লিখেছেন: রিয়াজ ওসমানী

জানুয়ারীর ২০, ২০১৯ তারিখে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে “যৌন সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানবদের অধিকার এখন ঝুঁকিতেঃ একটি বাংলাদেশী দৃষ্টিকোণ” নামক একটি সন্মেলনে আমি এই বক্তব্যটা রাখি। বিখ্যাত ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমকামী অধিকার কর্মী রাফিদা আহমেদ বন্যা, গীতা সেঘাল, মারইয়াম নামাজী, অজন্তা দেব রায়, সাদিকুর রহমান রানা, সাদিয়া হামিদ, জেমস বাঙ্গাস ইত্যাদিদের সাথে আমি সহাবস্থান করার গৌরব অর্জন করি। ইংরেজীতে রাখা বক্তব্যটার বাংলা অনুবাদ নিচে দেয়া হল।

 

ধন্যবাদ সুধী। আজকে একটি বক্তব্য রাখার জন্য সৈয়দ ইশতিয়াক হোসেনকে আমি অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি প্রয়াত অভিজিৎ রায় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তমনা এবং নাস্তিকদের প্রতি গভীর সন্মান জানাচ্ছি যারা কিছু বছর আগে ইসলামী মৌলবাদীদের হাতে খুনের শিকার হন। আমি আজকে অভিজিৎ রায়ের বিধবা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার সামনে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি, যিনি ২৬শে ফেব্রুয়ারীর সন্ধ্যা বেলায়ে এক ভয়ানক হত্যাকান্ডের পর তার প্রয়াত স্বামীর এবং তার ব্যক্তিগত মশাল হাতে নিয়ে চলছেন।

 

আমি এই মুহুর্তে  প্রয়াত জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব তনয়ের প্রতিও আমার গভীর সন্মান এবং ভালবাসা প্রদর্শণ করছি যারাও ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারা খুন হন। জুলহাজ ছিলেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সমকামী অধিকার কর্মী, তার বন্ধু মাহবুব ছিলেন একজন সমকামী সাংষ্কৃতিক কর্মী। আমি আরও স্মরণ করতে চাই অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ এবং নাস্তিক ব্লগার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধর্মগুরু, সংষ্কৃতিমনা শিক্ষাবিদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক মন্ডলের উন্নয়ন বন্ধু যারা গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে মুসলমান চরমপন্থীদের হাতে নিজেদের জীবন হারান।

 

অভিজিৎ রায় আমাদের জানা মতে বাংলা ভাষায়ে সর্ব প্রথম সমকামিতা নিয়ে একটি বই লিখেন। তাঁর এই কর্ম নাস্তিক এবং সমকামীদের মধ্যে পরষ্পর সমন্বয়ের একটি সুন্দর সম্পর্ক তুলে ধরে। একজন মুক্তমনা, বৈজ্ঞানিক লেখকের কাছ থেকে এই উপহার আমাদেরকে শিখিয়ে দেয় যে অন্তর্নিহিত একটি যৌনতা, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামী সামাজিক রীতির বাইরে পড়ে, তার গ্রহণযোগ্যতার জন্য মানুষকে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে পাওয়া বিভিন্ন উপলব্ধি এবং সংজ্ঞাগুলোর সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আসতে হয়।

 

এই বাস্তবতাটি বাংলাদেশ এবং বাকি বিশ্বের জন্য বর্তমানে একেবারেই প্রযোজ্য। লন্ডন ভিত্তিক কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরকার যৌন সংখ্যালঘুদের সাথে যুক্ত একজন নেট ভিত্তিক সমকামী অধিকার কর্মী হয়ে আমি জানতে পেরেছি কিভাবে ধর্মীয় শৈশব এবং চিন্তাধারা সমকামীদের কোনও মানবাধিকার তো বটেই, কোনও স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও এককভাবে প্রধান প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

আমাদের উপলব্ধি অনুযায়ী সনাতন মুসলমানের জীবন ধারার সাথে কোন মিল নেই, আমি এমন অনেক মানুষের আসা যাওয়া দেখেছি। উপরন্তু বাংলাদেশের সমাজ এবং অর্থনীতিতে এমন কিছু ঘটনা বিদ্যমান যা আমাদের ধারণা অনুযায়ী কোনও দিনও সনাতন ইসলামী সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। আমি পুরুষ দ্বারা নারীদের উপর যৌন এবং শারীরিক হিংস্রতার কথা বলছি। আরও বলছি ঘুষ, নিজের সুবিধার জন্য অন্যদের ক্ষতি, চরম দূর্নীতি, বিষমকামীদের মাঝে পরকীয়া, মাদ্রাসার শিক্ষক দ্বারা বালক ধর্ষণ, যে কোনও পুরুষ বা ছেলে দ্বারা বালিকা ধর্ষণ, চুরি, ছিন্তাই, ডাকাতি এবং আরও অনেক লম্বা তালিকাভুক্ত ঘটনাগুলোর কথা। কিন্তু ঠিক এই কুকর্মগুলোর সাথে জড়িত অনেকেই প্রথমে বলে উঠবেন যে সমকামিতা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে এবং মুসলমান দেশে আমরা এই সব সহ্য করতে পারবো না।

 

