মূল প্রবন্ধ: কুয়েনটিন সামারভিল এবং রিয়াম দালিতি।

অনুবাদ: বিকাশ মজুমদার

(Raqqa’s dirty secret By Quentin Sommerville and Riam Dalati)

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য এবং কুর্দি যৌথবাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে শত শত আইএস যোদ্ধা তাদের পরিবারসহ গোপন আঁতাতের মাধ্যমে রাকা থেকে কীভাবে পালিয়ে গেল সেটার বিশদ বিবরণ সম্প্রতি বিবিসি’র অনুসন্ধানে প্রকাশিত হয়েছে।

তাদের গাড়ির বহরে ছিল আইএস’র অতি কুখ্যাত কিছু সদস্য এবং সেই সাথে শত শত বিদেশি যোদ্ধা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সিরিয়া এমনকি তুরস্ক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।

লরি ড্রাইভার আবু ফাউজি ভেবেছিল এটাও বুঝি তার নতুন কোন চাকরি। ইতিপূর্বে সে তার ১৮ চাকার লরি নিয়ে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বিপদসংকুল স্থান পাড়ি দিয়েছিলেন। বোমার আঘাতে উড়ে যাওয়া সেতু, মরুভূমির বিস্তৃত গভীর বালি, সরকারি নিরাপত্তাবাহিনী, এমনকি আইএস’র নজরদারি কিছুই তার গতিরোধ করতে পারেনি।

কিন্তু এবার আবু ফাউজি’র লরিতে পরিবাহিত হচ্ছে মানুষ ভর্তি কার্গো। আইএস বিরোধী কুর্দিশ এবং আরব যোদ্ধাদের মিলিত শক্তি এই যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় বাধা সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোরসেস (এসডিএফ)। এরকম প্রতিবন্ধকতার মুখেই ইউফ্রেটিস নদীর তীরে তাবকা শহরের দক্ষিণ প্রান্তের ক্যাম্প থেকে তাড়া খাওয়া আইএস যোদ্ধার দল শত শত পরিবার পরিজনসহ এই লরির বহরে করে পালিয়ে যাচ্ছে। আবু ফাউজিকে আইএস যোদ্ধারা বলেছিল এই যাত্রা সর্বোচ্চ অথবা মোটের উপর ছয় ঘণ্টার কাজ। কিন্তু ১২ অক্টোবরে আবু ফাউজি এবং তার অন্যান্য সঙ্গী চালকেরা যাত্রা শুরু করার জন্য লরিগুলো একত্রিত করছিল তখন বোঝা গেল আইএস তাদের কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। আসলে এই যাত্রায় তাদের কমপক্ষে তিনদিনের কঠিন শারীরিক শ্রমসাধ্য সময় লাগতে পারে। মৃত্যুর মত ভয়ংকর কার্গোতে পরিবাহিত হচ্ছে শত শত আইএস জঙ্গি, তাদের পরিবার, অগুনতি পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ।

পলায়নপর আইএস জঙ্গিরা আবু ফাউজি এবং অন্যান্য লরি চালকদেরকে কয়েক হাজার ডলার পারিশ্রমিক দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু শর্ত একটা, সবকিছু গোপন রাখতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই সব ব্যবস্থা করে দেয় ইসলামিক স্টেটের স্বঘোষিত তথাকথিত রাজধানী রাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ। প্রায় চার মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরিত্যক্ত এক ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর ছেড়ে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। এতে হয়ত মৃত নগরীতে প্রাণ ফিরে আসবে এবং শেষ হবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। যদিও আরব, কুর্দিশ এবং অন্যান্য যোদ্ধারা আইএস জঙ্গিদের পালিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু তবুও শত শত আইএস জঙ্গি রাকা নগরী থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ঠিক সেই সময়ে ইউএস এবং ব্রিটিশ পরিচালিত যৌথবাহিনী এমনকি এসডিএফ কেউই চায়নি আইএস জঙ্গিরা পালিয়ে যাক।

