কোটি কোটি মানুষ দেখল একটি অসহায় ছেলেকে একদল উন্মত্ত যুবক কিরিচ দিয়ে কুপাচ্ছে। অবশ্য সেই দেখাটা ক্যামেরার চোখ দিয়ে । কিন্তু ক্যামেরায় ধারণকৃত এই ভিডিও চিত্রের অথেনটিকতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ প্রশ্ন তুলেনি। কেউ বলেনি এগুলো ফটোশপের কারসাজি। তার মানে এই নৃশংস ঘটনাটি বাস্তবেই ঘটেছিল। আমরা যারা নিজেকে মানুষ বলে বিশ্বাস করি সেদিন এই ভিডিওটি প্রথমবারের মতো দেখার পর নিজেকে মানুষ ভাবতে লজ্জা হচ্ছিল। কারণ শত শত মানুষের সামনে একদল মানুষ এই ঘটনাটি ঘটিয়েছিল একজন মানুষও সেই মানব আজরাঈলের থাবা থেকে অসহায় ছেলেটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি। একজন অবশ্য গিয়েছিলেন তিনি মানুষ নন মহামানব। তিনি একজন রিক্সাওয়ালা। সেই ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে তিনি হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সেই রিক্সাওয়ালা ভাইটিকেই মনে হয় সংবেদনশীল মানুষের শেষ প্রতিনিধি।
বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের যথাযত শাস্তি প্রদান করে আমাদের লজ্জা ঘুচাবার একটি শেষ সুযোগ ছিল কিন্তু মাননীয় আদালত সেই সুযোগটিকেও নস্যাত করে দিলেন। যে ভিডিওটি অথেনটিক যে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কারা কীভাবে বিশ্বজিৎকে হত্যা করছে কীভাবে মৃত্যুর সঙ্কীর্ণ জানালা দিয়ে সেই হতভাগা জীবনের দিকে পালাবার প্রানান্ত চেষ্টা করছে। এতসব চাক্ষুষ দেখার পরেও কেন আমাদের আদালত দূর্নীতির প্রজনন কেন্দ্র থেকে উঠে আসা পুলিশের রিপোর্টকেই প্রাধান্য দেবেন কেন দলবাজ ডাক্তারের পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেই আদালতকে বিশ্বাস করতে হবে ‘মানুষটি সত্যি মৃত্যুবরণ করিয়াছিল’ ? কোটি কোটি চোখের এমনকি মাননীয় আদালতেরও নিজ চোখে দেখার চেয়েও কি পুলিশ আর ডাক্তারের রিপোর্ট বেশী গ্রহণযোগ্য ? এখানে বিচারকের বিবেক বুদ্ধি বিবেচনার কোনো স্থান নেই ? এক গৎ বাঁধা আইনের মারপ্যাঁচে বন্দী সব কিছু ?
আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন বাস্তব ঘটনার সাথে পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট বা ডাক্তারের ময়না তদন্তের রিপোর্ট অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি তাই হয়ে থাকে তবে এক বা একাধিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ রিপোর্টকে আমলে নিয়ে আসামীদের শাস্তি লাঘব করা বা বেকসুর খালাস দেয়া কি স্ববিরুধী হয়ে গেলনা ? আদালত কি রায় স্থগিত করে পূণঃ তদন্তের আদেশ দিতে পারতেননা ? বিশেষ করে আদালত নিজেই যেখানে রিপোর্টগুলো নিয়ে সন্দীহান ? এগুলো হয়তো আইনের চোখে সঠিক কিন্তু আমরা যারা আম জনতা আইনের মারপ্যাঁচ বুঝিনা তাদের কাছে দুর্ভেদ্য ধাঁধাঁ বলেই মনে হয়।
আইন যদি নাগরিকের সুরক্ষা বিধানের সার্থেই হয়ে থাকে তবে আমাদের সনাতন ধারার আইনকে যুগোপযোগি করা ছাড়া বিকল্প নেই। কয়েকশত বছরের পুরনো আইন বর্তমানে অনেক দিক দিয়েই অচল পয়সা। কারণ দুইশ বছর আগের পৃথিবী আর বর্তমান পৃথিবী এক জায়গাতে নেই। সমাজ ব্যবস্থায় এসেছে যুগান্তকারী সব পরিবর্তন। জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে মানব সভ্যতা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কুয়াটি ছেড়ে অসীমের সন্ধানে ধাবমান। যে প্রযুক্তি আমাদেরকে সভ্যতার এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তাকেই আগে আমলে নিতে হবে তাকে বিশ্বাস করতে হবে। যে প্রযুক্তি একটি চলমান ঘটনাকে জীবন্ত রেকর্ড হিসেবে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে তার সমান্তরালে কীসের পুলিশী রিপোর্ট ? কেন তাকেই আবার দূর্নীতিবাজ পুলিশের চোখ দিয়েই দেখতে হবে? এসব সনাতন ধারা উপধারাকে এখনই শিকেয় তুলে রাখা উচিৎ। গ্রাম বাংলায় প্রবাদ আছে শিং খাইনা শিং এর ঝোল খাই। বিশ্বজিতের বিচারের রায়ে যেন সেই প্রবাদেরই প্রতিধ্বণি শুনা গেল। চোখে আমরা দেখছি ঠিক ঘটনাও ঠিক কিন্তু পুলিশের রিপোর্ট বলছে তা অঠিক অতএব ঘটনাটি অঠিক। কী বিচিত্র আইনের জগত।
