২৬’শে ফেব্রুয়ারি দিনটায় অভিজিৎ রায় নামের একজন মুক্তচিন্তক ভালো মানুষকে খুন করা হয়েছিল। এই মানুষটার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল অন্যের ভাল করা। প্রচুর লেখাপড়া করে, জ্ঞানার্জন করে অন্যকে সেই জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করা অথবা সেই সুন্দরের; সত্যের, আলোর পথের সাথী করাই ছিল যেন তার জীবনের সবকিছু।

বিজ্ঞানের বেশ কিছু জটিল বিষয় সহজ করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য অনেক লেখালিখি করত মুক্তমনের মানুষ ড: অভিজিৎ রায়। একজন পরিষ্কার যুক্তিবাদী মানুষ ছিল অভিজিৎ। কারো কিচ্ছু ক্ষতি করেনি সে। ওকে যেদিন জনসম্মুখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় সেদিন তার সাথে ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী, স্ত্রী ও তাঁর প্রিয় বন্ধু বন্যা আহমেদ। একই অস্ত্রের আঘাত বন্যাকেও করা হয়েছিল। কোনভাবে বেঁচে যায় বন্যা আহমেদ কিন্তু অভিজিৎ বাঁচল না। খুন হয়ে গেল। মাত্র অল্প ক’জন মানুষ জানতে চাইল, কেন এমন মানুষদের খুন করে ফেলা হয়? কেন, কে, কারা? মাত্র চার বছর পার হচ্ছে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অথচ এর মধ্যেই হয়ত ফিকে হয়ে যাচ্ছে অভিজিৎ খুনের ঘটনা। দায়সারা গোছের তদন্ত, বিচার আর শাস্তির ব্যবস্থা হবে হয়ত কিন্তু ন্যায় বিচার যে হবে কি না তা তো বলাই বাহুল্য।

অভিজিৎ বিজ্ঞানকে অবলম্বন করেছিল সত্যের সন্ধানে। অভিজিৎ নতুন কিছু আর লিখবে না বটে তবে মূলতঃ বিজ্ঞান ভাবনার কথাগুলো যা কিছু সে লিখেছে, বই হয়ে বেরিয়েছে সেগুলো নিশ্চই আদর পাবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞানের স্বভাবই হচ্ছে যতটুকু সম্ভব সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। অবিরাম চেষ্টায় যতটা সম্ভব কোন ভুল ধারণাকে শুধরে নেওয়া। এই পথটি সত্যানুসন্ধানের, প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার আর সিদ্ধান্তের। বার বার পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া মানুষের সাধারণ জানাকে, সত্যির মত মনে হওয়া সত্যকে কোন শক্ত ভিত্তি দেওয়া যায় না। আসল সত্যির কাছেই যেতে চায় বিজ্ঞান। বিজ্ঞান সব সময়ই নতুন চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানায়, পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রশ্ন আর সমালোচনার জন্য খুলে রাখে সবগুলো দরজা জানালা। গ্রহণীয় জ্ঞানলব্ধ ফলাফলকে সাথে নিয়ে আরো এগিয়ে যায় সেটা, পরিবর্তনকে নতুন সত্য জেনেই করে সেই সবকে করে আলিঙ্গন। এই পরিবর্তনের পথে অনেক স্থবির ভাবনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সত্যসন্ধানী বিজ্ঞান। পরিবর্তন হয় না এমন স্থবির অনেক ভাবনাগুলোর একটার নাম হচ্ছে ধর্ম। যেহেতু নতুন নতুন অর্জিত জ্ঞানকে ভিত্তি করেই এগিয়ে চলে বিজ্ঞান, তাই এখানে স্থবির জ্ঞান অর্থাৎ ধর্মজ্ঞান বা আচারের কোন স্থান নেই, নেই কোন আদর, নেই প্রয়োজন। মানুষদের এই যে এগিয়ে যাওয়া, এরই নাম প্রগতি যা প্রতিষ্ঠা করা খুব একটা সহজ নয়। ভয় দেখিয়ে যে সব স্থবির ভাবনাগুলো মানুষের মনের খুব গভীরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে সেইসব ভয়কে জয় করে এগিয়ে চলতে সাহস লাগে, লাগে মুক্ত মন। মুক্ত মন মানেই হল অনুসন্ধিৎসা; প্রশ্ন করে কোন বিষয়ের গভীরকে জানতে চাওয়া, কে কি কোথায় কখন কেন কিভাবে? এই জানতে চাওয়াটা কোন অপরাধ নয়, এটি সত্য সন্ধানের অভিপ্রায়ে কৌতূহলি হয়ে ওঠা মাত্র। আর এই কৌতূহলের ফলে; উত্তর সন্ধানের পথচলায়, উন্মোচন হতে থাকে নিত্য নতুন সত্য। সত্যিকার মুক্ত চিন্তার মানুষরাই শুধুমাত্র সত্য সন্ধানের পথে স্থির থাকে, যাদের অন্যতম উদ্দেশ্য অন্য মানুষকেও সত্য সুন্দরের পথের সাথী করা, যুক্তির পথ দেখানো। কেন? কি তাদের দায় পড়েছে? উত্তরটা সোজা, এরা পরোপকারী। এরা জ্ঞান অন্বেষণের চর্চায় সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি এগিয়ে, তাই তারা জানেও অনেক। মুক্তচিন্তক তার লব্ধ জ্ঞান বিলিয়ে দিতে চায়, ভাবে এটাই হয়ত তাঁর জীবনের আসল উদ্দেশ্য। এ দোষের নয়, হতেই পারে না। এ তো শুধু কল্যাণের, তবু মেরে ফেলা হয় মুক্ত চিন্তকদের। সত্য জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে এরা আর এজন্যই ভয় পেয়ে যায় শাসক, শোষক এবং স্বার্থপর গোষ্ঠী। গদি বাঁচাতে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলে তারা অনেক মুক্ত চিন্তকদের। গুম অথবা খুন করে ফেললেও সত্যি হিসেবে যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার মানুষদের কাজগুলো বাতিঘর’এর মতই উজ্জ্বল হয়ে পথ দেখিয়ে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের।