কিন্তু তবুও কি ছিল কোন অলিখিত চুক্তি যাতে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে রাকার গোপন নোংরা সত্য? যার ফলে সিরিয়ার জঙ্গিরা সিরিয়া থেকে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে পারে এবং বহির্বিশ্বের জন্য হুমকি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে? বিশ্বের কাছে এই সত্য গোপন রাখতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই? বিবিসি লরির বহরে অথবা পর্যবেক্ষণে থাকা পলায়নপর আইএস জঙ্গি এবং যারা জঙ্গিদের পালাতে সাহায্য করতে মধ্যস্থতা করেছিল তাদের সবার সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়।

 

নগরের বাইরে

তাবকায় তেল চিটচিটে একটা খোলা জায়গায় খেজুর গাছের নিচে তিনটে অল্প বয়স্ক ছেলে লরির ইঞ্জিন মেরামতে ব্যস্ত। তাদের সারা শরীর ইঞ্জিনের তেলে মাখামাখি অবস্থা। তাদের কালো চুলের ডগা পর্যন্ত তৈলাক্ত। তাদের কাছেই একদল লরি চালক। আবু ফাউজিকে দেখা যাচ্ছে সবার মাঝখানে, তার গায়ে উজ্জ্বল লাল রঙের জ্যাকেট। তার অতিপ্রিয় ১৮ চাকার লরির সাথে মিলে গেছে জ্যাকেটের রঙ। বোঝা যাচ্ছে আবু ফাউজি এই চালকদের নেতা, তিনি দ্রুত আমাদেরকে চা সিগারেট অফার করলেন। প্রথমে তিনি কথা বলতে আগ্রহ না দেখালেও কিছুক্ষণ পরেই তার সিদ্ধান্ত বদল করলেন।

তিনি এবং তার সহযোগী চালকেরা খুব রাগান্বিত। একসপ্তাহ হয়ে গেল তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল। পথের মধ্যে গাড়ির ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে, ভেঙ্গে গেছে লরির এক্সেল কিন্তু আইএস এখনো তাদের পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। আবু ফাউজি বললেন, “যদিও এই যাত্রা পথ ছিল ভয়ংকর বিপদ সংকুল”।   তবে একজন ড্রাইভার ম্যাপ দেখে লরি বহরের যাত্রাপথ খুঁজে বের করছেন।

তিনি বললেন, “রাকায় প্রবেশের পর থেকেই আমরা খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আমাদের যাওয়ার কথা ছিল এসডিএফ এর নিরাপত্তায়, কিন্তু আমাদেরকে একা একা যেতে হয়েছে। রাকায় প্রবেশের সাথে সাথে দেখতে পেলাম আইএস জঙ্গিরা অস্ত্রশস্ত্র এবং কোমরে আত্মহত্যার বেল্ট পরে সজ্জিত। তারা পাখি ধরার জালের মত আমাদের ট্রাকগুলোকে ফাঁদে ফেলে দিলো। যদি এই যাত্রাপথে সামান্যকিছু হেরফের হয় তাহলেই তারা পুরো গাড়ির বহর বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেবে। এমনকি জঙ্গিদের ছোট ছোট শিশু এবং নারীদের কোমরেও আত্মহত্যার বেল্ট বাধা। কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এসডিএফ জোট গণমাধ্যমকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এবং তারা প্রতিশ্রুতি দেয় যে আইএস ঘাঁটি থেকে জঙ্গিদের পলায়ন কখনো গণমাধ্যমে প্রচারিত হবে না। তার পরিবর্তে এসডিএফ প্রচার করে যে সামান্য কিছু আইএস যোদ্ধা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে আর তাদের সবাই স্থানীয়। কিন্তু একজন লরি চালক আমাদেরকে জানায় এসডিএফ’র এসব প্রচারণা সত্য নয়। আইএস জঙ্গিদের নিজস্ব গাড়ি এবং লরিতে নারী শিশু মিলিয়ে প্রায় চার হাজার আমরা মানুষকে রাকা থেকে পালাতে সাহায্য করেছি। যখন রাকায় প্রবেশ করলাম তখন মনে করেছিলাম হয়ত ২০০ মানুষ হবে কিন্তু বাস্তবে তারা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। যেমন আমার নিজের লরিতেই ১১২ জন মানুষ পরিবাহিত হয়েছে”। অন্য একজন লরি চালক বললেন, “গাড়ির বহরের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ছয় থেকে সাত কিলোমিটার বিস্তৃত। গাড়ির বহরে ছিল ৫০ টি ট্রাক, ১৩ টা বাস এবং আইএস’র নিজস্ব শতাধিক গাড়ি। পর্দায় মুখ ঢেকে সতর্ক চোখ আর হিংস্রতা নিয়ে তারা গাড়ির উপরে পাহারায় বসে ছিল।

গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ আমাদের কাছে চলে আসে। সেখানে দেখা যাচ্ছে অস্ত্রে সজ্জিত গিজগিজে আইএস জঙ্গির দলকে পরিবহন করে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ির বহর। যদিও এসডিএফ’র সাথে আপোষরফা হয় আইএস জঙ্গিরা শুধু তাদের নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আইএস জঙ্গিরা হাতের কাছে যত অস্ত্র ছিল সবই তাদের সাথে নিয়ে নেয়। দশ ট্রাক ছিল শুধু অস্ত্র এবং গোলাবারুদে বোঝাই করা”। আবু ফাউজি মাঠের মধ্যে মেরামত করা হচ্ছে এমন একটা সাদা ট্রাকের দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন, “অস্ত্র গোলাবারুদের ভারে এই ট্রাকের এক্সেল ভেঙ্গে গেছে। এটা যেন মোটেও আইএস যোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া নয় বরং মনে হচ্ছে এই যাত্রা তাদের এক্সোডাস বা ঐতিহাসিক বহির্গমন”।

এসডিএফ রাকা থেকে পিছু হটতে চায়নি কারণ সেটা হবে বিজয় থেকে পলায়ন। এসডিএফ এবং আইএস’র মাঝে সাব্যস্ত হয়েছিল, আইএস যখন রাকা শহর ছেড়ে চলে যাবে তখন তারা গাড়ির বহরে পতাকা বা ব্যানার প্রদর্শন করতে পারবে না। একই সাথে ঠিক হয় কোন বিদেশি আইএস জঙ্গি জীবিত অবস্থায় রাকা ছেড়ে যেতে পারবে না। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব জেমস মাতিস যুক্তরাষ্ট্রের একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আইএস’র সাথে যুদ্ধ হলো আইএস’কে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার যুদ্ধ। আমাদের ইচ্ছা আইএস’র বিদেশি যোদ্ধারা যেন যুদ্ধে বাঁচতে না পারে। তারা তাদের উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকায় নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাবে সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। কিন্তু একজন লরি চালক বললেন, “সিরিয়া কিংবা ইরাকের নাগরিক নয় এমন অনেক বিদেশি যোদ্ধা এই গাড়ির বহরে করে পালিয়ে গেছে”। পালিয়ে যাওয়া দলে অনেক দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক আছে যেমন ফ্রান্স, তুরস্ক, আজারবাইজান, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সৌদি আরব, চীন, তিউনিসিয়া, মিশর ……অন্যান্য চালকেরা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নাম উল্লেখ করতে লাগলেন।