বিচারে যদি বিচারকের নিজস্ব বিবেক বিবেচনা প্রয়োগের কোনো সুযোগই না থাকে সবকিছু এক গৎবাঁধা আইনের ছকেই আবর্তিত হতে হয় তবে আদালতে বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে কেন বিচারকের আসনে বসিয়ে হুদা হুদা পাবলিকের টাকার শ্রাদ্ধ করতে হবে ? বিচারকের স্থলে একটি কম্পিউটার বসিয়ে রাখলেইতো ল্যাটা চুকে যায়। আইনের সকল ধারা উপধারাকে ডেটা আকারে কম্পিউটারে টেসে ঢুকিয়ে দিলেই পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট আর ডাক্তারের ময়না তদন্ত রিপোর্টকে বিশ্লেষণ করে মিনিটেই একটি নির্ভুল রায় বের করে দেবে। কম্পিউটারের বড় সুবিধা একে মাসে মাসে মোটা অংকের বেতন দিতে হবেনা, নিয়োগ বদলীর ঝামেলামুক্ত আর তার রায় হবে শতভাগ স্বচ্ছ এবং আইনসিদ্ধ কারন কম্পিউটারে মানবিক রাগ অনুরাগের ব্যাপার নেই, আনুগত্যের বা উৎকোচের আশংকামুক্ত আর সবচেয়ে বড় উপকার হবে গোটা কয়েক কম্পিউটার দিন কয়েকের মাঝেই লক্ষ লক্ষ মামলার জট শূন্যতে নামিয়ে আনবে।
এই রায় শাসকদের এবং বিচার ব্যবস্থার এক অমোচনীয় কলংক হয়ে থাকবে। লক্ষ কোটি মানুষের চোখে দেখা একটি নির্মম সত্যকে মিথ্যায় পর্যবসিত করার দায় অবশ্যই বর্তমান শাসকদলের কারণ তারাই তাদের বশংবদ পুলিশ আর ডাক্তারকে দিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট করিয়েছে। আর বিচার বিভাগকে খুঁজে বের করতে হবে এমন একটি ব্যবস্থা যাতে কারোরই প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না থাকে বা প্রভাবিত হওয়ার মতো সংস্থাগুলোর গুরুত্ব হ্রাস করে প্রযুক্তি নির্ভর স্বাক্ষ্যকে অধিক গ্রহণযোগ্য করা। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা থেকেই এই দৃষ্টান্ত নেয়া উচিৎ।
আসলেই ছেলেটার নিস্পাপ চেহারা আর করুণ পরিণতির কথা ভাবলে বুক ভেঙ্গে যায়! ফারুক ওয়াসিফ যথার্থই বলেছেন যে এই রায়ের মাধ্যমে বিশ্বজিৎ কে দ্বিতীয়বার খুন করা হল। যতদূর বুঝতে পারছি মূল সমস্যা আদালতের নয়, যারা তদন্ত করে কেস দাঁড় করানোর দায়িত্বে ছিলেন তাদের। একজন দরিদ্র দরজী, তার উপর আবার সংখ্যালঘু, তাঁর অভাগা পরিবারের চোখের জল ছাড়া কি ক্ষমতা আছে যে প্রভাবশালী ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে। যাদের হাতে এর ভার ছিল তারা তো চাইছিলেনই অপরাধীদের বাঁচিয়ে দিতে। রাজনৈতিক পক্ষপাতে দুষ্ট কিছু মুখচেনা সুশীল এখনও নীরব, কারন তারা দলবাজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তারা বুঝতে চায় না যে কিছু বিষয়ে দলবাজির উপরে উঠে গঠনমূলক সমালোচনা করলেই দলের জন্য আখেরে ভাল হয়।
বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচার হয় নি, কোনদিন হবে বলেও মনে হয় না। আমাদের নষ্ট রাজনীতির একজন অসহায় বলি হিসাবেই কিছুদিন তাঁর নাম আমাদের ভাবনায় থাকবে, তারপর মুছে যাবে চিরকালের জন্য। এই নষ্টামি যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে এবং কোন রাজনৈতিক দলই এক্ষেত্রে নির্দোষ নয়। এসব ঘটনায় নাটের গুরু নেতাদের কোন শাস্তি হয় না; চুনোপুঁটি কর্মীদের দাবার বড়ের মত ব্যবহার করা হয়, আর জানমালের ক্ষতি হয় নিরীহ মানুষের । এই পরম্পরা চলতেই থাকবে যতদিন জনগনের হাতে দেশ শাসনের প্রকৃত ক্ষমতা যাবে না, আমাদের তথাকথিত নেতারা দায়িত্বশীল হবেন না।