একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ধর্ষণ বিষয়ে কথা বলা বা লেখা দারুণ স্পর্শকাতর একটি বিষয়। আমরা সকলেই জানি এটা কোনও সাধারণ শারীরিক আক্রমণ নয়, এটা কোনও সাধারণ অপরাধ নয়। অনেক দাগী অপরাধের সাথে অপরাধ হিসাবে ধর্ষণের পার্থক্য হচ্ছে এই ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের উপরে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত তৈরী হয়। আক্রান্ত হবার পর ধর্ষিতার মানসিক অবস্থা বোঝার চাইতে দুর্বহ কোনও কিছু হতে পারেনা। এটা নিজের শরীরকেই একটা শবদেহের মতো বয়ে বেড়ানোর মতো। শারীরিক ক্ষত সেরে উঠলেও মানসিক ক্ষত প্রায়শই সারা জীবনেও সেরে ওঠেনা। বিশেষত যেখানে সমাজ এই ধরনের অপরাধের আক্রান্ত নারীর সেরে ওঠার দায়িত্ব নেয়না, তাঁর শুশ্রূষার দায়িত্ব নেয়না, সেখানে এর পরিণতি আরো করুন, মর্মান্তিক হয়। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর একটি বড় অংশে নারী ও কন্যা শিশুদের ধর্ষণ বিষয়ে কোনও রকমের সচেতনতা তৈরী করা হয়না। একথা তো আমাদের সবারই জানা ভারতবর্ষে নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি বঞ্চনা, অপমান, শারীরিক আক্রমন সর্বগ্রাসী। তাই একদিকে যেমন নারী ও কন্যা শিশুদের শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশী, অন্যদিকে আক্রান্ত হলে পরিবার ও সমাজের যে সহানুভুতির উষ্ণতা দিয়ে আক্রান্ত নারীকে সেরে উঠতে সাহায্য করার কথা, তাও বিরল। তাই অপরাধ হিসাবে এর মাত্রা ভিন্ন, এটা সবচাইতে ভয়াবহ অপরাধগুলোর একটি। দুনিয়ার সকল দেশেই। আমাদের দেশে ধর্ষণ বলতে কেবল বলপূর্বক দেহসংশ্রবে বাধ্য করার ঘটনাকেই বোঝানো হয়, যদিও উন্নত বিশ্বে যেকোনো ধরনের “অনিচ্ছুক” শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করাকেই ধর্ষণ বলে ধরে নেয়া হয়। সেই অর্থে দাম্পত্য ধর্ষণের ঘটনাও প্রচুর ঘটে থাকে। বাংলাদেশে যে ধরনের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তা সুস্পষ্ট ভাবেই শুধু নারীকে অনিচ্ছুক শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করা নয়, এর সাথে যুক্ত হয় ভয়াবহ রকমের শারীরিক নির্যাতন বা ভায়োলেন্স এর ঘটনা। প্রায়শই আক্রান্ত নারীকে হত্যা করা হয়। সকল অর্থেই ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ, ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সামাজিক পর্যায়ে যে ক্ষত সেরে ওঠার নয়।

এই আপাদ দীর্ঘ ভূমিকাটির দেয়ার উদ্দেশ্য ধর্ষণ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার একটা সহজ বয়ান উল্লেখ করা। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ব্লগে, ধর্ষকের শাস্তি কি হওয়া উচিৎ সে প্রসঙ্গ নিয়ে এক দীর্ঘ, অনাকাংখিত বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে মুক্তমনা, নারীবাদী ও প্রগতিশীল মানুষেরা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে উঠেছেন। এটা অনাহুত, অপ্রীতিকর এবং ক্ষতিকর। মুক্তচিন্তার আন্দোলনের জন্যে, নারীবাদী আন্দোলনের জন্যে এবং যে কোনো মানবতাবাদী চর্চার জন্যে এই ধরনের বিরোধ ক্ষতিকর। ব্যক্তিগতভাবে আমার দায় হচ্ছে, এই সমগ্র বিতর্কটি শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার একটি পোষ্টকে কেন্দ্র করে। যে বিপুল সংখ্যক প্রতিক্রিয়া আমি দেখেছি, শুনেছি তার সবগুলো আমার পড়া হয়নি। প্রতিনিধিত্ত্বশীল কয়েকটি লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, একটা নিশ্চিত ভুল বোঝাবুঝির ফলশ্রুতি এই ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। “ভুল” টা কোথায় হচ্ছে সেটা আমি ও অনেকেই চিহ্নিত করতে পেরেছি এবং তাঁর ব্যাখ্যাও দিয়েছি। কিন্তু তাঁর ফলাফল শেষ পর্যন্ত হয়েছে তিক্ত। ব্যক্তিগত ভাবে আমি তাই দায়বোধ করি এই বিতর্কের একটা যৌক্তিক উত্তর দেয়ার, যা আমার নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষকের শাস্তি হিসাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপরাধীর “লিঙ্গ কর্তনের” ঘটনা ঘটেছে। এই লিঙ্গ কর্তনের ঘটনাগুলো কখনও ঘটেছে আক্রান্ত নারীর আত্মরক্ষার অংশ হিসাবে আবার উত্তেজিত জনতা “মব জাস্টিস” বা জনতার আদালত ধরনের উদ্যোগে ধর্ষণকারীকে আয়োজন করে প্রকাশ্যে হিংস্রভাবে তাঁর অঙ্গহানি ঘটিয়েছে। কখনও জনতা নিজেই তা করেছে আবার কখনোবা মাংসের দোকানের কসাইকে দিয়ে ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করানো হয়েছে। অথচ সকল ক্ষেত্রেই অপরাধিকে পুলিশে তুলে দেয়াটাই প্রধান দায়িত্ব ছিলো। এই সকল ঘটনার সংবাদ সমূহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে অনেকেই দাবী করেছেন ধর্ষকের অপরাধের শাস্তি “লিঙ্গ কর্তন” হওয়া উচিৎ। যারা দাবী করেননি তাঁদের অনেকেই বাহবা দিয়েছে কিংবা নিদেন পক্ষে ধর্ষকের “লিঙ্গ” নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছেন। যারা এই রকমের দাবী করেছেন তাঁরা নারীবাদী কিনা তা আমার জানা নেই। অন্তত আমার পরিচিত কোনও নারীবাদী লেখক বা ব্লগারকে আমি এভাবে দাবী করতে দেখিনি। যদিও ব্লগ আকারে অনেক নারীবাদী লেখক দাবী জানিয়েছেন “লিঙ্গ কর্তন” বা “খোজাকরণ” ইত্যাদি শাস্তির, আমি এই লেখায় সে প্রসঙ্গ আংশিক আলোচনা করবো। প্রথমেই দেখে নেয়া যাক আমি আসলে কি লিখেছিলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের পাতায় আমার ছোট্ট লেখাটিতে।


