সিরাজ সিকদার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আলোচিত নাম। কারো চোখে তিনি ভুল বিপ্লবের বাঁশিওয়ালা, কারো কাছে তিনি ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে লড়াই করা এক বীর যোদ্ধা যাকে ১৯৭৫ সালে সরকারী হেফাজতে হত্যা করা হয়। সরকারী হেফাজতে হাই প্রোফাইল নেতা হিসেবে সিরাজ সিকদার ছিলেন প্রথম হত্যাকাণ্ডের শিকার। লক্ষ্য করুন, বলেছি সরকারী হেফাজতে থেকে, সরকারী বাহিনীর হাতে খুন নয়। কারণ স্বাধীনতার পর সরকারী বাহিনীর হাতে অংখ্য খুনের ঘটনা ঘটেছে।

১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে চিহ্নিত করে সিরাজ সিকদার নিজের বিপ্লবী থিসিস শুরু করেন। সেই থিসিসের উপর ভিত্তি করে সর্বহারা পার্টি প্রথমে “পূর্ব বাঙলা শ্রমিক আন্দোলন” ও পরবর্তীতে “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম” শুরু করে। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো তার পার্টি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায় । তারিখটি ছিল ৮ জানুয়ারি ১৯৭০ সাল। এই পতাকার ডিজাইন করেন একজন বিহারী মুসলিম। নাম-সাইফুল্লাহ আজমী। তিনি সিরাজ শিকদারের পার্টি করতেন। তিনি ছিলেন একজন বিহারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তবে পাকিস্তানীদের সাথে লড়াইয়ে তিনি প্রাণ হারাননি। সাইফুল্লাহ আজমী প্রাণ হারান মুজিব বাহিনীর হাতে। মুজিব বাহিনী আলোচনার জন্যে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করে। ৭১-এ মুজিব বাহিনীর এরকম অনেক বিতর্কিত ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ সরকার মুজিব বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না। শেখ মণি’র মতন নেতারা মনে করতেন শেখ মুজিবের অবর্তমানে তারাই অভিভাবক। ফলে প্রকাশ্যে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বের বিরোধিতা করতো তারা। অভিযোগ আছে- বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকেও হত্যা চেষ্টা করে তারা।

সিরাজ সিকদার চীনপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ফলে ভারতের সহযোগিতায় স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ থেকে ভিন্ন। সিরাজ সিকদারের দল মনে করতেন পাকিস্তানীদের থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের গোলামী করার জন্যে বাংলার মানুষ যুদ্ধ ও সংগ্রাম করেনি। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধে চীনপন্থি বামদের হাতে যেন অস্ত্র না যায় সে ব্যাপারে ভারত সরকার শক্ত অবস্থানে ছিল। বামপন্থীরা সব সময় ভারতীয় আধিপত্যের বিরোধী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বামপন্থী কিংবা সেক্যুলার লাইনে ভারতের আধিপত্যের বিরোধিতা ব্যর্থ হওয়ায়, সেই ব্যর্থতার ফাঁক দিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক বার্তা চাঙ্গা হয়েছে। ফলে মৌলবাদী দলগুলো ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করার সুযোগ পেয়েছে।

