লালনের মতন একজন নন-একাডেমিক স্বশিক্ষিত মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের ভিতরে জাত-পাতের ভিন্নতা আসলে দুইটা- মেয়ে-জাত আর পুরুষজাত। সামাজিক বিদ্যাপীঠ বা স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক শিক্ষায়নের ঘাটতির কারণে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে বৃহন্নলা শ্রেণি তখন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নাই। লালন যতই আলাদা সমাজ গড়ার চেষ্টা করুক না কেন, সে আসলে বৃহত্তর বাঙালী সমাজেরই অংশ। তাই তাঁর ভিতরে তৃতীয় লিঙ্গ-চেতনার অনুপস্থিতি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বাঙালী সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত বহুজনের মধ্যে আজও এই লিঙ্গচেতনার ঔদার্যটুকু স্থান করে নিতে পারেনি। সেই দিকে বিবেচনা করে লালনকে দোষ দেয়া যায় না। শিখণ্ডীরা নরকবাসী, অভিশপ্ত, অচ্ছুৎ এই মনোভাব যুগ থেকে যুগে সাবলীল স্রোতধারার মতন আমাদের মন-মেজাজে স্থান করে নেয় নিঃশব্দে নিভৃতে। আমরা সেই মনোস্রোতের নৈতিক অবস্থানটা চিহ্নিত করতে অসমর্থ হই। গা এলিয়ে দেই বিভেদ-বিদ্বেষী সামাজিকতার আবর্তে। কিন্তু মানুষের তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। সে তো জানবে, শিখবে, এগোবে। তা হচ্ছে কই? মানুষ কি আসলেই এগোচ্ছে? কাণ্ডজ্ঞানে যতটুকু ধরা পড়ে তাতে মনে হয়- মানুষ জাতি যত সংখ্যায় এগুচ্ছে, তারচেয়ে বেশী সংখ্যায় পিছচ্ছে। সংখ্যা শক্তি, বিবেচনাযোগ্য, অন্তত: এই একবিংশ শতকে। শুধু কোয়ালিটি দিয়ে সংখ্যার গুরুত্বকে ম্লান করে দেয়া যায় না। কথা হচ্ছিলো লিঙ্গ-চেতনা ও লৈঙ্গিক স্বীকৃতির ব্যাপারে। এই লিঙ্গ-চেতনা যখন পূর্ণতা পায়, তখনই প্রত্যেক লিঙ্গ-শ্রেণি, তা সে যত ভিন্নই হোক নিরঙ্কুশ সমর্থনে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এই পারস্পরিক স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে একটা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌন-চেতনা সমাজদেহে স্থায়ীভাবে গড়ে উঠার পথ পায়, যা একটা ইউটোপিয়ান সমাজ গড়ার প্রাথমিক পূর্বশর্ত।

মানুষের যৌনচেতনার গভীরে যাওয়ার আগে একটুখানি ঘুরে আসা যাক প্রাণিজগতের যৌনতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের ভিতর দিয়ে। পৃথিবীতে প্রাণ আগমনের প্রাথমিক দিকে প্রাণীদেহে কোন লিঙ্গচিহ্ন ছিল না। তাই তাদের মধ্য ছিল না কোন যৌন প্রজননের অস্তিত্ব। প্রাণী তার শরীরের অংশ থেকে সেলফ-ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে যেভাবে প্রজাতি রক্ষা করতো তার নাম ছিল অযৌন প্রজনন।


