লিখেছেন: জীবন

চলমান সভ্যতার, বহতা সময়ের দেয়ালে দেয়ালে গ্রন্থিত ইতিহাসে আস্থা রেখে যদি বলি যে, আগুনের আর্বিভাব, সভ্যতার ক্রমধারায় প্রথম পদচিহ্ন এঁকে দেয়, তা’হলে সে পথে “ভাষা”-র আর্বিভাব-আবিষ্কার-প্রয়োগ হবে নিশ্চিতভাবেই মধ্যম। পরবর্তীতে অক্ষর-শব্দ-বাক্যের উদ্ভব-বুৎপত্তি-উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে আমরা সভ্যতার-ভব্যতার আচারিক অবয়ব প্রাপ্ত হই। তবে বিবর্তনের এই ধারা চলমান এবং চলছে। যে, কারণে ভবিষ্যৎ-ও এই ধারাকে অগ্রাহ্য করতে পারবেনা। তা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু এই মুহুর্তের সময়কে স্থির রেখে যদি, দৃঢ়তার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বলি যে, “ভাষা”-র শরীর বেয়েই আমরা বর্তমানের সভ্যতায় আছি কিংবা সভ্যতার “পূর্ণতা” প্রাপ্তি ঘটেছে, তা, বোধহয় অন্যায় হবেনা। তবে, হ্যাঁ এর সাথে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা-শিল্পবিল্পব-যন্ত্রবিপ্লবকেও সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে মানুষ। কিন্তু, সময়ের হিসেবে তা অনেক পড়ে।

“পূর্ণতা” কিংবা “সভ্যতা”-র মাত্রা-পর্যায় নিয়ে বির্তক আছে, থাকাটাও স্বাভাবিক। এটাও নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আগামিও এই বির্তক বহন করবে। কেননা, মানুষ-মনুষ্যত্ব-সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব, কতটুকু সভ্য-ভব্য-বিজ্ঞ-সজ্জ্বন-মানবিক-সহনশীল হলে সভ্যতার পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে বা ঘটবে, তা সহজ-সরলভাবে বলা বোধহয় বেশ কঠিনই। এই বিন্দুতে ই-প্রত্যয়টা বেশ ভারী মনে হচ্ছে-এই কারণে যে, আজকের পৃথিবীও ভাষা-ধর্ম-গোত্র-বার্ণিক-সম্প্রদায় ভেদ-প্রভেদ-দ্বেষ-দ্বেষণা-বিদ্বেষ হতে মুক্ত হতে পারেনি, বরঞ্চ বলা যায় যে, আশংকাজনকভাবে তা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে। ভাষার আবিষ্কার-প্রয়োগ যে সঞ্জিবনী-মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি হিসেবে গুহাবাসী বণ্যমানুষকে পশুচার থেকে প্রথম মানুষের পর্যায়ে নিয়ে আসে, তা আজকে ভেদ-প্রভেদের, মায়ায়-কায়ায় অনেকটাই ম্রিয়মান।

যতদূর জানা যায়, “বেদ” যখন আর্যদের মুখাশ্রিত বাক্যের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে আসে, তখন ভাষার অস্তিত্ব থাকলেও গ্রন্থন-লেখনযোগ্য বর্ণ-শব্দ-বাক্য আবিষ্কৃত হয়নি। যে কারণে “বেদ” গ্রন্থিত হয়েছে প্রায় 5/6 শত বছর পরে। মূলতঃ আর্যাশ্রিত কয়েকটি প্রজন্ম বেদ’কে স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছেন বছরের পর বছর। স্মৃতি থেকে গ্রন্থিত হওয়ায় বেদ’কে “স্মৃতিগ্রন্থ”-ও বলা হয়ে থাকে। এই ভেবে ভাবনায় ধাক্কা দেয় যে, ঐ সময়ে পৃথিবীতে অক্ষর-শব্দ-বাক্য অনুপস্থিত থাকলে আজন্ম নাক উঁচু আয ভাষা ভাষীদের উত্তরাধিকার হিসেবে দাবীকৃত ব্রাহ্মণ্যকূলের কি হতো। অনুরূপভাবে ‘কোরআন’বা অন্য সকল ধর্মগ্রন্থসমূহ নাজিলকালে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন কোন মানুষের অনুপস্থিতি ঘটলে কি অবস্থা হত ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ গুলোর তা কেবল তিনিই জানেন। কাজেই ধর্মের আর্বিভাব-স্থিতি-মহত্বেও ভাষার অবদান অগ্রগণ্য।