বামপন্থীরা শুধু স্বাধীনতা প্রশ্নে নয়; “জয় বাংলা” স্লোগান নিয়েও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ ছিল। তারা কেন “জয় বাংলা” বলতো না, এর জন্যে তাদের নিজস্ব বয়ান ছিল। যেমন বামপন্থী শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার ১৯৭০ এর নির্বাচনের কয়েকদিন আগে (৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০) দৈনিক সংবাদে লেখা উপসম্পাদকীয় লিখছেন-“আওয়ামী লীগ কেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির(ন্যাপ) প্রগতিশীল ও সংগ্রামী কর্মী এবং নেতাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে, গত দুদিন ধরে তার রাজনৈতিক কারণ ও পটভূমিটা বিশ্লেষণ করছিলাম। এই বিশ্লেষণ আজ একান্ত প্রয়োজনীয়। কেননা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে পার্টি দাঁড় করিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যে সুবিধাবাদী নীতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে তা থেকে একটি সিদ্ধান্তই টানা যায়। সে সিদ্ধান্তটি হল, আওয়ামী লীগ প্রগতির পক্ষে থাকছেন না, থাকবেন না। আওয়ামী লীগ থাকবেন প্রতিক্রিয়ার পক্ষে। সেই প্রতিক্রিয়ার পক্ষে থাকতে গেলে জনপ্রিয়তা হারাতে হবে, কাজেই এমন শ্লোগান নাও যাতে সেই প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাটা ঢাকা দেওয়া যায়। স্বায়ত্তশাসন, জয় বাংলা হল এ জাতীয় শ্লোগান। এসব শ্লোগান গালভরা শ্লোগান, লোক মাতানো শ্লোগান। অথচ এর দ্বারা জনগণের কাছে কোন নির্দিষ্ট ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতিও দিতে হচ্ছে না। কাজেই বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে তারপর বাঙ্গালী পুলিশ দিয়ে যখন বাঙ্গালী শ্রমিক বা কৃষকদের ঠ্যাঙ্গানো হবে তখন তা জয় বাংলার নামেই করা যাবে, যখন বাঙ্গালী মুনাফাখোর-কালোবাজারিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে তখন তা জয় বাংলার নামেই করা হবে। কেননা জয় বাংলা কিম্বা ছয় দফার কোথাও এসব করতে মানা নেই। জয় বাংলা কিম্বা ছয় দফার কোথাও জনগণের কথা নেই, রুটি- রুজি কিম্বা জমির কথা নেই। কাজেই জয় বাংলার নামে যা খুশি করা যাবে, ঠিক পাকিস্তান ও ইসলামের নামে মুসলিম লীগ যা করেছিল।”

ফলে কেউ “জয় বাংলা” না বললে কিংবা ৭১-এ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করলে তাকে পাকিস্তানপন্থী কিংবা স্বাধীনতা বিরোধী বলার সুযোগ নেই। সর্বহারা-পন্থী মুক্তিযোদ্ধা যেমন আছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মুজিব বাহিনীর প্রধান নেতাদের নিয়ে গঠিত জাসদ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত দল। ৭১-এ চীনপন্থিরা সাত-আট ভাগে বিভক্ত হয়। চীনপন্থি আব্দুল হকের গ্রুপ ছাড়া অন্য সকল গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বরিশালের পেয়ারা বাগানে (মুক্তাঞ্চল) সিরাজ সিকদার গড়ে তোলে জাতীয় মুক্তিবাহিনী। জাতীয় মুক্তিবাহিনী বরিশাল, বিক্রমপুর, ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সহিত লড়াই করে বীরত্বের পরিচয় দেয়। এছাড়া যুদ্ধে শুরু হওয়ার পূর্বে ১৯৭১ সালে ২ মার্চ তার পার্টির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে খোলা চিঠিতে “মুক্তিবাহিনী” গঠন করে “মুক্তিযুদ্ধ” চালানোর আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারকে খোলা চিঠি দিয়ে প্রস্তাব করা হয় যে, জামায়াত ইসলামীসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে যেন বিলিয়ে দেওয়া হয়।

সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫-এর ২ জানুয়ারি। সেই ৭৫-এই খুন হোন বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা। পরবর্তীতে সেনা বাহিনীর চাপে হোক কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে জিয়ার হাতে খুন হোন কর্নেল তাহের। তাহেরও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। তাহেরকে হত্যা করে জিয়াও শেষ রক্ষা হয়নি। জিয়া নিহত হোন তারই অধীনস্থ সেনা বাহিনীর হাতে। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক জুয়া খেলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বামপন্থী, উদারপন্থী-মধ্যপন্থী কিংবা আওয়ামী পন্থী নেতারা বিলীন হয়ে গেলেও গোলাম আযমরা ঠিকই টিকে ছিল। এবং যুদ্ধাপরাধের দায় মাথায় নিয়ে পুনরায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ দল ও নেতা হিসাবে হাজির করতে সক্ষম হয়।