বিবিসি’র অনুসন্ধানের আলোকে এসডিএফ জোট স্বীকার করে যে তারা আইএস জঙ্গিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। ২৫০ জন আইএস যোদ্ধার সাথে তাদের পরিবারের ৩৫০০ জন সদস্যকে রাকা ত্যাগ করতে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আইএস’র বিরুদ্ধে পশ্চিমা জোটের “অপারেশন ইনহেরেন্ট রিজলভ” প্রোগ্রামের মুখপাত্র কর্নেল রায়ান ডিলন বলেন, “আমরা একজন জঙ্গিকেও রাকা থেকে পালাতে দেব না” কিন্তু আমাদের রণকৌশলের মধ্যে থেকেই স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে এবং সাহায্য নিয়ে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এতে সিরিয়ারই পতন ঘটছে। তারা যুদ্ধ করছে আর বেঘোরে মারা পড়ছে। অপারেশনের খাতিরেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

যদিও মধ্যস্থতা করার সময়ে সেখানে পশ্চিমা অফিসার ছিলেন তবুও তারা আলোচনাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন নি। তবে কর্নেল ডিলনের হিসাব মতে মাত্র চারজন বিদেশি জঙ্গি সিরিয়া ছেড়ে চলে গেছে এবং তারা এখন এসডিএফ’র কাছে বন্দী আছে।

 

আইএস সদস্যদের পরিবারের রাকা ছাড়ার প্রস্তুতি

 

রাকার উত্তরাঞ্চলে সুন্দর সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে তুলা এবং গম ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে গাড়ির দীর্ঘ বহর এগিয়ে যাচ্ছে, পিছনে ফেলে দিয়ে রাকা শহর। ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে মরুভূমির দিকে রাস্তা। গাড়ির বহর প্রধান রাস্তা ছেড়ে মরুভূমির মধ্যের পথ ধরে যাত্রা শুরু করল। মরুভূমির পথ খুব বন্ধুর, কিন্তু চালকের আসনে যারা আছেন তাদের জন্য এই যাত্রা দুরুহতম। আবু ফাউজির এক চালক বন্ধু জামার হাতা গুটিয়ে আমাদের বললেন, দেখুন, ওরা আমাদের কী করেছে” জামার নিচে দেখতে পেলাম পুড়ে গেছে শরীরের চামড়া।

আবু ফাউজির ভাষ্যমতে এই বহরের প্রতিটি চালকের সাথে তিন চার জন করে বিদেশি ছিল। তারা চালকদেরকে মারধর করতো এবং নামের সাথে কাফের, শুয়োরের বাচ্চা বলে ডাকতো। যদিও এই চালকেরা জঙ্গিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করছে তবুও তারা সারা রাস্তা আরবের চালকদেরকে গালিগালাজ করতে লাগল। আর প্রতি মুহূর্তে হুমকি দিতো। আবু ফাউজি বললেন, “তারা বলত, কবে নাগাদ রাকা আবার পুনর্গঠিত হবে, আমাদের জানাবে, আমরা আবার আসব”। তারা ছিল দুর্বিনীত এবং কোন কিছুর পরোয়া করে না। রাকা থেকে তাদের বিতাড়নের জন্য আইএস জঙ্গিরা আমাদের দায়ী করত”। একজন নারী জঙ্গিও তাকে একে-৪৭ দেখিয়ে হুমকি দিয়েছিল।

দোকানি মাহমুদ এসবে মোটেও ভয় পায় না। বিকেল চারটার দিকে শহরে এসডিএফ’র গাড়ির ঝাঁক প্রবেশ করে তখন তারা উপস্থিত স্থানীয় শানিন নামের একজনকে লক্ষ্য করে উপস্থিত অন্যান্য সবাইকে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে বলে। শহরে আমরা আমাদের মত করে ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে একটা এসডিএফ’র গাড়ি থামল আমাদের পাশে। গাড়ি থেকে একজন আমাদের জানালো, আইএস এবং এসডিএফ’র মাঝে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়েছে। এখন আপনারা এই স্থান ফাঁকা করে যে যার স্থানে চলে যান। মাহমুদ আইএস’র সমর্থক না, তবুও ৪০০০ আইএস যদি ক্রেতা সেজে তার গ্রামের মধ্য দিয়ে চোখের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যায় তার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সে ব্যবসায়ের কোন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।