এই ধারণাটা তাদের মনে একটি নিম্নমানের রেস্তোরাঁয়ে বাজে মসলার গন্ধের মত গেঁথে আছে। বিশ্বাসভিত্তিক একটি নিয়মের সাথে কেউ যেন তর্ক করতে পারে না। এই ভ্রম্যান্ডে যুক্তির কোন স্থান নেই। কেউ কিছু একটা বিশ্বাস করে ফেললে সেই বিষয়ে সেটাই হচ্ছে চুরান্ত অভিমত। উপরন্তু, কে এই বিষয়ে (বা অন্য কোনও বিষয়ে) কি বিশ্বাস করলো বা ধারণা পোষণ করলো তা বিভিন্ন ইমাম দ্বারা প্রচার করা ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর সংকীর্ণতা দিয়ে পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা। প্রায় কেউই কোরান শরীফ (আল্লাহর বাণী) এবং হাদিস (নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর বানী) কোনও একটি ভাষায়ে পড়েনি যেই ভাষা তারা বুঝে। বাংলা বা ইংরেজীতে কোরান এবং হাদিস পড়ার উপর কখনই কোন জোর দেয়া হয় নি। সবাই তোতা পাখির মত আরবী লেখাগুলো উচ্চারণ করতে শিখে এবং এর ফলে পুস্তকগুলোতে আসলে কি বলা আছে তার বিন্দুমাত্র সরাসরি উপলব্ধি কারও মাঝে আসে না। এই গন্ডির বাইরে চিন্তা করাটা সবার জন্য প্রায় অসম্ভব, এবং সেটার চেষ্টা করাটাকেও বৈধর্ম্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এবং এর বিরুদ্ধে কেউ যতই সংগ্রাম করুক না কেন, আল্লাহর কাছ থেকে প্রদত্ত হৃদয়ঙ্গম করা বিজ্ঞতা, যা নবী মুহাম্মদ (সঃ) দ্বারা প্রচারিত হয়েছে, তাকে কখনও প্রশ্ন করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে আমি আমার প্রথমে ইসলামের আদলে গড়ে তোলা জীবন এবং পরে আবিষ্কার করা যৌনতাকে সমন্বয়ে রেখে এগিয়ে যেতে পারিনি।

 

আজ আমি একজন প্রাক্তন মুসলমান (এক্স-মুসলিম); একজন সমকামী বাংলাদেশী এবং বিলেতি নাগরিক, যে জোরালোভাবে অনুভব করে যে ইসলামের ফলে চিন্তাধারার উপর সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়া এবং একই সাথে নিজের তথাকতিত বিপথগামী যৌনতাকে সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করে নেয়ার প্রচেষ্টা বড়জোর এক প্রকার ভণ্ডামি। অনেক কিছু ডাষ্টবিনে ফেলে দিয়ে, আন্তর্জাল আবিষ্কার হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে উদিত হওয়া  মুক্তমনাদের সাথে হাত মেলানো বরং একটি অপেক্ষাকৃত সৎ উদ্যোগ 😊

 

আচ্ছা, এখন বলতে হবে যে সমকামী মুসলমান বলতে একটা জিনিষ অবশ্যই আছে। এই বর্ণনার মানুষরা ইসলাম ধর্ম যথারীতি পালনও করে। এরা অধিকাংশই পশ্চিমা দুনিয়াতে বাস করে এবং সডম শহরের নবী লুত (আঃ) এর ঘটনার একটি নতুন ব্যাখ্যা থেকে তারা তাদের শক্তি অর্জন করে। প্রচলিত জ্ঞান অনুযায়ী সমকামিতার কারণে সডম শহরকে ধ্বংস করে ফেলা হয় (যার ফলে তারপর দুনিয়াতে সমকামীদের উপর নিপীড়ন শুরু হয়); কিন্তু কিছু পশ্চিমা আলেমরা ইদানীং ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে পুরুষ ধর্ষণের কারণে সডমে আল্লাহর গজব পড়ে, প্রাপ্তবয়ষ্কদের মধ্যে সন্মতিসূচক সমলৈঙ্গিক যৌনাচারের জন্যে না। এই ব্যাখ্যাটা শুনতে ভালই লাগে। কিন্তু বাংলাদেশে (কিংবা ইরানে অথবা সৌদি আরবে) সমকামীদের এবং সমকামিতা নিয়ে জনসাধারণের চিন্তাভাবনা নির্ভর করবে কোন রূপকথা সর্বজনীনভাবে বিশ্বাস করা হবে। সুন্দর এবং সংশোধনবাদী সংস্করণটা আগামী দিনগুলোতে তেমন কোন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

 

তবে সমকামী মুসলমানরা শুধু কোরান ভিত্তিক ইসলামের দিকে নজর দিয়ে সান্ত্বনা পেতে পারেন। সডম নগরের ধ্বংসের কথা (সেটা যেই কারণেই হোক না কেন) কোরান শরীফে উল্লেখ করা আছে ঠিকই কিন্ত সমকামীদের শাস্তির বিধান কোথাও পাওয়া যায় না। বস্তুত, সমকামীদের কথা কোরান শরীফে কোথাও এসেছে কি না সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ।

 

কিন্তু হাদিসে তাদের কথা বলা হয়েছে বইকি। সেখানে সমকামিতার জন্য অজস্র শাস্তির বিধান রয়েছে। কেউ কোরান ভিত্তিক ইসলাম মেনে চলতে চাইলে হাদিসের সকল বই ফেলে দিয়ে সমকামীদের শাস্তির কথা উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন যে শুধু কোরান ভিত্তিক ইসলাম, সনাতন ইসলামী পন্থার একটি বিকল্প হতে পারে তবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আমি হলফ করে বলতে পারি যে বাংলাদেশের মত দেশে নবীকে প্রায় আল্লাহর মত সমান গুরুত্ব দেয়া হয় এবং প্রাচীন আলেম দ্বারা নিশ্চিত করা নবীর আসল বক্তব্যগুলো একেবারেই অলঙ্ঘনীয়।

 