(এখানেও দেখে নিতে পারেন)

আমার মূল বক্তব্যটি ছিলো, ধর্ষকের অপরাধের শাস্তি হিসাবে “লিঙ্গ কর্তন” অমানবিক, মধ্যযুগীয় যা আমাদের আধুনিক সময়ের মানবাধিকারের মূল্যবোধের পরিপন্থী। ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ সেটা আমি উল্লেখ করেছি এবং উল্লেখ করেছি ধর্ষণের কঠোর শাস্তি হতে হবে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে। পুরো বিষয়টিকে উল্লেখ করবার জন্যে আমি আমার চিকিৎসক জীবনের একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করি । আমার অভিজ্ঞতাটি ছিলো কেবলই একটি ঘটনার উদাহরণ। আমার লেখাটিতে আক্রান্ত নারিটির আত্মরক্ষার অধিকার বিষয়ে কোনও মন্তব্য ছিলোনা। কেননা, এটা যেকোনো কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষই জানেন, আত্মরক্ষার অধিকার যে কারো মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু বিচিত্র কারণে, এই ছোট্ট লেখাটি থেকে ধর্ষকের শাস্তি লিঙ্গ কর্তন হতে পারে কিনা সেই প্রসঙ্গ টিকে বাদ দিয়ে, উপেক্ষা করে, আমাদের নারীবাদী বন্ধুদের একটি বিশেষ উপদল ধর্ষণে আক্রান্ত নারীর আত্মরক্ষার অধিকারের বিপরীতে আমার লেখাটিকে দাঁড় করিয়ে দেন। তারপরে দলগতভাবে আমাকে দানবীয় আকৃতি দানের উৎসবে মেতে ওঠেন।

আমার পোষ্টটিতে অস্বচ্ছতা ছিলো, আমার বক্তব্যকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে। ফলে আমি দ্বিতীয় আরেকটি পোষ্ট দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি, যে “লিঙ্গ কর্তনের” বিষয়টি আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মরক্ষার অংশ হিসাবে ঘটে থাকার সাথে আমার প্রসঙ্গটি যুক্ত নয়। আমি উল্লেখ করেছি, একজন আক্রান্ত নারী তার নিজেকে রক্ষা করার জন্যে যেকোনো কিছু করতে পারেন। এমন কি তিনি খুন ও করে ফেলতে পারেন। সেই অধিকার তার আছে, প্রতিটি মানুষের আছে। আমি দ্বিতীয় পোষ্টটিতে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছি, প্রসঙ্গটি হচ্ছে তাঁদের জন্যে যারা ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে “লিঙ্গ কর্তন” দাবী করেন। এবং আমি তাঁদের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। নারীবাদী বন্ধুদের সংশয় ও ভুল বোঝাকে দূর করতে পারেনি। আমার দ্বিতীয় পোষ্ট টি পড়ে দেখুন।

(এখানেও দেখে নিতে পারেন)

এরপরে তাঁরা আবিষ্কার করেন আমি ধর্ষকের প্রতি মানবিক এবং ধর্ষকের মানবাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলি, তাই আমি ধর্ষকের সমগোত্রীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার দ্বিতীয় পোষ্টটির পরে আমি মানবাধিকার প্রসঙ্গে আরো একাধিক পোষ্ট দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি যে অপরাধীর প্রতি আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে যত ঘৃণাই থাকুক না কেনো, বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদ একজন কুখ্যাত অপরাধীর মানবাধিকারও নিশ্চিত করে। অপরাধীর মানবাধিকা প্রশ্নে আমার ছোট লেখাটি এখানে দেখে নেয়া যেতে পারে। (এখানে )

