লিখেছেন: অনিরুদ্ধ সোহন

মুক্ত মনের অধিকারী হওয়া বা মুক্ত পথের সন্ধান করা বড়ই কঠিন একটি কাজ। ভারতীয় উপমহাদেশে এই কাজটি কত বিপজ্জনক সেটি প্রমাণ করেছে বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়, পাকিস্তানে মাশাল খান আর দুদিন আগে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ড। অভিজিৎ রায় বা মাশাল খানের খুন যেমন একক ঘটনা নয়, তেমনই গৌরী লঙ্কেশের হত্যার আগে নিহত হয়েছেন এম কালবুর্গি, গোভিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র ধাভলকার। ধর্মীয় অন্ধত্ব মানুষকে যে অমানুষ বানাতে পারে এই চারটি হত্যাকাণ্ড সেটার প্রমাণ। এঁরা কেউই নিলয় চৌধুরি, অনন্ত বিজয় বা ওয়াশিকুর রহমানের মত তরুণ ছিলেন না, কালবুর্গি, পানসারে ও ধাবালকরের বয়স ছিল যথাক্রমে ৭৬, ৮১ ও ৬৮। বরং গৌরি লঙ্কেশই এর মধ্যে হলেন সবচেয়ে তরুণ – মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছে ৫৪। অভিজিতের জন্মদিনে বাঙালী পাঠকদের কাছে এই যুক্তিবাদী মারাঠী ও কানাড়িদের কিছু পরিচয় সংক্ষেপে দিচ্ছি।

নরেন্দ্র ধাভলকার

নরেন্দ্র ধাভলকার ছিলেন একজন চিকিৎসক, পরে অবশ্য তিনি সামাজিক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুরো সময়টা দিতেন। তিনি মহারাষ্ট্রে কুসংস্কার বিরোধী অন্ধশ্রাদ্ধ নির্মূলন সমিতির সভাপতি ছিলেন ও মহারাষ্ট্র বিধানসভায় Antisuperstition and Black Magic Ordinance নামে একটি বিল পাশ করাতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টি ও শিব সেনা এর বিরোধী ছিল যদিও বিলটিতে কোথাও ধর্মীয় আচার বিরোধী কথা ছিল না। ২০১৩ সনের ২০শে অগাস্ট পুনা শহরে তাঁকে আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করে মটোরসাইকেলে চেপে পালিয়ে যায়। যদিও ধাভলকার তাঁর দেহকে শিক্ষার জন্য দান করে দিয়েছিলেন, ময়নাতদন্তের জন্য সেটা ব্যবহার করা যায় নি। রীতি ভেঙ্গে তাঁর দাহকার্য তাঁর ছেলের পরিবর্তে তাঁর মেয়ে শুরু করেন। তাঁর হত্যাকারিদের সরকার এখনো ধরতে পারে নি।

ধাভলকর যে বছর নিহত হন, ২০১৩ সনে, সেই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি আনসার-উল-বাংলার একটি দল (যারা আবার নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল) আহমেদ রাজিব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে। সরকারের দাবি রাজিব হায়দারের প্রায় সব হত্যাকারিদের ধরা হয়েছে, যদিও যে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে একজন এখনো পলাতক। বাংলাদেশে শাহবাগ ও মুক্তচিন্তা আন্দোলনে রাজিবের ভূমিকা হয়তো ভবিষ্যৎ সমাজ করবে, তবে ধাভলকারের হত্যাকাণ্ডের একটা পরিণতি হল মহারাষ্ট্রে কুসংস্কার বিরোধী বিলটি পাশ হয় এবং ২০১৪ সনে ধাভলকরকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়া হয়।

গোভিন্দ পানসারে

গোভিন্দ পানসারেও মহারাষ্ট্রের মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন লেখক ও ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য।তিনি দাভলকারের Antisuperstition and Black Magic Ordinanceএর সমর্থক ছিলেন। পানসারের নিজের সংগঠন বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধী ছিল এবং আন্তঃবর্ণ বিবাহে সাহায্য করত। এছাড়া তিনি গর্ভবতী নারীর পুত্রসন্তান কামনার জন্য এক বিশেষ যজ্ঞের বিরোধিতা ও মোহনদাস গান্ধীর হত্যাকারি নাথুরাম গডসের স্তুতিকে নিন্দা করতেন।

২০১৫ সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মুম্বাইতে পানসারে ও তাঁর স্ত্রী উমা প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে ফিরছিলেন, সেই সময় দুজন আততায়ী মটোরসাইকেল করে এসে পানসারে ও উমা দুজনকেই গুলি করে। গোভিন্দ পানসারে এর পাঁচদিন পরে ২০শে ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, উমা বেঁচে যান। ধাভলকারের ছেলে হামিদ ধাভলকারের মতে পুলিশ যদি তাঁর পিতার হত্যাকাণ্ডের সমাধান করত তাহলে পানসারের হত্যাকে ঠেকানো যেত। পানসারের খুনের জন্য দু-একজনকে ধরা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বিচার হয় নি।

