শাহ আব্দুল করিমকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে সাকুল্যে দুইবার তাও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে। প্রথমবার দেখি ১৯৭২/৭৩ সালের কোনো এক শীতের রাতে। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার শাখোয়া ইউনিয়ন অফিস চত্তরে আয়োজিত এক মালজোড়া গানের আসরে। তিনি তখন বয়সের মধ্য গগনে আর আমি তখন কিশোর। দ্বিতীয়বার দেখা হয় ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে সিলেটে। বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার লিখিত প্রাচীন নিদর্শনের উপর আমার একটি প্রবন্ধ ছিল। সেই প্রবন্ধ পাঠের সুবাদে ইতিহাস সমিতির সম্মেলনে আমার অংশ গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল। রাতে ‘হোটেল পলাশ’ উপস্থিত সকল লেখক, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ডিনারে আপ্যায়িত করে। সেই ডিনারে একজন সম্মানিত ও আমন্ত্রিত অতিথী ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। বয়সের ভারে তখন তিনি অনেকটাই ন্যুব্জ আর আমি মধ্যবয়স ছুঁই ছুঁই করছি। দ্বিতীয় সাক্ষাৎটি খুব একটা স্মৃতিবহুল নয়। যদিও আমার খুব ইচ্ছা ছিল নিরিবিলি পেলে তাঁকে তাঁর জীবনের একটি অনুল্লেখিত অধ্যায় নিয়ে কিছু প্রশ্ন করার কিন্তু সেই সুযোগটি আমি পাইনি কেননা সিলেটের সুধী মহলে তিনি তখন এতটাই বরেণ্য যে পুরো ডিনার পর্বটিই তিনি গুণী এবং গুণমুগ্ধদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় সম্পন্ন করেছিলেন। ফলে প্রশ্নটি আর করা হয়নি পরে কোনোদিন আর সে সুযোগও আসেনি।

বরং প্রথম সাক্ষাৎটি অনেক স্মৃতিময়। যদিও তা দীর্ঘদিন আগের ঘটনা এবং আমার কৈশোর কালের কিন্তু সেই মালজোড়া অনুষ্টানের স্মৃতিটা এখনও মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দর্শনীর বিনিময়ে অনুষ্টান হলেও পুরো প্যান্ডেলটি দর্শক শ্রোতায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এর কারণ নয়মাসের দুঃস্বপ্নের পর প্রথমবারের মতো এলাকায় একটি বিনোদনমুলক অনুষ্টান হতে যাচ্ছে  তাছাড়া নবীগঞ্জের সাথে শাহ আব্দুল করিমের একটি বিশেষ যোগসূত্র ছিল। বিশেষ করে নবীগঞ্জের আশপাশের গ্রামগুলিতে তাঁর নাম ও গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। তাহলে শ্রুতিনির্ভর সেই যোগসূত্র প্রসঙ্গেই প্রথমে আলোকপাত করে নিই কারণ এই উপাত্তটি শাহ আব্দুল করিমের একটি তথ্যনিষ্ট জীবনী রচনায় প্রয়োজনীয় এবং সহায়ক হবে বলে মনে করি।

 

শাহ আব্দুল করিম জীবনের অজানা অধ্যায়;