সিরাজ সিকদারের হত্যার খবর শোনার পর মাহবুব তালুকদার- ‘ ১৯৭৫ সনের ৩রা জানুয়ারি শুক্রবার সকালে দৈনিক বাংলার সংবাদটি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। প্রথম পাতাতেই আছে_ ‘ সিরাজ শিকদার গ্রেফতার গ্রেফতার_পলায়নকালে নিহত।’ সংবাদটি পড়ে মন বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে রইল। সিরাজ সিকদার ভালো না মন্দ সেটা আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু পুলিশের হাত থেকে পালাতে চেষ্টা করল কিভাবে? সে সুযোগ পুলিশ দিল কেন? এর জবাবদিহি পুলিশ তথা প্রশাসনকেই দিতে হবে। ঘটনাটি সম্পর্কে কেবল পুলিশের ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার নিজস্ব কোরো রিপোর্ট নেই। অন্য পত্রিকাতেও নেই। এ কেমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ?

বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে অবজারভার হাউসে ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় চলে এলাম। সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী বাইরে থেকে মাত্রই ফিরেছেন।… বললাম, হায়দার ভাই‍ ! ওর সঙ্গে দেখা করার একটা আগ্রহ ছিল আমার।… কি অবস্থায় দেখলেন তাঁকে?দেখলাম__ রাজপুত্রের মত শুয়ে আছে। শান্ত সৌম্য চেহারা। গতকাল মারা গেলেও লাশ বিকৃত হয়নি।”

(মাহবুব তালুকদার, ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’, পঞ্চম মুদ্রণ : ২০১৭, পৃ.১১৬-১১৭)

২ জানুয়ারিতে নিহত সিরাজ সিকদারের শরীরে পাঁচটি গুলির দাগ পাওয়া যায়। ময়না তদন্তে জানা যায়, ৪টি গুলি সিরাজ সিকদারের দেহ ভেদ করে চলে যায়। এবং একটি গুলি ফুসফুসের পাওয়া যায়। পত্রিকায় সিরাজ সিকদারের স্ত্রী কন্যাসহ তার সকল কর্মকাণ্ড প্রকাশ করা হলেও রহস্যজনক-ভাবে মুক্তিযুদ্ধে সিরাজ সিকাদের ভূমিকার কথা পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৭৫ সালে সিরাজ সিকদারের বয়স ছিল প্রায় ত্রিশ বছর।

এখানে পাটের গুদামের আগুনের প্রসঙ্গটি হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাটের গুদামে আগুনের প্রসঙ্গে একদল সর্বহারা পার্টি ও জাসদের ঘাড়ে এই দায়টি দিয়ে দেয়। সর্বহারা পার্টি অনেক কর্ম/অপকর্ম করলেও পাটের গুদামে আগুন দেওয়ার সাথে তারা জড়িত না। এমনকি জাসদও জড়িত না। ১৯৭৪ সালে একসাথে ১৭টি গুদামে আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটে। তৎকালীন পত্রিকা পড়তে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সরকারী অফিসাররা গুদামের হিসাব উল্টাপাল্টা করতো বলেই ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগাত। এবং এতে সহায়তা করতো স্থানীয় সরকারপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা। অনেক কারখানায় শ্রমিকরা অভিযোগ করেছিল যে, হিসাব উল্টাপাল্টা থাকাতে তাই অফিসাররা গুদামে আগুন দেয়। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ভাষণে একটি- “আমি বিদেশ থেকে যা ভিক্ষা করে আনি। আর চাটার দর সব চেটে খেয়ে ফেলে।” পরের দিন তাজউদ্দীন আহমেদ গুলিস্তানে বঙ্গ মার্কেট উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন; দেশ চালাই আমরা তাহলে চুরি করে কারা?