এবং এটাই বাস্তব – যদিও নবীর মৃত্যুর ২০০ বছর পর হাদিসগুলোকে বই আকারে সঙ্কলন করা হয়। বংশ ধরে মানুষ মুখে মুখে নবী মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের কি বলেছিলেন তা একজন আরেকজনকে বলে আসতে থাকে। আপনি চাইনিজ হুইসপার্স খেলাটার নাম শুনেছেন? আপনি কি বিশ্বাস করেন যে সঙ্কলিত সংস্করণটিতে কোনও কিছু থাকতে পারে, যা নবী আসলেই বলেছিলেন কিন্তু যেটা তাঁর মৃত্যুর ২০০ পর লিখিত আকার ধারণ করে? মজার ব্যাপার হচ্ছে হাদিস সঙ্কলন করতে গিয়ে প্রাচীন আলেমরা প্রথমে মানুষের মুখে মুখে শোনা বিভিন্ন উক্তিগুলোর ৯০ শতাংশকেই ভ্রান্তিকর বলে বিবেচিত করেন। রত্নগুলোর শুধু ১০ শতাংশকেই তারা সহি হাদিস বলে গণ্য করেন! কোনগুলো সঠিক এবং কোনগুলো সঠিক না, তা নির্ণয় করার জন্য নিশ্চয়ই আলেমদের একটা মানদন্ড ছিল।

 

এই মানদন্ডগুলোর মধ্যে একটি ছিল পুরুষদের মাঝে স্ত্রী-বিদ্বেষ বা নারীদেরকে ছোট করে দেখার প্রবণতা। এই আলেমরা ছিলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ এবং যেহেতু একজন পুরুষ শারীরিকভাবে একজন নারীকে প্রবেশ করতে পারে, সেহেতু পুরুষরা নারীদেরকে দূর্বল এবং অসুরক্ষিত মনে করতো। একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে যদি প্রবেশ করে তাহলে সেটা হবে পুরুষত্বের তথা মানব জাতির সবচেয়ে বড় অপমান। একজন পুরুষ কি করে আরেকজন নারীর মত হতে পারে? একই সুত্রে একজন পুরুষ কি করে নারীর মত আরেকজন পুরুষের সাথে শয্যায়িত হতে পারে? আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মুসলমানদের ধর্ম কি করে আরব ও বাকি দুনিয়ায় প্রচার পাবে যদি সমস্ত পুরুষরা শুধু অন্য পুরুষদের সাথে শয্যায়িত হয়ে বাচ্চা প্রজনন বন্ধ করে দেয়?

 

পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে তখন যৌন প্রবৃত্তি নিয়ে ডাক্তারী আবিষ্কার আজকের দিনের মত অত বিকশিত হয়নি। কিন্তু বংশ ধরে পাওয়া এই মনোভাব আজকে বাংলাদেশে তরুণ সমকামীদের মাঝে চিরস্থায়ীভাবে নিজেদেরকে পাপী মনে করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেই তরুণরা বাল্যকাল থেকেই ইসলাম (ও অন্যান্য) ধর্মের সকল অলংকরণ দ্বারা মগজ ধোলাইকৃত হয়েছে। আগেকার দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার মত সেখানেও দেখা যাচ্ছে যৌন সংখ্যালঘুদের মাঝে বিষন্নতার প্রভাব এবং আত্মহত্যা করার প্রবণতা। এবং সাম্প্রতিক মোবাইল নেটের বিকাশের (সাথে সস্তা চাইনিজ স্মার্ট মুঠোফোনের আবির্ভাবের) আগে অধিকাংশকেই বিপরীত লিঙ্গের কাওকে বিয়ে করে ফেলার পরিণতিকে মেনে নিতে হত, সব সময়েই যে আত্মীয়স্বজনের চাপের মুখে তা নয়, অনেক সময়ে একটি বিকল্প পথের কোনও সুযোগ নেই, এই ভেবে।

 

বিকল্প পথের একটি সচেতনতা আজ এসেছে বইকি। কিন্তু ধর্ম এসে দাঁড়িয়েছে পথের একটি চিরকালীন বড় বাঁধা হয়ে। দেখা যাচ্ছে যে যারা ধর্মভীরু এমনকি যাদেরকে মোল্লা হিসেবেই গণ্য করা যায়, তাদের মাঝে যারা সুপ্ত সমকামী, তারা হচ্ছে সাধারণভাবে সমকামীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হুমকি। এরা অনেক সময়েই রাতে সমলৈঙ্গিক যৌনাচারে লিপ্ত হয়, কিন্তু পরের দিনের বেলায়ে জনসন্মুখে সমকামিতার বিরুদ্ধে জঘন্য কথা বলে যৌনতাকে প্রশ্ন করা অল্প বয়সের ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার সৃষ্টি করে এবং জনসাধারণের মধ্যে সমকামীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করে। বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার তৈরি করার দীর্ঘ যাত্রার এক অংশ হবে এই মানুষদের মুখোশ খুলে দেয়া – শুধু এই সুপ্ত সমকামীদেরই না, বরং শিশুকামীদেরও একই, কারণ মুসলমান দেশে সমকামীদের বিরুদ্ধে এরাও কথা বলে এবং মূলধারার সমাজ শিশুকামিতা এবং সমকামিতাকে এক করে ফেলে।

 

আমি এবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে মনোযোগ দিব যেহেতু সেখানে মুক্তমনা, নাস্তিক এবং যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারের সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে সেখানকার রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন ছল আর খেলের কথা বলতেই হবে। ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ডঃ কামাল হোসেনের মত একজন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনজীবীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সনে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানটি ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের হত্যাকান্ডের পর আমরা ক্রমান্বয়ে কিছু সামরিক শাসনের শিকার হই, যখন সেনা শাসকরা নিজেদের অসাংবিধানিক ক্ষমতাকে প্রীতিকর করে তোলার জন্য দেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনোরঞ্জন করার উদ্দেশ্যে ধর্মনিরপক্ষ সংবিধানটিকে কলুষিত করে।

 

