সুবর্ণচরের সেই হতভাগিনী নারীর জন্য সবার মত আমিও গভীর সমবেদনা অনুভব করছি।না, সম্ভবত একটু ভুল বললাম আসলে সবার মত নয় কিছু মানুষের মত।সব মানুষ কি নারীর প্রতি পুরুষের হিংস্রতার বিরুদ্ধাচারণ করেন? আদৌ নয়।অনেকেই একে মৌনভাবে সমর্থন করেন।কেউ দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে কেউ অতীতের শিক্ষা থেকে আর কেউ বিকৃত মানসিকতা থেকে।আর ঐতিহাসিক ভাবেতো দেখা যায় একেবারে ঈশ্বরের জবানিতেই একে সিদ্ধতা দেয়া হয়েছে।বিশাল বিশাল মহামানবগণ যুদ্ধ আর রক্তের হোলিখেলা শেষে চূড়ান্ত জিঘাংসাটুকু চরিতার্থ করেছেন প্রতিপক্ষের নারীর উপর।নারী হয়ে জন্ম নেয়া একটি শিশুও তাদের মাংসল কিরিচের বর্বরতা থেকে রক্ষা পায়নি।গোত্রে গোত্রে চলেছে স্বার্থ আর আধিপত্যের লড়াই কিন্তু তার শেষমূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে নারীকেই তার শরীর আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে।ঐতিহাসিকভাবে নারী আসলে মানুষ নয় রক্ত মাংসের জীবন্ত পণ্য।নারীযে আজও পূর্ণ মানুষের মর্যাদা পায়নি তা ভারতের কেরালার  সাবারিমালা মন্দিরে দুই নারী প্রবেশকে কেন্দ্র করে পুরো জনপদ উত্তাল হয়ে ওঠার ঘটনা থেকেই আঁচ করা যায়। ঐসব ধর্মালয়ে কুকুর বেড়াল প্রবেশ করলেও মনে হয় তেমন হৈচৈ পড়বেনা কিন্তু নারী প্রবেশ করাতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।দেবালয়ের শতাব্দীর পূত পবিত্রতা ধুয়েমুছে একাকার হয়ে গেছে কেননা নারীতো আসলে মানুষ নয় পশুর চেয়েও অধম আর অপবিত্র কোনো প্রাণী।

সুবর্ণচরের সেই ধর্ষিতা নারীকে বলা যায় আধুনিক যুগের মালে গনিমত। অনেকে দায়মুক্তির জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন ধর্ষকের কোনো দল নেই এটা অনেকটা রাজনীতিকদের মুখস্ত বুলি ‘সন্ত্রাসীর কোনো দল নেই’ এরই একটি ভিন্ন সংস্করণ।অথচ বাস্তবে দেখা যায় দল আসলে সন্ত্রাসীরই।সন্ত্রাসীরাই ক্ষমতার পালাবদলের মূখ্য নিয়ামক।এরাই প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দিয়ে ভোটের বাক্স ভরে জমিদারদের জমিদারির পত্তন ঘটায়। দুই হাজার একের সেইসব রোমহর্ষক গণধর্ষণ আর সুবর্ণচরের গণধর্ষণের একই দর্শন। এই ধর্ষকেরা রাজনীতিরই সৃষ্টি।রাজনীতিই এদের আশ্রয় দিয়েছে প্রশ্রয় দিয়েছে সেসাথে তাদের কামদন্ডকে উদ্দীপ্ত করেছে বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত সেই একই ‘মালে গনিমত’ তত্ত্ব।

সুবর্ণচরের ধর্ষকদের ধরা হচ্ছে। ধরলেও শেষপর্যন্ত বিচার হবে কি না আর বিচার হলেও দয়ার অবতার রাষ্ট্রপতির অনতিক্রম্য দয়ার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে  অপরাধীগণ শাস্তি ভোগ করবে কি না তা নিয়ে একগাদা প্রশ্ন থেকেই যায়।আর শাস্তি পাওয়া না পাওয়ায় কী এসে যায় সেই ধর্ষিতার? তিনি যা হারিয়েছেন তা কি কোনো ক্ষতিপূরণ দিয়ে মেটানো সম্ভব? বরং বিচার করাটা এই দেশ আর সমাজের স্বার্থেই প্রয়োজন। বিকৃতমনা মানুষদের এই সিগনেলটা দেয়া যে এখন আমরা মধ্যযুগে নেই। মধ্যযুগে যা ঈশ্বর প্রদত্ত এবং অনুমোদিত ছিল এখন তা অন্যায় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অতীতের কামুক ঈশ্বর এখন সভ্যতার নৈতিক মানদন্ডে আসামীর কাঠগড়ায়।

