ইতিপূর্বে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি তার নতুন ‘২১ শতকের জন্য ২১টা শিক্ষা’ বইতে বর্তমানে আমরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হই সেসব সমস্যার দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন। বইতে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন ফেসবুকের আগেও ‘বানোয়াট খবর’ বিষয়টা প্রচলন ছিল। ক্ষমতা, জাতি এবং গল্প-কথন (বা দিক থেকে ঘড়ির কাটার দিকে) ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন, খ্রিস্টধর্মের গল্প, ডোনাল্ড ট্রাম্প, পারমানবিক বোমা, ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। বর্তমান সময়ে আমাদেরকে বারংবার বলা হচ্ছে আমরা “সত্য থেকে বিচ্যুত” একটা নতুন দুঃসময়ে বাস করছি এবং আমাদের চারপাশে মিথ্যা গল্পের বেসাতি। উদাহরণের অভাব নাই। যেমন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়ার আর্মির একটা বিশেষ দল আর্মির কোন ব্যাচ পরিধান না করে ইউক্রেন আক্রমণ করে ক্রিমিয়া নগরীর প্রধান প্রধান স্থাপনা দখল করে নেয়। রাশিয়ার সরকার এবং প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণকারীদলের সাথে রাশিয়ার কোন সম্পর্ক নেই বলে পুনর্ব্যক্ত করেছিল। রাশিয়া সরকার আক্রমণকারীদেরকে বলেছে স্বতঃস্ফূর্ত স্ব-নিয়ন্ত্রিত বাহিনী যারা হয়ত স্থানীয় দোকান থেকে রাশিয়ার মত দেখতে সামরিক সরঞ্জামাদি কিনে থাকতে পারে। যদিও তারা সমস্বরে হাস্যকর দাবী করে আসছে, তবুও পুতিন এবং তার আশেপাশের গুণগ্রাহীরা ভালভাবেই জানত যে, তারা সচেতনভাবে মিথ্যা কথা বলছে।
রাশিয়ার জাতীয়তাবাদীরা এই নির্জলা মিথ্যা বলার পিছনে যুক্তি দেখিয়েছিল, এই মিথ্যা বলার কারণে তাদের বৃহত্তর সত্য অর্জিত হয়েছে। বাস্তবে যদিও রাশিয়া তখন পুরোপুরি যুদ্ধে জড়িত ছিল এবং বৃহত্তর সত্যের স্বার্থে যদি দেশটিকে মানুষ হত্যা করতে হয় তাহলে কি মিথ্যা বলা জায়েজ হয়ে যায়? যে বৃহত্তর স্বার্থের কারণ দেখিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর আক্রমণকে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে সেটা হলো পবিত্র রাশান জাতিকে সংরক্ষণ করার অজুহাত। রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী মিথের ভাষ্য মতে, রাশিয়া হলো এমন এক পবিত্র জাতিসত্তা যারা হাজার বছর ধরে অত্যাচারী ভয়ংকর শত্রুদের মুহুর্মুহুর আক্রমণের মুখে তাদের জনবল ক্ষয়ের পরেও শত আঘাত সহ্য করে এখনো টিকে আছে। সেই অতীত থেকে একের পর এক আক্রমণ করেছে মঙ্গোলীয়, পোলিশ, সুইডিশ, নেপোলিয়নের বিশাল সেনাবাহিনী, হিটলারের পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী, আর আধুনিককালে ১৯৯০ সালের পর থেকে ন্যাটো-বাহিনী, তারপর যুক্তরাষ্ট্র আর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারংবার রাশিয়াকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চেয়েছে এবং দেশটির মূল-ভূখণ্ড থেকে ইউক্রেনকে আলাদা করে ‘ভুয়া রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। অনেক রাশান জাতীয়তাবাদী মনে করেন, রাশান জাতিকে পুনরায় একত্রিত করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন যে মিথ্যা বলেছেন, তার থেকে যে প্রক্রিয়ায় রাশিয়া থেকে ইউক্রেনকে আলাদা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেটা আরও বড় মিথ্যা।
ইউক্রেনের নাগরিক, বাইরে থেকে যারা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করেন এবং ইতিহাসের সাথে যুক্ত পেশাজীবীগণ রাশিয়ার ব্যাখ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন এবং তারা এই ধরণের রাজনীতি চর্চাকে ষড়যন্ত্রের অস্ত্র ভাণ্ডারের ‘মিথ্যার পারমানবিক বোমা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। রাশিয়াকে বিভাজন করে ইউক্রেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এমন দাবী করা হলে জাতি হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব থাকে না এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের সুদূর অতীত থেকে বিস্তৃত ঐতিহাসিক ভিত্তি ধ্বসে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, রাশান ঐক্য যদি হাজার বছরের হয় তাহলে কিয়েভ এবং মস্কো রাশিয়ার সাথে সংযুক্তির ইতিহাস মাত্র ৩০০ বছরের। রাশিয়া আন্তর্জাতিক অনেক আইন এবং চুক্তি ভঙ্গ করেছে যেসব আইন এবং চুক্তিগুলোতে রাশিয়া আগেই স্বাক্ষর করেছিল এবং যার ফলে ইউক্রেন দেশটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে তার সীমানার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইউক্রেনের লাখ লাখ অধিবাসীগণ নিজেরা নিজেদের জাতিসত্তা সম্পর্কে কী চিন্তা করে রাশিয়া সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছে। তাদের কি নিজেদের সম্পর্কে কিছুই বলার ছিল না? ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীরা রাশান জাতীয়তাবাদীদের সাথে নিশ্চয় একমত হবেন যে, চারিপাশে অনেক ভুয়া রাষ্ট্রের ছড়াছড়ি। কিন্তু ইউক্রেন সেই ভুয়া রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে না। বরং ইউক্রেনকে বিনা উস্কানিতে আক্রমণ করার জন্য মুখোশ হিসেবে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে গঠিত “লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক” এবং “ডনেটস্ক পিপলস রিপাবলিক” দুইটা অস্তিত্বহীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
যে পক্ষেরই সমর্থন করেন না কেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা আসলে সত্যের ঊর্ধ্বে সত্য বিবর্জিত একটা ভয়ানক সময়ে বাস করছি যেখানে শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা করার মত ঘটনা নয় বরং পুরো ইতিহাস এবং জাতিসত্তাও মিথ্যার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু এখন যদি সত্য থেকে বিচ্যুত সময় হয় তাহলে কখনো কি সত্যের আদর্শ সময় ছিল? ১৯৮০ সাল সত্য যুগ? ১৯৫০ সালে কি সত্য যুগ ছিল? নাকি ১৯৩০ সত্য যুগ ছিল? কোন বিষয়টা আমাদেরকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিলো—এটা কি ইন্টারনেট? সামাজিক গণমাধ্যম? নাকি পুতিন আর ট্রাম্পের উত্থানে আমরা সত্যযুগ পেরিয়ে এসেছি?
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে একটু চকিত দৃষ্টি ফেলি তাহলে দেখতে পাবো অপপ্রচার আর তথ্যের বিকৃতি নতুন কিছু নয় এবং পুরো জাতিগোষ্ঠীকে অস্বীকার করা বা অভিজাত রক্তের অজুহাতে নতুন কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করারও নজির প্রচুর। চীনকে আক্রমণ করার জন্য অজুহাত তৈরি করতে ১৯৩১ সালে জাপানি সেনাবাহিনী নিজেরাই নিজেদের উপর কৃত্রিম যুদ্ধ যুদ্ধ নাটক সাজায় এবং চীনের উপর চাপানো যুদ্ধে জয়লাভ আইনসিদ্ধ করতে মানচুকুও নামের নকল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। চীন নিজেও দীর্ঘদিন ধরে তিব্বত রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আসছে। অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিটিশ জনবসতি স্থাপনের সময় আইনের ধারা দেখানো হয়েছিল যে অস্ট্রেলিয়া হলো ‘টেরা নুলিয়াস’ যার সহজ অর্থ দাঁড়ায় ‘এই জমি কারো অধিকারে নয়’। ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়া দখলের পর সেখানের ৫০,০০০ বছরের আদিবাসী ইতিহাস কার্যকরভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ২০ শতকের শুরুতে জনপ্রিয় ইহুদিবাদী শ্লোগান ছিল “ভূমিহীন মানুষ [ইহুদি জনগোষ্ঠী] ফিরে আসছে জনশূন্য ভূমিতে [প্যালেস্টাইন]”। স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
[ আমরা হলাম একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা একই সাথে অসংখ্য অপরিচিত আগন্তুকের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারি কারণ একমাত্র আমরাই গল্পের মালা গাঁথতে পারি, সাজানো গল্প পরিপাটি করে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং লাখ লাখ মানুষকে সেই কল্পিত গল্পে বিশ্বাস করাতে পারি। ছবি: এন্টোনিও ওলমস ]
১৯৬৯ সালে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার এক বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, “ফিলিস্তিনি মানুষ বলে আসলে কিছু নেই এবং অতীতেও এমন কিছু ছিল না।” এমনকি বর্তমানেও সাধারণ ইজরায়েলিদের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম আছে যদিও দশকের পর দশক ধরে ইজরায়েল অস্তিত্বহীন ফিলিস্তিনদের সাথে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি অধিবেশনে আনাত বারকো নামের একজন আইনসভার সদস্য ইজরায়েলি আইনসভার বক্তৃতায় ফিলিস্তিনি জনসাধারণের অস্তিত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। এমন সন্দেহ করার পিছনে তার কাছে কী প্রমাণ ছিল? খুব সহজ, আরবি বর্ণমালাতে ‘প’ অক্ষরটাই নাই, তাহলে আরবে প্যালেস্টাইনরা থাকে কীভাবে? (আরবি বর্ণমালায় ‘ফ’ অক্ষর দিয়ে ‘প’ বোঝানো হয় এবং প্যালেস্টাইন শব্দের আরবি উচ্চারণ ফালাস্তিন।)
