“ভারতের উচিত ছিল গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি চুক্তি করে নেওয়া।”
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান (কারাগারের রোজনামচা, মার্চ ২০১৭, বাংলা একাডেমি, পৃঃ ১৫৯)

ভারতীয় কাশ্মীরের পালওয়ামায় সাম্প্রতিক আত্মঘাতী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং সেই সাথে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই ঘটনাকে ঘিরে চলছে ভারত জুড়ে প্রতিবাদ আর সেই সাথে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের বাদানুবাদ। পারমানবিক অস্ত্রধারী দুই বৈরী প্রতিবেশীর অতীত যুদ্ধের ইতিহাস কেবল আশেপাশের দেশগুলোরই নয়, পুরো বিশ্বেরই উদ্বেগের কারণ, কেননা অদূর ভবিষ্যতে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার কোন আলামত আপাতত চোখে পড়ছে না।

বর্তমান বিশ্বে যে ভূ-রাজনৈতিক বিবাদগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা কে নাজুক করে তুলেছে, তাদের মধ্যে কাশ্মীর সমস্যা অন্যতম। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পরপরই এই সমস্যার সূত্রপাত, যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কয়েকটি সামরিক সংঘাতের জন্ম দিয়েছে; এগুলোর মধ্যে কার্গিলের যুদ্ধ এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ক্ষণস্থায়ী সীমান্ত-যুদ্ধের পাশাপাশি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠি দেশটির গুপ্তচর সংস্থার সাহায্যে একটা ‘প্রক্সি’ যুদ্ধও চালিয়ে যাচ্ছে। এই ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে ভারতে বেশ কিছু নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে পার্লামেন্ট ভবনে হামলা, বোম্বের তাজ হোটেলে হামলা এবং সাম্প্রতিক আত্মঘাতী হামলায় রিজার্ভ ফোর্সের সদস্যদের প্রাণহানির ঘটনা সবচেয়ে ভয়াবহ। যদিও পাকিস্তান বরাবরই এধরনের সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোর তদন্তে টাল-বাহানা করে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে আসছে, পরিপ্রেক্ষিত বিচারে তাদের সেই দাবী বেশ দুর্বল বলেই মনে হয়। তবে, পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে একই ধরনের ‘প্রক্সি’ যুদ্ধের অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়া ভারতের নৌ-কমান্ডার কুলভূষণ যাদবের পাকিস্তানে নাশকতামূলক কাজে অংশগ্রহণের স্বীকারোক্তি তাদের এই দাবীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে অনেকখানি। বর্তমানে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কমান্ডার যাদবের কেসটির শুনানি চলছে আন্তর্জাতিক আদালতে।

গত সপ্তাহের বোমা হামলায় ভারতীয় জওয়ানদের প্রাণহানির পর প্রতিবাদের অংশ হিসাবে ভারতীয়রা দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনে সাবেক ক্রিকেট-তারকা এবং পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছবি সরিয়ে ফেলার পর এখন দাবী উঠেছে পাকিস্তানকে আসন্ন ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে বাদ দেয়ার। কিন্তু, এসব পদক্ষেপ কেবল ভারতীয়দের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র; অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে মূল সমস্যার সমাধান এভাবে সম্ভব নয়। এই সমস্যার জড় ইতিহাসের গভীরে, তাই ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়েই এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে।

ভারত আর পাকিস্তান দু’দেশই চায় ভূ-স্বর্গ হিসাবে পরিচিত কাশ্মীরকে নিজেদের ভৌগলিক সীমার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পেতে। দু’দেশই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীরের অংশসহ পুরো কাশ্মীরকেই নিজেদের বলে দাবী করলেও দেশগুলো যখন স্বাধীন হয়, তখন কাশ্মীর তাদের কারও অংশেই ছিল না। যদিও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার সময় মুসলমান-সংখ্যাগুরু কাশ্মীরের সংযুক্তি পাকিস্তানের সাথে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, বাস্তবে তা হয় নি। শুরুতে কাশ্মীর স্বাধীন রাজ্য হিসাবে থাকলেও ভারতের স্বাধীনতার প্রায় দু’মাস পর কাশ্মীরের হিন্দু রাজা এককভাবে ভারতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই অনুযায়ী ভারতের সাথে একটি চুক্তিপত্র (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করেন। সেই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল যে ভবিষ্যতে কাশ্মীরের (অবিভক্ত) জনগণই ঠিক করবে তারা কোন দেশের সাথে থাকবে (অথবা স্বাধীন হয়ে যাবে)। দুঃখজনকভাবে, এই শর্তের বাস্তবায়ন কখনই আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে এই ইস্যুকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে কোন আইনগত বৈধতা ছাড়াই পাকিস্তান কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে নেয়।

