সারা পৃথিবীর মতন বাংলাদেশেও জঙ্গি-গোষ্ঠী শাসক শ্রেণির আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জঙ্গিবাদের দোহাই দিয়ে, প্রয়োজনে পরোক্ষভাবে জঙ্গি গোষ্ঠীর সহায়তা করে এরা নিজেদের ফায়দা আদায় করে নেয়। বাংলাদেশের সেনা বাহিনী ও তার গোয়েন্দা সংস্থাও এই ফায়দা নিতে সময় নষ্ট করেনি। তত্ত্বাবধায়কের সময় একদিকে তারা হুজিকে রাজনৈতিক দল গঠনে সাহায্য করছে অন্যদিকে জেএমবি বোমা হামলা করতে পারে এই অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত রাখে। আগ্রহীদের জন্যে- গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় হুজি-বি রাজনৈতিক দলে রূপান্তর: আরও দুটি মার্কিন গোপন তারবার্তা । যাই হোক,উইকিলিকস-এ প্রকাশিত মার্কিন গোপন তারবার্তায় কী লেখা আছে সে বিষয়ে আমরা বরং ফিরে যাই।

SENIOR MILITARY OFFICIAL DISCUSSES STATE OF EMERGENCY WITH AMBASSADOR
Date:2007 January 12, 10:07 (Friday) Canonical ID:07DHAKA66_a

১. ঊর্ধ্বতন এক সেনা কর্মকর্তা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানান, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট/ প্রধান উপদেষ্টা জনাব ইয়াজউদ্দিন আহমদকে অনুষ্ঠানিক পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। সেনাবাহিনীর এই চাপ সৃষ্টির পেছনে জাতিসংঘের ভূমিকা আছে বলে জানা যায়। শান্তি রক্ষা মিশনে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত বাংলাদেশের সৈনিক দলের অংশগ্রহণ অগ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জরুরী অবস্থায় জাতিসংঘ ও বহি:বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি এবং উপর্যুপুরি জামায়াতে মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর হুমকিতেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মার্কিন দূতাবাসকে জানানো হয়, সেনাবাহিনী মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সাধারণ নাগরিকের পক্ষে কাজ করবে। রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নাগরিকের অধিকার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রতি জোর দেন। সারকথা হল, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠক করেছে।

২. কাউন্টার টেরোরিজম ফোর্সের মহাপরিচালক বিগ্রে. জেনারেল আমিন রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে ১২ তারিখে তার সাথে দেখা করেন। সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মঈন ইউ আহমেদসহ তিন বাহিনীর প্রধান ১১ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমদেও সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে আর্মি চীফ স্টাফ লেফ্ট. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমও ছিলেন। মিটিং-এ তারা রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেন। শুধু তাই নয়, তারা নতুন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ এবং আসন্ন ২২ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করতে বলেন। রাষ্ট্রদূতের এক প্রশ্নের জবাবে বিগ্রে. আমীন জানান, তারা রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত নেবার কোন সময় দেননি। কারণ তারা জানতেন, সময় দিলে রাষ্ট্রপতি বিএনপির সাথে আলোচনা করে কালক্ষেপণ করতেন। এবং বিএনপি কখনোই ইয়াজুদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের ব্যাপারে সায় দিতো না। সারকথা হল, রাষ্ট্রপতি/প্রধান উপদেষ্টাকে জোর করে চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

৩. বিগ্রে. জেনারেল আমিন আরও জানান, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল মো. রেজাউল হায়দারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন। তারেক রহমানের দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিগ্রে. জেনারেল আমিন বলেন, ”সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাবো। আমীন আরও জানান, রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি জনাব মোখলেসুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় নি, তবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কারণ ধারনা করা হয় তিনি আদর্শিক-ভাবে বিএনপি পন্থী এবং ইয়াজউদ্দিন আহমদের বিশ্বস্ত লোক।

৪. আমীন আরও জানান, রাষ্ট্রপতিকে উচ্ছেদ করার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রেরিত পত্রকে মূল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনে যেহেতু সেনাবাহিনীর যোগসূত্র আছে, ফলে মঈন ইউ আহমেদ পূর্ব থেকেই জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন ব্যাপ্তিবর্গের সাথে আলোচনা করে বিষয়টিকে সামনে আনেন। এবং ১১ জানুয়ারির পূর্বমুহূর্তে এ-বিষয়টাকে মূল অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। জাতিসংঘ প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি না হলে শান্তি-মিশনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।

