অবয়ব মুছে যাওয়া অঙ্গার শরীর

কজন মানুষ হল অনেকগুলো রাস্তার সংগমস্থলের মত যেখানে এসে মিলিত হয় অনেক অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন।সেই হিসেবে চকবাজার ট্রেজেডিতে মাথাগুনতি হিসেবে আটাত্তর জন মানুষের মৃত্যু হলেও পুড়ে ছাই হয়েছে অসংখ্য আশা আকাংকা। অগনন স্বপ্ন পরিণত হয়েছে ভয়ানক দুঃস্বপ্নে। অনেক সাজানো বাগান হয়ে গেছে তছনছ। কোনো অর্থ বিত্ত সহানুভূতি সহমর্মিতাই সেই বিধ্বস্ত সংসার আর স্বজনহীন মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তবু মানুষ হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াই বা দাঁড়াতে চাই। রাষ্ট্রও তার দায়িত্ব নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায় এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু এইসব হাহাকারকে চাপিয়ে যখন দায়িত্বশীল জাতীয় পত্রিকাগুলো এমন কিছু অযৌক্তিক এবং অনৈতিক খবর ছাপে তখন আমাদের সভ্যতার বয়স নিয়ে প্রশ্ন জাগে।প্রশ্ন জাগে আর কত পথ পাড়ি দিলে পর আমরা মানবিক উপলব্ধির জায়গাটিতে পৌঁছব।বিভিন্ন মিডিয়ায় যখন পুড়ে যাওয়া মানুষগুলোর অসংখ্য বিয়োগান্তক কাহিনী আমাদের চিত্তকে বিপুলভাবে নাড়া দিচ্ছে তখনই কিছু পত্রিকায় এমন খবরও ফলাও করে ছাপছে- “চারপাশের সবকিছু পুড়ে ছাড়খার পাশের মসজিদটি অক্ষত, “আল্লাহু আকবার খচিত নামফলকটিকে আগুন স্পর্শ করেনি” এমনকি এক পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক ছাইভষ্মের মাঝে আরবি ছিপারার একটি অক্ষত পৃষ্টাকে ক্যামেরাবন্দী করে অলৌকিকতার শান আবিষ্কার করে বসেছেন।

                                                                   করুণ আর্তি আর স্তব্ধতার যুগপৎ ক্যানভাস

 

এখন প্রশ্ন হল দায়িত্বশীল সংবাদপত্রগুলো এসব নিউজ করে কী বুঝাতে চায়? অক্ষত বস্তুগুলো পবিত্র বলে আগুনে ভষ্ম হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছে? আল্লাহ তার পবিত্র নাম বা বাণীখচিত স্থাপনাগুলোকে নিজে এসে রক্ষা করেছেন? যারা এমন বিশ্বাস করেন বা বিশ্বাসকে অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে চান তারা কি জানেন প্রতি বছর কতটি মসজিদ পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়? প্রতিটি সন্ত্রাসী ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ আমেরিকায় কতটি মসজিদকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে? এমনকি সব মসজিদের পিতা পবিত্র কাবা মসজিদ কতবার ধংস হয়েছে? আগুনে ভষ্মীভূত করা হয়েছে? মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে? বন্যার স্রোত এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? একবারওতো আল্লাহ তার পবিত্র ঘরকে রক্ষা করলেননা? মানুষ বা প্রকৃতি কাবাকে ধ্বংস করেছে আবার মানুষই তাকে বার বার পূণনির্মাণ করেছে এখানে আল্লাহর কোনো হাত ছিলনা।এমনকি এই কিছুদিন আগেই হেইট ক্রাইমের অংশ হিসেবে টেক্সাসের একটি মসজিদ পুড়িয়ে দেয়ার পর অমুসলিম এমনকি আমেরিকান হিউম্যানিষ্ট এসোসিয়েসনের নাস্তিকদের সক্রিয় সহযোগিতায় তা আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালে মসজিদুল হারামের নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত একটি ক্রেন ভেঙ্গে পড়ে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করতে যাওয়া কয়েক হাজার পূণ্যার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হল কই আল্লাতো এই পূণ্যার্থীদের রক্ষা করলেননা? আর অক্ষত ছিপারার পৃষ্টা? আহা,ঐ মহা আবিষ্কারক সাংবাদিক যদি স্মৃতিভ্রষ্ট না হন তবে অবশ্যই তার ঐতিহাসিক শাপলাকান্ডের কথা মনে থাকা উচিৎ।সেখানে উন্মত্ত হেফাজতিদের তান্ডবে বায়তুল মোকাররমের বইয়ের দোকানগুলোতে কত সংখ্যক কায়দা ছিপারা কোরান পুড়ে ছাই হয়েছে তার পরিসংখ্যানটি কি তার জানা আছে? সেদিন কতটি অক্ষত পৃষ্টার ছবি তিনি তুলেছিলেন? আল্লাহর কালাম আগুনে পুড়েনা এই বিশ্বাস বা প্রচারনাকে ভুল প্রমাণিত করতে একজন বাঙ্গালী নাস্তিক লাইভে কোরানের পাতা ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে দেখিয়েছেন ধারণাটি ভুল। লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার এ দৃশ্য লাইভ দেখেছে।এতবড় ধৃষ্টতার পরও সেই নাস্তিক বহাল তবিয়তেই আছেন আল্লাহ তার কোনো অনিষ্ট করেননি। অবশ্য এটা ঠিক-হাতের নাগালে পেলে সেই নাস্তিককে হত্যা করতে লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী বেরিয়ে আসবে।এর একটাই কারণ- যা করার মানুষই করে মানুষই করছে কিন্তু নাম ভাঙ্গানো হয় আল্লাহর।

