অনুবাদ- বিকাশ মজুমদার

মূল প্রবন্ধ
প্রথম পর্ব ।। দ্বিতীয় পর্ব

আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা এবং আনসার আল-ইসলামের ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মধ্যেই সন্ত্রাসের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেটের মনে হলো ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের পদচারণা বাড়ানোর এইতো উপযুক্ত সময় এবং সুযোগ। সিরিয়া এবং ইরাকে ঘোষিত তথাকথিত খেলাফত মেনে নিয়ে ২০১৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের একদল অজ্ঞাত নাগরিক ইসলামিক স্টেটের আনুগত্য স্বীকার করে। তারা ইসলামিক স্টেটের প্রধান নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে বাঙালি মুসলমানদের একত্রিত করে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার শপথ নেয়।

সৌদিআরব আর বাঙালি সাংস্কৃতিক চিড়ে চ্যাপটায় আটকা পড়ে ইতিমধ্যেই ধর্মান্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের মুসলিম সমাজকে ইসলামিক স্টেট নৃশংস আদর্শে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়। সুপরিকল্পিত এবং বিস্তৃত প্রচার মাধ্যমের কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং হত্যাকাণ্ডে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সিরিয়া এবং ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইসলামিক স্টেটে যোগদিলে সাংস্কৃতিক হীনমন্যতায় ভোগা বাঙালি মুসলমান জিহাদি জোশে জেগে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইসলামিক স্টেটের জন্য কর্মী সংগ্রহের দায়ে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান। ক্রমাগত কয়েকজন সন্দেহভাজন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গী এবং জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকারী গ্রেফতার হয় যাদের সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়ত উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) সদস্য। সরকার বালিতে মাথা গুঁজে মরুঝড় অস্বীকার করলেও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় ইসলামিক স্টেট আগমনের শক্তিশালী বার্তা।

ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য জেএমবির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের থেকে সহায়তা পায় এবং তার বিনিময়ে ইসলামিক স্টেটের নিয়মিত প্রকাশনা ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনে প্রকাশ করে জেএমবির ফাঁসির সাজাপ্রাপ্তদের উচ্ছসিত প্রশংসা। জাদুর মত কাজ হয় এই প্রকাশনায়। একই সাথে আমাদের জানতে হবে, ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশের ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর ইসলামিক আন্দোলনের কঠোর সমালোচক। কারণ তারা ইসলামকে সংস্কারের নামে আধুনিকায়ন, নমনীয় এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের জন্য দায়ী করে।

আনসার আল-ইসলাম যখন প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে নিশানা নির্ধারণ করে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে দেশব্যাপী ক্রমাগত ত্রাস সৃষ্টি করে ঠিক তখন ইসলামিক স্টেটের নৈরাজ্যের ঢেউ শুরু হয়। ২০১৫ সালে ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশের আত্মস্বীকৃত এবং স্বঘোষিত জঙ্গী সদস্যদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় শিয়া, বিদেশী নাগরিক, এবং অমুসলিম নাগরিকদের উপাসনালয়। আঘাত হানা হয় ইসলামিক স্টেটের মৌলিক আদর্শ ও নীতিমালা অনুসারে। তারা আল-কায়েদার মত ছুরি চাপাতি ব্যবহার না করে বরং বন্দুক এবং বোমা দিয়ে আঘাত করে মুসলিমদের শিয়া এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।

বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের উপস্থিতি বিষয়ে সরকারের রহস্যজনক ঘোলাটে আচরণ, স্বচ্ছতার অভাব এবং ইসলামিক স্টেটের হামলাকে অস্বীকার করার কারণে বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বাড়তেই থাকে। কিন্তু যেহেতু সরকার স্বীকার করে না সেহেতু কারা শিয়া মতাবলম্বী মুসলিম, আহমদিয়া বিদেশী নাগরিক বা অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা সাক্ষম হামলা চালাচ্ছে সেটা নির্দিষ্ট করা কঠিন। সেই সুযোগে ইসলামিক স্টেট নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়। তবুও নিরাপত্তাবাহিনী কয়েকটি হামলার পিছনে জুন্দ আল-তাওহীদ ওয়াল খলিফা (জেটিকে) নামের জঙ্গীদল কলকাঠি নাড়ে সেটা ঠিকই বুঝতে পারে। যদিও নব্য গঠিত এই জঙ্গীদলের সম্পর্কে বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনী তেমন কিছুই জানে না। তবে নিরাপত্তাবাহিনী মনে করে জুন্দ আল-তাওহীদ ওয়াল-খলিফা দলটি বাংলাদেশের কিছু নাগরিককে সিরিয়ায় যুদ্ধের জন্য পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনী ২০১৫ সালের মে মাসে সাবেক জেএমবির উচ্চ পর্যায়ের নেতা বর্তমানে জুন্দ আল-তাওহীদ ওয়াল খলিফা দলে কাজ করা আমিনুল ইসলাম বেগকে গ্রেফতার করে এবং সন্দেহ করা হচ্ছে সে ২০ জন সাবেক জেএমবি সদস্যকে সাথে নিয়ে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যুদ্ধ করেছে।

