লিখেছেন: প্রস্তর প্রসূন

সময়টা ছিল ২০১৫ এর ফেব্রুয়ারি।ভাষার মাস,বইমেলার মাস।বইমেলায় প্রায়শই যেতাম।যেহেতু পুরাতন ঢাকায় ছোট থেকে বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি ঐতিহ্যবাহী এক সরকারি স্কুলে।তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা একাডেমির এই বইমেলার প্রতি অন্যরকম টান কাজ করতো।বন্ধুরা মিলে যেতাম,আবার একাও যেতাম।

তো সাধারণ এক দিনের মতো ২৬ ফেব্রুয়ারিও গিয়েছিলাম সেখানে।আসরের নামাজ বন্ধুরা এলাকার মসজিদে পড়ে বের হয়ে অনেক ঘুরাঘুরি করি।অনেক মজা করি।নাম না জানা অনেক লেখকদের সাথে ছবিও তুলি।এরপর ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরি।যেহেতু এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম ,সময়টা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।তাই বাসায় ফিরেই পড়তে বসি।
পড়ার এক ফাঁকে টিভি অন করতেই শুনি আজ বইমেলায় একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শুনেই একটু খারাপ লাগলো।যে চাপাতি দিয়ে মানুষ কুরবানীর সময় গরুর মাংস কাটে,সেই চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা !! তার নিশ্চয়ই ছোট একটা বাবু ছিল,হয়তো সেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এসব ভাবতে ভাবতে আরেক চ্যানেলে শুনি উনি নাকি একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ছিলেন।
ওহ শিট,নিশ্চয়ই শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন !! মনে মনে ভাবলাম।সময় গড়ালো আরো শুনলাম ভিকটিম এর ব্যাপারে।আরো জানলাম লোকটা একজন ব্লগার।এবার একটু ভ্রু কুঁচকে গেল।ব্লগার??নিশ্চয়ই নাস্তিক লোকটা!!
ব্লগার হলে ঠিক আছে।এই কুখ্যাত ব্লগাররাই আমার নবী মুহাম্মদ স: কে নিয়ে কটূক্তি করেছিল ২০১৩ এর ফেব্রুয়ারিতে।উফফ কিসব সেই লেখা!!ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে বারবার।তবুও একটু খানি দয়া কাজ করছিল কেনোনা সেও একজন মানুষ।মানুষকে হত্যা করা কি ইসলাম সমর্থন করে ??
এসব ভাবতে ভাবতে আবার পড়তে বসি ।পড়া কি আর হয় ?? ঘুরেফিরে একই জল্পনায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম।শত হলেও লোকটা নাকি বিজ্ঞানের লেখক ।এমনিতেই বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখকের অভাব।তাছাড়া বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বিজ্ঞানের প্রতি ও বিজ্ঞানমনস্কদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা কাজ করতো।সেই থেকেই একটা সহানুভূতি কাজ করতে লাগলো।দুয়েকদিন পর যা হবার তাই হলো।ভুলে গেলাম সব।তবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের খবর শুনলে আবার ভেতরটা নাড়া দিতো।
যেহেতু এসএসসি পরীক্ষার জন্য খুব বিজি ছিলাম।তাই সময় হয়ে ওঠেনি লোকটার লেখা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবার।SSC পরীক্ষা শেষ হতে হতে মার্চের শেষ অবধি চলে এল।এই দীর্ঘদিনের ব্যবধানে অনেক কিছুই ভুলে গেছি।তবুও পরীক্ষা শেষে আমার Nokia E5 মডেলের ছোট মোবাইলটি দিয়ে গুগলে সার্চ দেই “অভিজিৎ রায়” এবং তার ব্লগ “মুক্তমনা” এর ব্যাপারে।অনেককিছু জানলাম তার ব্যাপারে।বিভিন্ন জার্নাল, সাময়িকীতে তাঁর লেখা গুলো পড়লাম।এক বন্ধুর থেকে “জিরো টু ইনফিনিটি” নামক মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকা এনে পড়া শুরু করি।সেখানে এস্ট্রনমি নিয়ে তার একটি আর্টিকেল ছিল।তবে খেয়াল করি,অন্যান্য বিজ্ঞানের লেখকদের সাথে অভিজিৎ রায়ের পার্থক্য ছিল এই যে,অন্যরা প্রমাণ করতে চায় বিভিন্ন বিজ্ঞান কুরআন, গীতা,বাইবেল থেকেই এসেছে।ওনার লেখায় এমন কিছুই নেই।
