লেখক: পাপলু বাঙ্গালী

মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা বাতিলে উচ্চ আদালতে রিটের সমালোচন করে বলেন, ‘অনেক জরুরি মামলা থাকতে বাচ্চারা পরীক্ষা দেবে কি দেবে না তা নিয়ে একটা রিট করে বসে থাকে। জরুরি মামলা শুনানির সময় নেই। এই সমস্ত খুচরা জিনিস নিয়ে সময় কাটানো কেন?’ (বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট, নভেম্বর ২১, ২০১৭)

সংসদ নেতা শেখ হাসিনা পড়াশুনা নিয়ে দুশ্চিন্তাকে “খুচরা জিনিস” ভাবেন। সেই বক্তব্যে সার্টিফিকেট পেলে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘পরীক্ষার পর ছেলেমেয়েরা হাতে যখন সার্টিফিকেট পাবে– এটা একটা আনন্দের বিষয়। সার্টিফিকেট পেলে নিজেদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস আসে। এতে আপত্তিটা থাকতে পারে– বুঝতে পারি না।’ রাষ্ট্র প্রধানদের এই বুঝতে না পারাটা ব্রিটিশ আমলেও ছিলো, পাকিস্তান আমলেও ছিলো এখনো আছে।

ঔপনিবেশিক ইংরেজদের আমলে তারা এমন একটি শিক্ষা প্রচলন করলো যাতে বেরিয়ে আসে এমন এক শিক্ষিত শ্রেণি যে শ্রেণিটিই হবে এদেশের ইংরেজ প্রভূর পাহারাদার। ব্রিটিশরাও শিক্ষাকে “খুচরা” এবং নিজেদের গোলাম তৈরির পথ হিসেবেই বেছে নিয়েছিলো। পাকিস্তান নামক নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রটির শিক্ষা দর্শন প্রতিফলিত হয়েছিলো ধর্মভিত্তিক ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে। এমনকি আমরা যদি আরো পিছনে যাই। তাহলে দেখতে পাই প্রাচীন বাংলায় যখন আর্যরা আসেনি। ঠিক তখন প্রথমে অস্ট্রিক ও পরে দ্রাবিড় জনগোষ্টির জীবন প্রণালী ও দার্শনিক প্রত্যয়ে পরিচালিত হতো তখনকার বাংলার জনজীবন। আর্যরা আসার পরে শাসকের দর্শন হিসেবে আর্য চিন্তা ও আর্য দর্শন প্রধান হয়ে উঠে। প্রবল বর্ণাশ্রমে পীড়িত প্রাচীন ভারতে ভ্রাম্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এ উচ্চবর্ণগুলোর জন্য শিক্ষার অধিকার ছিল। সংখ্যাগরিষ্ট শুদ্ররা যারা ছিল মূলত শ্রমজীবী শ্রেণী,তারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এই বঞ্চনাকে ধর্মশাস্ত্রের বিধান দিয়ে ন্যায়ানুমোদিত করা হয়েছিল। পূর্বজন্মের পুণ্য নেই বলে তার বিদ্যাশিক্ষার অধিকার নেই। শুধু শুদ্র নয়, শূদ্র-অশুদ্র নির্বিশেষে সকল বর্ণের নারীদেরও একই দশা; তারা বহুবিদ্যা লাভের অধিকারবঞ্চিত। কেবল স্বামী তথা পুরুষের সেবার মধ্যেই নারী জন্মের স্বার্থকতা। বস্তুত এটি ছিল হিন্দু সভ্যতা। পরবর্তীকালে বৌদ্দ ও জৈন ধর্মের আবির্ভাবের পরে তা বহুলোককে আকর্ষন করেছে। মোট কথা প্রাচীন বাংলায় শিক্ষা দর্শন ছিল ধর্মভিত্তিক।

মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলেও এর খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। শিক্ষা ছিল মসজিদভিত্তিক। তত্ত্বগতভাবে সকল মানুষ সমান হওয়ায় ইসলামে বিদ্যালাভের অধিকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার থাকলেও মুসলিম রাজ-রাজড়াদের আমলেও শ্রেণি বৈষম্য শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। আশরাফ-আতরাফ বিভক্ত এ সমাজেও শিক্ষা আতরাফের নাগালের বইরে থেকে যায়। বন্দিত্বের চাপে নিষ্পেষিত ও নানা বিধি নিষেধের জ্বালায় জর্জরিত নারীদের অবস্থা ছিল আরো করুণ। খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাকে খুচরা ব্যাপার হিসেবে ধরে সেই প্রাচীনপন্থি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ, পাকিস্তান এমনকি বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঠিকে আছে।