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার এই ব্যাখ্যা এবং পুনরায় ব্যাখ্যা খুব কাজে লাগেনি। আমাদের নারীবাদী বন্ধুরা, আমার ব্যাখ্যাগুলোকে পড়া বা বোঝা তো দূরের কথা তাঁরা সম্ভবত সেসব চোখ দিয়েও উল্টে দেখেননি । আমার লেখাগুলো পড়া ও আলোচনা বা বিতর্কে অংশ নেয়ার বদলে তাঁরা আমাকে এবং আরো বেশ কজন অনলাইন এক্টিভিস্ট, ব্লগারকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা শুরু করলেন। অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে, ট্রল করা হয়েছে, নাম বিকৃত করে হাসি ঠাট্টা করা হয়েছে। এটা অনাকাংখিত হলেও অস্বাভাবিক নয়, আমাদের অনলাইন সংস্কৃতির গড়-পড়তা মান এমনটাই। তাই আমি অবাক হইনি। তবে আমি প্রয়োজন বোধ করেছি, যারা এই বিতর্কগুলোকে সুস্থ বিতর্ক হিসাবে এগিয়ে নিতে চান, তাঁদের জন্যে এই লেখাটি তৈরী করার। ব্লগে যতটা স্থান পাওয়া যায় নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করার “ফেসবুক” এ ততটা পাওয়া যায়না। আশা করছি এখানে আরেকটু স্বচ্ছ করে ব্যাখ্যা করা যাবে। সেজন্যেই মুক্তমনার দ্বারস্থ হওয়া।

“ফারস্ট থিং ফার্স্ট”
তিনটি স্ট্যাটাসকে যুক্ত করেও আমাদের নারীবাদী বন্ধুরা বুঝতে পারেননি অপরাধ হিসাবে ধর্ষণের প্রতি আমার বা আমার মতো ব্লগারদের মনোভাব কেমন। আমি নিশ্চিত নই তাঁদের পাঠের সততা প্রসঙ্গে। তবে আমি ধরে নিচ্ছি তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আমার লেখা এতোটাই অস্বচ্ছ ছিলো যে তাঁরা সততার সাথে পাঠ করেও তার মর্ম উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয়তো আমার লেখাটির গড়ন জটিল ছিলো, দুর্বোধ্য ছিলো। তাই সেই সকল পাঠকের জন্যে ছোটবেলায় পড়া সীতানাথ বসাকের আদর্শ লিপির চাইতেও সহজ ভাষায় লিখছি। অনেকটা আজকালকার কাস্টোমার সার্ভিস ওয়েবপেইজগুলোতে যেমন “ফ্রিকোয়েন্টলি আসকড কোয়েশ্চেন” বিভাগ থাকে, ঠিক সেই রকমের করে। দেখুন তো আপনাদের বোঝাপড়ার পরিবর্তন হয় কিনা।

নারীবাদী প্রশ্নঃ আপনি কি ধর্ষণকে একটি অপরাধ মনে করেন?
উত্তরঃ ধর্ষণ একটি আদিম ও ভয়াবহ অপরাধ। বাংলাদেশে ধর্ষণের সামাজিক সংজ্ঞা হচ্ছে “বলপূর্বক সঙ্গম বা শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করা”। কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য সভ্য সমাজে ধর্ষণের সংজ্ঞা আরো বিস্তৃত। যেকোনো অনিচ্ছাকৃত সঙ্গমে বাধ্য করাটাই ধর্ষণ। এই বিস্তৃত সংজ্ঞানুযায়ী, দুনিয়ার একটা বিরাট সংখ্যক নারী আসলে তার স্বামী, প্রেমিক কিংবা নিকট সম্পর্কের পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত। এটাও একই অপরাধ। কয়েকটি সভ্য দেশে, স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে, কারণ সেখানে নারী অভিযোগ করতে পারে। বাংলাদেশে যাকে আমরা ধর্ষণ বলি সেটা মূলত দুটি ভয়াবহ অপরাধের মিশেল – বলপূর্বক সঙ্গম এবং নারীর প্রতি সহিংসতা। দুটোই কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নারীবাদী প্রশ্নঃ আপনি কি ধর্ষণের শাস্তি চান?

উত্তরঃ নিশ্চিতভাবেই চাই। বিশেষত বাংলাদেশে আমরা ধর্ষণ বলতে যা বুঝি তা আসলে দুইটি কখনও কখনও তারও অধিক অপরাধের সমষ্টি। আমি চাই প্রতিটি অপরাধের আলাদা আলাদা শাস্তি। সেই অর্থে ধর্ষণের শাস্তি হতে পারে চল্লিশ বছর বা পঞ্চাশ বছরের কারাদন্ড।

নারীবাদী প্রশ্নঃ ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড হওয়া দরকার। আপনি কি মনে করেন?
আমি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। কোনও অপরাধের জন্যেই আমি মৃত্যুদন্ড চাইনা। অপরাধের মাত্রাভেদে তা সামাজিক সংশোধন থেকে শুরু করে আজীবন বন্দীত্ব হতে পারে, কিন্তু মৃত্যুদন্ড নয়।

নারীবাদী প্রশ্নঃ ধর্ষণের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে একজন ভিক্টিমের আত্মরক্ষার অধিকার কে কি আপনি স্বীকার করেন?

