অনুবাদক: বিকাশ মজুমদার

মূল প্রবন্ধ

আমরা ইউরোপের রাস্তায় আইএস দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিশোর বালকদের দেখা পেয়েছিলাম। তাদের কাজকর্ম দেখে মনে হয় শিশুদেরকে খুনিতে পরিণত করা আইএস’র দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ।

সতর্কতা: সন্ত্রস্ততা-উদ্দীপক উপাদানের উপস্থিতি

মুতাসিম একটু বিচলিত। ১৬ বছরের এই বালক আগে কখনো বিমানে ভ্রমণ করেনি। এথেন্স বিমানবন্দরের বহির্গমণ পথে সে অপেক্ষারত অন্যান্য যাত্রীদের দিকে হতবিহ্বল চোখেতাকিয়ে দেখছে।

সে তার নিজের সম্পর্কেই নিশ্চিত না। তাই সে পাসপোর্টের মধ্যে বোর্ডিংপাস রেখে, অন্ধভাবে অন্যদেরকে অনুসরণ করে লাইনে দাঁড়িয়েছে। বিমান উড্ডয়নের সময় ঘনিয়ে এলো।সিরিয়ান বালকটি সদ্য শেখা কয়েকটা স্প্যানিশ বাক্য মুখস্ত করার জন্য তোতা পাখির মত আউড়ে যাচ্ছে যদি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে তাই।শুধু তাই নয়, সে ভুয়া স্প্যানিশ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করতে যাচ্ছে। এই ভুয়া পাসপোর্টের জন্য তার খরচ হয়েছে ৩০০০ ইউরো। সিরিয়া থেকে পালিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপ যাওয়ার জন্য আদম ব্যবসায়ীদের একটা দলের কাছ থেকে সে নকল পাসপোর্ট কিনেছে।

মাত্র একমাস আগেই সে ছিল রাকাতে। তথাকথিত ইসলামিক স্টেট খেলাফতের একজন দুর্ধর্ষজিহাদি সদস্য। হাসপাতালে অসুস্থ এবং আঘাতপ্রাপ্ত আইএস জিহাদিদেরকে সাহায্য করার জন্য এই কিশোর বালককে রাকা শহরের একটা হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তার আগে সে আইএস’র প্রচারণা দলে নিয়োজিত ছিল।

কিন্তু সেটা ছিল অন্যজীবন যা সে ভুলতে চায়। তীব্র সাইরেন বাজিয়ে বিমানহামলা, চিৎকার, শিরোশ্ছেদ সবকিছু সে পিছনে ফেলে আসছে। সবকিছুই গোপন রাখতে হবে। যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ খেলাফতের ‘সিংহের বাচ্চার’ জিহাদী প্রশিক্ষণের খবর খুঁজে না পায় তাহলে জার্মানিতে তার জন্য নতুন জীবন অপেক্ষা করছে। তথাকথিত ইসলামিক স্টেট ভেঙে পড়ছে। সিরিয়া, ইরাক এবং লিবিয়াতে তাদের দখলকৃত অঞ্চল একের পর এক হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার উচ্চাশা আসলে অবাস্তব। কিন্তু তারা ধারণা করেছিল, এমনকি আশাও করেছিল যে বিশ্বব্যপী ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাদের বিকল্প পরিকল্পনাও ছিল যেমন খেলাফতের হাত থেকে রাকা, শিরতে এবং মসুল হাতছাড়া হয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার জন্য কার্যকরী সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছিল।

আইএস’এ নিয়োগের আগে শিশুদেরকে প্রস্তুত করা হয়। তারপরে একজন শিশুকে জিহাদী বানানোর জন্য নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যারা বড় হয়ে জঙ্গী হবে। ইসলামী খেলাফতের পরবর্তী প্রজন্ম বড় হচ্ছে ঘৃণা শিখে। মুতাসিম বড় কোন যোদ্ধা না। সে উচ্চতায় খাটো এবং ভীতু প্রকৃতির। জার্মানির একটা গ্রামে আমি তার সাথে দেখা করি যেখানে সে এখন বাস করছে। সে দিব্যি ধূমপান করছে। সিরিয়া ছেড়ে চলে আসার পর আইএস যেসব কাজ নিষেধ করেছিল সেগুলোই সে এখন বেশি বেশি করে। এমনকি এত সকাল সকাল সে আমাকে বড় এক ক্যান বিয়ার সাধল। সে বলল, “সে নামাজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার ধর্মবিশ্বাস চলে গেছে।” আগে সে আইএস’র গৃহীত উগ্র সালাফি শিক্ষানীতি চর্চা করতো।

মুতাসিমের সাথে কুয়েন্টিনের কথোপকথনঃ
মুতাসিম আমাকে বলল, যৌথবাহিনীর বিমান হামলার পরে সে ধ্বংসস্তুপের ছবি তুলেছিল। আহতদের হাসপাতালে সাহায্য করেছিল এবং প্রকাশ্যে মানুষের শিরোশ্ছেদের চাক্ষুষ সাক্ষী।সে প্রাক সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ পেয়েছিল। প্রশিক্ষণে মুতাসিমের মাত্র ১৫ দিন সময় লেগেছিল অন্যদের ক্ষেত্রে যা অনেক দিন বেশি সময় লাগে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম খুবই শ্রমসাধ্য। শুরু হয় ভোর চারটায় ফজরের নামাজের পরে। প্রথমে শারীরিক কসরত এরপরে অস্ত্রশিক্ষা এবং সবশেষে শরিয়া আইনের ক্লাস।

কিশোরদের গাড়ির জ্বলন্ত চাকার উপর দিয়ে লাফ দেয়া,হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়া প্রশিক্ষণের অংশ। আর এই সময়ে তাদের মাথার উপর দিয়ে গোলাগুলির প্রশিক্ষণ চলত। দামাস্কের পূর্বাঞ্চল থেকে আগত মুতাসিমের ১৩ বছরের এক বন্ধুর প্রশিক্ষণের সময় মাথায় গুলি লাগে এবং মারা যায়। মুতাসিমের বয়স ১৬ বছর হওয়ার আগেই তার জীবনে এতকিছু ঘটে যায়।

[ আইএস’র প্রোপাগান্ডার ভিডিওচিত্র থেকে ]

আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে বহু সন্ত্রাসীগোষ্ঠী যুদ্ধের জন্য শিশুদের প্রশিক্ষণ দেয়। শিশুদেরকে যুদ্ধে নিয়োগ দেয়া যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু আইএস যুদ্ধক্ষেত্রে শিশুদের নিয়োগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক করে ফেলেছে।