 

মাহমুদের দোকান

গ্রামের মধ্যে একটা সেতু একটা সংকীর্ণ পথ তৈরি করেছে যেখান দিয়ে আইএস জঙ্গিরা প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে এসেছে। মাসের পর মাস যুদ্ধ করে এবং বাঙ্কারে আবদ্ধ থেকে তারা বিবর্ণ এবং ক্ষুধার্ত। তারা মাহমুদের দোকানে ঢুকে জিনিসপত্রের সব তাক ফাঁকা করে ফেলল। একজন একচোখা তিউনিশিয়ান যোদ্ধা আমাকে বলল আল্লাহকে ভয় করতে। সে খুব শান্ত গলায় বলল, “কেন আপনি দাঁড়ি কামিয়েছেন?” তারপরে বলল, “আমরা ফিরে আসব, তখন এখানে আবার শরিয়া আইন কার্যকর করব।” তখন আমি বললাম, “শরিয়া আইনে আমাদের কোন সমস্যা নেই, কারণ আমরা সবাই মুসলিম।” ইনস্ট্যান্ট নুডুলস, বিস্কুট, হালকা নাস্তা যে যা হাতের কাছে পেল সব তারা কিনে নিলো।

 

দোকানে প্রবেশের পূর্বে তারা তাদের অস্ত্র বাইরে রেখে গিয়েছিল। একবার শুধু সামান্য একটু সমস্যা হয়েছিল যখন তিনজন যোদ্ধার নজর গেল অবৈধভাবে আমদানি করা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। তারা সিগারেটের বাক্স ছিঁড়ে ফেলে দিলো। মাহমুদ বললো, “তারা কোনকিছুই ঠিক করে নি, কিছুই না”। সেই তিনজন আইএস জঙ্গি উগ্র হয়ে গেলে অন্যান্য জঙ্গিরা তাদের সামলে নেয়। মাহমুদ জানালেন, “আইএস যা কিছু কিনেছিল, সেগুলোর জন্য তারা অর্থ প্রদান করেছিল”

 

তারা সব পণ্য কিনে দোকান একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল। আইএস’র সংখ্যা দেখে আমি তো অবাক। তাদের অনেকেই আমার কাছে পণ্যের দাম জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু আমি তাদের সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কারণ আমি তখন অন্যদেরকে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যস্ত ছিলাম। তাই তারা আমার কাছে জিজ্ঞেস না করেই দোকানের টেবিলের উপর টাকা রেখে চলে গেল।

 

আইএস সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হলেও লরি চালকেরা অকপটে স্বীকার করলেন, আইএস তাদের পাওনা পরিশোধ করেছিল। আবু ফাউজি স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, “আইএস মানসিক বিকারগ্রস্ত মারাত্মক খুনি হলেও তারা আর্থিক লেনদেনে সব সময় সৎ”। গ্রামের উত্তরের চেহারা একেবারে ভিন্নতর। সেখানে একটা ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ হচ্ছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাতাসে ভাসছে ধুলো এবং বালির রেখা। এখানে কয়েকটা গুচ্ছ গ্রাম এবং এখান থেকেই আইএস’র গাড়ির বহর অদৃশ্যে মিলিয়ে যাবে।

 