উত্তরঃ মানুষের আত্মরক্ষার অধিকার কারো স্বীকার করা না করার অপেক্ষা রাখেনা। এটা মানুষের মানবিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। ধর্ষণের হাত থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যে একজন ভিক্টিম প্রাকৃতিকভাবেই চেষ্টা করবেন। শুধু তাই নয়, বেশীরভাগ দেশে আক্রমনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আত্মরক্ষা বিষয়টি আইন দ্বারাই নির্ধারিত ও সুরক্ষিত।

নারীবাদী প্রশ্নঃ ধর্ষকের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে একজন নারী যদি ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করে সেটার অধিকার কি তার আছে?

উত্তরঃ আত্মরক্ষার জন্যে একজন নারী/মানুষ যেকোনো কিছু করতে পারেন। তা মুন্ডু কর্তন বা লিঙ্গ কর্তন। এটাও বেশীর ভাগ দেশে আইনী অধিকারের মধ্যে পড়ে। আমার জানা নেই, এমনভাবে কোথাও লেখা আছে কিনা কি কর্তন করা যাবে আর কি কর্তন করা যাবেনা। ধর্ষণ কোনও সাধারণ শারীরিক আক্রমণ নয়, তাই এ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে একজন নারী যেকোনো কিছুই করতে পারেন । সেখানে লিঙ্গ কর্তন বা মুন্ডু কর্তনের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।

নারীবাদী প্রশ্নঃ ধর্ষকের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার সময় আত্মরক্ষার জন্যে করা আঘাতের ক্ষেত্রে কি মানবিক হতে হবে?

উত্তরঃ এই ধরনের প্রশ্ন প্রমান করে, যে প্রশ্নকারী মূল প্রসঙ্গের বিষয়ে আগ্রহী নন। অথবা তিনি হয়তো “আত্মরক্ষা” ধারণাটিই জানেন না। আত্মরক্ষা হচ্ছে একটি রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তী প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষের মস্তিষ্কের একটি স্বয়ংক্রিয় বা অটোনোমাস পদ্ধতি কাজ করে। এই প্রক্রিয়াটি একটি বড় ভিমরুলের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কিম্বা একজন ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার জন্যে একইভাবে কাজ করে। সুতরাং আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে মানবিকতার বা মানবাধিকারের প্রশ্নটি একটি কূট-কচাল। বাঙালী যেহেতু কুট-কচাল ভালোবাসেন, তাই এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিচ্ছি – নিজেকে সম্ভাব্য আক্রমনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে মানবিক হওয়ার কোনও দরকার নেই, কেননা “আত্মরক্ষার” প্রক্রিয়াটি আপনার পরিকল্পনা মাফিক হয়না, এটা আপনার মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় অংশটি সিদ্ধান্ত নেয়।

নারীবাদী প্রশ্নঃ আপনি কি ধর্ষকের প্রতি মানবিক? কিম্বা আপনি কি মনে করেন ধর্ষকের কোনও মানবাধিকার থাকা উচিৎ?
ধর্ষকের প্রতি আমার কোনও ব্যক্তিগত সহানুভূতি নেই। আমি মনে করি, বিচারিক আদালতে প্রতিটি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিৎ। এমন কি যদি কোনও ধর্ষক একজন নারীকে/শিশুকে একাধিকবার বা অনেকবার ধর্ষণ করে, প্রতিটি ঘটনা আলাদা অপরাধ হিসাবে গন্য করা উচিৎ (দুনিয়ার অনেক সভ্য দেশে তা করা হয়) এবং এই সকল অপরাধের সমতূল্য শাস্তি হওয়া উচিৎ। মানবাধিকার প্রশ্নে, আমি মানবাধিকারের বিশ্বজনীন চুক্তিতে আস্থা রাখি। এই বিশ্বজনীন চুক্তি অনুযায়ী, দুনিয়ার তাবৎ মানুষের মানবাধিকার সমান। সেই অর্থে অপরাধীরও মানবাধিকার আছে। তার মানবাধিকার শুধুমাত্র ততটুকুই ক্ষুণ্ণ হয় যা একটি বিচারিক আদালতের মাধ্যমে “শাস্তি” হিসাবে নির্ধারিত হয়। সেই অংশটুকু ব্যতীত সকল অপরাধীরও মানবাধিকার আছে। অপরাধীর প্রতি ব্যক্তিগত সহিংসতা অপরাধকে কমায়না।

নারীবাদী প্রশ্নঃ ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে “লিঙ্গ কর্তন” এর দাবীকে কে আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তরঃ এটা একটা আদিম বর্বর দাবী। এই দাবী যারা করেন বা করছেন তাঁরা ধর্ষনের কারণ, এর সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা রাখেন না। আমি সন্দেহাতীতভাবে এই ধরনের বর্বর দাবীর বিরুদ্ধে।