যুদ্ধ বর্বর এবং নৃশংসকিন্তু আইএস সেই বর্বরতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং শাস্তির নিষ্ঠুরতা দেখানোর জন্য অধিকৃত অঞ্চলে আইএস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রোপাগান্ডা দল গঠন করেছে। পাঁচ বছরের বাচ্চা শিশুও সেখানে আইএস প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছে। রাকায় গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত একটা ভিডিওচিত্র বিবিসি’র হাতে চলে আসে। সেখানে দেখা যাচ্ছে অতিউৎসাহী একদল শিশু শহরের একটা খাঁচাকে ঘিরে ভীষণ উত্তেজিত। খাঁচায় বন্দী তাদের এক প্রতিবেশি মুদি দোকানদার। তার নাম সামির। \

খাঁচায়বন্দী মানুষঃ
শিশুরা খাঁচার কেন্দ্রে বসে থাকা বন্দী, মাথা সামনের দিকে নত হয়ে ঝুলে পড়া মানুষটির দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। একটা শিশু বন্দীর দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে মারলো। সামিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ সে একজন মুসলিম নারীকে যৌন হয়রানি করেছে। তার শাস্তি হলো সে চিড়িয়াখানার প্রাণিদের মত খাঁচায় বন্দী থেকে শিশুদের বিনোদনের খোরাক হবে। কিন্তু এই শিশুরা ইতিমধ্যে এত সস্তা আনন্দ অতিক্রম করে এসেছে। তারা এর থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখে এসেছে যেমন গলাকেটে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা।

কার্যসিদ্ধির জন্য জঙ্গীরা খুব কৌশলে কিশোরদের নিয়োগ দেয়। তারা কিশোরদের শুধু পরকালের পাপমুক্তি আর জান্নাতের লোভ দেখায় না বরং দুনিয়ার সম্পদের ব্যবস্থা করে দেয়। আইএস জঙ্গীদের সাথে জীবনযাপন কঠিন এবং বিপদসংকুল কিন্তু এর জন্য পুরষ্কারও কম কিছু নয়। যেমন, আইএস মুতাসিমকে একটা বউ এনে দিবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মাত্র ১৪ বছর ৬ মাসের মধ্যেই মুতাসিম বিয়ের জন্য উতলা হয়ে উঠল। যখন তার পরিবার এত অল্প বয়সে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন এগিয়ে আসে আইএস। আইএস মুতাসিমকে তাদের লোকদের সাথে থাকার অনুমতি দেয়, তাকে কিছু দায়িত্ব দেয়, গাড়ি চালানো শেখায় এবং একটা বঊ এনে দেবে প্রতিশ্রুতি দেয়। মুতাসিম বললো, “আইএস আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করত। মনে হতো আমি যেন রাজা আর তারা আমার ভৃত্য।”
মুতাসিম নিজের ইচ্ছায় আইএস এ যোগ দেয়। সে বলল, “আইএস এ যোগ দেয়া প্রায় ৭০% শিশু কিশোরই পারিবারিক কারণে এই মৃত্যু ফাঁদে পা দিয়েছে। শিশু-কিশোররা অনেক সময় আইএস জুজু পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করত। যেমন, হয় তাদের আবদার মেনে নাও অথবা তারা আইএস এ যোগ দেবে।”

যুদ্ধের মাত্রা বেড়ে গেলে রাকাতে মানুষের জীবন কঠিনতর হয়ে গেল। জিহাদিদের দ্বারা যখন ফ্রান্সের খেলার মাঠ আক্রান্ত হয় তখন রাকায় আমাদের চোখে ঘুম নেই। ফ্রান্স পুরো রাকা শহরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। নিরপরাধ মানুষ হত্যার জন্য আমার তখন খুব রাগ হয়েছিল। ২০১৫ সালের নভেম্বরে বিমানবাহী জাহাজ থেকে ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করে। একের পর এক বিমান হামলায় আমি শুনতে পেতাম শিশুদের কান্না আর সাহায্যের জন্য নারীদের চিৎকার। সেই দৃশ্য আমি জীবনে ভুলব না। মনে হচ্ছিল যেন হলিউডের মারদাঙ্গা সিনেমা দেখছি।

কিন্তু সময়ের ফেরে তার আইএস’র সুখস্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। মুতাসিম বলল, “শক্তিশালী এবং নির্ভিক যে যোদ্ধাদের সে পছন্দ করত তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গায় মোটেও সৎ ছিল না।”যখন দেখলাম একজন গুরুত্বপূর্ণ আইএস যোদ্ধা একজন নিরীহ নারীকে শারিরীকভাবে আঘাত করছে তখন আমি আইএস ত্যাগ করা সিদ্ধান্ত নিই। আমি যেন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। সে ছিল বিদেশি যোদ্ধা কিন্তু আঘাত করছে এক সিরিয়ান নারীকে। সেদিন থেকেই আইএস’র প্রতি আমার ঘৃণা শুরু হয়। আমার চার মাস সময় লেগেছিল আইএস নাগপাশ থেকে মুক্ত হত। মুতাসিম পুনরায় পরিবারের সাথে মিলিত হয়। অবশ্য পরিবার আগে থেকেই আইএস পরিত্যাগ করার জন্য বারবার অনুরোধ করে আসছিল। মুতাসিমের পরিবার আইএস থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্য চোরাকারবারিদেরকে টাকা দেয়।

তুর্কি/সিরিয়া সীমান্ত
যে মানবপাচারকারী মুতাসিমকে রাকা পার হতে সাহায্য করেছিল তার সাথে তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্তে দেখা করলাম।আবু জাসেনের বাড়ি রাকা এবং সে মুতাসিমদের পরিবারকে ভালভাবেই চেনে। সে ইতিমধ্যেই শত শত উদ্বাস্তু এবং আইএস থেকে পলাতকদের সীমান্ত পার করে দিয়েছে। কিন্তু সে কিভাবে জানে মুতাসিম আইএস’র সাথে সুসম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাচ্ছে? এই বিষয়ে মুতাসিমের পরিবারের ঘনিষ্টজনেরাআবু জাসেনকে আশ্বস্ত করেছে। সে জানালো, “মুতাসিম যদি একাকী আমার সাথে যোগাযোগ করত তাহলে হয়ত তাকে বিশ্বাস করতাম না। হতে পারে একটা মগজ আইএস দ্বারা ধোলাইকৃত বাচ্চা শিশুও আমার কাজের পরিধি সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরি করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে এই পরিবারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি।”