হুম,এবার কিছুটা কনফার্ম হলাম সে একজন নাস্তিক।রাজীব হায়দার, তসলিমা নাসরিন,আসিফ মহিউদ্দিনের মতো নাস্তিক।এমনিতেই ঘৃণা করতাম নাস্তিকদের।তীব্র ঘৃনা নিয়েই ঢুকলাম মুক্তমনা ব্লগের লেখা পড়বার জন্য। সর্বপ্রথম যে লেখাটি চোখে পড়লো সেটি ছিল অভিজিৎ রায়ের লেখা “বিজ্ঞানময় কিতাব” শিরোনামে একটি আর্টিকেল । শুরু থেকে শেষ অব্দি পড়ি লেখাটি।পড়ার পর মনে হলো যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথার উপর।যে কুরআন শরীফকে এতো নির্ভুুুল ভেবেছিলাম ,বিলিভ করতাম কুরআন এ কোন সন্দেহ নেই।সুুরাহ বাকারার দুই নং আয়াতকেই সবচেয়ে সত্য বলে জানতাম।
সেই বিশ্বাস যেন কাঁচের আয়নার মতো ভেঙে পড়লো।আর্টিকেলের প্রতিটি রেফারেন্স আলমারিতে রাখা গিলাফে জড়ানো অনুবাদ সহ কুরআন থেকে মিলিয়ে দেখি।একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে কখনোই সহিহ হাদিসের বই পাবেন না।যেমন বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ কিংবা সিহাহ সিত্তাহ ছাড়াও অন্যান্য হাদিসের বই ।তাদের একমাত্র জ্ঞানের উৎসই হলো মোকসেদুল মুমিনীন,ফাজায়েলে আমল কিংবা মৃত্যুর পরে কি হবে টাইপ বই।আমার পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না।তাই হাদিসের রেফারেন্স গুলো মিলিয়ে দেখতে পারি নি।কেবল যাচাই করি কুরআন এর রেফারেন্স গুলো। খুবই আশ্চর্যান্বিত হই রেফারেন্স সঠিক দেয়া দেখে।কেননা এতদিন শুনে এসেছি যে নাস্তিকরা ভুলভাল, মিথ্যে বকে।আসলেই কি তাই ??কিন্তু … আসলেই পৃথিবী সমতল,পাহাড় আসলেই কি পেরেকের মত কাজ করে,কিংবা সূর্য কর্দমাক্ত জলাশয়ে ডুবে যায়, … … ?? বিজ্ঞান বইয়ে তো পড়েছি অন্য কথা।তাহলে কোনটা সঠিক??সন্দেহহীন কুরআন নাকি বিজ্ঞান বই??সেদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে মোবাইল নিয়ে পড়ে রইলাম।আরও লেখা পড়লাম।পেয়ে গিয়েছি নতুনভাবে জানার এক অন্তর্জাল।পাশাপাশি আমার এক ডায়েরিতে সেসব রেফারেন্স গুলো লিখে রাখি।সেই আমার প্রথম সংগ্রহের ডায়েরিটা এখনও আছে।যার সাথে লেগে আছে অনেক স্মৃতি।।
এভাবে দিন চলছে আর মোবাইলের মেমোরি কার্ডে যুক্ত হতে লাগলো বিভিন্ন ধরনের বই,বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল।ধর্মের আশ্রয়ে লালিত বিভিন্ন কুসংস্কার, অজ্ঞানতা ও ভণ্ডামির পর্দা ফাঁস হচ্ছিল দিনকে দিন।অনন্ত দা এর নূহ নবীর মহাপ্লাবনের ব্যবচ্ছেদ পড়লাম।বুঝলাম মহাপ্লাবনের মিথের লজিক কতোই না ঠুনকো আজকের বিজ্ঞানের কাছে।কেবল কি নূহ নবী?? আদম হাওয়া কেও তো একেবারেই নাকানিচুবানী খাইয়ে ছাড়লেন ।তখন ৬০ কিউবিট লম্বার আদম আর তার বক্র হাড় থেকে তৈরি হাওয়ার প্রতিও বিশ্বাস রইল না।ধীরে ধীরে আকাশ মালিক, আসিফ মহিউদ্দিন, তসলিমা নাসরিন, সুষুপ্ত পাঠকদের লেখা গুলোও পড়লাম।আর ক্রমশই বিশ্বাস হারাতে লাগলাম।বাসায় দেখছে তাদের ছেলে দিব্যি খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে,আজান দিলে নামাজ পড়তে যাচ্ছে।কিন্তু তারা দেখছে না তাদের ছেলে ভেতরে ভেতরে কতটা পরিবর্তিত হচ্ছে।
প্রথমে যদিও কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন গালগল্পকে বিজ্ঞানের কষ্টিপাথর দিয়ে পরখ করে দেখছিলাম।আর বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বিষয়গুলোকে অনেক ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল।তাই বলে কি মুক্তমনার কথাকেই সত্যি ধরে বসে ছিলাম??