প্রকৃতপক্ষে মানুষ সব সময়ই সত্য বিবর্জিত সময়ে বাস করে আসছে। হোমো স্যাপিয়েন্স হলো এমন এক সত্য বিবর্জিত প্রাণী যাদের মূল চালিকাশক্তি কল্পিত গল্পকে মানুষের মাঝে সঞ্চার করা। এমনকি সেই প্রাচীনকালের পাথরযুগেও মানুষ নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ রাখার জন্য আত্মবল প্রচারের জন্য মিথের আশ্রয় নিয়েছে। মূলত হোমো স্যাপিয়েন্স এই গ্রহকে পদানত করার পিছনে মানুষের গল্প বানানো এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার অনন্য সাধারণ ক্ষমতা প্রধান কৃতিত্বের দাবিদার। আমরা হলাম একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা একই সাথে অসংখ্য অপরিচিত আগন্তুকের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারি কারণ একমাত্র আমরাই গল্পের মালা গাঁথতে পারি, সাজানো গল্প পরিপাটি করে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে পারি এবং লাখ লাখ মানুষকে সেই কল্পিত গল্পে বিশ্বাস করাতে পারি। যতদিন পর্যন্ত সবাই একই কল্পিত গল্পে বিশ্বাস করব ততদিন পর্যন্ত আমরা সবাই একই আইন মেনে চলব এবং আমরা কার্যকরভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার সমাজ চালনা করতে পারব।
যদি আপনি ফেসবুকের উপর দোষ চাপিয়ে দেন যে ট্রাম্প আর পুতিন সত্য বিবর্জিত নতুন একটা ভয়ার্ত সময়ের দিকে ধাবিত করছে তাহলে মনে করার চেষ্টা করুণ, শত শত বছর আগেই কোটি কোটি খ্রিস্টান আত্মবল বাড়ানোর জন্য মিথের বুদবুদের মধ্যে স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে বন্দী করেছে, তারা কখনো বাইবেলের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস দেখায়নি। একইভাবে কোটি কোটি মুসলিম প্রশ্নাতীতভাবে কোর’আনের উপর নিঃশর্ত বিশ্বাস স্থাপন করেছে। যুগ যুগ ধরে যেসব ‘খবর’ এবং ‘ঘটনা’ প্রবাহ মানুষের সমাজে গোচর হয়েছে তার বেশিরভাগই দৈব, ফেরেশতা, শয়তান, ডাইনিদের নিয়ে। সাহসী টিভি সাংবাদিক, রিপোর্টার পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে সরাসরি সেই খবরের জীবন্ত প্রচার করেছে। সাপ ইভকে আপেল খাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল এরকম কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের হাতে নাই, সব কাফেরদের রুহু মৃত্যুর পরে নরকে অনন্তকাল জ্বলতে থাকে এই সত্য কেউ দেখে আসে নাই, একজন কুলীন ব্রাহ্মণ অচ্ছুৎ নিচু বর্ণের কেউকে বিয়ে করলে রাগান্বিত ভগবানকে কেউ কোনদিন দেখে নাই তবুও কোটি কোটি মানুষ এইসব গাঁজাখুরি গল্পে হাজার ধরে বিশ্বাস করে আসছে। আসলে কিছু মিথ্যা খবরের মৃত্যু নাই।
আমি জানি ধর্মকে বানোয়াট খবর বলাতে অনেকে কষ্ট পাবেন কিন্তু বাস্তবতা এটাই। যখন কয়েক হাজার মানুষ মাস-খানেক ধরে কোন আষাঢ়ে গল্পের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তখন তাকে মিথ্যা খবর বলাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যখন সেই গাঁজাখুরি আষাঢ়ে গল্পের উপর কোটি কোটি মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বাস স্থাপন করে তখন সেটা ধর্ম হয়ে যায় এবং আমাদেরকে ধর্মকে গুজব না বলার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয় কারণ ধর্মকে মিথ্যা গল্প বললে অনেকের অনুভূতিতে আঘাত লাগে, অনেকের ভয়ানক ক্রোধ জন্ম নেয়। যাইহোক লক্ষ্য করুণ, ধর্মের কার্যকারিতা এবং সম্ভাব্য আমি উপকারিতাকে অস্বীকার করছি না। ঠিক তার বিপরীতে ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন মানুষের তূণীরে কল্পিত গল্পই হলো সবথেকে কার্যকরী তীর। এক ছাতার তলায় একত্রিত করে ধর্মীয় রীতিনীতি বিপুল পরিমাণ মানুষকে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব করেছে। ধর্ম মানুষকে সেবার জন্য হাসপাতাল, শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, যোগাযোগের জন্য রাস্তা ও সেতু স্থাপন করতে উৎসাহিত করছে। সেই সাথে ধর্ম সেনাবাহিনী আর জেলখানা বানিয়েছে। আদম এবং হাওয়া বলে আসলেই কেউ ছিল না তথাপি চারট্রেস ক্যাথেড্রাল দেখতে কতই না নয়নাভিরাম। বাইবেলের বেশিরভাগ গসপেল নিছক বানানো ছেলে ভুলানো গল্প কিন্তু এখনো কোটি মানুষের মনে আনন্দ বয়ে আনছে সেইসব বানানো গল্প, মানুষকে ব্যথিতের জন্য সমব্যথী হতে উৎসাহিত করছে, বাইবেলের গসপেল মানুষকে সাহসী এবং সৃষ্টিশীল করেছে। এমন আরও অনেক কল্পিত অসাধারণ গল্প আছে যেমন ডন কুইক্সোট, ওয়ার অ্যান্ড পিস এবং হ্যারি পটার।