 

 

                                                      অলৌকিকতার পোস্টার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকের দালিলিক উপস্থাপনা

 

জানি এই কথাগুলো অনেকের মর্মমূলে কিছুটা হলেও আঘাত করবে।আমি ব্যক্তিগতভাবেও মানি ব্যক্তির বিশ্বাস অবিশ্বাস তার নিজস্ব ব্যাপার এবং এতে অকারণ আঘাত করা সম্পূর্ণ অনুচিৎ।কিন্তু বিশ্বাস বা অবিশ্বাসকে যখন মানবতার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয় তখন সে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন-সরু গলির কারণে পানিবাহিত গাড়ি নিয়ে ফায়ারব্রিগেড কর্মীরা ঢুকতে পারছিলেননা তখন তারা পার্শবর্তি মসজিদের পানির ট্যাংক ব্যবহার করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের অনুমতি দেয়নি কারণ তাদের কাছে ফজরের নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের অযুর পানি মওজুত রাখাটাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। অথচ ওয়াহিদ ম্যানশন নামক নরকটিতে তখন  জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে নারী পুরুষ আর শিশুরা।এমনকি যে শিশুটি পৃথিবীতে আসার সন্ধীক্ষণে ছিল সেও তখন মাতৃগর্ভে থেকেই নারকীয় আগুনে শাস্থি ভোগ করছে।খবরটি সত্য হলে এটি অত্যন্ত নির্মম নিষ্টুর  অনৈতিক এবং গর্হিত কাজ হয়েছে।এই কর্তৃপক্ষ নামক দানবদের আইনের আওতায় নিয়ে বিচার করা প্রয়োজন।একজন মানুষের জীবনের চেয়ে কোনো ধর্মালয় বা ধর্মাপোসনার মূল্য বেশি হতে পারেনা।এমনকি যে রিক্সাওয়ালাটি পুরান ঢাকায় খেপ দিতে গিয়ে নিজেই মৃত্যু-খেপের একজন হয়ে গেল পৃথিবীর সকল মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডার চেয়েও তার জীবনের মূল্য অনেক বেশি কেননা একটি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে এক টুকরা শুকনা রুটি গুঁজে দেবার মুরোদও এইসব ধর্মালয়ের নেই কিন্তু সাহাব উদ্দিন নামক সেই শ্রমজীবী মানুষটির প্যাডেল-মারা পায়ের গোড়ালী আর স্টিয়ারিং ধরা হাত একটি সংসারের চাকাকে সচল রেখেছিল। একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান হারানোর শোকে তার বৃদ্ধ বাবার বুকে যে আগুন এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে তা কি  শত সহস্র মসজিদের পানির ট্যাংক উপোড় করে দিয়েও নিভানো সম্ভব হবে? এদের উদ্দেশ্য করেই কি কবি নজরুল লিখেছিলেন-

“অথবা হয়তো কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,

আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত বিক্ষত,পড়িয়া দুঃখ দহে

তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়

ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়।