এটা ঠিক যে, স্বাধীনতার পর যে দুটি দল মুজিব সরকারকে চরম বিপাকে ফেলছিলে তার মধ্যে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি অন্যতম। আরেকটি দল হচ্ছে জাসদ। তবে সরকারের দমন নীতি জাসদের তুলনায় সর্বহারা দলের উপরই ছিল বেশি তীব্র। সিরাজ সিকদার নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন শেখ কামালও। বলা যায় তিনি গুলি খেয়ে মরতে বসেছিলেন। মরেন নাই শেষ পর্যন্ত, তবে ব্যাংক ডাকাতের একটা তকমা দীর্ঘদিন ধরে শেখ কামালের নামের সঙ্গে জুড়েছিল। এখনও হয়তো কেউ কেউ তা বিশ্বাসও করেন।

দুই বছরের মধ্যেই ৬০টিরও বেশি থানা এবং ২০-টিরও বেশি ব্যাংক লুট করে তার দল চমক সৃষ্টি করে তরুণ প্রজন্মকে রোমাঞ্চিত করতে সক্ষম হয় সর্বহারা পার্টি। কিন্তু সর্বহারা পার্টির লাইন বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গ্রহণ করেনি। সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক লাইন ভুল ছিল, তেমনি আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার লাইন ভুল ছিল। ভুল কর্মসূচীতে ছিল জাসদও। ভুল না হলে ব্যর্থ হলো কেন? পৃথিবীর ইতিহাসে আওয়ামী লীগ হয়তো একমাত্র রাজনৈতিক দল, যে দলটি স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী জনপ্রিয় দল হয়েও স্বাধীনতার ৪ বছরের মাথায় গদি থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে। শেখ মুজিব সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করেও শেষ পর্যন্ত এক দলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন। সিরাজ সিকদারের হত্যা পর শেখ মুজিবের- “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? ” এমন উক্তির জন্যে সমালোচিত হলেও খুনাখুনির রাজনীতি যেহেতু শেখ মুজিব করতেন না, সেহেতু সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার হুকুম তিনি দেননি এতোটুকু জোর দিয়ে বলা যায়।  তাই তো বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে যখন বলা হয় সিরাজ সিকদার পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে নিহত হন। তখন তাঁর মুখে শুনতে পাই-‘লোকটাকে তোরা মেরে ফেললি’।

কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?