২০১৪ সালের অক্টোবরে সন্দেহভাজন জুন্দ আল-তাওহীদ ওয়াল খলিফা (জেটিকে) এক ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের মুসলিম নাগরিকদেরকে আবু বকর আল-বাগদাদিকে সমর্থন দিয়ে ইসলামিক স্টেটের পক্ষে জিহাদের আহ্বান জানায় এবং জিহাদের উদ্দেশ্যে সংগঠনটিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে বলে। হতে পারে জেটিকে হলো ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশি ‘খলিফার’ সৈন্যদল। ইসলামিক স্টেটের ম্যাগাজিন ‘দাবিকে’ দাবী করা হয় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সব সন্ত্রাসী হামলার পিছনে ইসলামিক স্টেটের হাত রয়েছে।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে ইসলামিক স্টেট প্রথমবারের মত বাংলাদেশে সন্ত্রাসী আক্রমণের দাবী করে। এক দায় স্বীকারোক্তিমূলক ঘোষণায় বলা হয় ইসলামিক স্টেটের ‘বাংলাদেশে খেলাফতের সৈন্য’ দুইজন বন্দুকধারী ঢাকায় ইটালির নাগরিক এনজিও কর্মী জিসার তাভেলাকে গুলি করে হত্যা করেছে। একই বছরের ৩রা অক্টোবর ইসলামিক স্টেট দাবী করে রংপুরে তারা গুলি করে হত্যা করেছে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও।

২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ইসলামের ভিন্নমতাবলম্বী শিয়া, আহমদিয়া এবং ভিন্নধর্মীদের লক্ষ্য করে ক্রমাগত হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ইসলামিক স্টেটের সমর্থক জঙ্গীগোষ্ঠী ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের বিখ্যাত মসজিদ হোসেনি দালান, বগুড়ায় শিয়া মসজিদ এবং রাজশাহীর বাগমারায় চকপাড়া আহমদিয়া জামাত মসজিদে আত্মঘাতি বোমা হামলা ছালায়। শিয়া এবং আহমাদিয়া মসজিদে হামলার সাথে সাথে ইসলামিক স্টেট হামলার দায় স্বীকার করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামিক স্টেট হামলা পরিচালনার খুঁটিনাটি জানিয়ে দেয় এবং জিহাদীদের নাম প্রকাশ করে।

ইসলামিক স্টেট প্রভাবিত বাংলাদেশি জিহাদি জঙ্গীদল অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে একের পর কে হত্যা করতে থাকে। ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর তারা খুন করে ফেইথ বাইবেল চার্চের পালক লুক সরকারকে, ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর বন্দুকধারী জঙ্গীদের হাতে খুন হন ইটালির নাগরিক ডাক্তার এবং খ্রিস্টান পাদ্রি পিয়েরো পারোলারি। ৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ তারিখে ইসলামিক স্টেটের ভাবাদর্শে দীক্ষিত জিহাদি জঙ্গীদল দিনাজপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের কান্তজীউ মন্দিরে হামলা করে। হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানদেরকে লক্ষ্য করে এইসব ক্রমাগত হামলার জন্য বাংলাদেশ সরকার জেএমবিকে দায়ী করে বাংলাদেশ সরকার এবং একই সাথে হামলার পিছনে বিদেশী জিহাদি বা আন্তর্জাতিক কোন জিহাদি সংগঠনের অস্তিত্ব বা তাদের ভূমিকা নাকচ করে দেয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, জেএমবি বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের নামে নিজেরা আবার সংগঠিত হয়।