শাহ আব্দুল করিম যখন স্রেফ একজন আব্দুল করিম, এক ঘরছাড়া ঘরপালানো ছন্নছাড়া যুবক তখন তিনি অস্থায়ী বসত গেড়েছিলেন তৎকালীন নবীগঞ্জ থানা সদরের সন্নিকটবর্তি গন্ধা গ্রামে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস। কখনো একটানা কখনো বিচ্ছিন্নভাবে। দীর্ঘ সময় বসবাস করার ফলে তিনি এ গ্রামেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন। গন্ধা আমার গ্রাম। অগ্রজজনদের মুখে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। তখন সবে তাঁর গায়ক জীবনের শুরু। টুকটাক গান দিয়েই তিনি গ্রামে একটি অবস্থান করে নিয়েছিলেন। গন্ধাগ্রাম পড়ালেখায় পশ্চাদপদ হলেও এ গ্রামে গান-বাজনার ঐতিহ্য বেশ পুরনো। বিশেষ করে বাউলা গানের। প্রতিদিনই কারো না কারো উঠানে গানের আসর বসতোই। আমার শৈশবকালেই ঢোল ডপকির আওয়াজ না শুনে কটি রাত ঘুমিয়েছি মনে হয় হিসেব করেই বলতে পারব। (হয়তো ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবর্তিত আকারে এখনও গানের আসর বসে) এছাড়া আন্তঃগ্রাম বাউল প্রতিযোগিতায়ও গ্রামের নিয়মিত অংশ গ্রহণ ছিল। বাউল দলের প্রধান হিসেবে এ গ্রামের প্রবীন দুই বিশাষণির (শব্দটি সম্ভবতঃ বিশেষণ>বিশেষণী থেকে উদ্ভুত, নাকি বিশ্লেষণ> বিশ্লেষণী থেকে?) নাম জানা যায় একজন তোতামিয়া এবং আরেকজন ইন্তাজ আলী, যারা শুধু দলকে পরিচালনাই করতেননা নিজেরা প্রয়োজনে পদও রচনা করতেন। এছাড়া আছদ উল্লাহ পিরের মোকামবাড়ি ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আউল বাউল পির ফকির আর সাধু সন্নাসীর পরম তীর্থ। কত অঞ্চলের কত ভবঘুরে মানুষ যে এখানে প্রতিদিন এসে সমবেত হতো, কত বিচিত্র গানের আসর বসত তা বলে শেষ করা যাবেনা। বাউলময় এমন গ্রামে আব্দুল করিমের মতো ঘর-পালানো মানুষের আগমন, অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিকতা থেকে নিজেকে ঋদ্ধ করা অস্বাভাবিক ছিলনা। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় তখন এক রুপসী বিধবা ছিলেন নাম আলতার মা। কিঞ্চিত ফকিরালী ঘরানার ছিলেন তাই লোকে তাকে আলতার মা পিরানী বলে সম্বোদন করত। সেই আলতার মার বাড়িতেই তিনি আস্থানা গেড়েছিলেন। কিন্তু যখন তাঁর খ্যাতি ও পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন কী এক রহস্যজনক কারণেএই গ্রামের সাথে তাঁর সম্পর্ক একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রতিষ্টিত হওয়ার পর তিনি কখনো এ গ্রামে  এসেছেন তেমন তথ্য জানা যায়না। এমনকি কোনো স্মৃতিচারনেও তাঁর জীবনের এই অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন বলে মনে হয়না। যেসব লেখক গবেষক আব্দুল করিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেন, লেখালেখি করেন তারাও কি তাঁর জীবনের সেই বিস্মৃত অধ্যায়টি সম্পর্কে অবগত আছেন? মনে হয়না। শুনেছি এই লোককবির একটি স্মৃতিকথামুলক বই আছে সে বইয়ে গন্ধা গ্রাম এবং আলতার মা প্রসঙ্গ আছে কি না জানিনা।  না থাকলে বুঝতে হবে এর মাঝে রহস্য আছে। তিনি ইচ্ছে করেই এ প্রসঙ্গটি চেপে রেখে গেছেন। মানুষের যৌবনকালটিকেই জীবনের সোনালী সময় বলে আমরা জানি। সেই সময়ের স্মৃতিতো ভুলার কথা নয়। অথচ তিনি যে এ গ্রামে ছিলেন, গান রচনা করেছেন আসর করে গান গেয়েছেন তাতো কল্পিত কিছু নয়। খুব বেশিদিনের কথাতো নয় বড়জোর পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের কথা। খোঁজ করলে তাঁর সমসাময়িক কাউকে এখনও গ্রামে জীবিত পাওয়া যেতে পারে যিনি তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেই আলতার মার উত্তরপুরুষেরা এখনও গ্রামে খুব ভাল অবস্থায় আছেন। এরা ভদ্র সজ্জন। আলতার মার নামেই তাদের পরিচিতি। ‘আলতার মার বাড়ি’ বা ‘আলতার মার গুষ্টি’ বলে শুধু গ্রামে নয় প্রতিবেশী গ্রামগুলিতেও তারা পরিচিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গোত্র গোষ্টি বা পরিবারের নামকরণ বা পরিচিতি সাধারনতঃ পরিবারের প্রধান কর্তাটির নামেই হয়ে থাকে কিন্তু গন্ধা গ্রামের এই পরিবারটির পরিচিতি একজন নারীর নামে এটাও কিছুটা ব্যাতিক্রমী ঘটনা। এ থেকে এটিও প্রমাণিত কথিত আলতার মার পরিচিতি পরিবারের পুরুষ প্রধানদের চেয়েও বেশি ছিল।

সমসাময়িকদের কাছ থেকে শুনেছি আব্দুল করিম খুব কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। গানের সাথে সাথে চুটকি গল্প আর মানুষের স্বভাব বা আচার আচরন নিয়ে বিশেষণ সংযোজনে তিনি খুব দক্ষ ছিলেন। প্রতিযোগিতামুলক বাউল গানে এই  গুণটি একজন বাউলের জন্য খুব প্রয়োজনীয় প্রতিভা। এ প্রসঙ্গে অনেকের মুখ থেকে শুনা একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করছি। আমাদের গ্রামের প্রথম দিককার শিক্ষিতদের একজন ছিলেন আকামত আলী। সমবয়সী হওয়াতে আব্দুল করিমের সাথে তার সম্পর্ক ছিল অনেকটা তুই তুখারির পর্যায়ের। তিনি একাধিকবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ন হলেও কখনও উত্তীর্ণ হতে পারেননি কিন্তু তৎকালীন সময়ে নামের সাথে ‘মাষ্টার’ বা ‘মাষ্টর’ বিশেষণ সংযুক্ত হতে বিদ্যের এই পূঁজিটুকুই যথেষ্ট ছিল। তিনি গ্রামে ‘মাষ্টর’ নামে পরিচিত ছিলেন। পড়ালেখার চেয়ে তিনি তাস খেলাতেই অধিক মনযোগী ছিলেন সে জন্যই কিনা কে জানে আব্দুল করিম তার সেই মাষ্টর নামের সাথে আরেকটি বিশেষণ যুক্ত করে নাম দিয়েছিলেন ‘বাউজের মাষ্টর’ অর্থাৎ ‘ভাবীর মাষ্টার’। আর আমার চাচা আকামত আলীকে আব্দুল করিমের দেয়া এই বিব্রতকর তকমাটি দীর্ঘকাল নামের সাথে  বয়ে বেড়াতে হয়েছে। মুরব্বিদের কাছ থেকে জানা যায় তিনি তখনই খুব ঠোঁটকাটা প্রকৃতির ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ কোনো ব্যঙ্গার্থক মন্তব্য করলে তাৎক্ষণিক তার উপযুক্ত জবাব নিয়ে যাবেনা এটা ভাবা যেতনা। যারা তাঁর গানের অনুষ্টান উপভোগ করেছেন তারাই জানেন তীর্যক বাক্যবাণে তিনি কতটুকু পারদর্শী ছিলেন। আমার চাক্ষুস অভিজ্ঞতার বর্ণনা এ লেখার শেষে উল্লেখ করব।

গন্ধাগ্রামের বাউলিয়া আবহ আব্দুল করিমকে আকৃষ্ট করেছিল নাকি অন্য কোনো সম্পর্কে তিনি বাঁধা পড়েছিলেন এ নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারে আবার কোন সূত্রে তিনি এখানে এসেছিলেন তাও খুঁজে দেখা প্রয়োজন। তাঁর জন্মস্থান উজান ধল আর গন্ধার দুরত্ব তৎকালীন সময়ের বিচারে কম ছিলনা। বর্ষায় নৌ যোগাযোগ ভাল থাকলেও হেমন্তে পায়ে হাঁটা ছাড়া গত্যন্তর ছিলনা। তবে দুরত্ব যতই হোক দুই গ্রামের মাঝে আত্নীয়তার যোগসূত্র ছিল। আমাদের গ্রামের একাধিক পরিবার আছে যাদের পূর্বপুরুষ এসেছেন উজান ধল থেকে। আমার পিতামহের শশুরবাড়ি ছিল উজান ধলে। একই গ্রামে আমার দাদার এক বোনেরও বিয়ে হয়েছিল। সুতরাং যে কোনো এক সূত্রেই তাঁর এখানে আসা সম্ভব। তিনি যখন গন্ধা আসেন তখন তাঁর নিজ গ্রামবাসী কারো কারো এ গ্রামে জীবিতাবস্থায় থাকার সম্ভাবনা।

শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসর আমার গ্রামের আলো-বাতাস-মাটি একজন আব্দুল করিমের মানস গঠনে কিঞ্চিত অবদান রেখেছে এটা ভেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। শাহ আব্দুল করিমের জীবনীকারগণ যদি এ ব্যাপারে এখনই অনুসন্ধান করেন তবে অনেক সমসাময়িক স্বাক্ষীর সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁর জীবনের এই মিসিং অধ্যায়টিকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।

 

করিম-মানস।

ফকির লালনের জাত ধর্ম নিয়ে  বিতর্ক অনেক পুরনো যদিও লালন নিজেই “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে” গানে এই জাতের ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। আব্দুল করিম সমসাময়িক কালের তাই তার জাত ধর্ম নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ ছিলনা কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তিনি বাউল কি না এ নিয়ে বেশ তিক্ত উত্তপ্ত এক বিতর্ক জমে উঠেছিল। বিতর্কটির শুরু হয়েছিল লালনগীতির স্বনামধন্য শিল্পী ফরিদা পারভিনের একটি বক্তব্যকে ঘিরে। শাহ আব্দুল করিমকে বাউল সম্রাট বলে অভিহিত করাটাকে সম্ভবত এই বরেণ্য শিল্পীর পছন্দ ছিলনা তাই অনেকটা তুচ্ছতা সহকারে বলেছিলেন ‘তিনিতো আসলে বাউলই না’ করিম ভক্তদের এই উক্তিটি বেশ ক্ষ্যাপিয়েছিল। ফরিদা পারভীনকে উদ্দেশ্য করে করিমের তরুন ভক্তকুল অনেক আক্রমনাত্নক মন্তব্য করেছিলেন। তার মাঝে কিছু কিছু শালীনতার মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফরিদা পারভিনের কথার ঢংটিকে অশোভন মনে হলেও বক্তব্যটি এক অর্থে সঠিক ছিল বলেই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। শাহ আব্দুল করিমকে শাস্ত্রগত বিশুদ্ধ বাউল বলা যায়না। বাউলকে যদি পৃথক একটি ধর্মমত মনে করা হয় তবে আব্দুল করিম সে ধর্মের অনুসারী ছিলেননা। “গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম” আব্দুল করিম সিলেট ময়মনসিংহ এলাকার সেই বাউলা গানের বাউল। অর্থাৎ শুদ্ধ বাউল নয় সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত বাউল। এক সময় বৃহত্তর সিলেটের পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতামুলক বাউল গানের আসর বসত। পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও আন্ত গ্রাম বাউল প্রতিযোগিতা সাড়ম্বরে অনুষ্টিত হতো। বাউল দলের প্রধানকে বলা হতো বিশাষণী। এরা প্রশ্নোত্তর পর্বে দলকে নেতৃত্ব দিতেন। চারন কবিদের মতো তাৎক্ষণিক মুখে মুখে গান রচনা করে দলবল সহ তা পরিবেশন করতেন।এই বিশাষণী বা বাউল দলের কেউই শুদ্ধাচারী বাউল ছিলেননা। বাউল বা বাউলাগান ছিল গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম। লালন শাহ বিশুদ্ধ বাউল ছিলেন সেজন্য তাঁর প্রতিটি গানেই গুঢ় আধ্যাত্নিকতার প্রকাশ ঘটেছে কিন্তু আব্দুল করিমের অনেক গানই আবার আধ্যাত্নিকতামুক্ত। তাঁর গানের বিষয় কিছুটা বিচিত্রগামী। তার এই ধারার গানগুলি সমাজচিন্তা রাজনীতি স্বদেশভাবনায় সমৃদ্ধ। কিছু গানে সমকালের সাথে সমান বাঙময় হয়ে উঠে এসেছে সুবর্ণ অতীতও। এজন্য অতীতচারিতাও তাঁর গানের এক অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে কিছু উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন ‘হুরু থাকতে আমরা কত খেইর খেলাইতাম’ শীর্ষক গানটিতে তাঁর শৈশবস্মৃতি এতটাই বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে যা পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ শুনলে স্মৃতির বায়স্কোপে যেন নিজের অতীতটাকেই দেখতে পায়। এই গানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো সিলেটের আঞ্চলিক শব্দের চমৎকার ব্যবহার। ‘ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এই জনপ্রিয় গানটি পঞ্চাশ বা তৎপূর্ব সময়ের এক নিখুঁত চিত্রকল্প যাতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সরল চিত্র। ‘আগের বাহাদুরী এখন গেল কই/চলিতে চরণ চলেনা দিনে দিনে অবশ হই” গানে বার্ধক্যের মর্মযাতনা যেন হাহাকার করে উঠেছে। তাঁর অকপট দেশপ্রেম দেশাত্নবোধ ফুটে উঠেছে ‘ আমি বাংলা মায়ের ছেলে’ গানটিতে। চিরকালের গান-পাগল মানুষ তিনি, গানই তাঁর ধ্যাণ জ্ঞান সাধনা। গানের প্রতি তাঁর প্রেম নিষ্টা অতৃপ্তিবোধের পরিচয় মিলে একাধিক গানে অর্থাৎ গানকে বিষয়বস্তু করেই এসব গান রচিত হয়েছে “আমি গান গাইতে পারিনা/ গানে মিলে প্রাণের সন্ধান, সে গান গাওয়া হলনা, গান গাই আমার মনরে বুঝাই, মন থাকে পাগলপাড়া/ আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া  অথবা “যা দিয়েছ  তুমি আমায় কি দেব তার প্রতিদান/মন মজালে ওরে বাউলা গান’ ইত্যাদি। এছাড়া বাঙ্গালীর চিরন্তন প্রেম ভালবাসা মিলন বিরহকে ধারণ করে এমন কিছু গান তিনি রচনা করেছেন যা কালোত্তীর্ণ হয়ে থাকবে। এই পর্যায়ের বিপুল জনপ্রিয় গানগুলির মাঝে “বসন্ত বাতাসে সইগো বসন্ত বাতাসে, কেন পিরীতি বাড়াইলারে বন্ধু ছাইড়া যাইবা যদি, বন্ধু মায়া লাগাইছে পিরীতি বাড়াইছে, এই মিনতি করিরে সোনাবন্ধু ভুইলনা আমারে,আইলায়না আইলায়নারে বন্ধু করলায়রে দিওয়ানা ইত্যাদি। আধ্যাত্নবাদীরা অবশ্য এই মানবিক আকুতিকে ঈশ্বরানুভুতির সাথে মিলিয়ে ফেলতে পারেন। তাতে অবশ্য ভিন্নমতেরও কারণ নেই কেননা একজন বাউলের সাথে তার পরমাত্নার সম্পর্ক আশেক-মাশুকের। রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজার অনেক গানেও মানবিক প্রেম আর অতিন্দ্রীয় প্রেম পাঠক-শ্রুতার চিত্তে একাকার হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর আর বাউলের ঈশ্বর অনেকটা মাসতুত পিসতুত ভাইয়ের মতো, উভয়ই প্রেমময়।

আব্দুল করিমের গানের এই বিচিত্র প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে তাঁকে নিছক বাউলকবির বৃত্তে আবদ্ধ করে রাখা মনে হয় সমীচীন হবেনা। তাঁকে বলা যেতে পারে সমাজ ও সময় সচেতন একজন লোককবি এবং লোকশিল্পী। বাউল সম্রাট শব্দটি তাঁর তরুন ভক্তকুলের আবেগ ও ভালবাসার প্রকাশমাত্র। আব্দুল করিম তাঁর জীবদ্দশায় মানুষের যে ভালবাসা ও সম্মান লাভ করেছিলেন তা এক কথায় বিরল।  জীবন্ত কিংবদন্তি শব্দটির স্বার্থক উদাহরণ ছিলেন তিনি।

ধর্মীয় কুসংস্কার ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে এখন প্রচুর লেখালেখি হয়। অনেক মুক্তমন মুক্তচিন্তার তরুন লেখক এইসব অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে এখন সোচ্চার। মিডিয়ার কল্যাণেই তা সম্ভব হয়েছে। অথচ বিশ পঁচিশ বছর আগে তা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু একশ দেড়শ বছর পূর্বেও এসব অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়েছে। আর এই সাহসী কাজটি করেছেন গ্রামের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত আউল বাউল গায়েন বয়াতিরা। “নিম্ন পথে বাতাস গেলে মুখ ধুইয়া পাক হইতে হয়/ এ কেমন বিধির বিধান জানতে বড় ইচ্ছা হয়, নবীর কালিমা ভজব সুখে/নবী করলেন চৌদ্দ নিকেহ/কোন বিবির দেনা রেখে নবী গেল মিরাজে (লালন) অথবা “যে নবীর চৌদ্দ বিবি ছিল/তিন বিবির সন্তান হলো/এগারো বিবির কী দোষ ছিল/ফকির লালন ভাবে তারই’ এসব ছিদ্রান্বেষী প্রশ্ন উত্থাপন করার কারণেই মোল্লারা এদের বলেন বেশরা ফকির। শরিয়তপন্থীরা যখন ধর্ম-গিলাপের ছিদ্রগুলিকে ঢেকে রাখাকে পরম দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে বিশ্বাস করেন তখন এই মারিফতপন্থীরা সেসব ছিদ্র উন্মোচন করতেই যেন অধিক  তৎপর। কিন্তু এই আউল বাউল গায়েন বয়াতিরা নাস্তিক নন। তাদেরও একজন ঈশ্বর আছে। অবশ্য সে ঈশ্বর ধর্মে বর্ণিত ভয়াল ক্রুদ্ধ ভীতিজাগানো স্তুতিপ্রিয় আর নিয়মাচারের নিষ্টুর বিধায়ক স্বৈরতন্ত্রী ঈশ্বর নন তিনি প্রেমময় ঈশ্বর।সেই ঈশ্বরের সাথে তাদের সম্পর্ক প্রেমের। সে সম্পর্ক আশেক আর মাশুকের।  সমাজের ভেতর বসবাস করেও এরা তাই অন্য এক স্বপ্নলোকের বাসিন্দা।

মোল্লা ফকিরের দ্বন্দ্ব সুদীর্ঘ্য কালের। এই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক অনেকটা সর্প-বেজির সম্পর্কের মতো। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’য় সেই দ্বন্দ্বের উপর চিত্রায়িত পালাটি খুব উপভোগ্যভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তানভির মোকাম্মেলের লালন  ছবিতেও ক্রুদ্ধ মোল্লাদের দেখা যায় আর গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ ছবিতেতো দেখা যায় লালনের বিরুদ্ধে মোল্লা-পুরুত একেবারে এককাট্টা। বর্তমান সময়ে এই দ্বন্ধটি আর প্রকট নয় এর কারণ ধর্মীয় অনুভূতির দাপটে আউল বাউলেরা এখন কোনঠাসা। এখন এইসব তথাকথিত নিয়মাচারের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করার সাহস এই নিরীহ সম্প্রদায়ের আর নেই। এরপরেও এদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বছর খানেক পূর্বে শুনেছিলাম গ্রাম্য মাতবর আর মোল্লারা মিলে বাউলদের ধরে তাদের লম্বা চুল জটা কেটে ফেলেছিল। যে আব্দুল করিম জীবদ্দশায় অসংখ্যবার মোল্লা আর কট্টরপন্থীদের দ্বারা নানাভাবে নিগৃহিত হয়েছেন মৃত্যুর পরেও সেই নিগ্রহ থেকে তিনি মুক্তি পাননি। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে সমবেত ভক্তদের মেরে পিটে  অনুষ্টান পন্ড করে দেবার ঘটনাও নিকঠ অতীতে ঘটেছে।

শাহ আব্দুল করিমের যে অনুষ্টান উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই অনুষ্টানে কী কী গান তিনি গেয়েছিলেন তা আর মনে নেই। কারণ তার গানের গলাটি খুব আকর্ষণীয় ছিলনা। তাছাড়া তিনি মালজোড়ার আসরে একজন উস্তাদ মেজাজের শিল্পী ছিলেন। বেহালায় সুর তুলতে তুলতেই তিনি অনেক সময় নিতেন। বলাবাহুল্য একজন কিশোরের কাছে তার দীর্ঘ সময়ব্যাপি বেহালা সঙ্গত ভাল লাগার কথা নয় বরং  কিছুটা বিরক্তই হয়েছিলাম। কিন্তু যখন গানের ফাঁকে ফাঁকে চুটকি বলা শুরু করলেন তখনই তা আমার কাছে চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠল। সেদিনের আসরে তার বলা দুটি চুটকি গল্প হুবহু মনে আছে। চুটকিগুলি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে কথিত হলেও তাতে মুলত মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিরই স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। করিম-মানসকে বুঝতে সহায়ক হবে বলেই স্মৃতি থেকে সেই দুটি চুটকি গল্প এখানে উদ্ধৃত করছি।

প্রথম চুটকিটি ছিল এ রকম- এলাকায় নতুন এক মৌলানা এসেছে। ভয়ংকর তার শাস্ত্রজ্ঞান। তার তুজুর্বার সামনে দাঁড়ানোর সাহস কারোরই নেই। তো অত্র এলাকার বনেদি মৌলানা পড়লেন মহা ফাঁপরে। বাইর থেকে এক আজনভি এসে এলাকায় জুড়ে বসেছে স্বভাবতই তার আসনটি নড়বড়ে হয়ে যাবার ঝুঁকিতে। পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই শুনিয়ে শুনিয়ে বাঁকা কথা বলে। এতদিনতো খালি বনে বাঘ শিকার করেছ এইবার আসল বাঘের ঠ্যালা সামলাও। চিন্তায় মৌলানার ঘুম হারাম। কী করে এই উঠকোকে পরাস্ত করবেন তা নিয়ে দিনরাত চিন্তা করে যান। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন বেটাকে তাড়াতে হবে চালাকি করে। নিজের শাস্ত্রজ্ঞান দিয়ে তা অসম্ভব তা তিনি ভাল করেই জানেন। তিনি ফন্দি এঁটে পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে ঘোষণা করলেন নবাগত মৌলানার সাথে তিনি বাহাস লড়বেন।দিন তারিখ ধার্য্য হয়। একটি চ্যালেঞ্জিং বাহাস প্রতিযোগিতা সুতরাং চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে আয়োজনস্থল লোকে লোকারণ্য। মঞ্চের উপর বসে নবাগত মৌলানা মিট মিট করে হাসে কারণ সে জানে পুরান মৌলানা তার সাথে পেরে উঠবেনা। সবাই প্রতিক্ষায় কিন্তু পুরান মৌলানার টিকিটিরও দেখা নেই। সভাস্থলে গুঞ্জন উঠল মৌলানা কি ভয়ে পিঠটান দিল না কি? তাহলেতো লজ্জার কথা। এলাকার মান সম্মানের প্রশ্ন এটা। এ দিকে নবীন মৌলানাও ঘটনা অনুমান করতে পেরে মঞ্চে হম্বিতম্বি শুরু করে দিল। কোথায় আপনাদের হুজুর ? গুঞ্জন এক সময় কোলাহলে পরিনত হয়। এ কি কান্ড করলেন হুজুর ? পারবেননা তো বাহাসের ঘোষণা দিলেন কেন ? সবাই ব্যাকুল হয়ে পথের দিকে তাকায়। হঠাৎ কে একজন চিৎকার করে বলে- হুজুর আসছেন। সকলের দৃষ্টি রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হুজুর সত্যি আসছেন। তবে একা নয় বেশ কিছু মানুষ সাথে। দুজনের কাধে লাল সালুতে মোড়ানো লাশের মতো জিনিষ একটা। আরো দুজনের কাধে তেমনি সালু মোড়ানো কিতাবের মতো কিছু যা খুবই ওজনদার বলেই মনে হয়। জনতা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে হুজুরকে স্বাগত জানায়। নবীন মৌলানার মুখের হাসি কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। হুজুর সোজা মঞ্চে উঠে নিজের আসনে গিয়ে বসেন। কাধে করে আনা বস্তু দুটি মঞ্চের একপাশে রাখা হয়। আয়োজনকারীদের কেউ একজন কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করে হুজুর এই জিনিষ দুটি কী ? হুজুর বলেন-কিতাব। গোল লম্বাটির নাম ‘দাড়াতুল ইসলাম’ আর ছোটটি ‘পাটাতুল ইসলাম’। নবীন মৌলানার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। সে ভাবে, এত পড়ালেখা করলাম এত কিতাব-কালাম চর্চা করলাম কিন্তু দাড়াতুল ইসলাম আর পাটাতুল ইসলামের নামতো কোনোদিন শুনলামনা। তার মাঝে একটা অস্থিরতা দেখা যায়। সে হুজুরকে বলে- আপনি আমার বাবার বয়সী মুরব্বি আপনিই আগে শুরু করুন এই ফাঁকে আমি একটু বাথরুম থেকে আসি। হুজুর প্রস্তাব গ্রহণ করে শুরু করেন। দোয়া কালাম পড়তে থাকেন। পড়তেই থাকেন। এ দিকে নবীন মোল্লার বাথরুম থেকে আসার নাম নেই। হুজুর বিষয়টি অনুমানে আঁচ করতে পেরে বলেন-আপনাদের হুজুরের বাথরুম আর কতক্ষণ চলবে, উনি না ফিরলেযে আসল বয়ানে যেতে পারছিনা। তাইতো, নয়া হুজুর গেলেন কোথায়? তার খোঁজে বাথরুমে গিয়ে দেখা যায় বাথরুম ফাঁকা সেখানে কেউ নেই। অবশেষে ঘটনা খোলাসা হয় নয়া হুজুর পালিয়েছে। সভাস্থলে পুরান হুজুরের জয় জয়কার পড়ে যায়। বাড়ি ফিরলে বিবি জিগ্যেস করেন-ক্যামনে কী করলেন? হুজুর হেসে বলেন- সবই ব্রেইনের কাম। কিতাব দুইটার একটাও আসল নয়। দাড়াতুল ইসলাম হইল ধান শুকাইবার দাড়াকে গোল করে পেঁচিয়ে সালু দিয়া মোড়ানো আর পাটাতুল ইসলাম হইল তোমার মরিচ পিষার পাটা, গোপনে উঠায়ে নিছলাম তুমিও দেখ নাই। বেটা বেকুব নাম শুনেই চম্পট দিছে।