৭০ দশকের শেষের দিকে জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান বদলে দেয়ার একটি ঘোষণা দিয়ে দেশের ইসলামীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে দেন। সংবিধানের প্রস্তাবনায়ে তিনি “বিসমিল্লাহের রাহমানের রাহিম” অভিবাদনটি প্রবেশ করিয়ে দেন। সমাজতান্ত্রিক চেতনা অনুযায়ী ধর্ম থেকে মুক্ত হাওয়া থেকে সরে গিয়ে অনুচ্ছেদ ৮(১) এবং ৮(১ক) তে যোগ করা হয় “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্থা”। ৮০র দশকে রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা পুরাপুরি জলাঞ্জলি দিয়ে জেনারেল এরশাদ সংবিধানে বাড়তি পরিবর্তন এনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এই লালিকা চলমান রাখেন।

 

শেখ মুজিবর রহমানের একজন কন্যা, শেখ হাসিনা, যিনি হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান, তিনি তার পিতা দ্বারা চালিত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টি অথবা বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন যার নেতৃত্ব ১৯৮১ সালে তার হত্যাকান্ডের পর তার বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া হাতে তুলে নেন। এতে করেই শুরু হয় দুই রাজনৈতিক পরিবারের দ্বন্দ্ব যা আজ অবদি বাংলাদেশের জন্য আশির্বাদ ও অভিশাপ উভয়ই বয়ে নিয়ে এসেছে।

 

১৯৯১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে গনতন্ত্রের কিছুটা বিকাশের সাথে সাথে আমরা লক্ষ্য করেছি সুষ্ঠ এবং জালিয়াতিমণ্ডিত উভয় ধরণের নির্বাচনের মাধ্যমে দুই দলের পালাক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতার অধীনে আরও বেড়ে যাওয়া ইসলামিকরণ। তবে আমরা ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়টুকুর মধ্যে বাংলাদেশের সমাজের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করি। বিএনপি এবং সাথেকার জামাতে ইসলামী নামক একটি রাজনৈতিক দলের যৌথ রাজনীতি এবং প্রশাসনের সময়ে আমরা দেখতে পাই যে জাঁকাল শাড়ি এবং উন্মুক্ত কেশ পরিধান করা যুগের সাথে তাল মেলানো মহিলাগন তাদের আধুনিক এবং বাঙ্গালী পোষাক পরিত্যাগ করে আরব দুনিয়ার মরুভূমি থেকে আমদানীকৃত হিজাব এবং বোরখা গ্রহণ করে নেয়। গনমাধ্যমের পরিচিত নারী ও পুরুষ ব্যক্তিদের দেখতে পাই তাদের পোষাক-আষাক বা বার্ষিক হজ্ব পালনের মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় পরিচয় জনসন্মুখে প্রকাশ করতে।

 

১৯৭১ সালে একটি যুক্ত পাকিস্তান হারিয়ে সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশকে সকৌশলে এবং সময়ের সাথে সাথে একটি ইসলামী রাষ্ট্র বানিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জামাতের অবস্থানের যুক্তি তখন তারা তুলে ধরেছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মের সংরক্ষণ করার কথা বলে। ভারতের অপর প্রান্তে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিকভাবে আলাদা হয়ে গেলে পুর্ব প্রান্তে হিন্দু ধর্ম থেকে গজিয়ে ওঠা বাঙ্গালী সংষ্কৃতির আদলে ইসলামী মূল্যবোধের অবক্ষয়ের আশংকা ছিল। এই বিশ্বাসকে কাঁধে করে নিয়ে তারা নির্দ্বিধায় বাঙ্গালী জাতির উপর গনহত্যা ও ধর্ষণ চালাতে এবং বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিদের বাছাই করে হত্যা করতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে – ভারতের হস্তক্ষেপের ফলে যার অবসান ঘটে এবং সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে হয় বাংলাদেশের জন্ম।

 

বিএনপি এবং জামাত ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায়ে থাকার সময়ে একটি চরম সাম্প্রদায়িক চেহারার পরিচয় দেয় যার ফলে বাংলাদেশের চেহারা হয়তো চিরকালের জন্য কিছুটা পাল্টে গেছে। আমরা ভারতের উদ্দেশ্যে দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ব্যাপক দেশান্তর হতে দেখি। ইসলামের নামে আমরা দেশের আনাচে কানাচে এক সাথে ৫০০টা বোমা বিস্ফোরণ হতে দেখি। তখন জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা কোথা থেকে এসেছিল তা আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি।

 

কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময়ে আমরা বেশ কিছু চমক এবং নিরাশার সাক্ষী হই। যদিও শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসর জামাত নেতাদের বিচার করে সময়ের একটা বড় দাবী কার্যকর করেছেন, এর পরবর্তীকালীন সময়ে একটি ধর্মনিরপক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সকল আশা গুরুতরভাবে ভঙ্গ হয়েছে। জামাত নেতা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমর্থনকারী বিভিন্ন ব্লগার এবং ছাত্রদের নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন শাহবাগ আন্দোলনের প্রত্যুত্তর হিসেবে আমরা হেফাজতে ইসলাম নামের চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি মধ্যযুগীয় ধর্মগোষ্ঠীর আবির্ভাব দেখতে পাই। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করে দেয়া, দেশের সকল নাস্তিকদের ফাঁসি দেয়া, জনসন্মুখে নারী ও পুরুষদের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করা, নারীদের রান্নাঘরে পুনরায় সীমাবদ্ধ করে দেয়া, এবং সরকার এসকল দাবী অমান্য করলে দেশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি শেখ হাসিনার জন্য একটু বেশিই হয়ে যায়।

 

আমরা চমকিত এবং নিরাশ হয়ে দেখি যে তাদেরকে জামাতের ন্যয় শেষ করে না দিয়ে তিনি তাদেরকে শান্ত রাখার আশায়ে তাদেরকে তোষামোদ করতে থাকেন। এতে করে শুরু হয় এমন এক প্রক্রিয়া যেটার ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগের চাটুকাররা এখনও দিয়ে থাকে একটা নিছক রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। এখানে একটু চুষনি জাতীয় কিছু দিলে দেশে শুধু শান্তিই বিরাজ করবে না, বরং ধর্মভীরু মুসলমানে ভরা একটি দেশে এটা হবে ভোট পাওয়ার একটা দুর্দান্ত পন্থা। এই চাটুকারদের মনে আওয়ামী লীগ এখনও ধর্মনিরপেক্ষতায়ে বিশ্বাসী একটি দল, এবং শেখ মুজিবের বেটি, আমাদের মাননীয় নেত্রীর হাতেই বাংলাদেশের এরকম একটা ভবিষ্যত নিশ্চিত করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।