আবু জাসেনের সাথে কুয়েন্টিনের কথোপকথনঃ
রাকা এবং রাকার আশেপাশের চারিদিক এখন যুদ্ধক্ষেত্র। আইএস এবং যৌথবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে এবং সেখানে আছে অনেকগুলো তল্লাশিকেন্দ্র। পথে পথে অনেক ঝুঁকি তাই বিপদের সম্ভাবনাও প্রচুর। আইএস থেকে যদি কেউ পালাতে চায় তাহলে তার জেলের ভাত নিশ্চিত। ইতিপূর্বে যারা পালানোর চেষ্টা করেছে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। আবু জাসেন জানালো, ২০১৪ এবং ২০১৫ থেকে এখনকার পথ অনেক বিপদসংকুল। সীমান্তে পৌঁছাতে হলে প্রথমেই কুর্দিশ এবং আরবযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস’র মুখোমুখি হতে হবে। আইএস এ যোগ দেয়া সবার নামের তালিকা তাদের কাছে আছে এবং তারা আইএস সদস্যদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এরপরের দুঃসাধ্য কাজ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদ এবং আইএস বিরোধী ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল অতিক্রম করে যাওয়া। রাতের আঁধারে তুরস্ক সীমান্ত পার হয়ে যাচ্ছে মানুষ গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত এমন একটা ভিডিওচিত্র সম্প্রতি বিবিসি’র হাতে এসেছে। সেখানে দেখতে পাবো সীমান্ত পাড়ি দিতে মুতাসিমকে কী পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। নিরাপত্তা চৌকির পাহারার চোখে ধুলো দিয়ে, দিনের আলোর মত ফ্লাড লাইটকে আড়াল করে সিরিয়ান রিফিউজির দল তুরস্ক সীমান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

রাতের আঁধারে সিরিয়ানদের সীমান্ত পারঃ
মুতাসিম বলল, “তারা আমাদের মাথার উপর দিয়ে ফাঁকা গুলি বর্ষণ শুরু করে। যদিও তুরস্কের নিরাপত্তাবাহিনীকে মানুষ পাচার করে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা দেয়া হয়েছিল কিন্তু ভয়ের কোন কমতি ছিল না।”তারপরে গ্রীসে এবং সেখান থেকে এথেন্সের বাইরের এক বিমানবন্দর দিয়ে নকল পাসপোর্টে নিয়ে উড়াল। সে এখন জার্মানির একটা উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করে। একটা গাছের নিচে বসে মুতাসিম তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলছিল। এই দুঃসহ স্মৃতি সে জীবনেও ভুলতে পারবে না।

মুতাসিমের সাক্ষাতকার নিচ্ছেন কুয়েন্টিন

কুয়েন্টিনকে দেয়া মুতাসিমের সাক্ষাৎকারঃ
যখন কারো পৃথিবী সংঘাতময় হয়ে যায় তখন সেই বিরোধপূর্ণ সময়টাই সারাজীবনে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে যায়। মুতাসিম রাকাতে আইএস’র মর্গে কাজ করত। একদিন একটা লাশ স্প্রিং এর মত দাঁড়িয়ে গেল এবং তার পা জড়িয়ে ধরলো। আসলে সে ছিল আঘাত প্রাপ্ত একজন বেসামরিক মানুষ আইএস তাকে মৃত ঘোষণা করে মর্গে ফেলে দেয়। বাস্তবে সে এখনো একজন জীবিত মানুষ।
এখন আমি ওষুধ খাচ্ছি যাতে এই দুঃসহ স্মৃতি ভুলে যেতে পারি।

জার্মান কর্তৃপক্ষ মুতাসিমের অতীত জীবন জানে না। তারা জানে না আইএস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে পালিয়ে ইউরোপে আসার শ্বাসরুদ্ধকর ভ্রমণকাহিনী। মাত্র একমাসে বোধহয় জানাও সম্ভব না। শুধু তাই না, মুতাসিম একা ইউরোপে আসেনি। তার সমবয়সী এক কিশোর সিরিয়া এবং ইরাকের মসুলে ইসলামিক খেলাফতের খাদেম ছিল সে এখন বেলজিয়ামে উদ্বাস্তু শিবিরের পথে আছে।যারা আমার শত্রু ছিল, এখন আমি তাদের সাথে বাস করি।

ওমরের বয়স ১৭ বছর। কিন্তু খুব সহজেই তাকে আরো কম বয়সী বলে চালিয়ে দেয়া যায়। এছাড়া কেউ যদি তার চোখের দিকে তাকায় সেখানে দেখতে পাবে ক্লান্তি আর মৃত্যুভীতি।সে ভীষণ কঠিন প্রতিপক্ষের সাথে মোকাবিলা করেছে এবং কেউ তাকে আবার আইএস’র পক্ষে যুদ্ধে পাঠাতে পারে ভেবে উদ্ধত হয়ে আছে।

ওমর এখন বেলজিয়ামে বাস করছে এবং ইতিমধ্যে উশৃঙ্খলতার জন্য তিনটি রিফিউজি আশ্রয় শিবির থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। সে নিরপরাধ পথচারীকেও আক্রমণ করতে ছাড়ে না। মাসের পর মাস সময় নিয়ে তার আইএস জীবনের আদ্যপান্ত কাহিনী শুনলাম। সে অনেককিছু বাড়িয়ে বলত। এরমধ্যে প্রকাশ পেয়ে গেল সে কিভাবে আইএস জঙ্গীদের হাতে নিরুপায় ব্যবহৃত হয়েছে তার ছবি। ব্লুবেরি ফ্রুট বিয়ার খেতে খেতে সে আইএস’র গল্পের ঝুড়ি উন্মোচন করল। কিন্তু তার কিছু তথ্য মনগড়া এবং অতিমাত্রায় সতর্ক। সে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছেলে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সে বুঝতে পারে আইএস’এ তার যোগদান কত ভুলে ভরা আর ব্যর্থ। সে রাকা থেকে এসেছে এবং রাকাতে সে একটা গাড়ির গ্যারেজে কাজ করত। সে প্রথম দিকেই আইএস’এ যোগ দেয়। “আমার সব বন্ধুই আইএস’এ যোগ দেয়। আমিও ভাবলাম লেগে পড়ি তাদের সাথে। কারণ, সত্যি কথা বলতে গেলে, আমি আইএস’কে পছন্দ করতাম। শুরুতে আইএস’র চমৎকার সুনাম ছিল কিন্তু পরে তাদের প্রকৃত চেহারা বেড়িয়ে পড়ে”।