ব্যস, এখানেই থামছি। এই ডায়ালগধর্মী প্রশ্নোত্তর অংশটুকুকে অনেকের কাছে কৌতুকপ্রবণ মনে হতে পারে, কিন্তু ধর্ষণ ও ধর্ষকের শাস্তি প্রসঙ্গে আমাদের সামাজিক কাণ্ডজ্ঞানের যে নমুনা সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তাতে আমার মনে হয় এই প্রশ্নোত্তর পর্বটি প্রয়োজনীয়। আমি জানি, এখান থেকেও কেউ কেউ এমন কিছু আবিষ্কার করবেন যা দিয়ে আমাকে বা আরো অনেক মুক্তমনা অনলাইন এক্টিভিস্ট কে “ধর্ষক”, “ধর্ষণ প্রবণ”, “ধর্ষকের সমর্থক” ইত্যাদি বানিয়ে দেয়া যাবে।

যাক এ বিষয়ে আমি আর বিতর্ক উত্থাপন করবোনা এখানে। এবারে বরং মূল প্রসঙ্গে ঢুকি।

মূল ভাবনার শুরু
ধর্ষণের শাস্তি “লিঙ্গ কর্তন” একটি আদিম, বর্বর দাবী। এর সাথে বর্বর আরব সংস্কৃতির মিল আছে। মধ্যযুগে দুনিয়ার আরো বেশ কিছু দেশে এই আইন চালু ছিলো। এমন কি সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও এই আইন প্রবর্তনের কথাবার্তা হয়েছে। ধর্ষণের শাস্তি বিষয়ে বাঙালীর মনোভাবের বিষয়ে আমার এই অনুসন্ধানটির শুরুটা একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ থেকে। সেই কথাটি একটু বলি।

সাম্প্রতিক সময়ে, একজন ফেসবুক সেলেব্রিটি একটি টিভি শোতে গিয়ে বাংলাদেশের নারীবাদীদের গালিগালাজ করে আসেন। তিনি থার্ড ওয়েভ নারীবাদকে শরীর ও যৌনতা সর্বস্ব বলে উল্লেখ করেন। তার এই সকল গাঁজাখুরি কথাবার্তা ও অনুষ্ঠানের আলোচনার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ পোর্টাল এর কথা উঠে আসে। এই পোর্টালটি বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় হলেও আমার কখনও পড়া হয়ে ওঠেনি। গুগোল করে দেখলাম, এই পোর্টালে শত শত লেখা ছাঁপা হয়েছে। বিভিন্ন লিংক এর সূত্র ধরে আমি পোর্টালটি ঘুরেফিরে দেখি ও এর লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করি। প্রথম দুসপ্তাহে, নতুন পুরনো মিলিয়ে আমি সম্ভবত গোটা তিরিশেক আর্টিকেল পড়ে ফেলি। একটি পুরনো আর্টিকেল পড়তে গিয়ে আমার চোখ ও মস্তিষ্ক আটকে যায়। ব্লগটির শিরোনাম – “ধর্ষণের শাস্তি হোক কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন”। শিরোনামটি আগ্রহ উদ্দীপক। তাই লেখাটি কয়েকবার পড়েছি। সোজা বাঙলায় কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন মানে হচ্ছে ঔষধ দিয়ে পুরুষের যৌনক্ষমতা বা ইচ্ছা ধ্বংস করা। এটা আংশিক কিংবা স্থায়ী দুভাবেই করা যেতে পারে। লেখাটিতে লেখক পাঁচটি প্রধান বিষয় উল্লেখ করেছেন –

১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কম্পিউটার বিজ্ঞানী এলান টুরিংকে সমকামীতার অপরাধে কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন করা হয়। যার পরিনতিতে তিনি এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করেন।

২। ধর্ষণের যে সকল সমাজতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়া হয় আমাদের চারপাশে সেসকল ব্যাখ্যা প্রায়শই অর্থহীন মনে হয় এই লেখকের কাছে।

৩। এলান টুরিং এর অভিজ্ঞতাকে উল্লেখ করে তিনি জানান – কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন এর ফলে মানুষটি শুধু তার যৌনক্ষমতাই হারান না, যৌনক্ষমতা হারানোর অভিজ্ঞতা তাকে কুরে কুরে যন্ত্রনা দেয় এবং এক পর্যায়ে তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এটা হচ্ছে যন্ত্রনা পেয়ে মৃত্যুবরণ করা।

৪। তিনি মনে করেন – ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড খুব যথেষ্ট শাস্তি নয়। কেননা মৃত্যুদন্ড খুব সাময়িক যন্ত্রনাকর একটি বিষয়। ধর্ষকের শাস্তি হওয়া দরকার দীর্ঘ যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে।

৫। যেহেতু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড যথেষ্ট নয়, তাই তিনি প্রস্তাব করছেন, ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন করে দেয়ার। তাতে ধর্ষক তার যৌনতা হারাবে এবং যন্ত্রণাদগ্ধ হয়ে একদিন আত্মহত্যা করবে। এটাই হতে পারে ধর্ষণের যথাযথ শাস্তি।