 

এই চাটুকাররা কম করে হলেও নিজেদের এবং অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করছেন। আর তার বেশী হলে এরা হলেন মিথ্যাবাদী। না হলে আমরা কেনই বা দেখবো বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ পাঠ্যক্রম থেকে সরে নিয়ে এসে সেগুলোকে একটি সাম্প্রদায়িক চেহারা দেয়াটি? আমি ছোট বেলায়ে পড়েছি এমন কিছু বাংলা কবিতা ও গল্প যা আমরা কিছু হিন্দু লেখকদের কাছ থেকে পেয়েছি, তা কেনই বা এখন বাদ দেয়া হয়েছে? সরকার থেকে দেয়া সংস্কারের দাবীগুলো আদায় না হয়েই কওমি মাদ্রাসা থেকে প্রাপ্ত স্নাতককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ স্নাতকের সমান মর্যাদা কেন দেয়া হল? এই বিষয়ে হাসিনা কেন হেফাজতের শেষ কথার প্রতি মাথা নত করলেন? তিনি কেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রাঙ্গণে প্রথমবারের মত খাড়া করা শাড়িতে আবর্তিত লেডি জাস্টিসের একটি সুন্দর মূর্তি সরিয়ে ফেলার জন্য হেফাজতের দাবী মেনে নিলেন? তিনি কেন সৌদি আরবের সহায়তায়ে পুষ্ট দেশী তহবিলের অর্থায়নে দেশে ১০০০টা “আদর্শ” মসজিদ গড়ে তুলতে যাচ্ছেন? তিনি কি জানতেন না যে আলাদিনের চেরাগ থেকে এই দৈত্যকে একবার বের করলে সেটাকে আর ঢোকানোর কোনও উপায় নেই? পাকিস্তান এবং অন্যান্য কিছু দেশের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে তিনি কি কিছুই শিখেন নি? আর সবচেয়ে বড় কথা হল, শেখ হাসিনা কয়েকবার গনমাধ্যমের সামনে বলেছেন যে তার সরকার কখনোই কোরান ও হাদিসের বিরুদ্ধে যাবে এমন কোন আইন পাস করবে না। তাহলে পুরাপুরি শরীয়া আইন আনতে বাঁধা কোথায়? রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এই অর্ধেক ভেতর ও অর্ধেক বাহির কেন?

 

২০০৮ সালে তার দল সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার আদলে তিনি আবার ক্ষমতায় আসার পর তিনি বাংলাদেশের সংবিধানকে ১৯৭২ সনের চেহারায়ে ফিরিয়ে আনার জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেন। আগেই বলেছি যে সংবিধানকে অতীতকালে দুইজন সেনা জেনারেল (জিয়াউর রহমান আর এরশাদ) কলুষিত করে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার জন্য শেখ হাসিনার চেষ্টাটা ছিল হাস্যকর। সংবিধান থেকে আশির দশকে এরশাদ কর্তৃক পাওয়া মুখপোড়া সেই রাষ্ট্রধর্মটি বাতিল না করে তিনি একটি অনুভিতি সহ সেটা বলবৎ রেখে দেন – অনুভিতি বা শর্তটি ছিল যে আর বাকি সকল ধর্ম দেশে সমানভাবে পালন করা হবে। একটা রাষ্ট্রের চোখে কি করে সকল ধর্ম সমান মর্যাদা পায় যদি তাদের একটিকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মনোনীত করা হয়? অধিকাংশ বাংলাদেশীরা কি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা দেয়ার অর্থই হচ্ছে বাকি ধর্মের অবলম্বনকারী ও ধর্মহীণদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে দেয়া? মূলত, রাষ্ট্রধর্ম সহ একটা দেশকে কোন্ প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপক্ষ বলা যায়? বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে কবে একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ছিল? আমি নিশ্চয়ই তখন বাচ্চাদের বুটি পরে দিন কাটাতাম। পশ্চিমা দুনিয়ায়ে সকলের অনুধাবিত সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতা অর্জন করতে হলে রাষ্ট্রকে সকল ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকতে হবে, অনেকটা ফ্রান্স দেশটার মত। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝায়ে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। সেখানে ধর্মনিরপক্ষতা মানে কিছুটা ভারসাম্যের ভিত্তিতে সকল ধর্মের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।

 

বর্তমান সরকারের বিগত দশ বছরের দিকে তাঁকালে আমরা দেখতে পাই যে ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক, মুক্তমনা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং যৌন সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক স্তর দ্বিতীয় শ্রেণীর হয়ে পোক্ত হয়ে গেছে। নিম্নে উল্লেখিত কিছু ঘটনার সময়ে সরকারের ভূমিকা ছিল জঘন্য। সেই ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল ইসলামী জঙ্গিদের দ্বারা মুক্তমনা, নাস্তিক ব্লগার, অভিজিৎ রায়ের মত বিখ্যাত লেখক, সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ ও তনয়, লালন ও বাউল কৃষ্টির কিছু সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ এবং হিন্দু, খৃষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মের কিছু ধর্মগুরুদের ক্রমাগত খুন। হতাশার সাথে আমরা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে বার বার শুনতে পাই যে এগুলো ছিল সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলগুলোর উপর দোষ চাঁপিয়ে দিয়ে, এবং হত্যার শিকার হওয়া মানুষদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে লেখার জন্য তাদেরকেই দায়ী করে নিজেকে সকল দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। তার ধারণকৃত কথা অনুযায়ী আমরা জেনেছি যে তার সরকার এই সব নাস্তিকদের দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। সন্ত্রাসী খুনীরা সরকারের এই মনোভাবের ফলে অধিকতর উৎসাহিত বোধ করেছিল বৈকি।

