লিখেছেন: মিঠুন তলাপাত্র

মাসখানেক আগে বাসায় ফেরার জন্য জার্মানির স্টুটগারট শহরের প্রধান স্টেশন এ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। স্টেশন এর প্ল্যাটফর্ম এ এলইডি স্ক্রিন থাকে যেখানে ট্রেন আসার নোটিশ, ব্রেকিং নিউজ ও বিভিন্ন ইভেন্ট এর আপডেট সহ বিজ্ঞাপন চলতে থাকে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি ব্রেকিং নিউজ গুলো দেখি, সময় কেটে যায়। সেদিন দেখলাম জার্মানিতে আগত শরণার্থীদের এ দেশের অর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সাথে ইন্টিগ্রেশন এর উপর একটি প্রতিবেদন প্রচার হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে আগত শরণার্থীদের সামজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি জার্মান সরকার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এর
ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন- জার্মান ভাষা শিক্ষা ও বিভিন্ন কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা, যাতে করে শরণার্থীরা এখানকার ব্যবস্থার
সাথে যোগাযোগ ও নিজেদের কে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে পারে। নিঃসন্দেহে এটি ছিল সবচেয়ে সময়োপযোগি একটা সিদ্ধান্ত। সেই প্রতিবেদন এ দেখানো হচ্ছিল কিভাবে এই ইন্টিগ্রেশন প্রোগ্রামটি ভাল ফল বয়ে এনেছে। অনেকেই ভাষা
শিখে নিজেদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করছে, কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ শেষে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করছে। আসলেই
তাই, যখনই বড় বড় শহর গুলোতে যাই, দেখি বিভিন্ন দোকান, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট এমনকি বিভিন্ন কারখানা গুলোতে প্রবাসীদের প্রাধান্য।

অন্যদিকে, জার্মানদের অনেকাংশ এই নিয়ে খুব ভীত। ওরা শুরু থেকেই ভীত ছিল, ঘৃণা করত। কারণ তাদের ট্যাক্স এর টাকায় শরণার্থীদের বসে বসে খাওয়ানো হবে, তাদের কর্মক্ষেত্রে চাপ পড়বে ইত্যাদি নানা কারণে। বলে রাখা ভাল যে, এইখানে আয় এর উপর এমনভাবে ট্যাক্স চার্জ করা হয় যেনো অধিকাংশ চাকুরীজীবী পরিবারের আয় ও ব্যয়ক্ষমতার ব্যবধান নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থাকে। এই নিয়ে জার্মানরা নিজেরাই অসন্তুষ্ট। তো ইতিমধ্যে তাদের এইসব ভয় দূর হয়ে গেছে। কারণ, রাস্তায় নামলেই দেখা যায়, প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের দরকার, রাস্তা পরিষ্কার থেকে পাবলিক যানবাহন গুলো প্রবাসিরাই চালাচ্ছে। হ্যাঁ, অফিস-আদালতে প্রবাসী দেখতে পাওয়া বেশ মুশকিল, ওই জায়গাগুলো শিক্ষিত এখনও জার্মানদের দখলে। কিন্তু এখন তাদের ভয়টা অন্যদিকে, তাদের নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা নিয়ে। কারণ, প্রবাসীদের অধিকাংশ মুসলিম আর তারা তাদের কম্যুনিটির মধ্যে থাকে এবং সেইভাবেই তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে চায়। বিভিন্ন গ্রাম গুলোতে দেখা গিয়েছে লোকাল জার্মান দের চেয়ে প্রবাসী মুসলিমদের সংখ্যা বেশি। সেইখানে তারা নিজেদের জন্য মসজিদ ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করতে চায়। জার্মানরা মনে করে, যেহেতু তাদের সরকার অনেক বেশি লিবারেল ও সবার সামাজিক সুবিধাদি প্রদানের জন্য বেশ অমায়িক, শরণার্থীদের এইসব দাবি-দাওয়া মেনে নিলে হয়ত তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ই নষ্ট হয়ে যাবে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত খারাপ দিকগুলো শিখবে।

আমার ব্যক্তিগত ধারনা হচ্ছে, সভ্যতার স্রোতধারায় কোন অঞ্চল ই শুধুমাত্র নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার নিয়ে থাকতে পারে না।
প্রত্যেকটি অঞ্চলেই বিভিন্ন অনুপ্রবেশকারীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে প্রবেশ করে, সময়ের ধারাবাহিকতায় মিলে-মিশে
একটা নতুন কিংবা পরিবর্তিত সংস্কৃতি জন্ম নেয়। বেশিরভাগ সময়ই অনুপ্রবেশকারীরা হয় অনাকাংখিত। কখনো ধর্ম প্রচারে,
কখনো রাজ্য বিস্তারে, কখনো সম্পদের লোভে, কখনওবা জীবন বাঁচাতে। সাময়িক ভাবে ভাবলে মনে হয়, একটা অঞ্চলের
নিজস্বতা হারিয়ে যায়। কিন্তু এইভাবেই তো সভ্যতার স্রোত বয়ে চলছে, হাজার হাজার বছর ধরে। তা নাহলে তো পৃথিবীর
একটা অংশ অন্ধকারেই থেকে যেতো।

এই যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, এই নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত থাকে শিক্ষিত শ্রেণীর লোকজন। কিন্তু তারা কখনও ভাবে না,
তার মতই দুটি হাত, দুটি পা নিয়ে জন্মানো ব্যচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে এক যুবক খেটে মরছে ১০ টি হাজার টাকা মাসান্তে আয় এর জন্য পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, সেখানে সে একটি বিএমডব্লিও এর মালিক। তারা কখনো ভাবে না, পৃথিবীতে যদি সম্পদের সুষম বন্টন হত, তাহলে হয়ত গরিব দেশ বলে কিছু থাকত না, শিক্ষিত বেকার বলে কিছু থাকতো না উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সবারই তো অধিকার আছে, সমান সুবিধা গ্রহন করার, শুধুমাত্র গরিব বা উন্নয়নশীল দেশে জন্মানোই তো মানুষের অপরাধ হতে পারে না!

যেহেতু এইভাবে সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার সম্ভব নয়, তাহলে আমাদেরকে এই সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও মেনে নিতেই
হবে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এই যে আগে এই পরিবর্তন টা দুর্বল দেশগুলোকেই মেনে নিতে হত, কিন্তু এখন অপেক্ষাকৃত সবল
দেশ গুলোকেই এই অবস্থা মেনে নিতে হচ্ছে।