সিরাজ শিকদারের মৃত্যু নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। “কোথায় আজ সিরাজ শিকদার’, শেখ মুজিবের জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যের এই একটিমাত্র বাক্য উদ্ধৃত করে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল সিরাজ শিকদারকে বুঝি শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে। অথচ সংসদে শেখ মুজিব এ প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলেছিলেন, যা থেকে বোঝা যায়, তিনি দেশের ‘অরাজক পরিস্থিতি এবং দূর্বৃত্তদের’ সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে সিরাজ শিকদারের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন৷ তাঁর বক্তব্যটি ছিল এরকম-  “বিপ্লবের বিরোধিতা করে এবং শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজ দেশবাসীকে যারা হত্যা করে, কোনো জাতি তাদের কখনো ক্ষমা করে না আমরা করেছি। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমার লোকেদের ভালোবাসো, দেশের জন্য কাজ করো এবং স্বাধীনতাকে মেনে নাও৷ এখানে থাকো। কিন্তু তারা বদলায়নি। তারা বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তারা ভাবে আমি কিছুই জানি না। যারা ডাকাতের মত রাতের বেলায় মানুষ খুন করে, তারা মনে করে কেউ তাদের ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? যদি তাকে পাকড়াও করা যায়, যদি তার লোকদের ধরা যায় তাহলে ঘুষখোর কর্মকর্তাদেরও আমরা ধরতে পারবো। যারা গোপনে বিদেশ থেকে টাকা পায়, আমরা কি খুঁজে বের করতে পারব না? যারা সম্পদ লুট করে, তাদের কি আমরা ধরতে পারব না? মজুতদারদের ধরতে পারব না, কিংবা কালোবাজারিদের? নিশ্চয়ই পারব।”  তথ্যসূত্র- মহিউদ্দিন আহমদ, জাসদের উত্থান পতনঃ অস্থির সময়ের রাজনীতি
এস এ করিম তাঁর “[Karim, S. A (2004), Sheikh Mujib-Triumph and Tragedy’ বইতে বলছেন, সিরাজ শিকদারকে হত্যার ব্যাপারে শেখ মুজিবের হাত ছিল- জনমনে এ ধরনের একটা ধারণা তৈরির চেষ্টা করেছেন অনেকেই। কিন্তু সত্যি কি তা-ই? আটক অবস্থায় নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি উৎসাহী কোন কর্মকর্তা যে তাঁকে হত্যা করতে পারেন, এই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সিরাজ শিকদারের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা শেখ মুজিবের কাছে গেলে তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোরা ওকে মেরে ফেললি?’
হায়দার আকবর খান রনোর শতাব্দী পেরিয়ে বইতে শিবপুরের মুজিবুর রহমানের একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যার ডাক না ছিল ঝিনুক।। ঘটনাটি এরকম- ঢাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমানকে তুলি নিয়ে যায় রক্ষী বাহিনী। ঢাকা থেকে রক্ষী বাহিনী তুলে নেওয়ার কোন অধিকার নেই এই কাজ করতো স্পেশাল বাহিনী। যেহেতু মামলাটি ঢাকার বাহিরে শিবপুরের ছিল তাই রক্ষী বাহিনী গ্রেফতার করে। রনো বলছেন, তাদের কাছে খাঁটি খবর ছিল যে রাত ১ টায় ঝিনুককে হত্যা করা হবে। তিনি হত্যা রোধ করার জন্যে অনেক জায়গায় দৌড়া-দৌড়ী করেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হোন। এবং বঙ্গবন্ধুর কারণে ঝিনুক বেঁচে যান। হায়দার আকবর খান রনো আক্ষেপ করে বলছেন,” শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গিয়ে পার্সোনাল অ্যাপ্রোচ করতে পারলে হয়তো এরকম আরও অনেককে বাঁচানো যেত। কিন্তু তা কী সব সময় সম্ভব? আমি একবার তাকে বলেছিলাম, কোথায় কোথায় কাজে হত্যা করা হয়েছে। তিনি একটু রেগে গিয়ে বললেন, শুধু তোদের লোক মরছে, আমার লোককে মারছে না। আমি বললাম, আমার লোক আর আপনার লোক এভাবে বলছেন কেন? আপনি না জাতির পিতা। সবাই তো আপনার লোক। শেখ মুজিব একটু আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, জাতির পিতা হয়েইতো বিপদে পড়েছি।

“৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন: ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

আর্জিতে বলা হয়, ” ……. সে সময় ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭ নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১ নং আসামিকে নির্দেশ দেন ……।” তথ্যসূত্র : ভাসানী মুজিব জিয়া : ১৯৭২-১৯৮১ / জিবলু রহমান ॥ [শুভ প্রকাশন – মে, ২০০৪ । পৃ: ১৮৯]

সিরাজ সিকদার রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার এটি বলতে সিরাজ শিকদারের পার্টির মেম্বার কিংবা চীনা/বামপন্থী হওয়ার প্রয়োজন নেই। হনুমানের লেজের আগুনে যেমন লঙ্কা পুড়ে অঙ্গার হলো। তেমনি বিচার বহির্ভূত হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। আর সেই পথ হারানো পথে হারিয়ে গেল অসংখ্য প্রাণ।কবি রুদ্রের তাইতো লিখেছেন-

হাজার সিরাজ মরে
হাজার মুজিব মরে
হাজার তাহের মরে
বেঁচে থাকে চাটুকর, পা-চাটা কুকুর
বেঁচে থাকে ঘুনপোকা, বেঁচে থাকে সাপ।

পত্রিকার কপি কৃতজ্ঞতায়:PID, Ministry of Information
তথ্য সহায়তায়:
শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প-পারভেজ আলম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর)
বিপ্লবের ভেতর-বাহির-শওকত মাসুম
শতাব্দী পেরিয়ে- হায়দার আকবর খান রনো