 

ব্যাপার যেই দিকে এগুচ্ছিল, ঢাকার গুলশানে একটি অভিজাত কফির দোকানে বর্বর আক্রমণটি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং তারপরে প্রয়োগ হওয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চাপের ফলে প্রশাসন বিশেষ কিছু অভিজান চালিয়ে জঙ্গিদের অনেককেই আটক এবং নির্মূল করে, যে সকল জঙ্গিদের অস্থিত্বই শেখ হাসিনা এর আগ পর্যন্ত অস্বীকার করে এসেছিলেন। মুক্তমনা এবং নাস্তিকদের ভাগ্য নিয়ে রাজনীতি করার মানসিকতা সহ সরকারের কিছু আগের নিরূদ্যম মনোভাব না থাকলে গুলশানের সেই দোকানে হত্যাকান্ডটি নাও ঘটতে পারতো। সাথে আজ বেঁচে থাকতো সেই জাপানী প্রকৌশলীরা এবং বাংলাদেশের কিছু রত্নরা, যারা অন্ধবিশ্বাস এবং তার পরিণতিস্বরুপ সামাজিক বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আগে থেকেই সোচ্চার হয়েছিল।

 

আজকের দিকে তাঁকালে দেখবো যে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ গত ডিসেম্বরে একটি হাস্যকরভাবে পাতানো নির্বাচনের পর ৫ বছরের জন্য আবারও ক্ষমতায়ে এসেছে। বাংলাদেশের মত রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত একটি দেশে এরকম হেসে উড়িয়ে দেবার মত ফলাফল পাওয়া যাওয়ার কথা না, যেখানে সংসদের ৩০০ আসনের শতকরা ৯৫ ভাগ একটি রাজনৈতিক দল বা তার নেতৃত্বে একটি জোটের পক্ষে যায়। কিন্তু আসলে তাই হয়েছে। সরকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলিয়ে নতুন একটি জোট যার নাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিশিষ্ট ব্যক্তি ডঃ কামাল হোসেন, যার কথা আমি শুরুতে বলেছি, তিনি তার নিজের দল সহ আরও কিছু দলকে এই জোটে একত্র করে নির্বাচনে আনতে পেরেছিলেন। এই ঐক্যের সবচেয়ে বড় দলটা ছিল বিএনপি যেটা একটি নৈতিক এবং রাজনৈতিক অপরাধ করে জামাতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে অস্বীকৃতি জানায়। ২৫ জন প্রাক্তন জামাতীরা বিএনপির একই প্রতিকের নিচে সাংসদ হিসেবে দাঁড়ায় যেহেতু জামাত এখন বাংলাদেশে আর কোনও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয় এবং নিজের প্রতিকের নিচে নির্বাচন করতে পারে না।

 

এক দিকে ঐক্যফ্রন্টের ছাতার নিচে বিএনপি-জামাতের পুনরায় ক্ষমতায়ে আসার সম্ভাবনা, অন্য দিকে আরও ৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসন – এই কঠিন বাছাইটি সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক, মুক্তমনা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং যৌন সংখ্যালঘুদের এক বিরাট বিড়ম্বনায়ে ফেলে দেয়। ভোট দেয়া যদি বাধ্যতামূলক থাকতো তাহলে আমরা অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না কাকে নির্বাচিত করবো। দু’টি দলই ছিল অপাংক্তেও। আমরা বিএনপি-জামাতের প্রশাসন থেকে কখনোই একটা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ উদিত হবার আশা রাখতে পারতাম না, যদিও সেই প্রশাসনটা ডঃ কামাল হোসেনের নৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বে আলিঙ্গনকৃত থাকতে পারতো। অন্য দিকে কিছু আগে দেয়া আমার বর্ণনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা তার ধর্মনিরপেক্ষতার আসল পরিচয় দেখিয়ে আমাদেরকে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা উপহার দেন। কেউ যদি এরপর বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে মনোযোগ দিত, তবে তা হত সহজেই অনুমেয়। দেশ থেকে রাষ্ট্রধর্ম উঠিয়ে দেয়া সহ ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার তাদের ব্রত আমাদের কানে সঙ্গীতের মত বেজে ওঠে। দুর্ভাগ্যবসত, এই একই বামপন্থীরা এখনও কার্ল মার্ক্স আর চীনের জেনারেল মাওয়ের লেখা বইগুলো পড়া নিয়ে ব্যস্ত। তারা এখনও বিশ্বায়ন এবং মুক্ত বাজারকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্বাসের সাথে এদের হাতে তুলে দেয়া হবে সেই অর্থনীতির স্থবিরতা এনে দেয়ার শামিল।

 

অর্থনীতির কথা এলে বলতে হবে যে হাসিনাকে যারা চরমভাবে ঘৃণা করে এক মাত্র তারাই গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশ যেই অসাধারণ অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভেতর দিয়ে গিয়েছে সেটাকে অস্বীকার করবে। বস্ত্র শিল্প, ঔষধ, উঠতি তথ্য-প্রযুক্তি ইত্যাদি দ্বারা বেসরকারি খাতের চাকার সাথে যোগ হয়েছে শুধু বিদেশ থেকে পাঠানো বাংলাদেশী শ্রমিক এবং পেশাজীবীদের কষ্টার্জিত অর্থই নয়, বরং সাথে দেশের অবকাঠামোতে বিস্ময়কর বিনিয়োগ এবং জরুরী সমাজ কল্যান ভিত্তিক কর্মকান্ডের সূচনা বা ধারাবাহিকতা। আজ বাংলাদেশ তার সকল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোর জন্য গর্ব বোধ করতে পারে এবং এর কৃতিত্বের বিরাট এক অংশ বর্তমান সরকারের উপরেই বর্তায় এবং বর্তানো উচিৎ।