বাইবেলের সাথে হ্যারি পটারের তুলনা করাতে আবারো কারো অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। যদি আপনি একটু বিজ্ঞানমনষ্ক খ্রিস্টান হন তাহলে আপনি হয়ত বাইবেল এবং মিথের যাবতীয় অসংগতি বুঝতে পারবেন এবং মিথ আর বাইবেলের অসাড়তা এবং সীমাহীন সাংঘর্ষিক অবস্থান দেখে আপনার নিজের কাছে যুক্তি দেখা দিতে পারে যে পবিত্র বাইবেল আসলে সত্য দর্শন হিসেবে পড়ার কোন দরকার নেই। বরং বাইবেল হলো রূপক গল্পের সমাহার যেখানে গভীর জ্ঞানের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু হ্যারি পটার কি একই ধরণের সত্য উপস্থাপন করে না? আপনি যদি গোঁড়া খ্রিস্টান হন তাহলে আপনি হয়ত গুরুত্ব আরোপ করে বলবেন বাইবেলের প্রতিটি অক্ষর আক্ষরিকভাবেই সত্য। আলোচনার সুবিধার্থে আসুন ধরে নিই, আপনিই সঠিক এবং বাইবেলের প্রতিটি বর্ণ সন্দেহাতীতভাবে সত্য যা এসেছে একমাত্র সত্য ঈশ্বরের কাছ থেকে। তাহলে কী, কোর’আন, তালমুদ, প্রাচীন আমেরিকান সাধু মরমনদের পবিত্রগ্রন্থ, বেদ, আভেস্তা, প্রাচীন মিশরীয়দের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বই এগুলো সম্পর্কে আপনার মতামত কী বলে? আপনার কি এইসব পবিত্র বই সম্পর্কে রক্ত মাংসের মানুষের রচিত অথবা হতে পারে শয়তানের লেখা বই বলতে আগ্রহ জাগে না?
প্রাচীন ধর্মগুলোই যে শুধু মানুষের মাঝে সম্পর্ক মজবুত করতে গল্পের জাল বুনতে শুরু করে তাই নয় বরং সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি জাতি নিজেদের মত করে তাদের জাতীয় মিথের কাহিনী ফেঁদেছে। একই সাথে কিছু আদর্শগত আন্দোলন যেমন কমিউনিজম, স্বৈরতন্ত্র, লিবারেলিজম, নিজেদের উন্নয়নের জন্য কিছু রীতিনীতি বিস্তৃতভাবে প্রচার প্রসার করে। নাৎসি-বাহিনীর প্রোপাগান্ডা গুরু জোসেফ গয়েবলস অপপ্রচার তথা গুজবকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছিল এবং গোয়েবলস আধুনিক সময়ের সবথেকে বড় গণমাধ্যম জাদুকর হিসেবে স্বীকৃত। তার বিখ্যাত উক্তিতে সে সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, “মিথ্যা কথা একবার বললে সেটা মিথ্যাই রয়ে যায়, কিন্তু একটা মিথ্যাকে যদি বারবার বলা যায় তখন সেটা সত্যের মত শোনায়।” হিটলারের আত্মজীবনী মাইন কাম্ফে হিটলার লেখেন, “সবথেকে মেধাবী প্রোপাগান্ডা কৌশলেও কোন কাজ হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত মানুষের মনের মধ্যে কোন চিন্তা চিরস্থায়ীভাবে প্রভাব বিস্তার না করে। প্রোপাগান্ডা কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে এবং বারংবার একই চর্চা করতে থাকবে। তখনই প্রোপাগান্ডা থেকে সফলতা আসবে।” আজকের দিনে গুজব প্রচারকারীরা কি তাদের অবস্থার উন্নতি করতে পেরেছে?
জোসেফ স্ট্যালিনের শাসনে সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা মেশিনও সত্য প্রচারে একইরকম দক্ষ ছিলো। সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা কার্যক্রম এতটাই দক্ষ ছিল যে তারা দেশের মধ্যে দানবিক কাজ পরিচালনা করলেও দেশের বাইরে কমিউনিজমকে সাম্যবাদের মোড়কে সফলভাবে বাজারজাত করতে সক্ষম হয়। আজকের দিনেও ইউক্রেন অভিযোগ করে আসছে পুতিন খুব সার্থকভাবে পশ্চিমা গণমাধ্যমের চোখে ধুলো দিতে পেরেছে ফলাফল ইউক্রেনের ক্রিমিয়া এবং ডনবাসে রাশিয়ার অভিযান চলা কালে ঠিক কী হয়েছিল সেটা কেউ জানে না। পুতিনের শিল্প মানোত্তীর্ণ ষড়যন্ত্রের পরেও পুতিন স্ট্যালিনের ধারে কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। ১৯৩০ শতকের শুরুর দিকে স্ট্যালিনের দুঃশাসনে যখন ইউক্রেন এবং অন্যান্য সোভিয়েত নাগরিকগণ লাখে লাখে মারা যাচ্ছিল দুর্ভিক্ষে আর অনাহারে ঠিক তখন পশ্চিমা বামপন্থী সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ইউনাইটেড সোভিয়েত স্টেটস অফ রাশিয়াকে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিল। একইভাবে বর্তমানের ফেসবুক, টুইটারে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে আমাদেরকে দোটানায় ভুগতে হয় কী ঘটনা বা কোন সংবাদে বিশ্বাস করব। কারণ বর্তমানে কোন রাজ্যের পক্ষেই বিশ্বের এত দেশের অগোচরে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা সম্ভব নয়। ধর্ম এবং আদর্শগত মতবাদের বাইরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বানানো গল্প আর ভুয়া সংবাদের উপর নির্ভর করে। ব্রান্ডিং হলো গুজব ছড়ানোর ওস্তাদ। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ কোন পণ্যের উপযোগিতাকে সত্য বলে স্বীকার করে না নেয় ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রান্ডিং একই মনগড়া গল্প বারংবার প্রচার করতে থাকে। যখন কোকা-কোলার কথা মনে পড়ে তখন আপনার মনে কোন চিত্রটি প্রথম মনে আসে? আপনি কি তখন মনে করেন একজন স্বাস্থ্যবান যুবক খেলাধুলা আর মজা করে বেড়াচ্ছে? আপনার কি কখনো মনে পড়ে একজন স্থূলকায় ডায়াবেটিস রোগী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে? অধিক পরিমাণে কোকা-কোলা পান করলে আপনি মোটেও যুবক হয়ে যাবেন না, আপনি কখনো সুস্বাস্থ্যের অধিকারীও হয়ে যাবেন না, আপনি কোন খেলোয়াড়ও হয়ে যাবেন না বরং কোকা-কোলা পান করলে আপনার শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে এবং আপনি ডায়াবেটিসে ভুগতে পারেন। তবুও দশকের পর দশক জুড়ে তারুণ্য, সুস্বাস্থ্য এবং খেলার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে কোকা-কোলা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে আসছে এবং বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ অবচেতন মনেই তারুণ্য, সুস্বাস্থ্য এবং খেলার সাথে কোকা-কোলার যোগসূত্রটা খুঁজে পায়। বাস্তবতা হলো হোমো স্যাপিয়েন্সের এজেন্ডায় সত্য কখনো অগ্রাধিকার পায়নি। অনেক মানুষ ধারণা করেন, যদি কোন বিশেষ ধর্ম বা আদর্শ বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তাহলে কিছুদিন আগে হোক বা পরে হোক সেই ধর্ম বা আদর্শের অনুসারীরা বিকৃতি খুঁজে বের করে ফেলবে। কারণ, মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে ধর্ম বা আদর্শ কোন স্বচ্ছ দর্শনের সামনে টিকতে পারবে না। যাইহোক, এটাও আরেকটা সুখকর মিথ। মানুষকে একত্রিত করার সময়ে সত্যের থেকে বরং মিথ্যা গল্পের এক ধরণের অন্তর্গত সুবিধা আছে।
বাস্তবে, মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার শক্তি নির্ভর করে সত্য এবং কল্পিত গল্পের মধ্যে সুষম ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে। যদি আপনি বাস্তবতা খুব বেশি বিকৃত করেন তাহলে বাস্তবতা বিবর্জিত উপায়ে কাজ করতে করতে আপনি প্রকৃতপক্ষে দুর্বল হয়ে পড়বেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯০৫ সালে পূর্ব আফ্রিকার কিঞ্জিকিটেলে এনগাওয়ালে নামের মাজি মাজি সম্প্রদায়ের নেতা এবং ওঝা একদিন দাবী করে বসলেন তার উপরে সাপের আত্মা ‘হঙ্গো’ ভর করেছে। এই নতুন নবী ঈশ্বরের সাথে তার যোগাযোগ আছে প্রচার করে পূর্ব আফ্রিকার জার্মান উপনিবেশের অধিবাসীদের মাঝে বিপ্লবাত্মক বার্তা পাঠাতে লাগলেন যেমন, একত্রিত হও এবং জার্মানদের তাড়িয়ে দাও। তার বার্তাকে আরও গ্রহণযোগ্য করার জন্য এনগাওয়ালে তার অনুসারীদের একটা জাদুকরী দাওয়া দিয়ে দিলেন। যার ফলে জার্মান সৈন্যরা গুলি করলে সেটা পানি হয়ে যাবে। এনগাওয়ালের প্রচারণার কারণেই মাজি মাজি বিদ্রোহ শুরু হয় এবং তারা জার্মানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধের মাঠে গিয়ে দেখা গেল জার্মান বুলেট পানিতে পরিণত হয় না। বরং মারাত্মক অস্ত্র হাতে জার্মান সৈন্যরা মাজি মাজি বিদ্রোহীদেরকে নির্দয়ভাবে তছনছ করে দেয়।
অপরদিকে মিথের গল্প ছাড়া আপনি বিশাল সংখ্যক মানুষকে কার্যকরভাবে একত্রিত করতে পারবেন না। যদি আপনি সত্যের প্রতি নির্মোহ থেকে নির্জলা সত্য আঁকড়ে ধরেন তাহলে সামান্য কিছু মানুষ হয়ত আপনাকে অনুসরণ করতে পারে। আসল কথা হচ্ছে, মানুষকে একত্রিত করতে সত্যের থেকেও জুয়াচুরি আষাঢ়ে গল্প অধিক কার্যকর। কারণ, কাল্পনিক গল্পের অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। যদি আপনি একটা দলবদ্ধ মানুষের আনুগত্য চান তাহলে তাদেরকে সত্য কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করতে না বলে বরং অবাস্তব কিছুতে বিশ্বাস করাতে হবে। যদি কোন দলপতি বলেন “সূর্য পূর্বদিকে ওঠে আর পশ্চিমদিকে অস্ত যায়” তাহলে তার এই কথা বলার জন্য দলপতির প্রশংসা পাওয়ার আশা নাই। কিন্তু দলপতিটি যদি বলেন, “সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে আর পূর্বদিকে অস্ত যায়” তাহলে তার সত্যিকারের অনুগতরা হাত তালি দেবে। একইভাবে আপনার প্রতিবেশী সবাই যদি উগ্র গল্পে বিশ্বাস করে তাহলে দেখবেন যেকোন সংকটের মুহূর্তে তারা পরস্পর একত্রিত থাকে। কিন্তু তারা যদি শুধু বিশ্বাসযোগ্য সত্য গল্পে বিশ্বাস করতেন তাহলে কী প্রমাণিত হতো?