রাকাতে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে তাকে মসুল পুনর্দখলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে সে দুই সপ্তাহ ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দেয়। আমরা সেই ঘর থেকে মোটেও বের হইনি, কারণ আইএস আমাদের বলেছিল, “কেউকে আমরা যেন ঘরের দরজা খুলে না দিই।”মসুল পতনের পথে। মসুলে দুইবছরের অধিক সময় যুদ্ধ করছে এমন সিরিয়ান জঙ্গীদের সাথে তাদের দেখা হয়েছিল। সে বলল, “এই দুই বছরে তারা একদিনের জন্যও ছুটি পায়নি। এই সময়ে তারা সম্মুখে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে আর তাদের জন্য খাদ্য হিসেবে ছিল সামান্য দই, রুটি আর খেজুর। এমনকি তারা ২৪ ঘন্টাও খাবার ছাড়া অতিবাহিত করেছে।”

মুজাহিদিনদের জন্য কোন কিছুর সুব্যবস্থা ছিল না। শরিয়া প্রশিক্ষণের সময় আমাকে বলা হয়েছিল সকালের নাস্তায় সিদ্ধ আলু আর ডিম দেয়া হবে। দুপুরে রাত্রে পর্যাপ্ত খাবার আছে এবং মাঝে মাঝে জলপাই তেলে জাতার খেতে দিবে।” ওমর কখনো পুরোপুরি যোদ্ধা হতে পারেনি যদিও সে যোদ্ধা হতে চেয়েছিল।

রাস্তায় অস্ত্র হাতে আইএস’র শিশু ‘সিংহের বাচ্চা’ যোদ্ধাঃ
আইএস’র সুচনাপর্বের ক্লাসে সঠিক সময়ে উপস্থিত না হতে পারার কারণে ওমরকে ‘জয়স আল খলিফা (খেলাফতের আর্মি)’ থেকে বাদ দেয়া হয়। এরপরে সে পুনরায় আবেদন করে। এবার সে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) অর্থাৎ বোমা তৈরির জঙ্গীদলে যোগ দেয় কিন্তু এখানেও সে ব্যর্থ হয়। অবশেষে সে তথ্য সংগ্রাহকের নিম্নপদস্থ কাজ পায়।তার কাজ হলো কুর্দি যোদ্ধা, ধূমপায়ী, কেউ অবৈধ অস্ত্র বহন করছে কিনা তার গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ানো। প্রত্যেক গোপন খবরের জন্য সে কিছু নগদ অর্থ পায়।

খেলাফতের সাথে তার দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ধূমপানের অভিযোগে একদিন আলজেরিয়ার আইএস জঙ্গী ওমরকে ধরে নিয়ে গেল। তখন গভীর রাত, আলজেরিয়ার সেই জঙ্গী তাকে গাড়ির পিছনে জোর করে উঠিয়ে নিলো ধর্ষণের উদ্দেশ্যে। ওমরের চিৎকার শোনার জন্য তখন কেউ ছিল না। ওমর বলল, “আমি তখন ভীষণ ভীত ছিলাম আর আলজেরিয়ান জঙ্গী ছিল নিয়ন্ত্রণে। সে আমাকে যেকোন অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারত এবং আইএস পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে পারত।” তখন ওমরের মনে হলো, তার আইএস ছাড়ার সময় হয়েছে।

আজ ওমর তার অতীত ভুলে যেতে চায়। সে তার প্রেমিকার প্রতি কৃতজ্ঞ কারন সেই নারী তাকে টাকা দিয়েছে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। ওমর বলল, “আমি ইউরোপিয়ানদের জন্য হুমকি নই। এক সময়ে তারা আমার শত্রু ছিল কিন্তু এখন তারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের সাথে বাস করছি তাদের সাথে খাচ্ছি, পান করছি। তারা আমাকে বন্ধুর মত গ্রহণ করেছে এবং আমার ভালোমন্দ দেখভাল করে। আমি আমার অতীত জীবন ঘৃণা করি এবং ভবিষ্যতে নতুন জীবনে বাঁচতে চাই।”

[ ছবি তোলার জন্য ওমরের পোজ ]
গত কয়েক মাসে বিবিসি’র অনুসন্ধান দল জানতে পারে কমপক্ষে তিনজন সাবেক আইএস জঙ্গী ইউরোপে বাস করছে। তারা সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে চায় না। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুলিশের দ্বারস্থ হলাম কিন্তু বিস্ময়করভাবে ইউরোপোল এই বিষয়ে কোন মতামত দানে বিরত রইল।

ঘৃণা শিক্ষার পাঠ্যক্রমঃ আইএস এর পাঠ্যবই
আইএস শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধা নিয়োগের উপরেই গুরুত্ব দেয়নি বরং তারা পৌঁছে গেছে সমাজের গভীরে, বাড়িতে বাড়িতে, স্কুলের শ্রেণীকক্ষে এবং সর্বোপরি শিশুদের মনোজগতে। আইএস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের স্কুলের পাঠ্যসূচীতে শিশুদের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হলেই তাদেরকে যুদ্ধ, সহিংসতা, হিংস্রতা এবং রক্তের মত শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। তারা খেলাফতের ‘সিংহের বাচ্চা’ (শিশু যোদ্ধা) এবং পবিত্র যুদ্ধের যোদ্ধা হিসেবে তাদের যাত্রা কেবল শুরু।

আইএস’র শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছে শিশুদের মাঝে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে। কিন্তু শিক্ষকদের পরামর্শ দিয়েছে নবীর আদর্শ এবং ধর্মীয় শিক্ষা যেমন ক্ষমা, ধৈর্য, সাহস, শক্তিমত্তা, আল্লাহর উপর অটুট বিশ্বাস এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বিষয়ে শিশুরা যেন শিক্ষা পায়। পরামর্শ দেয়া হয়েছে যেন শিশুদের মনে ইসলামের শত্রুদের সম্পর্কে ঘৃণা জাগ্রত হয়। এর জন্য তারা ছড়া, কবিতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। শিশুরা জিহাদকে গৌরাবান্বিত করে আল্লাহর জন্য মৃত্যু বরণ এবং হত্যা করার উগ্র ছড়া শিখে বড় হতে থাকে। হে মানব জাতি, আল্লাহ আমাদের মালিক, তোমার রক্তের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করো। কেবল শহীদের রক্তের বিনিময়েই কাফেরদের বিপক্ষে বিজয় অর্জন করা সম্ভব।

