পার্বত্য জেলা বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমি অধিগ্রহণের ফলে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় ৭৫০টি ম্রো আদিবাসী পাহাড়ি পরিবার হারিয়েছে অরণ্যঘেরা স্বাধীন জনপদ। ছবির মতো অনিন্দ্যসুন্দর পাহাড়ি গ্রাম, জুম চাষের (পাহাড়ের ঢালে
বিশেষ চাষাবাদ) জমি, ঐতিহ্যবাহী শিকার- সব কিছুই আজ অতীত।

উচ্ছেদে হতদরিদ্র ম্রো জনগোষ্ঠী সেই থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে বাস করছেন চিম্বুক প্রধান সড়কের পাশে। তাদেরই একাংশ ‘ক্রামাদি পাড়া’ নামক নতুন একটি বসতি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু জুম চাষের জমি কমে আসায় জীবন হয়েছে আরো কঠিন। কেউ বা পেশা বদল করে পরিণত হয়েছেন দিনমজুরে। এত কিছুর পরও হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য নাচ-গানের সংস্কৃতি ধরে রাখারও চলছে প্রাণান্তকর চেষ্টা। কিছুদিন আগে সরেজমিনে চিম্বুক পাহাড়ে ঘুরে দেখা গেছে, উচ্ছেদের এক যুগ পরেও পুনর্বাসিত হয়নি ভাগ্যহত ম্রো পরিবারগুলো।

চিম্বুক পাহাড়ের স্থানীয় যুবক চিনপাত ম্রো ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর উচ্ছেদ অভিযানের বর্ণনা দিয়ে আলাপচারিতায় বলেন, ‘আমি তখন ঢাকায় নটরডেম কলেজের ছাত্র। ছুটিতে পুরনো পাড়া নামক গ্রামের বাড়িতে ফিরছি। শরীর-মনজুড়ে বাড়ি ফেরার আনন্দ। কিন্তু বিকেলের দিকে গ্রামে ফিরে দেখি সব ফাঁকা। কোথাও জনমানুষ নেই। অনেক চেষ্টার পর রাতের বেলা গহিন জঙ্গলে আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে পাই। ভয়াবহ শীতের রাতে ৩৩টি পরিবার জঙ্গলের ভেতর কলাপাতা দিয়ে অস্থায়ী ছাউনি করে কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। উচ্ছেদের পর অজানা আতঙ্কে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত।’

চিনপাত বলেন, ‘আমাদের গ্রামটি প্রায় ৫০ বছরের পুরনো। উচ্ছেদের পর আমরা চিম্বুক পথের ধারে অল্প কিছু জমিতে ক্রামাদি পাড়া নামে নতুন বসতি গড়েছি। আমাদের জুম পাহাড়, শিকারের বিস্তীর্ণ বন, মাছ ধরার নদী, ঝরণা- সবই এখন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবিরের জন্য অধিগ্রহণ করা। জুম চাষের জমি কমে যাওয়ায় ঘরে ঘরে অভাব লেগেই আছে। পর্যটনের গাড়ি চলাচলের সংখ্যা বাড়ছে বলে চিম্বুক সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। সে সঙ্গে রয়েছে কক্সবাজার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের উৎপাত। আমাদের মেয়েরা আগের মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। নতুন উচ্ছেদ আতঙ্ক এখনো তাড়া করে ফেরে। সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বান্দরবান প্রশিক্ষণ এলাকাটি নিরাপত্তা বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। ওই এলাকাটি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার লামা-সুয়ালক ও বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের সংযোগস্থলের হলুদিয়া নামক স্থানে অবস্থিত। এটি মূলত একটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। প্রশিক্ষণ এলাকাটি ১৯৯১-৯২ সালে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয়ের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়। ফায়ারিং রেঞ্জ এলাকাটি মোট ১১ হাজার ৪৬৭ দশমিক ৪৮ একর জমি নিয়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে সরকারি খাস জমির পরিমাণ আট হাজার ৬৩৫ দশমিক ২১ একর এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির পরিমাণ দুই হাজার ৮৩২ দশমিক ২৭ একর। একটি সূত্র বলছে, অধিগ্রহণকৃত জমিতে ‘অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারীদের’ ২০০৬ সালে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