উত্তর হচ্ছে, না।আমি এমন কিছু ওয়েবসাইট পেলাম যারা মুক্তমনার বিভিন্ন ভুল ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।তার মধ্যে একটির কথা না বললেই নয়।সেটি ছিল সদালাপ নামক একটি ব্লগ।খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লাম।খেয়াল করলাম, তাঁদের রিফিউট অতিরঞ্জিত গোঁজামিল ও মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই না।এমন এমন কিছু ভুল ছিল যা ধরতে কোন বৈজ্ঞানিক হওয়া লাগে নাই,এই এক ছোট্ট কিশোরের চক্ষুতেই ধরা পড়ে যায় তা !!
তাই ধীরেধীরে আমার অবিশ্বাস গাঢ় হতে লাগলো।বেশ অনেকদিন পরে মুক্তমনা ব্লগে অভিজিৎ রায়ের ছেলেবেলা, কৈশোর কাল,বয়ঃপ্রাপ্তির জীবন ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারি।তার ছেলেবেলার ঘটনার সঙ্গে আমার ঘটনার তুলনা করি।তার বাবা তাকে রাজ্যের ধনসম্পদ দিতে পারেননি, কিন্তু দিয়েছিলেন অফুরন্ত জ্ঞানের আকর।আর আমার বাবা ??মসজিদ কমিটির সভাপতি বাবা আমাকে কখনো বই পড়ার ব্যাপারে তাগিদ দেন নি।কখনও তুলে দেন নি গল্প,উপন্যাসের বই।বন্ধু পার্থ কিংবা রুশদানের কাছ থেকে কোন বই চেয়ে আনতাম পড়ার জন্য,বাবা বলতেন বই ফেরত দিয়ে আসতে।বলতেন মুসলমান ছেলেরা একমাত্র বই পড়বে সেটা হলো আল কুরআন।আজ বাবার কথা রেখেছি বিধায় জানতে পেরেছি ইসলামের অজানা কিছু অধ্যায়।জেনেছি কুরআন নবীর হাতেই বানানো।
দিন যতই গেল শেখার ও জানার নেশায় বুদ হতে লাগি।বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে লাগি।মুক্তমনা ব্লগে নবীজী স. এর জীবনীভিত্তিক কিছু লেখাও পেয়ে।খুব মর্মান্তিক যে ঘটনা ছিল তা হলো বানু কুরাইজার ৮০০-৯০০ লোককে এক রাতে জবাই করে হত্যার ব্যাপারটা।এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম।স্কুলে মিলাদ অনুষ্ঠানে ক্বিরাত এবং হামদ প্রতিযোগিতায় দুইটা বই পুরস্কার পেয়েছিলাম ।বই দুটির নাম ছিল “আর রাহীকুল মাখতুম” এবং “খাসায়েসুল কুবরা” ।খুঁজতে থাকি সেখানেই এ ব্যাপারে।১ম বইয়ে স্পষ্টভাবে বলা ছিল ৮০০ লোককে হত্যার ব্যাপারে।লেখাটা পড়ে আমার মাথা ঝিম ধরে উঠল।৮০০ জন??চাট্টিখানি কথা?? নবীর ব্যাপারে জানতাম সে খুব দয়ালু যেকিনা তাকে কষ্ট দানকারী এক ইহুদি বুড়িরও সেবা যত্ন করতেন। আবার,তিনি এমনও নির্দেশ দিয়েছেন যে কেউ তাকে অপমান করলেই তাকে যেন হত্যা করা হয়।