হিটলার যেমন যুবকদেরকে রাইখের জন্য যুদ্ধ করতে নাৎসি বাহিনীর সাথে একত্র করে দিয়েছিল, আইএস তেমনি খেলাফতের যুদ্ধে রক্তের যোগান দিতে শিশুদের প্রবেশ করায়। ইতিমধ্যে আইএস ২০১৪ সালের শীতকালে পুরোপুরি রাকার দখল নিয়ে নেয় এবং সেখানে আইএস’র তথাকথিত রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। এবং তখন রাকার শিক্ষা ব্যবস্থার খোল নলচে পালটে ফেলার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। নবগঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুরুতেই এক নির্বাহী আদেশে রাকার বিদ্যালয়গুলোতে গানের ক্লাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একইভাবে বিদ্যালয়গুলোতে সামাজিক শিক্ষা, ইতিহাস, খেলাধুলা এমনকি সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিষিদ্ধ করে আইএস’র পরিকল্পিত জিহাদের নিয়ম কানুন এবং ইসলামি শরিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পাঠ্যপুস্তক চালু করে। যেহেতু আইএস এখনো ছাপানো বই শিশুদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি তাই তারা সিরিয়ার চলমান পাঠ্যপুস্তকই কাটাছেঁড়াকরে আইএস শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আইএস ঘোষিত নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, “ব্যাংকের সুদ, গণতন্ত্র, নির্বাচন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ পাঠ্যসূচী থেকে বাতিল করা হইল।” শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো, নিষিদ্ধ পাঠ্যসূচীর পরিবর্তে ছাত্রদেরকে যেন পড়ানো হয় “শরিয়া এবং ইসলামিক স্টেটের পরিপন্থী কিছু করো না।”

২০১৪ সালের জুলাইতে আইএস’র হাতে ইরাকের মসুল শহরের পতন ঘটে এবং সেখানে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। রাকার থেকে ছয় গুণ বড় ইরাকের ধনী শহর মসুলে অনেক মানুষের সমাগম এবং অবকাঠামোর দিক থেকে অনেক উন্নত। আইএস’র নিজস্ব শিক্ষা নীতি প্রণয়ন, উপকরণ ছাপানোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল এবং সম্পদের এখন আর অভাব নেই।

আইএস’র পাঠ্যপুস্তকঃ ১০ বছর বয়সীদের জন্য ইতিহাস শিক্ষা
২০১৪ সালের জুলাই থেকেই আইএস বিশাল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নতুন পাঠ্যক্রম চালু করার কাজ হাতে নিলো। ইসলামী মৌলভী ইউসুফ বিবিসি’কে জানালো,“শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদর্শিকভাবে অনুগত এবং ইসলামী জ্ঞানেদক্ষ শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে সমস্ত গ্রীষ্মজুড়ে চলল শিক্ষানীতি প্রণয়ন।” প্রাথমিক বিদ্যালয়েরপাঠ্যক্রমে ঢুকে গেল অমুসলিমদের প্রতি ধর্মীয় হিংসার বাণী। ছাপানো হলো আইএস’র প্রচারণার জন্য ছোট পুস্তিকা যেখানে শিশুদের কাছে আইএস’কে উপস্থাপন করা হলো ইতিবাচকভাবে।

আইএস শেষ পর্যন্ত ২০১৫-২০১৬ শিক্ষা বছরে তাদের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। শিশুরা ৫ বছরে বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তারা স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। যেখানে নিয়মিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের আরও প্রায় চার বছর বেশি লাগত। তার মানে চার বছর তাদের শিক্ষাজীবন থেকে বেঁচে গেল। আইএস স্কুলে তারা ১২ টা বিষয়ে পড়ালেখা করবে।এই বিষয়গুলোর অধ্যয়নসূচী প্রণয়ন হবে আইএস’র নিয়মানুসারে এবং আইএস কিভাবে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করে তার আলোকে। জিহাদ হয়ে গেল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম এবং খেলাফতের বিধিবদ্ধ নিয়মের বাইরে সবাই ইসলামের শত্রু।

মসুলের পতন হয়ে গেছে এবং আইএস’র তথাকথিত রাজধানী রাকা’র পতন সামনের কয়েক মাসের মধ্যে আসন্ন এমন সময়েও শিশুদের পাঠ্যক্রমে ঘৃণার শিক্ষা চলছে আইএস নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। তাদের প্রাথমিক শিক্ষার বছরগুলোতে তারা সাধারণত আরবি শেখে। শিশুদের শেখানো হয় মুসলিমদের বিনাশ করার জন্য তাদের চারিদিকে পরিবেষ্টিত অসংখ্য শত্রু। শিয়া, মুরতাদ, সুন্নি মুসলিম কিন্তু আইএস’কে সমর্থন করে না এমন মুসলিম, ইরানের জনগণ, পশ্চিমাবিশ্বের ক্রুসেডার, ইহুদি-খ্রিস্টান জোট, জাতিসংঘ এবং যেসব শাসক বা নেতা শরিয়া আইন মেনে চলে না সবাই ইসলামের শত্রু। আইএস শৈশব থেকেই এই শিশুদের মনে বিধর্মী, ইসলামত্যাগীদের হত্যা করার জন্য জিহাদের আগুন জ্বেলে দেয়। শেখানো হয় ইসলামবিরোধীরা ধ্বংস হোক।

প্রথমেই আইএস তার অবশ্য কর্তব্য নির্ধারণ করে ফেলে। প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে নবী মুহম্মদের জীবনাচরণ এবং তার কথামালা নিয়ে গঠিত হাদিস পড়তে হবে।একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে আবু বকর আল-বাগদাদীকে ঘিরে জঙ্গীদের উল্লাস। তারা অস্ত্র উঁচিয়ে ইসলামিক স্টেটের খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে।

আইএস’র আইন বইঃ
আইএস স্কুলের শিক্ষকদের মনে করিয়ে দেয় তাদের সংকট কী কী। “ইসলামের শত্রুরা আমাদের মুসলিম পরিচয় কবর দিয়ে দিতে চায় এবং আমাদের সম্পদ লুট করতে চায়। আমরা চেষ্টা করেছি ছাত্রদেরকে যতটা সম্ভব শরিয়া আইনের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত করতে যাতে তারা আমাদের পরিচয় সমুন্নত রাখতে পারে এবং চলমান যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে।”আইএস’র পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে তায়মিয়াহ এবং ইবনে আল-কাইয়ুমের বিতর্কিত ধর্মীয় শিক্ষা। ইসলামের মধ্যযুগের এই দুই ইসলামী চিন্তাবিদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজকের উগ্র এবং রক্ষণশীল ইসলাম এবং সালাফি জিহাদি ধর্মতত্ত্ব। ক্লাস ৬ থেকে ১১ পর্যন্ত শিশুরা পাঠ্যক্রমে বারবার পড়তে থাকে ‘আল-ওয়ালা এবং আল-বারা’ তত্ত্ব। আল-ওয়ালা এবং আল-বারা তত্ত্বের মূলকথা হলো যারা আল্লাহকে ভালবাসে তাদেরকে তুমি ভালোবাসো আর যারা আল্লাহকে ভালোবাসে না তাদেরকে ঘৃণা করো এবং প্রয়োজন অনুসারে জিহাদ করো।