বাংলা ভাষায় কথা বলা মুক্ত চিন্তকদের মধ্যে অভিজিৎ এ সময়ের একজন অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমান করে গিয়েছে অভিজিৎ যে অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে গেলে নিজের প্রানটাকেও হয়ত দিয়ে দিতে হতে পারে। অথচ সত্যি কি তা জানতে চাওয়াটা একজন মানুষের খুবই মৌলিক অধিকার। কে; কি; কোথায়; কখন; কেন; কিভাবে, এই সব কথাগুলো যতক্ষণ একজন মানুষ ভাবতে না শিখবে ততক্ষণ মুক্ত চিন্তকদের ছুটি নেই। কোন ভয়ভীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে মুক্ত ভাবে চিন্তা করাটাই জ্ঞান অর্জনের শুরু; শুধুমাত্র এইটুকু ভাবতে পারলেই একজন সচেতন মানুষের জন্য তা যথেষ্ঠ, সে নিজেই নিজেকে আলোকিত করতে পারবে। প্রয়োজনে নিশ্চয়’ই তাদের পাশে থাকবে সকল মুক্ত মনের মানুষ অথবা তাদের মুক্ত চিন্তার অসীম অনুভব।

একালের সব ক’জন প্রিয় মুক্তচিন্তক, যারা অন্যকে ভালবেসে নিজেদের বিসর্জন দিতে ভয় পায়নি আর যারা বেঁচে আছে তাদের সবার জন্য রইল উষ্ণ ভালবাসা। প্রিয় অভিজিৎ’কে ভালবেসে আজ যারা লিখছেন, বলছেন অথবা ভাবছেন, তাদের সবার প্রতি থাকলো একজন সহযাত্রীর একাত্বতা। সকল ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পথহারা মানুষের জন্য এক একটি বাতিঘর হয়ে জ্বলুক এক একজন সত্য সন্ধানী মুক্ত মনের মানুষ, একজন মুক্ত চিন্তক যার ভাবনা অনেকটাই অভিজিৎ’এর মত।