পানসারের মৃত্যুর ঠিক ৬ দিন পরে অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদের ওপর ঢাকায় ইসলামিস্ট চরমপন্থীদের আক্রমণ হয়, অভিজিৎ মৃত্যুবরণ করেন, বন্যা গুরুতরভাবে আহত হন। দুই সপ্তাহের মধ্যে উপমহাদেশের দুইপ্রান্তে – মুম্বাই ও ঢাকায় – হিন্দু ও মুসলিম চরমপন্থীদের যুক্তিবাদী স্বামী ও স্ত্রীর ওপর আক্রমণ ২০১৫ সনের ফেব্রুয়ারি মাসকে বিষন্নতার মাস হিসেবে আমাদের মনে থাকবে। একদিকে বাংলাদেশের সরকার সাময়িক রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য যুক্তিবাদী ও নিরীশ্বরবাদীদের হত্যাকাণ্ডকে উপেক্ষা করতে চেয়েছে, অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও শিবসেনা সরকার তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যর জন্য দাভলকার বা পানসারের হত্যাকারীদের খোঁজার ব্যাপারে সেরকম আগ্রহ দেখায় নি।

মালেসাপ্পা কালবুর্গি

কর্ণাটকার মালেসাপ্পা কালবুর্গি তাঁর গবেষণাপত্রের জন্য সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি কর্নাটকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কানাড়া সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন ও কিছুদিনের জন্য হাম্পিতে কর্নাটকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যও ছিলেন। তাঁর গবেষণা ছিল দ্বাবিংশ শতাব্দীর কানাড়া ছন্দ পদ্য বচনা সাহিত্যের ওপর। তিনি হিন্দুধর্মে বিভিন্ন কুসংস্কার প্রথার বিরোধী ছিলেন। কর্ণাটকায় প্রভাবশালী লিঙ্গায়ত গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা দ্বাবিংশ শতাব্দীর শৈব দার্শনিক বাসব সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ এবং মূর্তি পূজা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য তাঁকে অনেকের বিরাগভাজন করে। ৩০শে অগাস্ট, ২০১৫ সনে তাঁর বাড়িতেই দুজন আততায়ী মটোরসাইকেলে চড়ে এসে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে অনেক সাহিত্যিক তাঁদের আকাদেমি পুরস্কার বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন।

কালবুর্গি হত্যার ২৩ দিন আগে ৭ই অগাস্ট নিলয় নীল চ্যাটার্জিকে ঢাকায় ইসলামী চরমপন্থীরা চাপাতি দিয়ে হত্যা করে। নিলয় নীলের হত্যাকাণ্ডের যেমন সমাধান হয় নি কর্ণাটকা সরকার কালবুর্গি হত্যার কোনো কিনারা করতে পারে নি যদিও ভারতীয় কংগ্রেস এখন সেখানে ক্ষমতায়।

গৌরী লঙ্কেশ

গৌরী লঙ্কেশ ছিলেন একজন সাংবাদিক, উনিও ছিলেন কর্ণাটকার বাসিন্দা। লঙ্কেশ পত্রিকে নামে একটি কানাড়া ভাষার পত্রিকা চালাতেন, পত্রিকাটি ওনার বাবার করা। যদিও গৌরী এর আগে The Times of Indiaর সাংবাদিক ছিলেন এবং তাঁর মাধ্যম ছিল ইংরেজী, পিতার মৃত্যুর পরে তাঁর পত্রিকার দায়িত্ব নেবার পরে কানাড়াতেই লিখতেন। বামপন্থী ছিলেন ও হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন। বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা এনেছিল। রাজনৈতিক মহলে সুপরিচিত ছিলেন এবং কর্ণাতকা কংগ্রেস তাঁকে নক্সালদের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য একটা কমিটির সদস্যও করেছিল।

এ বছরের ৫ই সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত আততায়ীরা ব্যাঙ্গালোরে তাঁকে তাঁর বাড়ির গেটে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যার সঙ্গে কালবুর্গি হত্যার যথেষ্ঠ মিল রয়েছে বলে পুলিশ জানাচ্ছে যদিও সরকার উভয় ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে অসমর্থ হয়েছে। তাঁর দেহ জনসাধারণের দর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল এবং তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সরকারি গান স্যালুট দেয়া হয়েছে। অনন্ত বিজয় বা অভিজিৎ যা পায় নি অন্তত সেটুকু গৌরী লঙ্কেশ পেয়ে গেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশ যে এক ধরণের অদ্ভূত ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। এই চক্র থেকে বের হবার জন্য দরকার সুস্থ ও যৌক্তিক মস্তিষ্ক। মানুষের ভিন্ন মতামতকে সহ্য করার মত মানসিকতা সুশিক্ষার অংশ। ওয়াশিকুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর এক নিকটজন বলেছিলেন মানুষের মাথায় তো কত চিন্তাই আসে, সেটার জন্য তাকে মেরে ফেলতে হবে! মানুষের মাথায় যদি ভিন্ন চিন্তা না আসত তাহলে সমাজে কোনো অগ্রগতিই হত না। যে সমাজ এই সব হত্যাকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেয় সেই সমাজকে এখনো বহূদূর যেতে হবে।