কিন্তু সম্ভবত সর্বাপেক্ষা ম্যাকিয়াভেলিয়ান উগ্রতা দেখা যায় ইসলামিক স্টেটের কোরান শিক্ষার ক্ষেত্রে। ইসলামিক স্টেট নিয়ন্ত্রিত স্কুলে শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া আছে কোরানের জিহাদি ধারণা আছে এমন সুরা, আয়াত যেন ক্লাসে শিক্ষা দেয়া হয়। তারা কোরানের আয়াত বলেই ক্ষান্ত থাকে না, বরং জিহাদি আয়াত লিখিত কোরানের পাতার নম্বর, সঠিক তথ্যসূত্রের সন্ধান দেয়। প্রথমে শিক্ষকদের এইসব আয়াত শেখানো হয় যাতে তারা ছাত্রদেরকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারে। তাদেরকে শেখানো হয় “জিহাদ হলো আল্লাহর খুশির জন্য। যুদ্ধে কাফেরের সাথে বিজয় অথবা জিহাদের ময়দানে মৃত্যু সবই আল্লাহর নিমিত্তে।

সময়ের সাথে সাথে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন হয়ে যায়। এই পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হওয়ার পরে শিশুরা যখন কিশোর হয় তখন তারা মুসলিমদের সর্বজনীন পবিত্র কিতাব আল-কোরান এবং আইএস’র নীতিমালার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে পারে, কখনো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে, আইএস স্কুলে পড়া কোন শিশু কিশোর যখন দেখে কোন মুসলিম কোরানের শিক্ষা মেনে চলছে না সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে। আর ইসলাম ধর্মানুসারে মুরতাদকে হত্যা করা ওয়াজিব। আজকের (সিংহ শাবক) শিশুদের উপর ঘৃণার পাঠ্যক্রমের প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ আইএস’র সত্যি সিংহের প্রশিক্ষণের সময় এবং সেটা প্রচারণা ভিডিওতে দেখতে পাবো। ভিডিওতে ধারাভাষ্যকার একজন শিশুকে প্রশ্ন করছে, “তোমার আমির কে?” শিশুটি উত্তর দিলো, “আবু বকর আল-বাগদাদী।” শিশুটির নাম আবদুল্লাহ। অসাধারণ চঞ্চল কাজাখ এই শিশুটির বয়স ১০ বছরের বেশি নয়। “ইনশাল্লাহ, ভবিষ্যতে তুমি কী হতে চাও?” শিশুটির উত্তর, “ওহে কাফের, আমি হবো তোমার হত্যাকারীদের একজন,ইনশাল্লাহ, আমি মুজাহিদ হবো।” তিনমাস পরে, অন্য একটা ভিডিওতে আবদুল্লাহকে দেখা যাচ্ছে, তার হাতে ধরা আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দুজনকে গুলি করে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো। ঘৃণার পাঠ্যক্রমে শিক্ষিত একটা নিষ্পাপ শিশু কিভাবে অস্ত্রহাতে পারদর্শী হয়ে গেল!

আইএস’র প্রচারণা ভিডিওঃ ভবিষ্যৎ সিংহের অস্ত্রশিক্ষা

পাঠ্য বই, সরঞ্জাম এমনভাবে প্রণয়ন করা যাতে শিশুরা বড় হয়ে খেলাফতের সৈনিক হতে পারে। যেমন একটা শিশু তার বাবাকে প্রশ্ন করছে, “বাবা, কাছের ঐ মসজিদে অস্ত্র হাতে যোদ্ধা কেন?” শিশুটির বাবা উত্তর দেয়, “খেলাফতকে রক্ষা করতে এবং কাফের, মুরতাদ, শিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তারা সারা দুনিয়া থেকে এখানে এসেছে।”হাসিখুশি শিশুটি উত্তর দিলো, “বাবা, আমিও তাদের একজন হতে চাই।”

শিশুটির বাবা উত্তর দেয়, “অবশ্যই। আমরা তোমার বড় হয়ে যোদ্ধা হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তুমি আল্লাহর ধর্ম সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে এবং মুসলিমদের রক্ষা করবে।”

এভাবেই ইসলামিক স্টেটের একটা সিংহ শাবকের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন হয়। তার ভবিষ্যৎ অবস্থান ফুটে উঠেছে ১১ বছর বয়সী শিশুদের পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদে। প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে, একটা শিশুর ঘাড়ের উপর দিয়ে পিঠে ঝোলানো বন্দুক। চারিপাশে ধূসর। তার গমনপথ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। এই পায়ে চলার পথ চলে গেছে যুদ্ধের চুল্লির দিকে এবং সেখানে ধ্বংসের মধ্যেই তার মুক্তি।

ভয় দেখানোর ঐতিহ্য
শীঘ্র, অতি শীঘ্র তুমি দেখতে পাবে বিস্ময়
স্কুলের খেলার মাঠে অথবা বাড়িতে, যখন শিশুরা খেলে তখন তারা গেয়ে ওঠে আইএস’র জিহাদী সঙ্গীত, পশ্চিমাবিশ্বকে আক্রমণ করার অনুপ্রেরণার গান।
তুমি দেখবে এক মহাকব্যিক যুদ্ধ,
আমরা তোমাদের দেশে যাবো
আমাদের যোদ্ধা তোমাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করবে।
আইএস মসুল থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাদের জিহাদি গান এখনো উসামা, ইয়াকুবের মত শিশুদের মুখে মুখে।
মৃত্যু ছাড়া কোন পরিত্রাণ নাই,
আমরা আসছি তোমাদের মৃত্যু নিয়ে,
তোমাদের বাসস্থানে তোমাদের ছিন্নভিন্ন করবো,
গলার উপর ছুরি দিয়ে জবাই।
বালকেরা বাড়ি ফেরার পথে স্মৃতি থেকে গাইছে আইএস’র গান। শহরের বিদ্যুতের খাম্বায় ঝুলানো লাশের সারি। তাদের স্মৃতিতে ভেসে আসছে জবাই করার ভিডিও।
আমরা মৃত্যুকে পার হয়ে যাবো এবং আসব ফিরে
এখন যেমন যাচ্ছি, মরে যাবো সিংহের বিক্রমে।