এর ফলে বৃদ্ধ কবি আবু আফাকও মারা পড়েন।বাঁচতে পারেন নি আসমা বিনতে মারওয়ানও,যে কিনা মারা যাওয়ার একটু আগেও তার ছোট বাচ্চাকে স্তন পান করাচ্ছিলেন।ইবনে খাতালকে তো তৎকালীন আরব সমাজের নিয়মকে জলাঞ্জলি দিয়েই হত্যা করা হয়।তখনকার নিয়ম ছিল,কেউ যদি আশ্রয়লাভের জন্য কাবার গিলাফ ধরে থাকে তাহলে তাকে হত্যা করা হতো না।কিন্তু বাঁচতে পারেননি খাতাল ও। মুহাম্মদের চ্যালাচামুন্ডারা জান্নাতের লোভে তার জীবন কেড়ে নেয়।
পরবর্তীতে আরো অনেক লেখা থেকে জানলাম, আমাদের পেঁয়ারে নবী ইহুদীদের জায়গা কথিত আল্লাহর দোহাই দিয়ে দখল করেছিলেন, তাদেরকে নির্বাসিত করেছিলেন ।তাদেরই পিতৃভূমি তে ইসলামের পতাকা উড়িয়েছিলেন,কথিত আল্লাহর যুদ্ধে বিভিন্ন নারীদের সম্ভ্রম লুফে নিতেও কুন্ঠাবোধ করেন নি আমাদের দয়ার নবী,মানবতার নবী।একই কারণে যদি পাক হানাদারদের ঘৃণা করতে পারি তবে নবী মুহাম্মদ কে কেন নয়??
এরকম হাজারো অসঙ্গতি নিয়েই গবেষণা করে চললাম।তখন নামাজ যে একেবারেই ছেড়ে দিছিলাম তা বলা ভুল।মাঝেমধ্যে ৩-৪ ওয়াক্ত এবং সাপ্তাহিক জুম্মার নামাজ পড়তাম।জুম্মার নামাজের শুরুর ১ ঘন্টা আগেই আমি আর রুশদান ও পাড়ার কিছু বন্ধুরা মসজিদের ছাদে বসে এসব নিয়ে আলোচনা করতাম।আলোচনা চলত কুরআন নাজিল নিয়ে,আলোচনা চলত কুরআনে বিজ্ঞান নিয়ে,আলোচনা চলত নবীজির জীবনী নিয়ে ।আমার আর বন্ধু রুশদানের হাত ধরে অনেক বন্ধুরাই অন্ধকার ইসলাম থেকে বেরিয়ে এসেছেন।জানি,ওরা কখনোই এসব শেয়ার করবে না কারো সাথে।কারণ শেয়ার করতে তারা ভয় পায়।ভয় হয় তাঁদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয়।ভয়..চাপাতি নামক এক ইসলামী হাতিয়ারের ভয়!!
কিন্তু আমি কোন ভয় পাই না।আমার কোন ভয় নেই।ভয়েরা সব পালিয়েছে।ভয় পাননি  অভিজিৎ রায়ও।যার প্রতিটি কলমের আঘাতে,প্রতিটি কীবোর্ড বাটনের প্রেসে ঈশ্বরের আরশ কেঁপে উঠত।শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠত্ব হতো ভূলুণ্ঠিত। আকাশচুম্বী দেবতাদের দৈববল মুখ থুবড়ে পড়তো মাটিতে !! অভিজিৎ রায় তো নিজেই একজন আলোর পথযাত্রী, যে কিনা আলো হাতেই এসেছিল আলো দেখাতে।আলো পূর্ণরূপে ফুটে উঠার আগেই আলোকে নিভিয়ে ফেলে অন্ধকারের জালিমেরা।তবে হে অভিজিৎ রায়, ভয় নেই।আলো নিভে নাই।আলোকে জ্বালিয়ে রেখেছি।।মরেছে কেবল এক অভিজিৎ, হাজার অভিজিৎ জন্মের অপেক্ষায় !!