লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ The Washington Post Fact Checkers Database অনুযায়ী এ বছরের পহেলা আগস্ট পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪২২৯ টি মিথ্যা বলেছেন। সে হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৭.৬ টি মিথ্যা বলেছেন যা তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার প্রথম ১০০ দিনের দৈনিক গড়ে ৪.৫ টি মিথ্যার চেয়ে বেশি। ট্রাম্পের এ মিথ্যা বলার প্রবনতাকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য তার সমর্থকেরা বলেন যে, “সব রাজনীতিবিদই মিথ্যা বলেন।“ অবশ্যই বলেন এবং একটু অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে আমরা এও দেখতে পারি যে সব মানুষও বলে। কিন্তু মিথ্যা বলার ধরন ও প্রবণতা মানুষের মাঝে পার্থক্য তৈরি করে। অধিক মিথ্যা বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সব মিথ্যাই সমান প্রয়োজনীয় নয়। কিছু মিথ্যা আত্মরক্ষামূলক। একজন রাজনীতিবিদ বিরক্তি এড়াতে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অথবা নিজ রাষ্ট্রের সুবিধার জন্য মিথ্যা বলতে পারেন।

রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের মিথ্যা কখন কখন মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একজন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান তার মিথ্যার জন্য পরবর্তীতে ইতিহাসবিদদের ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন। কেননা তাদের সেই মিথ্যা “বৃহৎ গোষ্ঠী স্বার্থে” ব্যবহৃত হয়েছিল। জন এফ কেনেডি ১৯৬২ এর কিউবান মিসাইল সংকটের সময় তুরুস্কে অবস্থিত মার্কিন জুপিটার মিসাইলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিলেন যা সেই সংকট মোকাবেলায় ইতিবাচক প্রভাব রাখে। আরো উৎকৃষ্ট উদাহরন হলো ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়ার পর তৎকালীন জার্মান সরকার ও হিটলার মার্কিন জনগণের জন্য কতটা ভয়ংকর তা বোঝানোর জন্য ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের একটি মিথ্যা বিবৃতি। তিনি বলেন একটি জার্মান সাবমেরিন একটি মার্কিন গানবোটকে আঘাত করেছিল যদিও এর বিপরীতটাই ছিল সত্য। যুদ্ধকালীন সময়ে মুখ ফসকে সত্য বলার ফল ছিল শত মানুষের মৃত্যু যে কারণে গোপন তথ্য ছিল খুবই স্পর্শকাতর। একারণে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, “একটি সত্য এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এটির সাথে কয়েকটি মিথ্যাকে বডিগার্ড হিসেবে রাখা উচিত।“

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মেয়াদের শুরু থেকেই অপ্রয়োজনীয় মিথ্যাগুলো বলে যাচ্ছেন। যেমন- ওবামার জন্ম কেনিয়ায় বলা, মেক্সিকান প্রধানমন্ত্রীর ফোন পাওয়ার কথা বলা, নিজ শপথ অনুষ্ঠানে ওবামার শপথ অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি মানুষ আসার দাবি করা ইত্যাদি। রাজনীতিতে মিথ্যা নতুন কিছু না হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। মিথ্যা নিয়ে আলোচনায় আসা আরেকজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন ডয়েট ডি আইসেনহাওয়ার। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ভূপাতিত একটি মার্কিন ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানকে আইসেনহাওয়ার আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বিমান হিসেবে দাবি করেন। পরবর্তীতে উক্ত বিমানের পাইলট গ্রেপ্তার হয়ে জবানবন্দী দিলে আইসেনহাওয়ার সত্য স্বীকার করে নেন এবং ব্যাপক সমালচনার মুখে পড়েন। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মিথ্যা বক্তব্য, বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অপব্যবহারের দায় নিয়ে অভিসংশিত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। যৌন কেলেঙ্কারির দায়ে অভিসংশিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপদেষ্টা ক্রিস লেহান বলেন,”মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মাঝে ক্লিনটন অন্যতম জনপ্রিয় একজন কেননা জনগন তার পাবলিক ও প্রাইভেট জীবনের মাঝে পার্থক্য করতে পেরেছিল।”

একজন রাজনিতিবিদকে কেউই সত্যের দেবতা হিসেবে দেখতে চান না। কিন্তু বিগত কয়েক যুগে প্রাতিষ্ঠানিক নানা পরিবর্তন রাজনিতিবিদের মিথ্যা বলার ক্ষেত্র প্রসারিত করেছে। টেলিভিশনের টক শো, ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে বর্তমান সময়ে যেকোনো খবরের নির্ভরযোগ্যতা আপেক্ষিক। আর কোন সর্বজন স্বীকৃত গণমাধ্যম না থাকার ফলে সত্য বিকৃত করা এখন খুবই সহজ। এছাড়া বিভক্তির রাজনীতির এ যুগে যেখানে রাজনীতিবিদরা ভোটারদের পক্ষে বিপক্ষে টানতে ব্যস্ত, সেখানে মিথ্যা শব্দটির সংজ্ঞাই পরিবর্তন হয়ে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিথ্যাগুলো শুধু যে তার নিজের ভাবমূর্তিকেই খর্ব করছে তা নয়। তা প্রভাবিত ও খুন্ন করছে বহির্বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিও। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ও তার মিথ্যাগুলোর মাঝে পার্থক্য হল এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যপকতা। politifact.com এর মতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের মাঝে ২০ শতাংশ সত্য, ৬৯ শতাংশ আংশিক ও ১১ শতাংশ সম্পূর্ণ মিথ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে ট্রাম্প রাজনৈতিক মিথ্যাচারকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছেন যা মার্কিন নাগরিকেরা আগে কখনো শোনেনি। তবে তার মিথ্যাগুলোর মূল সমস্যা হলো এগুলো যে মিথ্যা তা বিশ্ববাসী জানে এবং তা প্রমানিত। আর তিনি যে পরিমানে মিডিয়াকে আক্রমন করে চলেছেন তার ফলে অনেক মার্কিন নাগরিকই মনে করেন, “হয়তো ট্রাম্পই সত্য বলছেন!”