আপনি হয়ত যুক্তি দেখাতে পারেন, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে তো কল্পিত গল্প বা মিথের ব্যবহার না করেই কোন একদল মানুষের যৌথ সম্মতিতে তাদের মাঝে কার্যকর অর্থপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে। হ্যাঁ, এমনটা ঘটেছে কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, অর্থ এবং ব্যবসায়িক কর্পোরেশনগুলো যেকোন ঈশ্বর বা পবিত্র কিতাব থেকেও মানুষকে অধিক কার্যকরভাবে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও সবাই জানে এসব শুধুই মানুষের সৃষ্ট একটা নিয়ম মাত্র। পবিত্র কিতাবের ক্ষেত্রে, একজন ধর্ম অন্তপ্রাণ বিশ্বাসী বলবে, “আমি এই পবিত্র বইতে বিশ্বাস করি” কিন্তু ডলারের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের প্রশ্ন আসলে একজন সত্যিকারের বিশ্বাসী বলবে, “আমি বিশ্বাস করি অন্য মানুষেরাও জানে ডলার মূল্যবান।” এটা তো নিশ্চিত যে, মানুষই ডলার সৃষ্টি করেছে, তবুও পৃথিবীব্যাপী সব মানুষ ডলারকে সমীহ করে চলে। যদি তাই তাহলে মানুষ কেন মিথ আর কল্পিত গল্পকে চিরতরে বিদায় জানায় না এবং পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিজেদেরকে সংগঠিত করে না ডলারের ক্ষেত্রে ঠিক যেমনটা ঘটেছে?
যাইহোক, মানুষের এই ধরণের সম্মিলন বানানো গল্প থেকে হয়েছে এটা সুস্পষ্টভাবে আলাদা করা যায় না।প্রথম দেখায় মনে হতে পারে পবিত্র কিতাব এবং অর্থের মধ্যে খুব কম পার্থক্য কিন্তু উদাহরণ দিলে বলা যাবে পবিত্র কিতাব এবং অর্থের মধ্যে কী পার্থক্য বিদ্যমান। যখন বেশিরভাগ মানুষ ডলারের বিলকে দেখে তখন তারা ভুলে যায় ডলার শুধুই মানুষের সৃষ্ট একটা সর্বসম্মতি মাত্র। মানুষ যখন দেখে এক টুকরো হালকা নীল রঙের কাগজের উপর একজন মৃত শ্বেতাঙ্গের ছবি, তখন তারা কাগজের মধ্যে মূল্যবান সম্পদজাতীয় কিছু একটা জিনিস দেখতে পায় এবং সত্যিই কাগজটা মূল্য বহন করে । সুতরাং বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোন কিছু মানুষের সম্মিলনে সম্পাদিত হয়েছে জানা এবং কোন কিছু অন্তর্গতভাবে মূল্য বহন করছে বিশ্বাস করার মধ্যে কোন সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নাই। বরং বহু ক্ষেত্রেই মানুষ জানা এবং বিশ্বাসকে গুলিয়ে ফেলে অথবা ভুলে যায়। কোন কিছু জানা এবং না জানার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের। কল্পনা এবং বাস্তবতার মধ্যে অস্পষ্ট বিভাজন রেখা টানা হয়েছে বহু কারণেই। কখনো শুধুই আনন্দফুর্তি করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে এবং বাকি সময়ে বৈরি পরিস্থিতিতে টিকে থাকার তাগিদে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনি যদি অবিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে রাখতে না পারেন তাহলে হয়ত খেলা খেলতে বা একটা উপন্যাসও পড়তে পারবেন না। সত্যিই যদি আপনি ফুটবল খেলায় আনন্দ করতে চান তাহলে আপনাকে ফুটবল খেলার কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে এবং অন্তত ৯০ মিনিটের জন্য ভুলে যেতে হবে ফুটবল খেলার এইসব নিয়মনীতি মানুষেরই বানানো। যদি আপনি সেটা না পারেন তাহলে আপনার কাছে ২২ জন খেলোয়াড়ের একটা বলের পিছনে দৌড়ানকে হাস্যকর মনে হতে পারে। ফুটবল হয়ত নিছক নির্মল আনন্দের জন্য খেলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপরে ফুটবল খেলা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন ইংলিশ হুলিগান বা আর্জেন্টিনার জাতীয়তাবাদীদের কাছে ফুটবল নিঃসন্দেহে বিশেষ কিছু। ফুটবল মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে, ফুটবল বিশাল মানুষের মাঝে দৃঢ় সম্পর্কের বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে এমনকি ফুটবল সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। জাতি এবং ধর্ম মানুষের মনোজগতে অনেকটা ফুটবল ক্লাবের মত কাজ করে।