————এমিবার অযৌন প্রজনন———

এতে দুটো মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি ছিল প্রাণী জগতের সামনে। এক- সংখ্যায় তারা হয়তো বাড়ত, কিন্তু নতুন প্রজাতি সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। দুই- পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া ও মাইক্রোবায়োলজিকাল জগতে প্রতিরোধের যুদ্ধে যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন হয়ে আপন অস্তিত্ব রক্ষার সব পথ বন্ধ হবার উপক্রম হলো। এই দুই বিপদ মোকাবেলায় প্রকৃতি প্রাণীর দেহে সেটে দিলো লিঙ্গচিহ্ন। তাই ঘোড়া, জিব্রা, গাধা, খচ্চরদের একই জেনাস (Genus-Equus) পরিচয়ে পাওয়া গেলেও তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির। এটা সম্ভব হয়েছিল যৌন প্রজননের কারণে। তারা অনেক টেকসই এবং যোগ্যতম প্রাণী অস্তিত্ব রক্ষার (struggle for existence) দিক দিয়ে। প্রজননের খাতিরে প্রাণী যে মোটিভেশন বা প্রত্যয়ানুভুতির মাধ্যমে লিঙ্গ তথা প্রজননতন্ত্র ব্যবহার করে তার নামই যৌন-চেতনা। মানুষের মতে মানুষ ছাড়া আর সব প্রাণীর বেলায় এই যৌনচেতনার শ্রেণিগত নাম হতে হবে যৌন সহজাত প্রবৃত্তি। কারণ প্রাণীরা জানে না, তারা কি করছে, কিন্তু মানুষ জানে, তাকে জানতে হয় সে কি করছে। কারণ যৌনতার ব্যাপারে সে যৌন-চেতনা ধারণ করে। এইসব জানাজানির কাজে মানুষের জন্যে তৈরি হয়ে আছে তার পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত মস্তিষ্ক, বা বুদ্ধিমত্তা (intelligence) যা অন্য কোন প্রাণীর নেই। কিন্তু মানুষ কি সুশৃঙ্খলভাবে তার এই চেতনার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছে? সামাজিক বাস্তবতা বলছে, এইব্যাপারে তার সাফল্য গর্ব করার মতন নয়। কারণ প্রায়শই তাকে যৌনতার ব্যাপারে মানবিক চেতনা থেকে ভ্রষ্ট হয়ে সহজাত প্রবৃত্তির অবস্থানে চলে যেতে হয়, নিজস্ব ব্যর্থতার জন্যে। এই জৈবনিক ব্যর্থতারও রয়েছে বিবর্তনীয় মনোবৈজ্ঞানিক পটভূমি।

জেফরি মিলার তার যুগান্তকারী বই দ্যা মেটিং মাইণ্ডে দেখিয়েছেন কিভাবে একটা অনন্য শিল্পকর্ম, কবিতা, সঙ্গীতসৃষ্টির পিছনে যৌনতার সূক্ষ্মতম তন্ত্রী ক্রিয়াশীল রয়েছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের চুলচেরা বিচারে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ তার যৌন চেতনার অদৃশ্য প্রভাবের মাধ্যমে যে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা লাভ করেছে ও করবে তা যথেষ্ট টেকসই এবং বিবর্তনশীল।

তবে এই বিবর্তন কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটছে, অর্থাৎ তা মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার সীমানার মধ্যে। তারমানে যৌনচেতনার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ মানুষের উন্নত প্রজাতি ও উন্নত সমাজ গঠনে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে যাবে। যৌনচেতনার নির্বুদ্ধিবৃত্তিক (Idiotic) নিয়ন্ত্রণ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় পৃথিবীতে তার উদাহরণও রয়েছে। কেনা জানে অতিঅর্থডক্সির প্রত্যক্ষ প্রভাব যৌন-অবদমনের প্রজননক্ষেত্র প্রস্তুত করে। মনোবিশ্লেষনের মাধ্যমে জানা যায়, যৌন অবদমন সমাজে এমন সব অপরাধের বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটায় যা স্বাভাবিক মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। ছোটবেলা থেকে কঠোর লৈঙ্গিক বিভাজন ছেলেমেয়েদের সহজ ও স্বাভাবিক মেলামেশার পথ রুদ্ধ করার মাধ্যমে, ধর্মের নামে যাবতীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে তুলে নেয়ার ফলশ্রুতিতে যৌন-অবদমনের সৃষ্টি হয়, পাকেচক্রে তা চরম বিধ্বংসী আত্মঘাতী বোমারুও তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। তাই অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিথোস্কৃয়া এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক যৌনাচারণের অভ্যাস যৌন-অবদমনকে তিরোহিত করে, এই সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানের।