আইএস’র গাড়ি বহর মাহমুদের ছোট্ট গ্রামে পৌঁছানোর সাথে সাথে প্রাণের ভয়ে লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু গাড়িগুলো ডানদিকে মোড় নিয়ে প্রধান সড়ক ছেড়ে মরুভূমির পথে রওনা হলো। গাড়ি বহরের পুরোভাগে আছে দুইটা হামভি। মাহমুদ বললেন, “তারা গাড়িগুলো এমনভাবে সাজাল যাতে অন্য কোন গাড়ি তাদেরকে অতিক্রম করতে না পারে”। গাড়ির বহর মরুভূমির দিগন্তে মিলিয়ে গেল, কিন্তু আইএস চলে গেলেও মাহমুদের মত গ্রামবাসীদের মনে সহসা শান্তি ফিরে এলো না। আমাদের সবাই বলতে লাগল, চলে যাওয়ার সময় আইএস মুখের উপর আঙুল তুলে হুমকি দিয়ে গেছে তারা ফিরে আসবে। মাহমুদ বললেন, “আমরা বিগত চার পাঁচ বছর প্রচণ্ড আতংকের মধ্যে দিনযাপন করেছি। মানসিক সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে আমাদের কিছু সময় লেগেছিল। আমরা ভাবতাম তারা হয়ত নিজেরাই ফিরে আসবে অথবা তাদের দক্ষ কোন ক্ষুদ্র প্রতিনিধি দল পাঠাবে। আমরা এখনো জানি না সত্যিই তারা চিরতরে চলে গেছে কিনা”। আর আমরা নিজেরা বলাবলি করছিলাম, আমরা শুনেছি মরুভূমির পথে গাড়ির বহর লক্ষ্য করে সন্ত্রাস-বিরোধী জোট বিমান এবং ড্রোন নিয়ে আইএস’কে ধাওয়া করছে।

 

আবু ফাউজি গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে পেলেন, সন্ত্রাস-বিরোধী জোটের যুদ্ধবিমান তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল, চারিদিকে ছড়িয়ে দিলো আলোর ঝলকানি, আলোকিত হয়ে গেল গাড়ির দীর্ঘ সারি এবং তাদের সামনের গমন পথ। গাড়ির বহরের শেষ গাড়িটি যখন পেরিয়ে যাচ্ছিল তখন চারিদিক আলোকিত করে একটা মার্কিন যুদ্ধ বিমান উড়ে গেল খুব নিচ দিয়ে। তখন মনে হয় মার্কিনীদের ভয়ে আইএস জঙ্গিদের প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলার মত অবস্থা। সন্ত্রাস-বিরোধী ঐক্যজোট নিশ্চিত করেছিল যেহেতু স্থলে তাদের কোন নিয়মিত বাহিনী নেই সেহেতু তারা আকাশ থেকে গাড়ির বহরের উপর নজরদারি জারি রেখেছিল।

 

কোন অঞ্চলে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার মত রাকার ভাগ্যেও ভিন্নতর ব্যবহার প্রত্যাশিত ছিল না। চূড়ান্ত একপেশে হয়ে যাওয়া, ক্লান্ত বিধ্বস্ত এবং পরিবারের জন্য ভয়ার্ত আইএস জঙ্গিদের উপর সমঝোতার টেবিলে ১০ অক্টোবর বোমা ফেলানো হয়। প্রায় ১০ ঘণ্টা তাদের উপর বিমান হামলা চলে। আবু মুসাব হুথাইফা জানান, বিমান হামলায় ৫০০ থেকে ৬০০ জন আইএস জঙ্গি এবং তাদের পরিবারের সদস্য নিহত হন।

১১ অক্টোবর প্রকাশিত একটা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাস-বিরোধী জোটের বিমান হামলায় রাকার কিছু অঞ্চলে শত্রুর সীমারেখার পিছনে মৃত মানুষের স্তূপ। নারী ও শিশুদের চিৎকারের মাঝেই আইএস জঙ্গিদের মধ্যে ঝগড়া চলছে। বিশেষভাবে কার্যকর শক্তিশালী বোমা পড়ছে তাদের মাথার উপর। মানবাধিকার কর্মীরা দাবি করছে, একটা বসত বাড়ির ভবনে ৩৫ জন নারী ও শিশু মারা গেছে। তাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এটা যথেষ্ট।

 