২০১৫ সালের নভেম্বরে ইসলামিক স্টেট ঘোষণা দেয় তারা বাংলাদেশে তাদের স্থানীয় নেতার নাম প্রকাশ করতে যাচ্ছে যে ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশ অংশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং দেশটিতে ইসলামিক স্টেটের স্বরূপ তুলে ধরতে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করবে। ইসলামিক স্টেট দাবী করে চলতি বছরে তারা হামলার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করবে। তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামিক স্টেট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে খুন করে। খুনের তালিকায় একে একে যোগ হতে থাকে নিখিল জোয়ারদার নামের একজন হিন্দু দর্জি, খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হোসেন আলি নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা, আব্দুল রাজ্জাক, ছমির উদ্দিন মন্ডল, সানোয়ার হোসাইন নামের একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এবং যোজ্ঞেশ্বর অধিকারী নামের একজন হিন্দু পুরোহিত।

এমনকি বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনী নিশ্চিত নয় আসলেই ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশে স্থানীয় জঙ্গীদলের সাথে আদৌ কোন সরাসরি নির্দেশনা আছে কীনা বা তাদের ইসলামিক স্টেটের নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তারা পরিচালিত হয় কীনা। এমনকি ঢাকা এবং রাকার মাঝে যোগাযোগের ধরণ কেমন সেটাও পরিষ্কার নয়। তবে এটা নিশ্চিত যে, স্থানীয় জিহাদি জঙ্গীদল হামলাগুলো পরিচালনা করেছে এবং নিজেদেরকে ইসলামিক স্টেট পরিচয় দেয়ার জন্য আগ্রাসীভাবে হামলা করেছে।

ইসলামিক স্টেটের গণমাধ্যম বিভাগ বাংলাদেশে তাদের প্রচারণার জন্য সব ধরণের পন্থা অবলম্বন করে। তাদের ম্যাগাজিন ‘দাবিক’ এর এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় “বাংলাদেশের মুসলিম জনতা আবু বকর আল-বাগদাদির খেলাফতকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশে খলিফার সৈনিকদের একত্রিত করতে তাদের মাঝে পদ বন্টন হয়েছে। তাদেরকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করতে হবে”। ইসলামিক স্টেটের গণমাধ্যম বিভাগ জিহাদি কার্যক্রম, জিহাদি ভাষণ বাংলা ভাষায় প্রচার করার জোর দাবী জানায়।

ইসলামিক স্টেটের সাম্প্রতিক সংখ্যায় দাবী করা হয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক ইসলামিক স্টেটের পক্ষে সিরিয়া এবং ইরাকে যুদ্ধ করছে এবং বাংলাদেশে ক্রমেই বাড়ছে তাদের উপস্থিতি। বাংলাদেশে তারা নিজেদেরকে খেলাফতের সৈনিক হিসেবে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশের আরও জিহাদিকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে দাবিকের এপ্রিল সংখ্যায় বাংলাদেশের আইএস যোদ্ধা আবু জান্দাল আল বাঙ্গালী ওরফে আশেকুর রহমান সিরিয়ার রাকাতে কাফেরদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হওয়ায় তার জন্য শোকগাঁথা ছাপায়।


[ ছবি- ইসলামি খেলাফতের সম্ভাব্য বাংলাদেশি সৈনিক (দাবিক) ]

দাবিকের একই সংখ্যায় ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ শাখার আমিরের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়। ছবিতে অনুপস্থিত ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ শাখার আমির শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে অতি চমকপ্রদভাবে খুঁটিনাটি তথ্য এবং বিশদ পরিকল্পনা প্রকাশ করে। যদিও কিছু দাবী করা হয়েছে আবু হানিফের নিজ দ্বায়িত্বে এবং নিজেরদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। আবু হানিফ দাবী করে তাদের জিহাদি দলটি ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের আইসিসে অন্তর্ভুক্ত করেছে তাদের প্রায় সবাই জামায়াতে ইসলামির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। আবু হানিফ বাংলাদেশ এবং ভারতের কিছু অংশ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করে এবং এখান থেকেই প্রতিবেশী ভারত এবং মায়ানমারে জিহাদ পরিচালনার আহ্বান জানায়। আবু হানিফ আরও জানায়, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ইসলামিক খেলাফতের সৈনিক এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ইসলামিক স্টেট উইলিয়াত খোরাসানের যৌথ উদ্যোগে সাবেক তালিবান নেতা হাফিজ সাঈদ খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে। মনে করা হচ্ছে আল-কায়েদার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে শুরু হলো ইসলামিক স্টেটের নতুন পদচারণা।

মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সুন্নি মুসলিম বিভাজন কাজে লাগিয়ে নৈরাজ্য এবং সন্ত্রাস কায়েমের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা বাড়ানো ইসলামিক স্টেটের রণনীতি। ঠিক একইভাবে আবু হানিফ ঘোষণা দেয় ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশ শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সংখ্যালঘু জনগণকে লক্ষ্য করে আক্রমণ পরিচালনা করবে। কারণ হিসেবে আবু হানিফ বলছে, হিন্দুরা বাংলাদেশের প্রশাসনের উঁচু পর্যায়ে অবস্থান করে আছে এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। হিন্দুদের লক্ষ্য করে যদি গণহারে হত্যা না করা যায় তাহলে বাংলাদেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে গুড়ে বালি। সেজন্য এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে মুমিন এবং নাস্তিক বিভাজন করতে হবে এবং ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী এবং বিধর্মী নাস্তিকদের মাঝে মেরুকরণ করতে পারলে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা অনেক সহজ। মে মাসের শুরুতে সিঙ্গাপুরে ৮ জন বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেফতার হলে বাংলাদেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে যায়। পুলিশি তদন্তে জানা যায় আটককৃত বাংলাদেশি নাগরিকরা সিঙ্গাপুরে বসে ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ গঠন করে এবং পরিকল্পনা করে কীভাবে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলা চালানো যায়। একই বছর জানুয়ারিতে ইয়েমেন বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক উগ্রপন্থী ওয়াহাবী ইসলামের তাত্ত্বিকগুরু আনোয়ার আল-আওলাকির মতাদর্শ অনুসরণের দায়ে সিঙ্গাপুর সরকার ২৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। সিঙ্গাপুরের পুলিশ সন্দেহ করে উক্ত বাংলাদেশী নাগরিকরা আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের উগ্র মতবাদের অনুসারী।

অবাক করা ব্যাপার হলো, সিঙ্গাপুর থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি নাগরিকরা বিশ্বের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জিহাদি জঙ্গীগোষ্ঠি আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট উভয়কেই সমর্থন করে এবং তাদের মাঝে কোন বিভেদের দেয়াল নেই। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এই দুই জিহাদি সংগঠনের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। পরিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সব ইসলামিক জিহাদি জঙ্গীদলগুলো আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট উভয়কেই তাদের আদর্শিক অবস্থান থেকে সমর্থন জানায় কারণ উভয়েই মুসলিম উম্মাহর জন্য কাজ করছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাবেক সদস্য এবং আত্মস্বীকৃত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গী আবদুল্লাহ গালিব ২০১৫ সালের মে মাসে গ্রেফতার হয়। সন্দেহ করা হয় আবদুল্লাহ গালিব জুন্দ আত-তাওহীদ-ওয়াল-খলিফা (জেটিকে) এবং ইসলামিক স্টেটের পক্ষে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করে। গ্রেফতার হওয়ার সময় তার বাসা থেকে আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের জিহাদি বই পাওয়া যায়।

উপসংহার

জঙ্গীদলগুলো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংঘাতকে পুঁজি করে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী আক্রমণকে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ আস্তে আস্তে পরিণত হয়েছে অসহিষ্ণু ভূখন্ডে। লাখ লাখ ইসলামপন্থী বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতাকে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। সাংস্কৃতিক বিরোধের জেরে জিহাদের বারুদ আগে থেকেই ছড়ানো ছিল আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট সেই বারুদে পেট্রোল ঢেলে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ফলাফল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি অতীব ভীতিকর অন্ধকার কারণ বিশেষ করে সরকার যখন আন্তর্জাতিক জঙ্গীদলের উপস্থিতিকে স্বীকার করে না।

যদিও বিশ্বের অন্যান্য জিহাদ আক্রান্ত অঞ্চলে আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট পারস্পারিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং টিকে থাকার লড়াইয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত কিন্তু বাংলাদেশে তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বর্তমানে বাংলাদেশের ইসলামিক জঙ্গীদলগুলোর কাছে ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়েদার মধ্যে খুব বেশি বিরোধ নেই।

পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে প্রমাণিত হয় আফগানিস্তান ফেরত জিহাদিরা আল-কায়েদার অনুগত এবং তারা ওসামা বিন লাদেনকে সমর্থন করে। তারা আল-কায়েদার নীতিমালা এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। আশ্চর্যজনকভাবে তারাই আবার আবু বকর আল-বাগদাদির সাহস, জিহাদের অভিনব উপায় এবং ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রশংসা করে। এটা খুবই আশঙ্কাজনক যে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আল-কায়েদা আর ইসলামিক স্টেটের মিশ্রণে এক নতুন ধরণের বৈশ্বিক জিহাদি দলে জন্ম হবে আর সেই বাতাস এসে লাগবে স্থানীয় জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর জিহাদি পালে।