সত্য এবং ক্ষমতা একসাথে বেশি দূর যেতে পারে না। কম বেশি সময় পরেই তারা ভিন্ন পথে ধাবিত হয়। যদি আপনি ক্ষমতা চান তাহলে আপনাকে গুজব ছড়াতে হবে আর যদি আপনি পৃথিবী সম্পর্কে সত্য জানতে চান তাহলে আপনাকে চিরতরে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হবে। আপনাকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে আপনার নিজের ক্ষমতার উৎস কী, যেমন ক্ষমতা মানুষের জোটকে রাগান্বিত করতে পারে, আপনার অনুসারীদেরকে বিমুখ করতে পারে অথবা সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। সমস্ত ইতিহাসজুড়ে পণ্ডিতগণের মাঝে এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। তারা কার সেবায় নিয়োজিত হবে, ক্ষমতা? নাকি সত্য? পণ্ডিতগণের কি লক্ষ্য হবে একই গল্প বিশ্বাস করিয়ে সকল মানুষদের মাঝে ঐক্য নিশ্চিত করা? অথবা পণ্ডিতগণ সাধারণ মানুষদেরকে প্রকৃত জানতে দেবে তাতে যদি মানুষের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি হয় তবুও? সবথেকে শক্তিশালী পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিগুলো হোক সেটা ক্রিস্টান ধর্মপ্রচারক, চীনের মান্ডারিন কনফুসিয়াস অথবা গোঁড়া কমিউনিজম সত্যকে পাশ কাটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণেই এইসব মতবাদ্গুলো এত শক্তিশালী।
মানুষ সত্য থেকে ক্ষমতা বেশি পছন্দ করে। পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করার থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা বেশিরভাগ সময় ব্যয় করি। প্রাণী হিসেবে, মানুষ সত্য থেকে ক্ষমতা বেশি পছন্দ করে। পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করার থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা বেশিরভাগ সময় ব্যয় করি, এমনকি যখন আমরা পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করি, তখন আমরা সাধারণত এই আশা নিয়ে পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করি যাতে পৃথিবীকে আরও সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সুতরাং, যদি আপনি এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখেন যেখানে সত্য সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে রাজত্ব করছে এবং মিথ অবহেলিত তাহলে সেই সমাজের মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত বলে কিছুই নাই। বরং আপনি শিম্পাঞ্জিদের সমাজ নিয়ে গবেষণা করে দেখেন কিছু করতে পারেন কীনা।
এই সব কিছুর অর্থ এই নয় যে গুজব ছড়ানো মিথ্যা সংবাদ কোন গুরুতর সমস্যা নয়। রাজনীতিবিদ এবং পুরোহিতগণ তাদের মুখ দিয়ে মিথ্যা কথা বলার লাইসেন্স পেয়েছেন। আবার সবকিছুই ভুয়া সংবাদ ভেবে স্থির সিদ্ধান্তে চলে আসাও ভুল হতে পারে। কেউ যদি সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে তাহলে সে ভয়াবহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে কারণ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সাথে গুজবের মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য খুব বেশি পার্থক্য নেই। সব মিথ্যা সংবাদের চাপায় তলানিতে পড়ে থাকে প্রকৃত ঘটনা এবং বাস্তবিক যন্ত্রণা। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সত্যিই যুদ্ধে জড়িত ছিল, হাজার হাজার মানুষ সেখানে সত্যিই নিহত হয়েছিল এবং হাজার হাজার মানুষ সেখানে সত্যিই তাদের যথা সর্বস্ব, বাড়িঘর আশ্রয় হারিয়েছিল। তাই নিয়মমাফিক কোন মিথ্যা সংবাদ গ্রহণ করার পরিবর্তে আগে আমাদেরকে অনুমানের উপর নির্ভর না করে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে এবং আমাদেরকে বাস্তবতা এবং গল্পকথার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
কখনো পরিপূর্ণতা প্রত্যাশা করবেন না। ইতিহাসের সবথেকে বড় কল্পকাহিনী হলো বিপুলা পৃথিবীর জটিলতাকে অস্বীকার করে পুরোহিতদের নিষ্কলুষটা আর শয়তানের চতুরতায় চূড়ান্ত বিশ্বাস স্থাপন করা। কোন রাজনীতিবিদই পরিপূর্ণ সত্য বলে না বা সত্যের অপলাপ করে। কিন্তু কিছু রাজনীতিবিদ আছে যারা অন্যদের থেকে বেশ ভালো। আস্থার কথা যদি আমার সামনে আসে তাহলে আমি স্ট্যালিনের বদলে চার্চিলকে বেছে নেব, যদিও এই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে যতটা সত্যের মোড়কে উপস্থাপন করা হয় মোটেও তিনি সেটা ততটা নন। একইভাবে কোন সংবাদপত্রই পক্ষপাত এবং ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু কিছু সংবাদপত্র সত্য প্রকাশে সৎ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে আর কিছু আছে যারা মগজ ধোলাইয়ের কারখানা হিসেবে কাজ করে। যদি আমি ১৯৩০ এর দশকে বাস করতাম তাহলে আমার মনে হয়, সেই সময়ে হয়ত আমার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র “প্রাভাদা” এবং জার্মানির নাৎসি প্রোপাগান্ডা পত্রিকা “ডার স্টুরমার” থেকে “নিউ ইয়র্ক টাইমস” এর উপর বিশ্বাস করার বোধ জন্ম নিতো।