আবু মুসাব বললেন, “১০ ঘণ্টা পরে আবার সমঝোতা আলোচনা শুরু হলো। যারা প্রথমদিকে যুদ্ধবিরতি নাকচ করে দিয়েছিল তারাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং এভাবেই আমরা রাকা ছেড়ে চলে যেতে সক্ষম হই”। এর আগে শান্তি আলোচনার জন্য তিনবার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। রাকার স্থানীয় কর্মকর্তাসহ চার সদস্যের একটি দল শান্তি আলোচনায় কথা বলছে। তার বার্তার উপর নির্ভর করে আমাদের একজন সাহসী যোদ্ধা স্থানীয় কর্মকর্তার মোটর বাইকে চড়ে সম্মুখভাগ অতিক্রম করবে। সাব্যস্ত হলো, রাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় আমরা শুধু ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করতে পারব, পিছনে ফেলে দিয়ে যেতে হবে সব ভারি অস্ত্রশস্ত্র। যাইহোক, আমাদের কাছে খুব ভারি অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।

বর্তমানে তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তের জেলে বন্দী আবু মুসাব প্রকাশ করলেন, গাড়ি বহরকে আইএস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার জন্য ঠিক কী কী করা হয়েছিল। তিনি জানালেন, “গাড়ির বহর ইরাক সীমান্তের খুব কাছাকাছি সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলছিল। সেই সাথে পালিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষ”।

আবু মুসাবের পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা পশ্চিমাদের জন্য সতর্কবার্তা। কারণ যারা রাকা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে তারা ইতিমধ্যেই হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। শত্রু নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিরাপত্তাকর্মীদের নজরদারি এবং গ্রেফতার এড়িয়ে একজন কুখ্যাত শীর্ষস্থানীয় আইএস জঙ্গি কিভাবে পালিয়ে যেতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে আবু মুসাব জানালেন, “আমি তুরস্ক অভিমুখী একটা দলের সাথে ভিড়ে গেলাম”।

আইএস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের পতনের পর থেকে সবার কাছেই আইএস’র জঙ্গিরা ফেরারি, তার মানে হলো পলায়নপর দলটিকে ভয়ানক বৈরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। আবু মুসাব বললেন, “আমরা এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল নিরাপদে পার হওয়ার জন্য চোরাকারবারিদের ভাড়া করেছিলাম”

প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল। কিন্তু চোরাকারবারিদের উপর ভরসা করা খুব কঠিন। তারা কখনো কখনো যাত্রাপথের মাঝ রাস্তায় আমাদেরকে ফেলে চলে যায়। এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আমাদেরকে ভাগ্যের উপর সঁপে দিয়ে তারা হঠাৎ উধাও। তখন থেকেই আমরা দলছুট এবং যে যার মত “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” অবস্থা।

আবু মুসাব বললেন, “যদি সঠিক লোকের হাতে টাকা দিতাম অথবা ভিন্ন কোন রাস্তা দিয়ে যেতাম তাহলে হয়ত আমরা নিরাপদ থাকতাম।” রাকার পশ্চিমে ইদলিবের দিকে বিকল্প আর একটা পথ আছে। অসংখ্য আইএস জঙ্গি এবং তাদের পরিবার এই পথে নিরাপদে পাড়ি জমিয়েছে। ব্রিটেন, ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং মধ্য এশিয়ার বিদেশি জঙ্গিরা এই পথেই পালিয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার জন্য পাচারকারী দালালকে প্রতি ব্যক্তির জন্য ৪০০০ ডলার (৩০০০ পাউন্ড) এবং বড় পরিবারের জন্য ২০০০০ ডলার দেয়া লাগে।

ফ্রান্সের জঙ্গি

রাকার অবস্থা অবনতির আগেই ফ্রান্স থেকে আগত যুবক আবু বসির আল-ফারানসি রাকা ছেড়ে ইদিলিবে পাড়ি জমায়। সে এখন ইদলিবেই আছে এবং সেখানেই নিরাপদে থাকতে চায়। সে বলল, “কারণ রাকায় তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে”।