এ পর্যায়ে দেখা যাক, বিশিষ্ট গবেষক-লেখক জনাব গোলাম মুরশিদ তাঁর “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” গ্রন্থে “সংস্কৃতি” সম্পর্কে কিরুপ ধারণা-ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছেন:

“গ্রীক রাজা মিলিন্দ গিয়েছিলেন বৌদ্ধাচার্য নাগসেনের সঙ্গে দেখা করতে। নাগসেন মিলিন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন “মহারাজ, আপনি রথে চড়ে এসেছেন। কিন্তু রথ কী “ জবাবে রাজা বললেন, রথ হলো চাকা-লাগানো শকট, যা ঘোড়ায় টেনে নিয়ে যায়। ঋষি জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে ঘোড়া কী রথ? রাজা বললেন না। তবে চাকাগুলো কি রথ? ইত্যাদি। রথের সংজ্ঞা দেওয়াই যদি এতো কঠিন হয়, তা হলে সংস্কৃতির সংজ্ঞা দেওয়া অসম্ভব মনে হতে পারে। সত্যি বলতে কি, সমাজতাত্বিকরা সংস্কৃতির যেসব সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা মোটেই সরল বা সহজ নয়। এমনটি, কোন একটি, কি দুটি জিনিশ দিয়ে তা তৈরিও হয়নি। সংস্কৃতি অতি জটিল একটি ধারণা। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এডওয়ার্ড টেইলর সংস্কৃতির যে-সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, তা বিবেচিত হয় ধ্রুপদী সংজ্ঞা বলে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ এবং জ্ঞানের একটি সমন্বিত প্যার্টানকে বলা হয় সংস্কৃতি। ভাষা, সাহিত্য, ধারণা, ধর্ম ও বিশ্বাস; রীতিনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়মকানুন; উৎসব ও পার্বণ; শিল্পকর্ম এবং প্রতিদিনের কাজে লাগে এমন হাতিয়ার ইত্যাদি সব নিয়েই সংস্কৃতি……………।”

উপরের বিদগ্ধ উদ্ধৃতিতে আস্থা আছে বলেই লেখায় তাঁকে টেনে এনেছি। বিশ্লেষনে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে-সংস্কৃতি যদি হয়, শিকড়-পত্র-পল্লব-কান্ড-শাখা-প্রশাখা-পুষ্প শোভিত কোন “বৃক্ষ”, তবে “ভাষা” হবে নিছকই ক্ষুদ্র অংশীজন। কিন্তু, এরপরও খুব মানতে ইচ্ছে করে যে, ভাষা-বর্ণ-শব্দ-বাক্যের উদ্ভব-বুৎপত্তি-উৎকর্ষতার মাধ্যমেই সংস্কৃতি বৃক্ষ ঋদ্ধ হয়েছে এবং নিশ্চিতভাবে অনেকাংশেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হয়েছে। অনেকটা এমন যে, কুমোর কর্তৃক নির্মিত দূর্গা মূর্তি আপাত নয়নের মুগ্ধতা মেটালেও, পুরোহিত যতক্ষন পর্যন্ত না মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার আহাম্মকি চেষ্টাদি সম্পন্ন না করেন ততক্ষণ পর্যন্ত মূর্তিটি “মা দূর্গা” হয়ে ওঠেনা । কিংবা বলা যায় যে, ভক্তের ভাবনায়-হৃদয়ে ভক্তির স্থান পায়না।