আইএস’র গান গাওয়া বালকঃ

উসামা মুচকি হেসে তার চুলের নতুন ছাট নিয়ে আমাকে বলতে লাগল। তার মাথার একপাশ কামানো এবং মাথার উপর লম্বা চুলের ঝুঁটি। আইএস থাকলে চুলের এই ছাটের জন্য তাকে ১৫টা চাবুকের বাড়ি খেতে হতো। ইয়াকুব হাসল না। সে শুধু একটা আঙুল দিয়ে নিজের গলার কাছে জবাইয়ের ভঙ্গি করল। সে বলল, “আইএস এত সহনশীল নয়, তারা শ্রেফ মাথা কেটে ফেলে।”
উসামা, ইয়াকুবের মত শিশু কিশোর আইএস’র আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ভবিষ্যতের যোদ্ধা খুঁজে বের করা, সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার জন্য নির্বাচিত করার জন্য তারা সদা তৎপর। এরফলে ভবিষ্যতে যোদ্ধার যোগানে কমতি পড়বে না।

ইউসুফের সাথে কুয়েন্টিনের কথোপকথনঃ

ইউসুফ বলল, “আইএস কখনো ছাত্রদের সাথে খারাপ ব্যবহার করত না। তারা ছাত্রদের আবেগ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে সহমত।তারা বলত, “আমরা একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং আমরা তোমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সাহায্য করছি।” দুই বছর আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমি প্রথমবারের মত ইউসুফের সাথে কথা বলি। সে আমাকে আইএস অধিকৃত মসুলের যাবতীয় খবরাখবরের যোগান দিতো। সে আইএস’র পুরো পাঠ্যক্রম একটা সিডিতে পাঠিয়েছিল।

আইএস পাঠ্যক্রমঃ
ইউসুফ বলল, “আইএস’র আদর্শ ও ধর্মীয় তত্ত্ব সে ক্লাসে পঠিত হতে দেখেছে। মাঝে মাঝেই কিছু ছাত্র অদৃশ্য হয়ে যেত। তাদের বাবারাও হয় আইএস জঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে মারা গেছে অথবা অন্য জিহাদি দলের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। শিশুরা জিহাদি উৎপাদনের উর্বর ক্ষেত্র। আইএস সহজেই তাদের মগজ ধোলাই করতে পারে এবং ভবিষ্যতের আইএস’র শিশু জিহাদি সৃষ্টি করতে পারে। সে এমন কিছু তথ্য দিলো যা রীতিমত রোমহর্ষক, যেমনঃ বাবা মা অনেক সময় পরিবারের অন্যসব সদস্যদের বাঁচাতে একটা সন্তানকে আইএস’র হাতে সমর্পণ করত।”

শিশুদের মধ্যে উগ্রবাদের উত্থান কেন হয় গবেষণা করতে গিয়ে জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির শিশু উগ্রবাদ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মিয়া ব্লুম বলেন, “এটা হলো বিকৃত পিতার পুনরাবৃত্তি।” তিনি বলেন, “শিশুদের কোরবান করে দেয়া হয় হয়ত পরিবারের নিরাপত্তার জন্য, হয়ত আরও মহৎ কোন উদ্দেশ্যে।”আইএস নিশ্চিত করেছে যে শিশুরা সৈনিক হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে কাজ করছে তারা আর অন্য কাজ করবে না। যে পরিবার শিশুদের একবার আইএস’র কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তারা আর পরিবারের কাছে ফিরতে পারবে না।”

যখন আবু মালিকের ছেলে মারা যায় তখন তার জন্য আনুষ্ঠানিক দাফন কাফনের আয়োজন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। সামান্য কিছু বন্ধু, পরিচিতজন, পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে এসেছিল, কিন্তু তারা জানত প্রশ্ন করার থেকে চুপ করে থাকাই শ্রেয়তর। বছরের পর বছরে ধরে আবু মালিক তার সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। তাকে এই সর্বনাশা পথ থেকে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই! আবু মালিকের সবরকমের বিরোধীতা সত্ত্বেও তার ছেলে প্রথমে সিরিয়ায় আল-কায়েদা সমর্থিত শক্তিশালী জিহাদি সংগঠন জাবাত আল-নুসরা ফ্রন্টে যোগ দেয় তারপরে আইএস। কুর্দিশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময় সে আরও দুইজন জিহাদির সাথে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিজেকে উড়িয়ে দেয়। তার বয়স তখনো ১৮ পূর্ণ হয়নি।

২০১৩ সালে রাকায় নুসরা ফ্রন্টের এই জিহাদি তারকার উত্থান ঘটতে থাকে। আবু মালিকের ছেলের বয়স থেকে ১৩ বছর ৬ মাস। অন্যান্য অল্প বয়স্ক কিশোরদের মত তার মাঝেও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে জিহাদিদের প্রতি মোহ বাড়তে থাকে। সে দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলিম যুবকরা ইসলাম রক্ষার্থে জিহাদ করছে। ফলে ২০১৩ সালে সে নুসরা ফ্রন্টে যোগ দেয়। তিনদিন পরে তার বাবা তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে।
যখন ২০১৪ সালে আইএস পুরো রাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো, আবু মালিকের ছেলে তখন এই জঙ্গী দলে যোগ দেয়। আবু মালিক তাকে খুঁজে বের করে একজন শেখ এবং ইসলামী পণ্ডিতের কাছে নিয়ে গেল। সেই ইসলামী পণ্ডিত ছেলেটিকে ব্যাখ্যা করে বোঝাল যারা আইএস জঙ্গীদলে যোগ দিয়ে মানুষ মারছে, ত্রাস করছে, আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাচ্ছে তারা দোযখে যাবে।

একবছর পরে সেই ছেলে তার বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে আবার আইএস’এ যোগ দেয়। তার বাবা তাকে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। এবার ছেলের আবদার মেটাতে আবু মালিক ছেলের জন্য একটা নতুন স্যামসাং মোবাইল ফোন কিনে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই ফোন ছেলেকে আইএস’এ যোগ দেয়ার পথকে আরও প্রশস্ত করে দেয়। ফোনের মাধ্যমে সে আইএস’র মেসেজিং অ্যাপ এবং জিহাদি ভিডিওর নাগাল পেয়ে যায়। যখন সে আবার আইএস’এ যোগ দিলো তখন আবু মালিক রাগে ক্ষোভে সিরিয়া ছেড়ে তুরস্কে চলে যায়। সেখানে সে বাকি তিন ছেলে আর মেয়ে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। একটা ঔষধের দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করে দিনাতিপাত করে। ধর্মপ্রাণ মুসলিম আবু মালিক একদিন জানতে পারে তার ছেলে আত্মঘাতী জিহাদি হামলায় ইসলাম কায়েম করতে নিজেকে বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে সে কোনদিন এই ছেলের নাম মুখে পর্যন্ত আনে না।