তিনি উল্লেখ করছেন এভাবে –

যদিও এই লেখক উল্লেখ করছেন যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন শাস্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, বাস্তবত তিনি এর স্বপক্ষে কোনও রেফারেন্স দেননি। বাস্তবত ইন্দনেশিয়া হচ্ছে একমাত্র দেশ যেখানে কেমিক্যাল ক্যস্ট্রেশন কোনও রকম সামাজিক বাঁধা ছাড়াই আইন হিসাবে গৃহীত হয়েছে। দুনিয়ার সভ্য সকল অংশে কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন কোনও শাস্তি নয়, এটা একটা অপশন যা একজন ধর্ষক বা সম্ভাব্য ধর্ষক নিজে নির্বাচন করতে পারেন। কিন্তু প্রায় সকল সভ্য দেশে এর নৈতিক বৈধতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আগ্রহী পাঠকেরা এখানে পড়ে নিতে পারেন লেখাটি (এখানে ) এই প্রবন্ধের লেখক, প্রথমত একজন নাগরিক হিসাবে তিনি প্রস্তাব করতেই পারেন ধর্ষণের শাস্তি কি হতে পারে। কিন্তু আমি অবাক হয়েছিলাম যে তিনি ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ডকে যথেষ্ট মনে করছেন না, কারণ মৃত্যুদন্ড যথেষ্ট নিষ্ঠুর, যন্ত্রনাদায়ক ও নির্দয় নয়। তাই তিনি ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ডের চাইতে “কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন” বা ঔষধ দিয়ে পুরুষকে নপুংশক করে দেয়ার পদ্ধতিকে শাস্তি হিসাবে দাবী করছেন। কেননা এটা মৃত্যুদন্ডের চাইতেও অনেক নিষ্ঠুর, যন্ত্রনাদায়ক। তিনি শুধু এই দীর্ঘ যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির দাবী করছেন না , তিনি প্রস্তাব করছেন, এই রকমের দশজন অপরাধীকে প্রকাশ্যে এভাবে শাস্তি দিতে হবে এবং জনগনকে জানাতে হবে তাঁদের জীবনের করুণ পরিনতির কথা। এই লেখকের প্রস্তাবনার সাথে শরিয়া আইনের প্রকাশ্যে হাত কেটে দেয়া কিংবা প্রকাশ্যে নারীকে পাথর ছুঁড়ে মারার মতো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এটা কি আমাদের আধুনিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?

এই বিষয়টি আমার আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দেয়। আমি বোঝার চেষ্টা করি আসলে ধর্ষণের শাস্তি প্রসঙ্গে বাঙালীর ধারণা বা মনোভাব কেমন? আমি বিস্মিত হই, অনলাইনে এই রকমের শতাধিক লিংক যেখানে ব্লগ, সংবাদ আইটেম, সংবাদপত্রের মন্তব্য, ফেসবুকের মন্তব্য, স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে “লিঙ্গ কর্তনের” দাবী তুলে। এমন কি সেই আলোচিত পোর্টালেই আরেকটি ব্লগ পড়েছি যেখানে লেখক উল্লেখ করছেন তিনি আগে ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে “লিঙ্গ কর্তন” দাবী করতেন কিন্তু এখন করেন না। তারপর তিনি ব্যাখ্যা করছেন কেনও এখন আর তিনি লিঙ্গ কর্তন সমর্থন করেন না। এই ব্লগটির লেখক ব্যক্তিগতভাবে আমার – আমাদের অনেকেরই বন্ধুস্থানীয়, একজন প্রগতিশীল লেখক, এবং আইনজীবী। যদিও তিনি এখন আর ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে “লিঙ্গ কর্তন” কে সমর্থন করেন না, তবুও তার মতো একজন প্রগতিশীল মানুষ এবং আইন পেশায় প্রশিক্ষিত মানুষও এক সময় এই দাবীটিকে সমর্থন করতেন (হয়তো মৌন ভাবে), তাঁর সেই সরল স্বীকারোক্তিটি আমার বিস্মিত করেছে, আতংকিত করেছে। যদিও তার ব্লগপোস্টটি লিঙ্গ কর্তনের মতো বর্বর ধারণার বিরুদ্ধেই লিখেছেন তিনি, খানিকটা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সহ লেখাটির সাথে আমি পাঠক হিসাবে একমত। এখানে পড়া যেতে পারে লেখাটি (এখানে)। আরো একজন তরুন ব্লগার প্রিয় ডট কম এ ব্লগ লিখেছেন কেনো লিঙ্গ কর্তন ধর্ষণ প্রতিরোধের কোনও সমাধান নয় (এখানে)

এই দুই লেখক যেখানে যুক্তি দিয়ে বলছেন লিঙ্গ কেটে ধর্ষণ কমানো যাবেনা, সেখানে আরেকজন ব্লগার বলছেন পুরুষের যদি পুরুষাঙ্গ না থাকে তাহলে তো সে ধর্ষণ করতে পারবেনা, সেটাই কার্যকরী পথ।দেখুন তার প্রস্তাবনাটি কেমন (এখানে) –

“ধর্ষণের কারণ, নারী পোশাক, মেকআপ, হিজাব…এগুলো নিয়ে অনেক কথা অনেকেই বলেছেন, ধর্ষণ নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্ষণ বহির্ভূত নির্যাতন নিয়েও আদিম কাল থেকে লেখালেখি হচ্ছে। কে কাকে উস্কাচ্ছে এটা তো অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয় !

