ফিরে এল আবারও ২৬ ফেব্রুয়ারি।  এই দিনেই, ২০১৫ সালে, বইমেলার পাশেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়কে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন বন্যা আহমেদ।

 

অভিজিৎ রায়

 

অভিজিৎ রায় চেয়েছিলেন আমরা প্রকৃতিকে চিনব বিজ্ঞানের মাধ্যমে, চিন্তা করব মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। শিশু থেকে আরম্ভ করে সবার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বিরাজ করবে, কোনো কিছুর আনুগত্য করা যাবেনা প্রশ্নহীনভাবে। তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটির নামের মধ্যেই অভিজিৎ রায়কে খুঁজে পাওয়া যায়। রবি ঠাকুরের এই কলি এক ঘোরের জন্ম দেয়। মনে হয় অভিজিৎ রায় ঘন অন্ধকারে একটি পিদিম হাতে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গন্তব্যে আর মৃত্যুর দিকে চেয়ে হাসছেন মিটিমিটি।

যদিও তার লেখার বিষয় ছিল বিজ্ঞান ও দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো, তারপরেও মানবিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের জন্য লিখেছেন, সংখ্যালঘু-আদিবাসী নিয়েও তিনি খোঁজখবর রাখতেন। সমকামীদের অধিকার নিয়ে তো পুরো একটি বই-ই লিখে ফেলেছিলেন। এদের অধিকারের পক্ষে এভাবে কেউ হয়ত দাঁড়াত আরো শতাব্দিকাল পর, অনেক অনেক নিপীড়নের পর। কিন্তু অভিজিৎ সেটা করে দেখালেন এ সময়েই।

তিনিই বাংলা ভাষায়  স্পষ্টভাবে আমাদের শিখিয়েছেন বিজ্ঞান আর অ-বিজ্ঞানের পার্থক্য, এ বিষয়ে লিখে গেছেন বিস্তর। তিনি’ই দেখিয়েছিলেন কোনো কিছুর ঐশ্বরিক ব্যাখ্যার কোনো মানে হয় না, ঈশ্বর একটি বাড়তি হাইপোথেসিস মাত্র। অভিজিৎ এগুলো বলতে গিয়ে পতিত বুদ্ধিজীবীদের মত কোনো সুবিধাবাদের অন্তরালে নিজেকে ঢেকে নেননি, কোনো রাখঢাক তার ছিল না। এটা একদিকে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল সত্য সন্ধানীদের কাছে, সংশয়বাদিদের কাছে অপরদিকে তিনি এক বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ছদ্মবিজ্ঞানের আশ্রয়ে থাকা অন্ধকারের ফেরিওয়ালা ও ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে।

অভিজিৎ রায় সম্পর্কে বেশি কথা বলার সময় হয়ত এখনো আসে নি, এখনো তিনি আমাদের মাঝে জীবন্ত আছেন। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটি প্রকাশ হয়েছিল ২০০৫ সালে।  বইটির এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াই, তিনি ব্রুনো প্রসঙ্গে বলেছেন,

বোঝাই যায়, ব্রুনোর নশ্বর দেহ যখন আগুনের লালচে উত্তাপে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, ‘ধর্ম বেচে গেলভেবে ধর্মবাদীরা কি উদ্বাহু নৃত্যই না করেছিল সেদিন! তারপরও ঈশ্বর আর তার পুত্ররা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরা শেষ পর্যন্ত থামাতে পেরেছিলেন?”

অভিজিৎ রায়’কেও হত্যা করা হল নৃশংসভাবে। এর আগে হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা হল। হত্যা করা হল অনেকগুলো মেধাবী ব্লগার-লেখককে: অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর বাবু, রাজীব হায়দার, নীলাদ্রি নিলয়। কিন্তু মানুষের অগ্রগতি কি তাতে থামানো গেছে? এসব হত্যাকাণ্ড হাস্যকর অপ-বিশ্বাসগুলোকে কি বাস্তব করে তুলেছে?

আবহমান কাল থেকেই যারা প্রথা-বিরোধী, সমাজের অচলায়তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এদেরই হাত ধরে মানুষ এগিয়ে গেছে বহু বহু দূর, অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এসেছে আলোর দিকে। আমরাও নি:সন্দেহে অভিজিৎ রায় এর মশালের আলোয় এগিয়ে যাব এক সভ্য পৃথিবীর দিকে।

আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি অভিজিৎ রায় এর জন্য নির্মিত মুক্তমনা’র বিশেষ পাতায়: লিঙ্ক’, আর এখানে রয়েছে অভিজিৎ রায় এর বই, ছবি, জীবনী ইত্যাদি। অভিজিৎ রায় এর লেখা বইগুলো মুক্তমনা ই-গ্রন্থাগারেও রাখা আছে।