 

শেখ হাসিনা এই সাফল্যের মর্মটা একটু বাড়াবাড়ির সাথে আমলে নিয়েছেন এবং এর ফলে দেশে  আজ বাকস্বাধীনতা, অন্যদের জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ সহ সংবিধানে নিশ্চিত করা বিভিন্ন বিষয় যেমন আইনি নিরাপত্তা, আইন থেকে নিরাপত্তা, কোন প্রতিপক্ষ থেকে ভয় ভীতি ছাড়াই নিরাপদে জীবন যাপন (অনেক সময়ে যেটা সয়ং সরকার নিজেই), প্রভৃতি ব্যাপারগুলো একেবারেই হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে প্রচন্ড আপত্তি আসা সত্যেও একমাত্র সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার আদলে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামক একটি কালো আইন পাশ করেছে।

 

এই আইনের ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিভিন্ন রকম প্রয়োগকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং মতবিরোধের অনেক ন্যায্য উদাহরণের ফলাফল হিসেবে ধার্য করা হয়েছে বড় অংকের জরিমানা এবং কারাদন্ড। এই দন্ডবিধির ২৫ নং ধারা রাষ্ট্রের জন্য একটি বিশেষ ধরণের সংরক্ষণ নির্ধারণ করেছে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন বৈধ রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশকে নিষিদ্ধ করা বা সেটাকে দন্ডনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ২৮ নং ধারাতে বলা হয়েছে যে “ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন যে কোনও সংবাদ” – এর প্রকাশনা বা সম্প্রচার হচ্ছে একটি দন্ডনীয় অপরাধ। আইনটির ফলে পুলিশকে দেয়া হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে একটি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে – নিছক এই সন্দেহে বিনা পরোয়ানায় যে কাওকে গ্রেফতার করার সর্বোচ্চ ক্ষমতা। আইটির ফলে সরকারের কোন কর্মচারীকে গোপনে চিত্র বা কন্ঠ ধারণ করা, বা কম্পিউটার বা অন্য কোন ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে কোনও সরকারি কার্যালয় থেকে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করাকে ১৪ বছরের কারাদন্ডের সাজা দেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

আমরা সরকারের কাছ থেকে “আশ্বাস” পেয়েছি যে সাংবাদিকদের ভয়ের কিছু নেই, বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়নি ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমরা যেমনটি ভেবেছিলাম এবং যেমনটি পরে দেখেছি, এই সব কথাগুলো ছিল ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর কিছু না। আইনটি ইতিমধ্যেই অপব্যবহার করা হচ্ছে – গত নির্বাচনের অনিয়মের প্রতিবেদন পেশ করার জন্য সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করায় ব্যক্তিদেরকে আটক করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল যে শহিদুল আলম নামক একজন ফটো সাংবাদিক এবং অধ্যাপককে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয় এবং বহু কষ্টে পাওয়া জামিনের আগে তাকে ১০০ দিন কারারূদ্ধ করে রাখা হয়। আল-জাজিরার সাথে একটি সাক্ষাৎকারের এবং ফেসবুকের বিভিন্ন পোষ্টের মাধ্যমে তিনি ছাত্র লীগ এবং পুলিশকে ব্যবহার করে একটি সম্প্রতি জেগে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করার জন্য সরকারের তীব্র নিন্দা করেন। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র মামলা আনে। নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা কবে থেকে দেশদ্রোহিতার শামিল হলো বলতে পারেন? আমি বলতে পারি। এটা হলো সেই দিন থেকে যেই দিন সেই সরকারটা একটা মাথামোটা, চামড়াপাতলা এবং নির্লজ্জ স্বৈরাচারে পরিণত হয়।

 

ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তমনা, নাস্তিক এবং যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এবং তার বাইরে একটি আন্দোলন কিভাবে শুরু করবো সেটা জিজ্ঞেস করার আগে আমাদের মনে উপরে বর্ণিত বাস্তবতাটি ভালভাবে অনুধাবণ করে নিতে হবে। এরকম কিছু একটা করার পরিসর কোথায়? কোনও বর্ণের রাজনীতিবিদদের মাঝে তা পাওয়া যাবে না (কিছু বামপন্থীগন ছাড়া)। বিএনপি-জামাতের বদনাম সত্যেও আমি গত নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের কিছু বস্তুকে বেশ আকর্ষণীয় মনে করি। এগুলোর মধ্যে দেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ করবে এমন কিছু পদক্ষেপ ছিল অন্যতম। বর্তমানে দেশে বিচার বিভাগ লজ্জাস্করভাবে সরকারের হাতের মুঠোয়ে। ইশতেহারের আরেকটা বৈশিষ্ট ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সম্পুর্ণ অপসারণের প্রতিশ্রুতি যা অন্তত আমাদের কন্ঠ ফিরিয়ে দিত। মানছি যে বাংলাদেশে অধিকাংশ ইশতেহারই কখনোই পুরাপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না এবং নির্বাচনে ভোট পাওয়ার জন্য এগুলো ফাঁকা বুলি হিসেবেই থেকে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এই সব বস্তু একেবারেই ছিল না এবং কাকে ভোট দেয়া যায় সেটা নির্ধারণ করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের এই সকল আধপোড়া নিয়তগুলোই ছিল আমাদের নির্দেশক।

 