কিন্তু খুব কি দোষের হবে ধর্ষণের প্রতিবাদে পুরুষের লিঙ্গ কর্তন করতে চাইলে?
আদৌ কি পুরুষাঙ্গহীন পুরুষ ছাড়া ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব? কারণ ও তো উত্থিত হবেই প্রাকৃতিক নিয়মে!”

আরেকটি ব্লগে লেখক নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী পরিচয় দিয়ে লিখেছেন ধর্ষণের শাস্তি নিয়ে। তার ব্লগের শিরোনাম – “ঐ হারামীদের লিঙ্গ কর্তনের দাবী তুলুন”। এই লেখায় তিনি লিখেছেন –

”প্রতিটি ধর্ষকের চরম শাস্তি তার লিঙ্গ কর্তনের মাধ্যমেই হওয়া উচিত । কারণ, এই আলগা মাংস পিন্ডটা সে সামলাতে পারেনা । এটাই হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ।
চলুন, আমরা আমাদের খাসলতগুলা বদলাই সেই সাথে ওই হারামজাদাদের লিঙ্গ কর্তনের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করি। আমরা যে মানুষ তার পরিচয় দেই।“
(এখানে )

এমন কি মূলধারার অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ২৪ডট.কম এর ব্লগ বিভাগেও এই রকমের একটি ব্লগ ছাপা হয়েছে যেখানে লেখক ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় হিসাবে মোট আটটি প্রস্তাবনা করেছেন যার প্রথমটি হচ্ছে ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন। তিনি লিখছেন এভাবে –

১) ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন! সব নারীর নিজের সাথে একটা করে ধারালো ব্লেড রাখা জরুরি, যাতে সেটা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন! লিঙ্গ কর্তনের আরেকটা সুবিধা হলো ওই নরপশু তার বাকি জীবন নপুংসক হয়ে কাটিয়ে দিবে আর নিজের কৃতকর্মের জন্য সর্বক্ষণ নিজের মরণ কামনা করবে!

(এখানে)

এই তালিকা দীর্ঘ করতে চাইনা। আগ্রহী পাঠকেরা নিজেরাও খোঁজ করে দেখতে পারেন। সুতরাং যারা বলছেন – ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে লিঙ্গ কর্তনের দাবী কেউ করেননি, তাঁরা দয়া করে একটু চোখ কান খুলুন আর নিজের কাছে একটি সততার পরিচয় দিন। তাহলে কি দাঁড়ালো? ধর্ষণ বিষয়ে মানুষ মূল সমস্যাটিকে সমাধানের পথ না খুঁজে বরং এক ধরনের নৈরাজ্যবাদী ধারণাকে প্রচার করে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ধরনের নৈরাজ্যবাদ আসছে আমাদের বাংলাদেশী কথিত উচ্চশিক্ষিত বর্গের কাছ থেকে।

ধর্ষকের শাস্তি “লিঙ্গ কর্তন” হতে পারে কিনা, এই প্রশ্নটিতে আমাদের বাংলাদেশি অনলাইন নারীবাদীরা কোনরকমের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অংশগ্রহণ না করে বরং এই প্রশ্ন উত্থাপন করার জন্যে আমাকে ও আমার মতো আরো কয়েকজন ব্লগারকে স্থুল আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে তাঁরা তাঁদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিকে উন্মুক্ত করেছেন। যা হাস্যকর এবং কৌতুকময়।

শেষ কথা

অন্নপূর্ণা দেবী নামের একজন ব্লগারের একটি ছোট ব্লগ দিয়ে শেষ করতে চাই এই আলোচনাটি। ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে তিনি তার একটি ছোট ব্লগপোস্ট এ লিখেছেন এভাবে –

“বলেছিলাম- ধর্ষণ কেন হয়? কারা করে? কাকে করে? এর থেকে প্রতিকারের উপায় কি?

আমরা শর্টকাট ওয়ে পছন্দ করি, এই প্রশ্নগুলো ছাপিয়ে শাস্তিকেই সমাধান দিচ্ছি সবাই। কেউ কেউ ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন, কেউ প্রকাশ্যে হত্যা বা কেউ কেউ আবার এক কিলোমিটার দূরে দূরে বেশ্যালয় চাচ্ছেন। এটা হলে ঠক বাছতে গ্রাম উজাড় হবে। অনেকেই বলে থাকেন ৯৯% পার্সেন্ট পুরুষ মগজে মননে ধর্ষক। এতে করে পুরো পুরুষজাতির খোজা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

আপনি জন্মনিরোধ পদ্ধতি ব্যবহার করলে বাচ্চা হবে না, তা না করে আপনি প্রত্যেকবার গর্ভপাত করাচ্ছেন, এইটা তো সমাধান নয়।

আমাদের এমন কিছু সমাধান দরকার যা করলে ধর্ষণ রোধ হবে, ধর্ষকের শাস্তি পরের বিষয়। আগে ধর্ষক যাতে তৈরি না হয় সেরকম শিক্ষা দরকার। আগে আমি আপনি যেন ধর্ষক না হই, সেজন্য কি করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?”

