিতে চলে গিয়েছিল নাহয় অতিমাত্রায় নেশাজাতীয় কিছু গ্রহণ করেছিল।ক্ষুদ্রাকৃতির ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে কান-ফাটানো ভট-ভট শব্দের ভেতর বসে একজন আরেকজনকে- ‘ভাই আস্তে কথা বলুন,কানে বাজে’- বললে যেমন হাস্যকর শুনাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শব্দ-দূষণাক্রান্ত দেশে বাস করে ‘স্বল্প আওয়াজ সাউন্ড সিস্টেম’ব্যবহারের শর্ত তেমনি উদ্ভট এবং হাস্যকর শুনায়।যে দেশে মানুষের কাছে হর্ন বাজানো বাহাদুরির পরিচায়ক এবং ‘হর্ন হুদাই,বাজায় ভুদাই’ বলে কিছু সভ্য ভদ্র মানুষের কাগুজে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কাগজের দূর্গের মত তছনছ করে হর্নের শব্দ ছুটে চলেছে অনন্তের পানে। তারপরে আছে মাইক নামক মারণাস্ত্রের নিরন্তর আক্রমন। মাইকের ভয়ানক শব্দে মানুষ শ্রুতিশক্তি হারাচ্ছে, বধির হয়ে জন্ম নিচ্ছে শিশু, দুর্বল মানুষের হৃদপিন্ডের ছন্দপতন ঘটছে তবু মাইকের প্রেম বাঙ্গালী ছাড়াতে পারছেনা।মাইক যেন আমাদের সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনমে মাইক মরণে মাইক,হরষে মাইক বিষাদে মাইক বিবাহে মাইক,বিচ্ছেদে মাইক, ধর্মে মাইক অধর্মে মাইক ,জনসভায় মাইক,ইদুর মারার বড়ি বেচায় মাইক,কোথায় নেই মাইক? আর এইসব মাইকের আওয়াজের মাত্রা আনলিমিটেড, নিপীড়নের ব্যাপ্তি কোনো কোনোটির অষ্টপ্রহর কোনো কোনোটির দিবারাত্রি।বড় বড় শহরগুলো শব্দের কারণে একরত্তি সময় পায়না ঘুমাবার।রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে ঢাকায় জন্ম নিলে কখনও “কোলাহলতো বারণ হল,এবার কথা কানে কানে”এরকম রোমান্টিক পংক্তি লিখতে পারতেন না বরং আকাঙ্খা করে লিখতেন-কোলাহল যদি বারণ হত,কথা হত কানে কানে’।পুলিশ যদি স্বপ্নময় কল্প বিলাসী মুডে সাউন্ড সিস্টেমের এই অহি নাজেল করে থাকে তবে তারা তাদের কল্পনাশক্তির জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে।
৮নং শর্ত, মাদক বা নেশা জাতীয় দ্রব্য ক্রয় বিক্রয় বা সেবন করা যাবেনা, পড়ে হয়তো আপনার হাসি পেয়ে থাকবে।কিন্তু এটা আদৌ হাসির ব্যাপার নয় বরং পুলিশের অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতা।কেননা মাদকের সাথে পুলিশ এত বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে যে মাদক বিহীন একটি সোসাইটি, একটি মানব সমাবেশ তারা কল্পনাও করতে পারেনা।
তবে সর্বশেষ শর্ত-কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া কর্তৃপক্ষ এই অনুমতি আদেশ বাতিল করতে পারবে’ এটিই হল সারবস্তু।সকল শর্তের রাজা।অর্থাৎ তোমরা ছবির হাটওয়ালারা উপরের সব শর্ত মানলেই যে অনুমতি পেয়ে গেছ তা ভেবনা, বাছাধনরা।শেষতক আমার মর্জি বা করুণার উপরই তোমাদের অনুষ্ঠান হওয়া না হওয়া নির্ভর করবে।হাঁ, পুলিশ সর্বশেষ শর্তটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তারা অনুমতি আদেশ বাতিল করে দিয়েছে।
শেষমেষ বিকল্প ভেন্যুতে অনুষ্ঠান হওয়ার পেছনেও নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ছিল।তিনি নাকি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন-এসব কি আমাকে ডুবাবার জন্য করা হচ্ছে? ভাবুন একবার, আংশিক হওয়াতেই এতটুকু, পূর্ণাঙ্গ পুলিশি রাষ্ট্র হলে তার মাত্রা কদ্দুর গড়াবে?
সর্বশেষ নাকি সর্বস্ব প্যারাটি লেখার মান ক্ষুন্ন করেছে।
অরুন্ধতি নাটকেই বাক স্বাধীনতার হাল দৃশ্যমান। প্রতিবাদ জানাই।