সাংস্কৃতিক দলনেতা মেনলেং ম্রো আলাপকালে অভিযোগ করে বলেন, ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী কোনো রকম আগাম নোটিশ ছাড়াই ভাগ্যকূল, কদুখোলা, সুয়ালক ও টংকাবতির পাহাড়ে যে ৭৫০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে, তাদের মধ্যে ম্রো ছাড়াও বম, চাকমা এমনকি কিছুসংখ্যক বাঙালি পরিবারও রয়েছে। এরপর কেউ তাদের কোনো খবর রাখেনি।

তিনি জানান, ২০১০ সাল থেকে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামক একটি বেসরকারি সংস্থা ক্রামাদি পাড়ায় ‘রাইস ব্যাংক’ গড়ে তুলে অভাব মোকাবিলায় সহযোগিতা করছে। এপ্রিল, মে ও জুন- এই তিন মাসে জুমের ফসল থাকে না বলে সে সময় খাদ্যাভাব পরিস্থিতি চরমে ওঠে। তখন স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে তোলা ‘রাইস ব্যাংক’ থেকে যেকোনো অভাবী পরিবার খাদ্য সাহায্য পেতে পারে। এ ছাড়া একই উন্নয়ন সংস্থা ম্রো সাংস্কৃতিক দলটিকে প্রাচীন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে নাচের পোশাক ও বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে।

তুম মুম এবং তুম সিং নামের দুজন ম্রো তরুণী নাচেগানে খুবই পটু। তারা জানান, পরিবারের বয়স্ক নারীদের কাছ থেকে বংশ পরম্পরায় এসব নাচ-গান চলে আসছে। জুম চাষ ও ঘরের কাজের পাশাপাশি নাচ-গানের মাধ্যমে নিজস্ব ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে চান তারা।

ম্রো সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, এক ধরনের লাউয়ের খোলের ভেতর নানা মাপের বাঁশের নল পুরে তৈরি হয় ‘প্লুং’ নামের বাঁশি। এটি সম্ভবত একমাত্র দেশীয় বাদ্যযন্ত্র, যাতে একই সঙ্গে একাধিক সুর তোলা সম্ভব। প্লুং বাঁশিটি যত বড় হবে, এর সুরও হবে তত চড়া। নাচ-গানের সঙ্গে আরো যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় ম্রো ভাষায় এগুলো হচ্ছে তম্মা (ঢোল), ক্লিন চা (খঞ্জনি) ও লাং মেং সা (বড় খঞ্জনি)। এ ছাড়া মেয়েদের নাচের পোশাককে ‘লংকি’ এবং বাদ্যযন্ত্রীদের পোশাককে ‘লংকি বেন’ বলে। পাগড়িকে ম্রো ভাষায় বলে ‘ন পং’।

মেনলেং ম্রো জানান, ম্রো জীবনেও লেগেছে নগর জীবনের ছোঁয়া। প্রাচীন রীতিনীতি মেনে ম্রোরা এখন আর প্রকৃতি পূজা বা গো-হত্যা উৎসব করেনা না। ১৯৮৪ সালে সবাই একেশ্বরবাদী ‘ক্রামা’ ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ঐতিহ্য অনুসরণ করে বেশির ভাগ ম্রো যুবকই এখন লম্বা চুল রাখে না।

মেনলেং-এর ভাষায়, ‘সব কিছুই দ্রুত বদলে যাচ্ছে।’
______________________________

* সংযুক্ত : এক যুগ আগের সেই উচ্ছেদের খবর
https://bdnews24.com/bangladesh/2006/12/21/army-drive-throws-750-cht-f
amilies-out-of-homes

______________________________

ছবি : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, বান্দরবানে জুম চাষ।