জাতিসংঘের ইউনিসেফের মতে আর্মি দলে শিশুদের যে অবস্থানই হোক না কেন, তাদেরকে স্বেচ্ছায় অথবা অপহরণ অথবা জোরপূর্বক যুদ্ধে ব্যবহার করলে সেইসব শিশুরা ভুক্তভোগী। যুদ্ধে ব্যবহৃত শিশুদের কোন শৈশব স্মৃতি নেই এবং তাদেরকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য।
আইএস’র অনেক অপরাধ। ধর্ষণ, ধ্বংস, গণহত্যা, সন্ত্রাস, মুক্তিপণ, চোরাচালান হেন কোন অপ্রাধ নেই যা আইএস করে না। আইএস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে শিশুদের। তারা হারিয়েছে তাদের অতীত, বর্তমানে তারা নিয়মিত যুদ্ধ ফ্যাসাদে জড়িত এবং তাদের সামনে কোন ভবিষ্যৎ নাই।

কাসিস সিরিয়ার লাটাকিয়া থেকে এসেছে। সিরিয়া অঞ্চলের জঙ্গীদলে সে ১৫ বছর বয়সে যোগ দেয় এবং তখন থেকেই তার থেকে তার যোদ্ধা জীবনের শুরু। তার জিহাদি দলের নেতা দলবলসহ আইএস’এযোগ দেয়। কাসিস স্বেচ্ছায় আইএস’এ যোগ দেয়। কিন্তু অন্যান্যদের মত তারও আইএস মোহ দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হয়। এমনকি কাসিস তুরস্কে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় যেখানে সে এখন বাস করছে। অতি উৎসাহী শিশু কাসিস বন্দুকের গুলি চালানো শেখে, জিহাদে যোগ দেয়, সিরিয়ার আর্মির সাথে যুদ্ধে করে এবং অবিশ্বাসী কাফেরদের হত্যা করে। এসব কিছু এখন তার অতীত। যখন তুরস্কের গাজিয়েন্টেপের আশ্রয় শিবিরে তার সাথে দেখা করলাম তখন সে রুক্ষ, রিক্ত একটা ছেলে। হতাশা আর অপ্রাপ্তি তাকে আপদমস্তক গ্রাস করেছে। কাসিস লাটাকিয়া যখন আশ্রয় শিবিরে এলো, তখন কেউ কেউ তাকে বলত, “তুমি হেরে যাওয়া মানুষ। আমি যদি তুমি হতাম তাহলে তুমি যা করেছ, আমি সেটা করতাম না, কোন মানুষই সেটা করবে না। এটাকেই বলে ব্যর্থতা।” কাসিস ‘হেরে যাওয়া’ শব্দটা কোনদিন ভুলতে পারবে না। একে-৪৭ হাতে কাসিস [ছবি]

প্রকৃত সংখ্যা বের করা সত্যিই দুরূহ, কিন্তু কমপক্ষে ২০০০ শিশু আইএস খেলাফতের ‘সিংহ শাবক’ হয়েছে। শিশুযোদ্ধারা নিজেরাই আইএস’র কৌশলী যুদ্ধাস্ত্র। আরও হাজার হাজার শিশুকে আইএস’র ক্লাসরুমে জিহাদি মন্ত্রে দীক্ষা চলছে। তারা পরিস্থিতির শিকার এবং কেউ কেউ মারাত্মক হুমকি। যে সমাজে তারা বাস করে সেই সমাজ তাদেরকে ত্যাগ করেছে।

শিশু উগ্রবাদ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মিয়া ব্লুম বলেন, “এই সব জিহাদি জঙ্গী শিশুদের পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে এবং পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়াকে কেউ গ্রহণ করবে না। যেহেতু অপরাধ করার সব ধরণের দক্ষতা তাদের মাঝে আছেও সেহেতু অপরাধীরা এইসব শিশুদের ব্যবহার করতে পারে। তাদের শেষ স্থান হবে সংঘবদ্ধ অপরাধী দলের সাথে, তবে জিহাদি সংগঠনের সাথে যুক্ত হুওয়ার সম্ভাবনা কম। যদি আপনি তীব্র সিদ্ধ গরমে মসুলের পুরনো শহরে দাঁড়ান তবে, জিহাদিদের হাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া শহর দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে পারেন। অতীতের যুদ্ধক্ষেত্র যেমন ড্রেসডেন বা স্টালিনগ্রাদের সাথে মসুল বা রাকার তুলনা করা যেতে পারে। অতীতের যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরের বীভৎসতা ক্ষেত্রবিশেষে অনেক সময় বাড়িয়ে বলা হয়েছে, দেখানো হয়েছে ধ্বংসস্তুপের উপর থেকে ভাসা ভাসা। কিন্তু তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে গেছে। জাগতিক ক্ষতির মাত্রা পরিমাপ করা সহজ। মেরামত করাও সহজ। শহর আবার গড়ে উঠেছে।

কিন্তু স্বল্পকালীন সময়ে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের খেলাফত শিশুদেরদেরকে স্কুলে পাঠ্যবই, শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। এইসব বালকদের পাশে বসে তাদের মর্মান্তিক জীবনকাহিনী শুনে আপনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারবেন না।

কে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ সেটা নির্ধারণ করা অনেক কঠিন কাজ। ভালো ব্যবহার দিয়ে, চিকিৎসা দিয়ে তাদের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটানো হয়ত সম্ভব। কিন্তু এই ক্ষত সারানো ব্যয়বহুল হবে এবং এর অনেক সময় লাগবে। যথাযথ শিক্ষার অভাবে তাদের জন্য কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। জিহাদি মতাদর্শের স্পর্শে যেসব বিশ্বাস এখনো কলুষিত হয়ে যায়নি সেসবের মাধ্যমেই এই শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এরজন্য বিপুল ধৈর্য দরকার।ইরাক এবং সিরিয়ার পুনর্গঠনে তাদেরকে নিয়োগ দিয়ে, তাদের সমাজে ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবন দিলেই হয়ত তারা রক্ষা পাবে। শত আঘাত আর কষ্ট সহ্য করেযারা ইউরোপে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তাদেরকে শিক্ষা ও চিকিৎসা দিয়ে অপরাধী বা আরও খারাপ কিছু হওয়ার থেকে রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু এসব প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন এবং প্রায় অগহণযোগ্য। সম্ভবত আইএস’র বিশেষজ্ঞ দল জেনে বুঝেই এই ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়েছে।
সর্বোপরি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাতে চাওয়া এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জিহাদি বালককে কেইবা চায় সাহায্য করতে চায়?

মূল প্রবন্ধ: কুয়েনটিন সামারভিল এবং রিয়াম দালাতি