কাশ্মীর সমস্যা কেবল ভারত-পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বা দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়, বরং এই সমস্যার মূলে রয়েছে কাশ্মীরের জনগণের না পাওয়া আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, যা ভারতের সাথে সংযুক্তির চুক্তিপত্র অনুযায়ী তাদের ন্যায্য পাওনা। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মীরের মানুষেরা আপাতত নিজেদের অবস্থা বুঝে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার জিকির না তুললেও, ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে জানি যে তাঁরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। অন্যদিকে ভারতীয় কাশ্মীরে এই স্বপ্ন পূরণের দাবীতে মানুষ প্রকাশ্যে সোচ্চার হয়েছে বহুদিন থেকেই। দেশভাগের সময় এই অঞ্চলের সাধারণ হিন্দু-মুসলিম দু’পক্ষই ভয়াবহ মানবতা-বিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতীয় কাশ্মীরে স্বাধীনতার দাবীতে সহিংস আন্দোলন জোরদার হলে সেখানে সামরিক বাহিনীর অভিযানে বহু প্রাণহানিসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের এই ধারা ভারতীয় কাশ্মীরে এখনও চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন মোদী সরকারের হিন্দুত্ব-বাদী নীতি সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আর এই অবস্থার পুরো সুযোগ নিচ্ছে পাকিস্তান; তারা ভারতীয় কাশ্মীরের জনগণের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক নাশকতার ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করছে বা প্ররোচনা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে কাশ্মীরের সমস্যা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।

প্রায় সত্তর বছর ধরে কাশ্মীরের ভূমি নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের আজন্ম শত্রুতা চলছে, অথচ যুক্তি মেনে, একটু মানবিকভাবে সমস্যাটিকে দেখলে এর সমাধান হয়তো অসম্ভব নয়। কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে, কিছু ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় বসলে অচিরেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। তবে, কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা ভারত, পাকিস্তান দু’দেশের জন্যই একটি বিতর্কিত এবং স্পর্শকাতর বিষয়। ভারতীয় পক্ষে অনেকেই মনে করেন যে কাশ্মীর স্বাধীনতা পেলে তা তালেবানে অধ্যুষিত আফগানিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে আইসিস সমস্যার মতো একটি সমস্যার জন্ম দেবে। অনেকের মতেই স্বাধীন দেশ হিসাবে কাশ্মীরের জন্ম হওয়া মানে সন্ত্রাসের আরেক নতুন ক্ষেত্র তৈরি হওয়া, যেখানে বসে মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ড চালু রাখবে। যদিও এধরনের অস্থিরতার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, তারপরেও বলতে হয় যে এই সম্ভাবনাগুলোর বেশীরভাগই হাইপোথেটিকাল। ভারত আর পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চাইলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের কোন বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষিতে মনে রাখতে হবে যে কাশ্মীর ইস্যুই পাকিস্তানের ভারত-বিরোধিতার আসল কারণ, আর ভারতকে চাপে রাখতেই তারা নিজেদের দেশে ভারত-বিরোধী জঙ্গিদের জায়গা দিয়েছে। এই ইস্যুতে তারা নিজেদের নাক কেটে হলেও প্রতিবেশীর যাত্রাভঙ্গের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ধারনা করা যায় যে পাকিস্তান এখন জঙ্গিবাদ লালন করলেও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে নিজেদের স্বার্থেই তারা জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটনে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

সামরিকভাবে বা ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ করে কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে কোন দেশকে একঘরে করার চেষ্টা করে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাকিস্তান আর ভারতের উচিত সমস্যাটিকে কেবল ভৌগলিক বা ভূমির একচ্ছত্র অধিকার পাওয়ার বিষয় হিসাবে না দেখে, এই অঞ্চলের মানুষের প্রতিশ্রুত ন্যায্য অধিকার রক্ষার বিষয় হিসাবে দেখা। মানবিক এবং যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করে সবপক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সম্ভাব্য সমাধান হিসাবে কাশ্মীরের দু’অংশ এক করে পরীক্ষামূলক ভাবে সীমিত স্বায়ত্ত-শাসন দেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সংযুক্ত কাশ্মীরে ভারত, পাকিস্তান দু’দেশরই আংশিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে। এই ধরনের সম্ভাব্য সমাধানগুলোই প্রাথমিক ত্রিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে।