লেখক: পুলক ঘটক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উঠিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ঘোষণা করার পর বিজয় মিছিল করেছে আন্দোলনকারীরা। ২০-দলীয় ইসলামি জোটের মূল দল বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর ঐ ঘোষণা অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। ঐ জোটের দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি জামাতে ইসলামী এই আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর। কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তিতে তারা উল্লসিত হবে তা বলাই বাহুল্য।

সিপিবি ও এর সাথে জোটবদ্ধ বামসংগঠনসমূহ এবং তাদের ছাত্র ও যুব সংগঠনের অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে “কোটা সংস্কারের” আন্দোলনে সোচ্চার ভুমিকা পালন করতে দেখা গেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ ১৪ দলে বাম ঐতিহ্যের কয়েকটি সংগঠন থাকলেও শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত করার সাহস তাদের কারও কাছে প্রত্যাশা করি না। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোটে এসব দলের স্বকীয়তা অনেকদিন থেকেই অদৃশ্য। তাহলে কি দাঁড়ালো? কোটা রক্ষার পক্ষে বলার আর কেউ নেই।

রাজনীতির বিপরিত মেরুতে
বাংলাদেশের রাজনীতি স্পষ্টত: দুটি মেরুতে বিভক্ত: আওয়ামীলীগ বনাম বিএনপি। এই দুই মেরুর বাইরেও ভিন্ন চিন্তা নি:শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু কোটা বিরোধী আন্দোলনে আমরা কি দেখলাম?

বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বলয়ের এক প্রান্তে জামাতসহ ইসলামী দলগুলো, অারেক প্রান্তে সিপিবিসহ কিছু বামদল এবং মাঝখানে আওয়ামীলীগ – জাতীয় পার্টি – বিএনপিকে রেখে একটি রেখা অংকন করা যাক। এই একটি ইস্যুতে হাতে হাত ধরে দাঁড়ানো সরল রেখা দেখতে পাবেন। যে রেখাটি রাজনীতির গোটা বলয় জুড়ে বৃত্তায়িত। বৃত্তের মধ্যে কোন দল কার কত কাছাকাছি স্থান পাচ্ছে সেটা কল্পনা করুন; ভাবাবেগ উপচে উঠবে।

বিশেষ কোনো ইস্যুতে রাজনীতির সকল মেরু এভাবে মিলে গেলে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ভিন্ন চিন্তার মানুষ খুঁজতে সার্চলাইট পাওয়াও কঠিন। সুতরাং এ সময় কোটা বিলোপের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে শ্রাব্য-অশ্রাব্য সকল ভাষায় গালি খাওয়ার ঝুকি নেয়া। শুধু গালি খাওয়া নয়, বর্তমান বাস্তবতায় ঝুকিটা আরও বড়। নিজেকে বিপন্ন করে আমার সন্তানদের এরকম ঝুকিতে ফেলব ? নাকি অতিমাত্রায় বৈষম্য ও অন্যায্যতার দিকে ধাবমান নির্মম এক বাংলাদেশে বসবাসের ঝুকি সন্তানদের জন্য মজুদ রেখে যাব?

সুবিশাল বৃত্তের বাইরে গিয়ে কিছুই করতে পারব না, তা জানি। তবে উচ্চারণটা রেখে যেতে চাই। চিৎকার করে বলতে চাই, “আমি কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে ১০০% কোটা ব্যবস্থা প্রণয়নের পক্ষে।” যাতে কেউ অন্যায্যতার শিকার না হয়, কেউ বঞ্চিত না হয়।

অসম প্রতিযোগিতা নয়
অসম প্রতিযোগিতার রাজ্যে আমার সন্তানকে রেখে যেতে চাই না। সেই প্রতিযোগিতায় আমার সন্তান যদি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, তবুও না। কারণ আমার সন্তান সবল হলেও আমার ভাইয়ের একটি প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। আমার সবল সন্তানটির সঙ্গে ঐ প্রতিবন্ধী শিশুটি জীবনের দৌড়ে পাল্লা দেবে – এ রকম লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড দেখতে চাই না। প্রতিবন্ধী শিশুটিকে খেলায় হারিয়ে আমার শক্তিমানপূত্র বিজয়ের দেতো হাসি হাসবে? এরকম হিংস্র প্রতিযোগিতার রাজ্যে আমার সন্তানকে রেখে যেতে চাই না।

এক পায়ে চলা মানুষটির জন্য, পিছিয়ে পরা মানুষদের জন্য, সংকটগ্রস্ত মানুষদের জন্য, বঞ্চিত মানুষদের জন্য সুরক্ষামূলক রাস্ট্র ব্যবস্থা চাই। প্রত্যেকের সুরক্ষা ও অগ্রগতির জন্য সংরক্ষিত কোটা চাই। বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে চাকরির কোটা শতভাগ করা চাই।

Survival of the fittest অর্থাৎ `যোগ্যতমের টিকে থাকা’ -জঙ্গলের তত্ত্ব। দেশটা জঙ্গল নয়। এখানে মানুষ বাস করে। মানুষের দেশে মানবিক সমাজ চাই। জোর যার, মুল্লুক তার – তা হবে না। শুধু শক্তিমান বাঁচবে তা হবে না। শুধু মেধাবী বাঁচবে, কম মেধার মানুষ টিকতে পারবে না – এ রকম অসভ্য চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। আমার পরিবারে ৫ টি ছেলে। তাদের দুই জন মেধাবী, দু্ই জন চলনসই এবং এক জন বোকা ধরণের। এই ৫ জনের মধ্যে শুধু মেধাবী দু’জন বাঁচবে? বাকিদের কোনো কাজকর্ম থাকবে না? তাদের বাঁচতে হবে না? যার দাত আছে সে অন্য প্রাণীকে কামরে খাবে – দেশটাকে এমন জঙ্গল বানাতে দেয়া যায় না। যে দুর্বল তাকেও খেয়ে পড়ে বাঁচতে দিতে হবে। যে আপাত দৃষ্টিতে দুর্বল তাকে সবল ও কর্মশক্তিতে বলিয়ান হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

মেধাবীদের আন্দোলন?
নামে “কোটা সংস্কার” আন্দোলন হলেও এটা ছিল মূলত “কোটা বিরোধী” আন্দোলন; চাকরির মুক্ত বাজার তৈরির আন্দোলন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাজার অর্থনীতির স্রোতের তোড়ে এদেশের সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক, এমন কি পুজিবাদী ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’র ধারণায় বিশ্বাসী সবগুলো মহল ভেসে গেছে। এখন সবাই মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতা চায়। প্রতিযোগিতার এই বাজারে শুধু ”মেধাবীদের” স্থান থাকবে।

কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে চাকরি? তুমি কিসের মেধাবী হে? মেধাবী হলে আমলা বা কেরানী হতে চাও কেন? বিজ্ঞানী হও দেখি! মেধাবী হলে চিন্তায় ও কর্মে সৃজনশীল হও। তোমার আন্দোলনই বলে দিচ্ছে, তুমি মেধাবী নও। তুমি মূলত সুবিধাবাদী। তুমি দুর্বলের সকল সুবিধা কেড়ে নিয়ে নিজের সুবিধা নিশ্চিত করতে চাও। তোমার মস্তিষ্ক সে ভাবে কাজ করে না বলে তুমি বড় কিছু চিন্তা করতে পার না। মেধাবী হলে বড় কিছু ভাবতে। বড় কিছু নয়; তুমি ঘুষের চাকরি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। একজন মেধাবী মানুষ সরকারের কেরানী হওয়ার জন্য কেন ব্যাকুল হবে?

আমাদের দেশে মেধা যাচাইয়ের মানদন্ড কি? পাবলিক পরীক্ষা? আমি অনেকগুলো এসএসসি পরীক্ষায় হলের বাইরে দাঁড়িয়ে পাসের যুদ্ধ অবলোকন করেছি। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় উত্তির্ণ হতে দেখেছি। মাস্টার্স পর্যন্ত অস্যংখ্য বন্ধু-স্বজনের পাস করার, এমনকি ভাল রেজাল্ট করার কান্ড দেখেছি। কোটায় নয়, “মেধার ভিত্তিতে” অসংখ্য মানুষকে নিয়োগ পেতেও দেখেছি। নিয়োগের আগে এসব “মেধাবীর” তদ্বির দেখেছি। দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেছে। সবাই মেধাবী?

“কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!”

যে ছেলেটা তোমার ব্যাগ বহণ করল, অথচ স্কুলে ঢোকার সুযোগ পেল না, তুমি তার চেয়ে বেশি মেধাবী? শোষক মানসিকতা এ রকম চিন্তায় আত্মপ্রসাদ পায়। ঢাকা শহরে হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলে ভর্তির জন্য মহালড়াই চলে। এই কয়েকটি স্কুলে যারা পড়ার সুযোগ পেল শুধু তারাই মেধাবী? বাকি লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যারা ঢাকায়-গ্রামে-ছোট শহরে লেখা পড়া করছে তাদের মেধা নেই? যে ছেলেটি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করল তার মেধা নেই? শিক্ষা শেষে তার কাজ পাওয়ারও সুযোগ থাকবে না? আমি অসংখ্য ছেলে মেয়েকে নানা কারণে ঝরে যেতে দেখেছি – যারা এই দাবিদার “মেধাবীদের” চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী। ফুটপাতে শুয়ে থাকা ছেলেকে দেখেছি অসামান্য সুরেলা কন্ঠে গান গাইতে। সুযোগ পেলে সে হয়তো আমাদের প্রতিষ্ঠিত অনেক শিল্পীকে ছাড়িয়ে যেত। ১১/১২ বছরের এক সুইপার বালক আমাকে মামা ডাকত। সুন্দর ছবি আঁকত ছেলেটি। তার আঁকা ছবি আমাদের মত ভদ্রঘরের মানুষদের বিষ্ময়ে অভিভূত করত। সেই ছেলেটিকে তার বাবা ময়লা নিস্কাশনের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। “মামা, আমি যে মেথর! ভগবান কেন যে মেথর বানালো” -তার এই কথা আজো আমার হৃদয়ে বাজে। সে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না।

ঐ মানুষগুলো জানে না, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে সুইপারের কাজে যেতে বাধ্য করেছে। উন্নত দেশে সুইপারের ছেলে সুইপার হতে বাধ্য হয় না। এমন তো হতে পারত যে ঐ ছেলেটি বড় হয়ে এস.এম. সুলতান বা জয়নুল আবেদিন কে ছাড়িয়ে গেছে। আমার দেশে কত সংখ্যক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে শৈশবেই খুন করা হয় তার পরিসংখ্যান কে দেবে? তুমি বা আমি কিসের জন্য মেধার বড়াই করি বন্ধু? আমাদের লজ্জা হয় না! প্রকৃত প্রতিভাকে নিত্যদিন খুণ করে আমাদের তরুণরা কেরানীর চাকরির জন্য মেধার প্রতিযোগিতা করতে চায়! অফিসে আমার সহকর্মী ৬ জন পিয়নের মধ্যে অন্তত ৫ জন তুখোর মেধাবী। তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার-দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করে। কম্পিউটার বিভাগে কাজ দিলে ওরা অনেক ভাল করত। এমনকি সাংবাদিকতা করলে ওরা আমাদের কিছু সাব এডিটর বা রিপোর্টারের চেয়ে ভাল পারদর্শিতা দেখাত -এ আমি নিশ্চিত। আমাদের আবার মেধার বড়াই! ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির কোনায় বসে যে ছেলেটি জুতা সেলাই করে- তার কি অধিকার নেই আপন যোগ্যতাবলে ড. বি. আর. আম্বেদকরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার? আমার রাষ্ট্র ও সমাজ কি সে সুযোগ তাকে দিচ্ছে? ফুটপাতে কিংবা বস্তির দারিদ্রে নি:শেষিত হচ্ছে সম্ভাবনা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানে শোষণমুক্তির প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রত্যয় ভুলে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, কোটা ব্যবস্থা থাকবে না !

মেধার প্রতিযোগিতা
তুমি ক্লাসের পড়া মুখস্ত করেছ জন্য মেধাবী? পাবলিক পরীক্ষায় পাশ করা যদি মেধার মানদন্ড হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা মেডিকেলে ভর্তির জন্য আবার পরীক্ষা দেও কেন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবার দফায় দফায় পাশ দিচ্ছ। এত পাশের পর সরকারি চাকরি পেতে নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে কেন? এতগুলো পাশ করার পরও রাষ্ট্রের কাছে একটি কর্ম পাওয়ার স্বাভাবিক অধিকার তোমার হয়নি? সুইপার, পিওন, দারোয়ান, পুলিশের কনস্টেবল থেকে সরকারের ক্যাডার সার্ভিস পর্যন্ত চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। মাননীয় সরকার বাহাদূর কি মেধাবী সুইপার, মেধাবী পিয়ন, মেধাবী কেরানী বেঁছে নেওয়ার জন্য চাকরির পরীক্ষা আয়োজন করে? এসব পদে যারা কোটায় চাকরি পায় তারা কম মেধাবী, আর যারা কোটার বাইরে থেকে চাকরি পায় তারা বেশি মেধাবী? প্রশ্নটি আবারও করছি। যারা কোটার ভিত্তিতে পিয়নের বা দারোয়ানের চাকরি পেল সেকি কম যোগ্য পিয়ন এবং যে কোটা ছাড়া চাকরি পেল সেকি বেশি যোগ্য দারোয়ান? একটু ভেবে উত্তর দাওতো বাছারা ! হায় “মেধাবী” চাকরি প্রার্থীরা, তোমরা কি কারণে মেধার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে যাও? শুধু একটি চাকরির জন্য অসহায়ত্ব নয় কি? সেখানে মেধার ভূমিকা কতটুকু?

বেসরকারী (কর্পোরেট ও নন কর্পোরেট) অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে নিম্ন থেকে নির্বাহী পদ পর্যন্ত শুধুমাত্র মোখিক বা স্বাক্ষাতকারের ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা কি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম? এর কারণ কি? পরীক্ষায় মেধা যাচাই কি কাজে লাগে? তবুও চাকরি ক্ষেত্রে যারা প্রবেশ পাচ্ছে তাদের সবাই তোমাদের তথাকথিত মেধার প্রতিযোগিতায় ঊত্তির্ণ হয়েই তো চাকরি নিচ্ছে – সে কোটাই হোক আর কোটা বিহীন হোক।

যারা কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত হয় তাদের কি রাস্তা থেকে ধরে এনে চাকরি দেয়া হয়? তাদের মেধা যাচাই করা হয় না? তারা শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পার করে আসেনি? তারা কেউ মেধাবী নয়, আর তুমি মেধাবী – এটা কোন বিচারে দাবি কর? বিসিএস পাস না করলেও কি কোটার ভিত্তিতে সরকারী ক্যাডারে চাকরি দেওয়া হয়? যে ছেলে বা মেয়েটি বিসিএস কোয়ালিফাই করল তাকে তুমি মেধাহীন বল কোন অধিকারে?

মেধার পরীক্ষা চাওনা, তুমি তুমি আসলে চাকরি চাও। যেভাবেই হোক করে খেতে চাও। পিয়নের চাকরি হোক, আর মন্ত্রীপরিষদ সচিবের পদ হোক – তোমার চাকরি দরকার। কোটা ব্যবস্থাকে তোমার স্বার্থের প্রতিবন্ধক মনে হয়েছে, তাই তুমি আন্দোলন করেছ। চাকরি চাওয়াটা অন্যায় নয়। এটা তোমার অধিকার, সে তুমি মেধাবী হও আর কম মেধাবী হও। এই চাকরি ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করা অর্থাৎ ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া বন্ধ করা তোমার প্রধান দাবি হওয়া উচিৎ ছিল। তুমি তা করছ না।

বিদ্বেষ থেকে বিচ্যুতি
কোটা সংস্কারে ছাত্রদের যে আন্দোলন, সেটা বৃহত্তর সার্থের কিংবা সুষম স্বার্থের জন্য নয়। তারা যখন সকল গোষ্ঠির জন্য শুধুমাত্র ১০ % কোটা রেখে বাকি ৯০% চাকরি অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার দাবি করে – তখনই বোঝা যায় কি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়াশীল ধারণায় এগিয়ে গেছে দেশের তরুণ প্রজন্ম। স্বাধীন বাংলাদেশে এর চেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র-গণআন্দোলন আর কখনো হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। অথচ সেই আন্দোলনে জামাতের সাথে যুক্ত হয়েছে বামরাও। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের গোটা বুদ্ধিবৃত্তি আজ ভয়াবহ প্রতিক্রিয়াশীলতায় আবিষ্ট হয়ে গেছে। তবুও ভাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ইচ্ছা প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত এরা কেউ সরাসরি কোটা বাতিলের দাবিটা উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। তারা সংস্কারের কথা বলেছে, বিলুপ্তির কথা বলেনি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা আসার পরদিনই ছাত্ররা আনন্দ মিছিল করেছে। বিএনপি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে কোটা বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিতে পারলেন? তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী! দেশের সংবিধানের মর্মবাণী এক মুহুর্তের জন্য তার মনে হলো না? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই সংবিধান। সেখানে সমাজতন্ত্রের কথা বলা আছে, সুযোগের সমতাবিধানের কথা বলা আছে। সকল প্রকার বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট রাস্ট্রীয় অঙ্গীকার আছে। নারী-পুরুষ সমতার কথা বলা আছে। পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জাতিগোষ্ঠির জন্য কোটা সংরক্ষণের বিধান রাখা আছে। আমাদের পূর্বনেতৃত্ব, যারা দেশ ও সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তাদের চেতনার জায়গা থেকে আমরা কিভাবে সরে গেলাম?

আমার বেশি কষ্ট হচ্ছে বাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কান্ড দেখে। নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও চেতনা ভুলে গিয়ে তারা চাকরির বাজারকে উন্মুক্ত ও অসম প্রতিযোগিতামূলক করার অন্দোলনে নেমেছেন ! তারা সবাই সমাজতন্ত্রী; সাম্যবাদী! কেন তারা এসব করলেন? সম্পূর্ণ জেদের বসে। রাগ, ক্ষোভ ও জেদ অনেক সময় মানুষের কান্ডজ্ঞান তিরোহিত করে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে আমার ধারণা।

ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ একটি বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরি করেছে। তারা এখন প্রতিপক্ষ বিদ্বেষী। যে যতটা প্রতিপক্ষ তার প্রতি ততটা বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। তারা যেমন জামাত-বিএনপি কে দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে তেমনি ভিন্ন ধারার সকল মানুষকে কোনঠাষা করতে চাচ্ছে। ভিন্নমত সহ্য করতে পারছে না।আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা এখন শুধুমাত্র হেফাজতে ইসলাম এবং জাতীয় পার্টি ছাড়া প্রায় সবার বিরোধীতায় লিপ্ত আছে। তারা তাদের জোটের সহযোদ্ধাদের পালিত বলে মনে করে। জোটের বাইরে যারা আছে তাদের বৈরি মনে করে। কাউকে বন্ধু হিসেবে নিচ্ছে না। ফলে কি হচ্ছে? দেখা যাচ্ছে আওয়ামীলীগ সরকার এখন গণজাগরণ মঞ্চ বিদ্বেষী। গণজাগরণ মঞ্চ এখন আওয়ামীবিদ্বেষী। সরকার ব্লগার বিদ্বেষী, ব্লগাররা আওয়ামীলীগ বিদ্বেষী। সরকার সমালোচক বিদ্বেষী, সমালোচকরা আওয়ামী বিদ্বেষী। সরকার বাম বিদ্বেষী এবং বামপন্থীরা আওয়ামী বিদ্বেষী।

এই আন্দোলনে বামদের অবস্থান আওয়ামী বিদ্বেষ থেকে জাত বলেই আমার মনে হয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে ও বিভিন্ন সংকটে এর প্রভাব আরও বেশি করে দৃশ্যমান হবে বলে আমার মনে হয়। আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন করছে; আমরাও তাতে হাওয়া দেই – এরকম একটা মনোভাব বামদের মধ্যে কাজ করেছে। এটা করতে গিয়ে তারা তাদের নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। মানবিকতার দর্শন বিসর্জন দিয়ে মানুষকেও মুক্ত বাজারের পন্য কিংবা উপকরণে রুপান্তরের নির্মম দর্শন মেনে নিয়েছে।

বাম প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ছাত্র সমাজের বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনে বারবার পথ প্রদর্শক হয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কারের দাবিটা বাম ছাত্র সংগঠনগুলো অতীতে কথনোই তাদের কর্মসূচিতে যুক্ত করেনি। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠিগুলোই ভেতরে ভেতরে প্রচারণা চালিয়ে এই দাবিটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ছাত্র ও যুব সমাজের মনোভাব পাঠে প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা সময়মত সুপরিকল্পিত কর্মসূচী নিয়ে এগোতে পারেনি। হঠাৎ করে এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে।

এক্ষেত্রে বরং ইসলামী ছাত্র শিবির এগিয়ে ছিল। তারা এমনিতেই মানবতা বিরোধী এবং কোটা বিরোধী। কোটা একটি মানবিক বিষয়; মানবিক উন্নয়নের বিষয়। শিবিরের অবস্থান এর বিপরিতে। তারা প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে, সমাজের সম-উন্নয়নের বিপক্ষে এবং মানবিকতার বিপক্ষে।এ কারণে প্রথম থেকেই কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা তাদের জন্য সহজ হয়েছে। প্রগতিশীলরা সেটা পারেনি। বামদের মধ্যে আদর্শিক দ্বিধাদ্বন্দ কাজ করেছে। ফলে তারা দেরিতে নেমেছে।

প্রতিক্রিয়াশীল জামাতে ইসলামী এবং অন্যান্য মৌলবাদী দল ও গোষ্ঠীগুলো নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিরোধী, এবং সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধী। এই সব গোষ্ঠী প্রতিবন্ধীদের ভিখারী কিংবা আশ্রিত হিসেবে রাখতে চায়। তারা এদের জন্য দান-খয়রাদ করে পরকালের জন্য অশেষ সোয়াব হাসিল করতে চায়। কিন্তু প্রতিকুল অবস্থায় থাকা মানুষগুলো আপন কর্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হোক – সেটা দেখতে চায় না। সুতরাং তারা চাকরিতে এদের সবার জন্য সংরক্ষিত কোটা উঠিয়ে দেয়ার দাবি করবে এটাই স্বাভাবিক।

কোটা সংস্কার কিংবা মানুষের যে কোনো আন্দোলনে একগুঁয়েমি দেখানো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। সরকারের একগুঁয়েমি এবং সরকারপন্থীদের মারমুখী আচরণের কারণেই এবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। জনমত কোটা সংস্কারের পক্ষে ছিল। সরকার বল প্রয়োগ করে জনমত দমন করতে চেয়েছে। আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের লেলিয়ে দিয়েছে। অনেকের উপর নির্যাতন হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারে কাছেও যায়নি সরকার। সকল রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী গোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় বা বৈঠক করা দূরে থাক -নিজেদের জোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গেও তারা আলোচনা করেনি। এমনকি আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারকদের কোনো বৈঠক হয়েছে -এমন খবর পাইনি। সর্বময় ক্ষমতার অধিাকারী প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছে, তাই তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন।

আন্দোলনে সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে সরকারপন্থী বহু মানুষ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং বামপন্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও আন্দোলনের ব্যপকতা এবং বিএনপি, জামাত ও শিবিরের সক্রিয়তা দেখে সরকারের মধ্যে ধারণা হয়েছিল, এরা যেভাবেই হোক সরকারকে বিপাকে ফেলতে চায়। সরকারের এই ধারণা অমুলক ছিলনা। আন্দোলনকারী অনেকের মধ্যে মিথ্যা গুজব তৈরি, নাশকতা এবং দাবি আদায়ের চেয়ে পরিস্থিতি তৈরির প্রবণতা সুস্পষ্ট ছিল।

আন্দোলনের প্রভাব কি হবে এবং কোটা ব্যবস্থাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যেতে চায় –সে ব্যাপারে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নিজেদের কোনো স্টাডি ছিলনা। তাদের নেতাকর্মীরা চোখ বন্ধকরে আগুনে ফু দিয়ে গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু কি রকম সংস্কার দরকার তার কোনো রুপরেখা দিলেন না। কোটা ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কই? তারা কি কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তি চেয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বাজার অর্থনীতির স্রোতে গা ভাসিয়েছেন।

কেমন কোটা চাই?
দুর্বল ও অবহেলিতের স্বার্থ রক্ষা এবং জাতীয় সমতার নীতি সমুন্নত রাখার জন্যই কোটা পদ্ধতি বহাল রাখা অনিবার্য। দেশের পিছিয়ে পরা সকল জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে বিদ্যমান কোটাসমূহ সংস্কার করা দরকার। ১০০% কোটা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা দরকার। সরকারি চাকরির সিস্টেমটা পুরোপুরি ভাগ করে দেওয়া দরকার – যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়। একটি বৈষম্যের সমাজে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রেহাই দিতে হলে এবং সমভাবে অগ্রগতির সুযোগ দিতে হলে, রাষ্ট্রীয় সকল সুবিধা মানবিক ও প্রগতিশীল বিচারবোধ থেকে শতভাগ বন্টনের ব্যবস্থা করা উচিৎ।

প্রথমত: নারী কোটা। দেশের নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিতে সমঅধিকার পায় না। এ কারণে তারা অর্থনৈতিকভাবে এখনো পুরুষের উপর নির্ভরশীল। নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে একটি সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা বড় অন্তরায়। সম্পত্তিতে সম-অধিকার দিতে না পারেন, অন্তত: কর্মক্ষেত্রে তাদের সম-অধিকার দিন। নারীরা এগিয়ে যাক। এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নারীর অবস্থান ১০ শতাংশের বেশি হবে বলে মনে হয় না। চাকরিতে নারী ও পুরুষের অনুপাত সমান করতে হলে নারী কোটা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা দরকার। নারীদের শিক্ষার হার বেড়েছে। সুতরাং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবং ব্যত্যয়ের সুযোগ রেখে সরকারী চাকরির ৫০ শতাংশ নারীর জন্য এবং ৫০ শতাংশ পুরুষের জন্য সংরক্ষিত করুন। দেশটার সুষম অগ্রগতি হোক।

দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত কমছে। বিভিন্ন জরিপে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দেশের অন্তত: ১২ শতাংশ জনগোষ্ঠী হিন্দু। এছাড়াও বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান এবং আদিবাসী বিভিন্ন গোষ্ঠীর আলাদা ধর্মমত আছে। অথচ সরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশ সংখালঘু নেই। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে এসব মানুষ বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়। সমতল ও পাহাড়ে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংকটগ্রস্ত। বর্তমান বাস্তবতায় সংখালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ২৫ শতাংশ চাকরি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ রেখে ৭০ শতাংশ চাকরি সংখাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ করা উচিৎ। তবে কেউ প্রচলিত কোনো ধর্মেই বিশ্বাস না করতে চাইলে তাকে বাধ্য করা যাবে না। বাকি ৫ শতাংশ কোটায় তারা সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারবেন। এ রকম কোনো আবেদনকারী না থাকলে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যে কোনো সম্প্রদায়ের ব্যক্তি সেই কোটায় চাকরিতে নিযুক্ত হবেন।

ধনি ও দরিদ্রের কোটা সুস্পষ্ট করা দরকার। ধনি ব্যক্তিদের সরকারি চাকরির প্রয়োজন কি? যারা বেশি টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদের উন্নত বা বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন তাদের চাকরির দরকার কি? রাষ্ট্র চাকরির অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের জন্য। চাকরিতে আবেদনের সময় পরিবারের ও ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। নিজের ও পিতা-মাতার আয়কর সনদ সংযুক্ত করতে হবে। চাকরির জন্য দুষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে চারিত্রিক সনদ নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। জীবনের মূল ধারায় এদের সম্পৃক্ত করতে হলে তাদের জন্য চাকরির কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। যারা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে গণিকাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের পুন:বাসনের সুযোগ দেয়া দরকার। মেথর, মুচি, ডোমসহ সমাজের অন্তজ জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতদের জন্য আলাদা কোটা দরকার। কাজের পছন্দ বা অপছন্দ কোনো ব্যক্তির জন্মের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া বিষয় নয়। অন্য কর্মের যোগ্যতা থাকলেও তাকে ময়লা টানতে হবে – বিজ্ঞানী, দার্শনিক, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না – এটা হয়না। শুধু জন্মের কারণে বৈষম্য প্রদর্শন করা দেশের সংবিধান সমর্থন করেনা। এটা চরম অন্যায়; ভয়ঙ্কর বর্ণবাদ।

এরপর মুক্তিযোদ্ধা কোটা। পশ্চাদপদ গোষ্ঠীধারণার সাথে মুক্তিযোদ্ধা কোটা যায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ মুলত একটি সংরক্ষিত privilege। রাস্ট্র ও সমাজের প্রতি বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কাউকে প্রিভিলেজ ও সম্মান দেওয়া যেতেই পারে। তবে এই প্রিভিলেজ কিভাবে দেবেন, কতবার দেবেন – সেটা আলাদাভাবেও ভাবা যেতে পারে।

ইতিবাচক পক্ষপাত
আসুন মানবতাকে সমুন্নত রাখার জন্য চাকরি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পক্ষপাত (affirmative discrimination) করি। ১০০ টি পদের বিপরিতে ৫০০০ আবেদন পড়েছে। এদের মধ্যে যোগ্যতম ২০০ জনকে আমরা নির্বাচিত করব। এই ২০০ জনের সবাই যোগ্য হলেও তাদের সবাইকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ নেই। এই পর্যায়ে ইতিবাচক পক্ষপাতের পন্থা নিতে হবে। ২০০ জনের মধ্যে চাকরির প্রয়োজনটা কার সবচেয়ে বেশি? তাকে আগে বেঁছে নিতে হবে? তার সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। এজন্য সংরক্ষিত কোটা ব্যবস্থা দরকার।

হ্যা, চাকরিটা যদি ডাক্তারের হয়, তাহলে এ ধরণের কোনো বিবেচনা অগ্রাধিকার পাবে না। মেধা তালিকায় যে সবার উপরে, সেই নিয়োগ পাবে। চাকরি যদি বিজ্ঞান গবেষণার হয়, তাহলে মেধা তালিকায় যে এক নম্বর, তাকেই নিয়োগ দিতে হবে। অন্যান্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা আগে, তারপর সিরিয়াল বিবেচনা। কোটা বাতিল নয়; প্রগতিশীল সংস্কার দরকার।