আমরা ছিলাম সম্মুখভাগের যোদ্ধা। কুর্দিদের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ চলছে এবং সেখানের জীবনযাত্রা অনেক বিপদসংকুল। তখনো আমরা জানতাম না রাকার পতন ঘটতে যাচ্ছে। স্বপ্নভঙ্গ, ক্রমাগত যুদ্ধের ক্লান্তি আর জীবনের ভয়ে আবু বসির রাকা ছেড়ে ইদলিবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আবু বসির আইএস’র ফ্রান্স যোদ্ধাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সে রাকা ত্যাগ করার পূর্বে তার অধীনস্থ যোদ্ধাদের নতুন দায়িত্ব এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করে আসে। আমাদের দলের কিছু  ভাই ফ্রান্সের উদ্দেশে পালিয়ে গেছে, সেখানে তারা জিহাদ পরিচালনা করবে যার নাম দিয়েছি “হিসেব চুকানোর দিন”। রাকার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে অনেক কিছুই সেই সাথে কবর হয়ে গেছে পালানোর গোপন আঁতাত। স্থানীয় আদিবাসী বয়োবৃদ্ধরা স্বীকার করলেন পালিয়ে যাওয়া আইএস জঙ্গির সংখ্যা ধারণার থেকেও বেশি। অথচ কুর্দিশ পরিচালিত এসডিএফ জোট প্রথম থেকেই এরকম আঁতাতের কথা অস্বীকার করে আসছিল। যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে এসডিএফ জোট ঘটনাটিকে ক্রমাগত ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। তবুও বেসামরিক জিম্মিদের মুক্ত করার কোন অগ্রগতি নেই। কিন্তু বেসামরিক জিম্মি মুক্ত করার জন্য কোন তাগিদ জোটের মধ্যে লক্ষ্য করা গেল না। জোটের উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও আইএস এবং এসডিএফ জোটের মধ্যে কোন জিম্মি হস্তান্তর হলো না।  জোট অস্বীকার করলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে শত শত জঙ্গি পালানোর স্রোতে মিশে গেল। আইএস’কে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কুর্দি এবং আরব সম্প্রদায়ের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনাও একটা উদ্দেশ্য ছিল। আইএস রাকা শহরের হাসপাতাল এবং খেলার মাঠে পরিখা খনন করে রেখেছিল যাতে যাতে তাদেরকে উচ্ছেদ করতে গেলেও বিশাল রক্তক্ষয় হয় এবং যুদ্ধকে দীর্ঘায়ত করা যায়।

আইএস’কে নির্মূল করার দুইটা উদ্দেশ্য। প্রথমত তথাকথিত খেলাফত ধ্বংস করে দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা এবং দ্বিতীয়ত সিরিয়া ইরাক পেরিয়ে সন্ত্রাসী হামলা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে সেটা প্রতিহত করা। রাকা কার্যকরভাবে আইএস’র রাজধানী কিন্তু এটা একই সাথে রাকা হলো জঙ্গিদের পাতা ফাঁদ। আপোষরফা হয়েছিল সম্ভবত রাকাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে আইএস’কে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া। কিন্তু একই সাথে এটাও নিশ্চিত হয়ে গেল যুদ্ধ অভিজ্ঞ জঙ্গি ছড়িয়ে পড়বে সিরিয়া ছাড়িয়ে অন্যকোন যুদ্ধক্ষেত্রে। পালনোর দলে এমন অনেক জঙ্গি আছে যারা এখনো যুদ্ধ করেনি কিন্তু যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে আছে।

[ এই ফিচারে উল্লেখিত সমস্ত মানুষের নাম পরিবর্তন করে লিখিত হয়েছে। ]