কোন বিশেষ কিছুর উপর আমাদের পক্ষপাতিত্বের কারণ খুঁজে বের করার জন্য এবং আমাদের কাছে থাকা তথ্যের উৎস এবং সেই তথ্যের যথার্থতা বিচার বিশ্লেষণ করতে সময় এবং সামর্থ্য ব্যয় করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
প্রথমত, আপনি যদি নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে চান তাহলে তার পিছনে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করুন। আপনি যদি বিনা পয়সায় খবর পেতে চান তাহলে আপনি হয়ত নিজেই পণ্যে পরিণত হচ্ছেন। ধরে নিই, অবৈধ টাকার পাহাড়ের মালিক আপনাকে একটা প্রস্তাব দিলো, “তিনি আপনাকে প্রতিমাসে ৩০ ডলার করে দেবেন বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন একঘণ্টা আপনার মগজ ধোলাই করার অনুমতি দিলেন। সেই একঘণ্টায় তিনি তার পছন্দের রাজনৈতিক মতাদর্শ বা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন আপনার মগজে চালান করে দেবেন।” আপনি কি প্রস্তাবে রাজি হবেন? খুব কম সুস্থ মানুষই এমন প্রস্তাবে রাজি হবেন। সুতরাং অন্ধকার জগতের টাকার পাহাড়ের সেই মালিক কিছুটা ভিন্ন পথে একই প্রস্তাব দেবেন “আপনি আমাকে প্রতিদিন আপনার মগজ ধোলাই করতে অনুমতি দিন কিন্তু সেই সেবার বিনিময়ে আপনাকে কোন খরচ করতে হবে না। ” এখন কিন্তু প্রস্তাবটি লক্ষ কোটি মানুষের কাছে লোভনীয় মনে হচ্ছে। আপনি এই উদাহরণটি সযত্নে এড়িয়ে যাবেন।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো, যদি কোন বিষয় আপনার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তাহলে সেই বিষয় সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণামূলক লেখাগুলো পড়ে ফেলেন। আমি বোঝাতে চাইছি সমমনা বিজ্ঞানীদের মূল্যায়নকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ, বহুল প্রচলিত প্রকাশকদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত গবেষকদের প্রকাশনা এবং স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত অধ্যাপকদের লেখা আপনি পড়তে পারেন। বিজ্ঞানেরও সীমাবদ্ধতা আছে এবং বিজ্ঞানের অনেক বিষয় নিয়ে অতীতে ভুলভাবে চর্চা হয়েছে। তবুও এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানমনষ্ক মানব সম্প্রদায় যুগযুগ ধরে আমাদের জ্ঞান চর্চার নির্ভরযোগ্য উৎস। আপনি যদি মনে করেন একদল বিজ্ঞানী কোন একটা বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে আছে, সেক্ষেত্রে আপনার সন্দেহও সঠিক হতে পারে, নিদেনপক্ষে বিজ্ঞানীগণ জানতে পারবেন, আপনি তাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে স্বীকার করছেন না। তবে সেক্ষেত্রে আপনার আপনার দাবীর স্বপক্ষে গবেষণালব্ধ প্রমাণ উপস্থাপন করে বোঝাতে হবে কেন আপনি তাদের তত্ত্বকে স্বীকার করেন না। বিজ্ঞানীগণকে নিজেদের উৎকর্ষতার জন্য নিয়মিত সমসাময়িক বিতর্কে জড়িত থাকতে হয়। অভিজ্ঞ সহকর্মীরা নতুন বিতর্কের আবির্ভাবে কতটা বিস্মিত বা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এই চিন্তায় চিন্তিত হয়ে বিজ্ঞানীগণকে নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপনে ভীত হলে চলবে না। বরং তাদের উচিৎ সমস্যার নিবারণ বা ইতিহাস হয়ে যাওয়া। নীরবতা কখনো নিরপেক্ষতা নয়, বরং নীরবতা হলো চলমান বিরূপ পরিস্থিতিকে মেনে নেয়া।
মূল প্রবন্ধ: Yuval Noah Harari extract: ‘Humans are a post-truth species’
[…] মানুষ হলো সত্য বিবর্জিত প্রাণী: ইউভাল … আমরা ক্রমাগত ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি: ইউভাল নোয়াহ হারারি জঙ্গিবাদের নাট্যমঞ্চ-নোয়াহ হারারি […]
অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ। মূল বইটি এলোমেলোভাবে অর্ধেকের মত পড়েছি। মূল বই থেকে অনুবাদ করলে ভাল হত।
post-truth এর মানে কী? বলা যায়, আবেগ ও বিশ্বাসনির্ভর বাস্তবতা-বিমুখ।
@মেঘবতী রাজকন্যা, যৌনহতাশাগ্রস্ত মানুষ – এখানে কমেন্ট করছেন কেন? সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালেই তো পারেন।
আমরা চাই মানবাধিকার, অভিজিৎ রায় দাদাও মানবাধিকারের পক্ষে প্রচারণা চালাতেন, রায় দাদার করুণ মৃত্যুতে একটি আরব রাষ্ট্রও শোক প্রকাশ করেনি।