বাংলাদেশের শিক্ষা আইন ২০১৩-এ “মাধ্যমিক শিক্ষার পূর্ব স্তর পর্যন্ত সকল আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেই মৌলিক শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে”। দেশের সকল মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার মূল ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষার এ স্তর পরবর্তী সকল স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে। প্রাথমিক শিক্ষাকে এড়িয়ে কোনোভাবেই মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আর সেই প্রাথমিক শিক্ষাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা “খুচরা ব্যাপার” মনে করেন। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে করেন যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সার্টিফিকেট পাওয়া। কেননা তাঁর যুক্তি হলো, সার্টিফিকেট পেলে ছাত্ররা খুশি হয়।

গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংস করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারী আকার ধারণ করেছে। সরকার থেকে বরাবরই ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দায় এড়িয়েছে, গত ৫ বছরে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে নির্লজ্জ উক্তি করা হয়েছে। ফলে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো এমন অনৈতিক ঘটনা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ফলেই ঘটছে। শিক্ষা যখন মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন ছাত্র-শিক্ষক-প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সাথে যুক্ত কর্মকতা-কর্মচারি কারো মাঝে নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধ এসব কাজ করে না। আবার ফাঁসকৃত এসব প্রশ্ন যে সমস্ত শিক্ষার্থীদের হাতে পড়ছে, তাদেরও নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। কোমলমতি এই শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধঃপতনের দায় কে নেবে? – এই প্রশ্ন তোলাটাও কি খুচরা আলাপ?

এই যে কাগজ(সার্টিফিকেট) নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার মৌলিক দর্শনকে পেছনে ফেলে সার্টিফিকেট অর্জনের মার মার কাট কাট প্রতিযোগিতা; এটি কোনভাবেই কোন সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়। আমাদের শিশুদের জন্য তো আরো ভয়ঙ্কর। পরীক্ষা নামক যুদ্ধ করিয়ে শিশুদের যে মানসিক পীড়ন এবং ভীতিকর পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সেটা কোনভাবে কোন সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে চলতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সার্টিফিকেট নামক বস্তুটির ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাটা পাশ-ফেইল, বেশি নম্বর, কম নম্বর, বই গেলানো নির্ভর না। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। যেটাকে প্রদানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন “খুচরা ব্যাপার”।

ধরা হয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে পৃথিবীর সেরা শিক্ষা ব্যবস্থা। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক আলাপ হলোঃ সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ। ধনী, গরিব, শরণার্থী সবার জন্য একই ধরনের স্কুল, একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমাদের মত প্রাথমিক শিক্ষার শুরুতেই বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম (ইংলিশ মিডিয়াম), দাখিল মাদ্রাসা, কাওমী মাদ্রাসার বহুমাত্রিক বিভাজন নাই। এমনকি তাদের সকল স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে ফ্রি। এমনকি আমাদের মতো সরকারি স্কুল কলেজে পরীক্ষার ফি, ভর্তি ফিও দিতে হয় না। প্রি-প্রাইমারি বা প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক পর্যন্ত বই, খাবার এবং যাতায়াত ব্যবস্থা পর্যন্ত বিনামুল্যে প্রদান করা হয়। একটি দেশ কেন সবদিক থেকে এগিয়ে আছে, সেটা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে খোঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের উল্টো। আমরা মুখে বলছি আমরা সেরা হতে চাই। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, নারী নির্যাতন-ধর্ষণ, খুন, দূর্নীতি,ধর্মান্ধতায় আমরা শীর্ষে। এই অন্ধকার সময় থেকে মুক্তি চাই। আবার শিক্ষা নিয়ে জরুরি আলাপকে “খুচরা ব্যাপার” বলছি।

শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির আশা-আকাঙ্খা রূপায়নের ও ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার। কাজেই দেশের কৃষক,শ্রমিক,ম্যধবিত্তসহ সকল শ্রেণির জনগণের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের উপলব্ধি জাগানো,নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন এবং তাদের কাঙ্খিত নতুন সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চারই একটি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব ও লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের চেতনায় শিক্ষার্থীদের উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষে মানুষে মৈত্রী,প্রীতির মনোভাব এবং মানাবাধিকার,দৈহিক শ্রম ও মানবিক মর্যাদার প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টি করতে হবে।

আমাদের সংবিধানের ৩, ১৫ ও ১৭ নং ধারায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা দর্শনের মূল বীজ বা চেতনা নিহিত। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা বিষয়ে ১৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র- (ক) একইপদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছা-প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য। এরূপ স্পষ্ট সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকার পরও দেশের রাষ্ট্র প্রধানের কাছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা বাতিলের রিট কিভাবে “খুচরা ব্যাপার” হয় ?