পৃথিবীর সকল ভাষাই মাতৃভাষা। তবে, এটাও ঠিক যে, সকল দেশের “সংস্কৃতিবৃক্ষ” ভাষার অধীন নয়। ঠিক এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে প্রতিটি বাঙালি আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলতে পারেন যে, আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, ভাষার অধীন। তবুও, কিন্তু-ব্যতিক্রম থেকে যায়, তাইতো বিজ্ঞজনের উক্তি-বাঙালি হিন্দু-মুসলমান শিক্ষিত হয়ে হিন্দু-মুসলমান হয়েছে, কেও বাঙালি থাকেনি। এস্থলে বলে নেয়া উচিত হবে যে, পৃথিবীর কোন ভাষাই শতভাগ মৌলিক নয়। যেহেতু, ভাষা সীমানাবদ্ধ কোন বস্তু-উপাদান-উপাচার নয়, সেহেতু, এস্থলে আদান-প্রদান বেশ স্বাভাবিক। তবে, রক্ত দিয়ে কেও ভাষার স্বাধীনতা-স্বাদ-গন্ধ-ভালোবাসার অধিকার অর্জন করেছে, এমনটি কিন্তু বিরল। একজন লোকও যদি, কোন একটি ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করে তবুও সে ভাষাটি উক্ত ব্যক্তির কাছে আপনার চেয়েও আপন। কাজেই প্রতিটি ভাষা শ্রদ্ধা-সম্মান প্রাপ্তির দাবী রাখে। তবে কখনো যদি ভাবনায়-চিন্তায়-মননে ভাষার পবিত্রতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয় ?

বাংলা যেমন একটি ভাষা। আরবি, সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দি, উর্দূ, ইংরেজিও তেমনি একটি ভাষা মাত্র। শুধু তাই নয়, ভাষার মাধ্যমেই যেহেতু সংস্কৃতির আচারিক অবয়ব তৈরী হয় সেহেতু ভিন্ন ভাষা ভাষীদের সাংস্কৃতিক পার্থক্যও লক্ষনীয়। তবে, বিশেষ কোন ভাষায় বিশেষ কোন ধর্মের গ্রন্থ নাজিল-গ্রন্থিত হলে সে কিতাব-শ্রাস্ত্র-গ্রন্থের সঙ্গে সঙ্গে উক্ত বিশেষ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নিজ ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা-অবহেলায় নিয়ে উক্ত বিশেষ ভাষা ও সংস্কৃতিকে পবিত্রতার আসনে বসানো মানসিক বৈকল্য ভিন্ন কিছু নয়।

এই প্রসঙ্গে মধ্য যুগের বিখ্যাত বাঙালি কবি আব্দুল হাকিম (জন্ম: 1620খ্রিঃ, মৃত্যু: 1690) এবং তাঁর বঙ্গবানী কবিতাটি খুবই প্রাসঙ্গিক। উল্লেখ্য যে, কবি আব্দুল হাকিম ছিলেন একজন ধর্মপ্রান মুসলমান এবং মধ্য যুগে তিনি আরবী, ফার্সি, সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত হিসেবে গণ্য হতেন।

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হবিলাষ ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষা বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামত ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

আমি যে কথা গুলো ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে বলবার চেষ্টা করছি, সে কথাগুলো কত স্পষ্ট করে সেই মধ্য যুগে কবি আব্দুল হাকিম বলে গেছেন। তাও কতটা সহজ-সরল-আঞ্চলিকতার ভাষ্যে। ‘একুশ শতকের এইপাদে যখন বিজ্ঞান মঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন আমরা “উম্মাহ্” এবং “সেবাসংঘ” ভিত্তিক জাতিসত্ত্বায় সম্পৃক্ত হয়ে নিজেকে ধন্য-মান্য-পবিত্র করছি। যে কারণে বৈশাখ-হেমন্ত-বসন্ত এখন ছদ্মবেশী ভাওতা বাঙালিকে আর আলোড়িত করেনা। তবে, এরপরও এখনো কিছু মানুষ, কিছু ক্ষ্যাপাটে পাগল, বাংলা-বাঙালি-বাঙালিয়ানা-বৈশাখ-হেমন্ত-বসন্তকে হৃদয়ে-মননে-মানসে লালন করে-যত্ন করে-চর্চা করে-পালন করে। তাই আমরা এখনো সাহসের সাথে বলতে পারি- আমরা বাঙালি, আমরা ভাষার অধীন এবং ঋতু ভিত্তিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী’।