দ্বিতীয় গল্পটি  আদিরসাত্নক এবং নারীর পর্দা বিষয়ে তীব্র ব্যঙ্গার্থক। গল্পটি এমন- রাতে ইমাম সাহেবের স্বপ্নদোষ হয়ে যায়। ফরজ গোসলের ঝামেলা চুকাতে চুকাতে ফজরের নামাজের নির্দিষ্ট ওয়াক্ত চলে যাওয়ার উপক্রম তাই ইমাম সাহেব তড়িঘড়ি ছুটছেন মসজিদের দিকে। কিন্তু পথে আরেক বিপত্তি। গায়েরই এক সুন্দরী মহিলা কোনো রকম পর্দা ছাড়াই পথ দিয়ে আসার পথে একেবারে ইমাম সাহেবের মুখোমুখি। তিনি খুব কড়া এক গলা খাঁকারি দিলেন। এটা পর্দার সিগনেল বুঝতে পেরে মহিলা পরনের শাড়িটি কোনো রকম টেনে মাথার আংশিক ঢাকলেন। দরীদ্র মানুষের কাপড়ও সে রকম। যেমন দৈর্ঘে কম তেমনি প্রস্থে। তাই মাথা ঢাকতে গিয়ে তার পায়ের দিকের কিছুটা অনাবৃত হয়ে পড়ল। ইমাম সাহেব সে দিকে তাকিয়ে আরেকবার গলা খাঁকারি দিলেন। এবার আরেকটু চড়া মাত্রায়। মহিলা মনে করলেন পর্দা যথেষ্ট হয়নি তাই আঁচলটিকে আরেকটু টেনে মাথার পর্দা বাড়ালেন কিন্তু এতে তার শাড়ি নিচের দিক থেকে প্রায় হাঁটুর উপরে উঠে গেল। ইমাম সাহেব মহিলার অনাবৃত ফর্সা উরোর দিকে তাকিয়ে এবার হুক করে যে কাশিটি ঝাড়লেন তাতেই তার সর্বনাশ হয়ে গেল। তিনি যাচ্ছিলেন মসজিদের দিকে এবার ছুটলেন বাড়ির পুকুরের দিকে। আরেকবার গোসল করতে হবে যে।

এই চুটকি বলার সময়টি পূর্বেই উল্লেখ করেছি ১৯৭২-৭৩ সাল।  একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে বাঙ্গালী মানস তখন মোটামোটি একটা সেক্যুলার পর্যায়ে ছিল। তাছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্থ একটা দেশ, মানুষ তখন আক্ষরিক অর্থেই জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত। ধর্মীয় অনুভূতি নামক ব্যাধিটির তখনও উত্থান হয়নি। তবে এই ক্যান্সারের কোষযে মানুষের ভেতরে সুপ্ত ছিল কিছুদিন পর দাউদ হায়দার ইস্যুতে দেশ উত্থাল হয়ে উঠার ঘটনা থেকে তার আঁচ ভালই পাওয়া গিয়েছিল। অনুভূতির সেই প্রারম্বিক লগ্নেই তার আসুরিক শক্তির কাছে বঙ্গবন্ধুর মতো আজন্মসংগ্রামী এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্ব পরাজয় মেনে রাষ্ট্রের এক মুক্তমত প্রকাশকারী নাগরিককে এক কাপড়ে সম্পূর্ণ কপর্দকশূন্য অবস্থায় একা একটি প্লেনে তুলে দিয়ে চিরনির্বাসনে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধর্মানুভূতির সেই দানব এখন পূর্ণ শক্তিতে বিকশিত। আব্দুল করিম বর্তমান সময়ে যদি এই দাড়াতুল ইসলাম আর পাটাতুল ইসলামের গল্প বলতেন তবে নিশ্চিত ভাবেই  ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় কারাবরণ করতেন নাহয় চাপাতির আঘাতে নির্ঘাত প্রাণ হারাতেন।