সুবর্ণচরের নির্যাতিতা গৃহিনী নির্বাচনোত্তর সেই কষ্টকল্পিত সময়টাকে যদি তার স্মৃতি থেকে ইরেজ করে দিতে পারতেন তাহলে সম্ভবতঃ তার আগামী দিনগুলো স্বাভাবিক হয়ে আসত কিন্তু এটা কার্যত এক অসম্ভব ব্যাপার।কেননা তিনি তা ভুলতে চাইলেও সমাজ তাকে ভুলতে দেবেনা।বরং বলা যায় প্রাথমিক ধর্ষণপর্ব শেষে এখন শুরু হল দ্বিতীয় ধর্ষণপর্ব।প্রাথমিক ধর্ষণপর্বের মেয়াদ ছিল হয়তো ঘন্টাখানেক কিন্তু ধর্ষনোত্তর ধর্ষণপর্বের মেয়াদ অনন্ত।জীবদ্দশায়তো বটেই এমনকি তার মৃত্যুর পরেও তা অব্যাহত থাকবে। অন্তত ক্ষমতার চেয়ারটি যতদিন সহিংস এবং রক্তপিয়াসী মিউজিকেল চেয়ারের ভূমিকায় থাকবে ততদিন এই পর্ব চলতেই থাকবে। সেই অনন্ত কষ্টের পালা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন সুবর্ণচরে।তার সাক্ষাৎকার নিয়ে পত্রিকায় দিতে হবে টিভিতে প্রচার করতে হবে কেননা সেই খাদ্যের জন্য উদগ্র বাসনায় অপেক্ষা করছে ক্ষুধার্ত খদ্দের।ছুটে যাচ্ছেন সমাজকর্মী।নির্যাতিতার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে সেলফি তুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সোসাল মিডিয়ায়। নিজেকে তুলে ধরার এমন বিজ্ঞাপন কি মিস করা যায়? ছুটে যাচ্ছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং এনজিওজন। রাজনীতিবিদরা ছুটে যাচ্ছেন নগদ অর্থ এবং ভবিষ্যতের আশ্বাসের ঝুলি নিয়ে।হায়েনাদের নিষ্টুর আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে তাকে বারবার বিছানায় উঠে বসতে হচ্ছে,দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিতে হচ্ছে।তার চিকিৎসা এবং অবশিষ্ট সম্ভ্রমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তার কথা বলা। এ এক অনিঃশ্বেস এবং যন্ত্রণাবিদ্ধ পরিক্রমা। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ‍্য সেই নির্যাতিতার চারটি নাবালক শিশুসন্তানের। তারা বুঝে ফেলল ইলেকশনে পক্ষের দল হেরে গেলে এমন কিছু প্রলয় ঘটে যেতে পারে।এই বয়সেই তারা জেনে গেছে ধর্ষণ নামে পুরুষের একটি নিষ্টুরতা আছে যার শিকার তাদের জন্মদাত্রী মাতা।আহারে ফুলের মত শিশুরা! কত অল্প বয়সেই এরা রঙ্গরসে ভরা পৃথিবীর উল্টো পিঠের ছবিটাও দেখে ফেলল।

তদন্ত, ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিচারের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সুবর্ণচর ইস্যুটি এক সময় হয়তো ঝিমিয়ে পড়বে এবং এর সুষ্ট বিচার হল কি হলনা এর তোয়াক্কা না করেই আগামী কোনো এক নির্বাচনের প্রাক্কালে এটি আবার জেগে উঠবে এবং অবশ্যই নগ্ন নিষ্টুরতায়। তাকে নতুন জামাকাপড় পরে মুখে হালকা প্রসাদনী লাগিয়ে ক্যামেরার সামনে বসে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। কীভাবে তিনি সেই হায়েনাদের কামনার শিকার হয়েছিলেন তার পুংখানুপুংখ বিবরণ দিতে হবে। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কেউ ভাল না বাসলেও তাকে হৃদয়টাকে খুঁড়তেই হবে।তার নিজের নয় রাজনীতির স্বার্থে। এই দৃশ্য দেখেছি পূর্ণিমা শীলের ক্ষেত্রেও।পূর্ণিমা শীলের প্রতি কী হয়েছিল সেই  বর্বরতার বিবরণ এখানে আর দেয়ার প্রয়োজন নেই। অনেককাল পূর্ণিমা ইস্যুটি ঘুমিয়ে থাকার পর নির্বাচনকে সামনে নিয়ে আবার তা জীবন্ত এবং সজীব হয়ে উঠতে দেখা গেল। হবেইতো। পূর্ণিমা শীল একটি রাজনৈতিক দলের তুরুফের তাস। খেলার ক্লাইমেক্স মুহুর্তে সেই ট্রাম্পকার্ডের প্রয়োগ না করলে কি চলে? দেখা গেছে যথারিতি সাজগোজ করে দুই হাজার একের ‘মালে গনিমত’ এর শিশু দুই হাজার আটারোর পরিপূর্ণ নারী পূর্ণিমা ক্যামেরার সামনে বসে সেই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন বা বলা উচিৎ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর তার সেই সাক্ষাৎকারটিও নিচ্ছেন আরেকজন নারী। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকের প্রশ্নবানে যে পরিমাণ আবেগমাখানো ছিল তাতে মনে হল দীর্ঘ দেড়যুগ তিনি পূর্ণিমার কষ্টকে বুকের গভীরে বহন করে চলেছিলেন আর ইলেকশনকে সামনে নিয়ে হঠাৎ করে তার সেই কষ্ট উতল হয়ে উঠেছে। আহা, একজন নির্যাতিতা নারীর কষ্টকে পুঁজি করে আরেক প্রফেশনাল নারী সাংবাদিকের কী নিখুঁত অভিনয়!

আওয়ামীলীগ ভাগ্যবান, তাদের হাতে পূর্ণিমার মত একটি জু্তসই ট্রাম্পকার্ড আছে।এই ট্রাম্পকার্ডের জন্য বিএনপির বিবেকবান অংশটি এতদিন বিব্রত থাকত।বিএনপির সেই বিব্রতকালের মেয়াদটি সম্ভবতঃ ফুরাল। কেননা তাদের হাতেও একটি ট্রাম্পকার্ড এসে গেছে।সেই ট্রাম্পকার্ডে যতই সুবর্ণচরের বিবর্ণ কুৎসিত রূপটি প্রকাশিত হোকনা কেন বিএনপির জন্য তা একটি অমূল্য বিজ্ঞাপন হিসেবে ভবিষ্যতে  চমৎকার কাজ দেবে।