অন্নপূর্ণা দেবী, ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ (এখানে )

এই ছোট অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখাটিতে তিনি লিখেছিলেন ২০১৬ সালের ২৯ শে মার্চ। এবং দেখুন তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উল্লেখ করছেন ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন, প্রকাশ্য হত্যা ইত্যাদি শাস্তির কথা। এবং তিনি বলছেন ধর্ষকের শাস্তির চাইতেও জরুরী বিষয় হচ্ছে ধর্ষক যেনো তৈরী না হয়, সেই সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কথা। তিনি বলছেন – “ধর্ষকের শাস্তি পরের বিষয়”। আহা, আমি সুখী ধর্ষকের শাস্তিকে “পরের বিষয়” বলেও তাকে আমার বা আমাদের মতো আক্রান্ত হতে হয়নি। ধর্ষকের শাস্তি পরের বিষয় নয়, বরং শাস্তিই হতে হবে সবার আগে, সেই সাথে খুঁজে বের করতে হবে ধর্ষণের আর্থ -সামাজিক কারণগুলোকে। ধর্ষণকারীদের সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির উৎসকে চিহ্নিত করতে হবে। আমি অন্নপূর্ণা দেবীর এই বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ একমত। এবং বিস্ময়কর সত্যি হচ্ছে – আমার কথাটিও তাই, লিঙ্গ কর্তন করে ধর্ষণ কমানো যাবেনা, কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন করে ধর্ষণ কমানো যাবেনা। পুরুষ যেনো ধর্ষক না হয় সেই কাজটাকেই এগিয়ে নিতে হবে। শাস্তি নয়, বরং সমাজের রূপান্তরই হতে পারে সমাধান।

লিঙ্গ কর্তন বিষয়ে আমার আপত্তির যুক্তিটা নীতিগত, মানুষ যে বর্বরতাকে মধ্যযুগে ফেলে এসেছে, তাকে আবার এই আধুনিক কালে ফিরিয়ে আনার মাঝে কোনও গৌরব নেই। ধর্ষণের মতো জটিল ও ভয়াবহ সমস্যাকে আধুনিক মানুষের মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। মূল শেকড়টাকে উপড়ানো জরুরী, কিছু ডালপালা কেটে বিষবৃক্ষ কে দূর করা যায়না।

আপাতত আবারো সীতানাথ বসাকের ভাষায় বলছি – ধর্ষণ একটি ভয়াবহ অপরাধ। এটা মনুষ্যত্যের চরম লঙ্ঘন। এর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে হবে, দ্রুততার সাথে। সম্ভাব্য ধর্ষকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবার জন্যে নারীর প্রস্তুতি থাকা দরকার এবং আত্মরক্ষায় নারীর অধিকার আছে যেকোনো পন্থা অবলম্বনের। ধর্ষকের শাস্তি হতে হবে প্রচলিত আইনে এবং একটা সর্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার এই অপরাধের বিরুদ্ধে। ধর্ষকের সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির উৎসকে চিহ্নিত ও আঘাত করতে হবে।

ধর্ষণের শাস্তি নিয়ে কথা বলার এই অভিজ্ঞতায় আমি ভীত নই। অপরাধীর মানবাধিকার নিয়ে লেখার কারণে আমাকে ধর্ষকের কাতারে ফেলে দেয়াতেও আমি ভীত নই। আমি লিখবো, আরো বেশী করে লিখবো। গভীর ভাবনা ও বিশ্লেষণ সহকারেই লিখবো। আগ্রহী বন্ধুদের জন্যে, নারীবাদীগণ যারা আমাকে ও আমাদেরকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছেন, তাঁদের ভাবনাগুলো নিয়েও লিখবো। মানবতাবাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, তবু সেটাই তো মানুষের পথ, তাইনা?

নারীবাদী কবি প্রয়াত মল্লিকা সেন গুপ্ত আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাঁর একটি কবিতার নাম “মেয়েদের অ আ ক খ”, দেখুন এই কবিতার মুখের অংশটুকুতে তিনি কি লিখেছিলেন, দেখুন হে নারীবাদী বন্ধুরা, পড়ে বুঝতে পারেন কিনা আরেক নারীবাদীর কবিতা।

“অনেক তো হলো মানবিকতার ভাষ্য
পৃথিবীটা তবুও একচুলও এগোলোনা
এবার তবে মানবিকতাই হোক
একুশ শতকে স্বপ্ন দেখার চোখ”

“মেয়েদের অ আ ক খ”
মল্লিকা সেন গুপ্ত

মানবিকতার ব্যর্থতার কোনও সীমা পরিসীমা নেই, তবুও এই একুশ শতকে মানবিকতাই মানুষের সবচাইতে বড় সহায়।

চিয়ার্স !
সারওয়ার, সেপ্টেম্বর, ২০১৭