অতএব আমি গত নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য ঐক্যফ্রন্টকে সমর্থন করি, যেই নির্বাচনটি প্রহসনের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে আগামী ৫ বছর আমাদের কন্ঠস্বর রোধ করা হয়ে থাকবে। অধিকাংশ ধর্মনিরপক্ষ ব্যক্তিরা এখানকার দ্বিমূল বাছাইয়ের ব্যাপারটা সুষ্ঠভাবে অতিক্রম করতে পারে নি। আগামী ৫ বছরের জন্য অনেকেই বর্তমান সরকারকেই নির্বাচিত করেছে। আমার দৃশ্যানুযায়ী আমি এই সময়টাতে “প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনাচার” – কে নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রের চোখে সকল সমকামীদেরকে অপরাধী বানিয়ে দেয়া বাংলাদেশের দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া আনার কল্পনাও করতে পারছি না। এরকম একটা প্রক্রিয়ার সফলতার জন্য দেশের বিচার বিভাগের যথেষ্ট স্বাধীনতার প্রয়োজন। এবং সম্প্রতিকাল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিলুপ্তিও প্রয়োজন যাতে করে একজন মুসলমানের কল্পনা অনুযায়ী আমি তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছি এই অজুহাতে সে যেন আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে না পারে। মনে আছে, সমকামিতা ইসলামের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম এখনও ইসলাম?

 

আমি আর বাংলাদেশে বাসরত একজন যৌন সংখ্যালঘু অধিকার কর্মী ও আইনজীবী সম্প্রতি লন্ডনে অবস্থিত হিউমান ডিগনিটি ট্রাস্ট (এইচডিটি) নামক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সহায়তার দ্বারস্থ হই, যেই সংস্থাটি যেসকল দেশ সমলৈঙ্গিক সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে, সেসকল দেশে সেই আইনগুলোর বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনি প্রক্রিয়া আনার জন্য নিবেদিত। ঘটনাক্রমে সেই আইনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বিলেতি সাম্রাজ্যের অনশিষ্টাংশ এবং সেগুলো সেই সময়ে বিলেতিদের দ্বারা সেখানে বসানো হয়। যাই হোক, এইচডিটি বাংলাদেশে এরকম একটি আইনি প্রক্রিয়া আনার সম্ভাবনা যাচাই করার জন্য কিছু গবেষণা করে। তারা এই দিকে অগ্রহসর হতে জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত হওয়ার পেছনে অপ্রতিরোধ্য কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল দূরবর্তী। হেফাজতে ইসলাম নিশ্চয়ই এটা শুনে পুলকিত হয়েছিল। ভারতের ৩৭৭ ধারার সাম্প্রতিক এবং ঐতিহাসিক বিলুপ্তিকরণ, যার কারণে আমরা সবাই গর্বিত হতে পারি, তার কিছু পরেই হেফাজতের মোল্লাদের ধারণ করা ওয়াজ মাহফিলে শোনা যায় যে তাদের দেশে একই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজন হলে সকল সমকামীদের হত্যা করা হবে এবং দেশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে। শেখ হাসিনার চোখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এই সকল দুর্বৃত্তদের বেলায়ে প্রযোজ্য না।

 

বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে রাজনৈতিক পরিসরের অভাবের কারণে আমাদেরকে আমাদের সকল কাজ সামাজিক মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রেখে যত বিস্তীর্ণ সম্ভব মানুষদের কাছে পৌঁছতে হবে। সমকামিতা, মুক্তচিন্তা এবং নাস্তিকতা নিয়ে বাংলা ভাষায়ে বিভিন্ন ইউটিউব ভিডিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশের নেটওয়ালা তরুণদের মাথা নাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। এই প্রচেষ্টাকে বলবৎ রাখতে হবে এবং এর ব্যাপক বিস্তার নিশ্চিত করতে হবে। বৈচিত্র্য.বাংলা নামক একটি জালপাতার প্রধান সম্পাদক হয়ে আমি বিশ্বের সমকামীদের বিভিন্ন তথ্য বাংলাদেশের অন্য সমকামীদের কাছে এমন একটি ভাষায়ে পৌছে দিচ্ছি যেই ভাষায়ে সবচেয়ে বেশী প্রভাব রাখা সম্ভব। বিশ্ব জুড়ে বাংলা ভাষীদের মধ্যে সরাসরি ফেসবুকে স্বীয় ভিডিওর ব্যাপক ভক্ত তৈরি করতে পারার জন্য আমি এখন আসিফ মহিউদ্দিন এবং আরিফুর রহমান নামক দুই ব্লগারদের চেষ্টার প্রশংসা করছি।

 

আমি নিম্নের কিছু কথা দিয়ে শেষ করছি। বাংলাদেশে যৌন সংখ্যালঘু এবং নাস্তিকদের সম্পুর্ণ সমতা আনতে হলে আমাদেরকে এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হবেঃ

 

  • সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম অপসারণ
  • বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা
  • দেশের দন্ডবিধি থেকে ৩৭৭ ধারার অপসারণ

 

আমরা কিভাবে এই লক্ষ্যগুলোর একটিও অর্জন করতে পারবো তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এতটুকু বলতে পারি যে মুক্তমনা, নাস্তিক ও যৌন সংখ্যালঘুদের যাত্রা একই উদ্দেশ্য ও গন্তব্যের মর্ম দিয়ে গাঁথা। একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনের বিকাশ সম্ভব নয়। একজন আরেকজনকে হাত বাড়িয়ে দিব এবং আমরা একত্রে একটি দুনিয়া গড়ে তুলবো যেটা হবে মানব সভ্যতাকে উপহাস করা সংকীর্ণ মনোভাব থেকে মুক্ত। আমি সকল আল্লাহবিহীন বর্বরদের অনুরোধ করছি ধর্মীয় পুস্তকের অবরোধ থেকে মুক্ত, চিন্তাশক্তির সামাজিক পরিসর তৈরি করে দিতে – যাতে আমরা সমকামীরা জলের উপর আমাদের মাথা ভাসমান রাখতে পারি। বিনিময়ে আপনারা দেখবেন যে যেই সমাজ সমকামীদের গ্রহণ করে, সেই সমাজ নাস্তিকদেরও সমানে গ্রহণ করতে পারে। অনেক ধন্যবাদ এবং জয় বাংলা।