৫. আমীন জানান, রাষ্ট্রপতিকে উচ্ছেদে দ্বিতীয় কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে জেএমবির নাশকতার সম্ভাবনা। জেএমবির বোমা মজুদের খবর ও নির্বাচন পণ্ড করার পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নির্বাচন স্থগিতের জন্য রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করা হয়। মূল কারণ হিসাবে জনসাধারণের নিরাপত্তাকে উল্লেখ করা হয়।

৬. আমীন আরও নিশ্চিত করেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ঘোষণার পরপরই বর্তমান উপদেষ্টারা পদত্যাগপত্র জমা দেন। আইন ও বিচার বিষয়ক উপদেষ্টা বিচারপতি ফজলুল হক পদত্যাগ করেননি এবং নবনিযুক্ত উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসাবে নিজেকে অব্যাহত রাখেন। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি পদগ্রহণে অসম্মতি জানান। তার পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাপরিচালক ফখরুদ্দীন আহমদকে নির্বাচিত করা হবে বলে জানান আমীন। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীনকে সহায়তা করার জন্য ১০-১৫ জনের উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ হবে বলে। (নোট: ফখরুদ্দীন প্রধান হচ্ছেন। তার সাথে ১২ তারিখ বিকেল ৫টায় রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাক্ষাৎ করবেন।)

৭. আমীন জানান, সেনাবাহিনী একটি চাপমুক্ত, প্রতিনিধিত্বমূলক, সকলের অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কথা বলেই ক্ষমতার রদ বদল করেছে। নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তাকে দ্বিধান্বিত দেখা গেছে। নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও তিনি ১ বছর সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার হিসাবে সেনাবাহিনীর প্রধান তিনটি উদ্দেশ্যেও কথা তিনি উল্লেখ করেন: এক. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন/সংস্কার। দুই. একটি বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন। তিন: চাপমুক্ত নির্বাচনের রোডম্যাপ/পরিকল্পনা। তিনি আরও উল্লেখ করেন, সেনাবাহিনী দুর্নীতি দমন করার জন্য কাজ করবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করতে সেনাবাহিনী কঠোর অবস্থান নিবে বলে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বললেও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি সুস্পষ্ট কিছুই জানাননি।

৮. সেনাবাহিনীর মূল ভূমিকা প্রসঙ্গে আমীন জানান, সেনাবাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্যই হল জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে সহায়তা করা। দেশ সাংবিধানিক আইনেই চলবে। কিন্তু আইনের শাসনে নিশ্চিত করতে সরকারকে সেনাবাহিনী পেছন থেকে সহযোগিতা করবে। বিশেষ পরিস্থিতি/ জরুরী অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা তাদের নেই বলে জানিয়েছেন আমীন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারকে সহযোগিতার অংশগ্রহণের উদাহরণ হিসাবে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নে সেনাবাহিনী ভূমিকার কথা তিনি রাষ্ট্রদূতকে জানান।

৯. রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিটি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত। তারা চান, একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন নির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই তবে যুক্তরাষ্ট্র আশা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো সবাই মিলে একটা সমাধান খুঁজে বের করুক।

১০. ওয়াশিংটনকে রাষ্ট্রদূত লিখেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপর তারা নজর রাখছে। বিশেষত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য সেনাবাহিনীর আন্তরিকতা ইত্যাদি বিষয়ে তারা কড়া নজরদারি রেখেছে। যাদেরকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, সেসব গ্রেফতার উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা সে বিষয়েও মার্কিন দূতাবাস দৃষ্টি রাখছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

১১. রাষ্ট্রদূত আরও উল্লেখ করেন, সেনা সমর্থিত ছদ্ম-গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি সম্পর্কেও মার্কিন দূতাবাস সচেতন। রাষ্ট্রদূত তার চিঠিতে থাইল্যান্ডের সেনা সমর্থিত সরকারের রেফারেন্স উল্লেখ করেন।