বলতে দ্বিধা নেই, যৌনতা বিষয়ে পাশ্চাত্য যেভাবে চিন্তা করে, প্রাচ্য সেভাবে করে না। এই পার্থক্যটা বুদ্ধিবৃত্তিক। এখানেই ধরা পড়ে যায় প্রাচ্যের যৌনচেতনার দৈন্যতা। পূবে যৌনতা একটা ট্যবুর নাম, পশ্চিমে তা অনেকটা স্নান, ঘুম আর আহারের মতন স্বাভাবিক জীবনবৃত্তীয় বিষয়। খাদ্য-ক্ষুধার মতন যৌনতা প্রাণীদেহের একটা স্বাভাবিক চাহিদা। মানুষের অন্যসব চাহিদার মতন এরও দুইরকমের ব্যবহার বয়েছে- স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ব্যবহার। প্রথমে দেখা যাক পাশ্চাত্য এই স্বাভাবিক ব্যবহারের সীমানা প্রাচীর কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পেরেছে। যৌনতার স্বাভাবিক ব্যবহার উন্নত সমাজ গঠনে অপরিহার্য্য অনুষঙ্গ। সেই অনুষঙ্গের সাথে সমাজকে ক্রিয়াশীল করার নিমিত্তে প্রথমে তারা শিক্ষাক্রমকে এই যৌন চেতনার অনুকূল করে তোলে। পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষাক্রমের সাথে যৌনশিক্ষাকে সন্নিবেশিত করে তারা আগামী প্রজন্মকে স্বাভাবিক যৌনতার ব্যাপারে জ্ঞানদান পরিপূর্ণ করে।


———বুদ্ধযুগে মন্দির পর্যায়ে যৌনশিক্ষা ও যৌনভাষ্কর্য——–

তখন এই নবীন প্রজন্ম কর্মক্ষেত্রে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে পা রেখে সহজেই অনুধাবন করতে পারে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক যৌনতার পার্থক্য। তারা বুঝতে শেখে বলপূর্বক অথবা মিথ্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে সম বা বিপরীত লিঙ্গের কাউকে যৌনতায় নিয়োজিত করার নাম অস্বাভাবিক যৌনতা। অস্বাভাবিক যৌনতা একটা ফৌজদারি অপরাধ। এই অপরাধের অনুষঙ্গ, যেমন বিনাঅনুমতিতে যৌন উদ্দেশ্যে কারও শরীর বা যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা, অশালীন মন্তব্য করা, শিস দিয়ে উত্যক্ত করা, এদের কোনটাই ইভটিজিং নয়, যৌন নির্যাতন, যা ফৌজদারি অপরাধও বটে- কোনভাবেই বয়সের দোষ বা ঐ জাতীয় কিছু নয়। তারা জানতে বুঝতে ও ব্যবহার করতে শেখে স্বাভাবিক যৌনতাও। আঠারো বছর বয়স হয়ে গেলে পরস্পরের অনুমতি সাপেক্ষে যৌনতায় নিয়োজিত হওয়া স্বাভাবিক অভ্যস্ততা। এই বিধান সকল লিঙ্গের মানুষের জন্যে- নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা, সবার জন্যে তা প্রযোজ্য হবে। এই বিধানের ব্যত্যয় যাতে না হয়, তার জন্যে সদা প্রহরায় নিয়োজিত রয়েছে পুলিশ ও আদালত। যে কোন ধরণের অস্বাভাবিক যৌনতার জন্যে রয়েছে আইনের শূন্য-সহনশীলতা।

পশ্চিমে স্বাভাবিক যৌনতাকে উৎসাহিত করা হয় অস্বাভাবিকতার সামাজিক বিস্তারকে কমিয়ে আনার জন্যে। এই কারণে তারা যৌনতার বহুমুখীকরণের পক্ষে বহু আগে থেকেই বুনিয়াদী অবস্থানে রয়েছে। প্রাচ্যের অনেক শুদ্ধবাদী মনে করেন- বাণিজ্যিক মুনাফার স্বার্থে পশ্চিমে যৌনতাকে বহুমুখী করার সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। ধারণাটা একেবারেই ভুল। কেউ যদি কানাডার স্কুল পর্যায়ের শিক্ষাক্রম লক্ষ করে, তাহলে দেখবে, সেখানে রয়েছে প্রতিটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের আলোচনায় সোশাল ইমপ্যাক্ট বা সামাজিক প্রভাবের বিষয়টি। তেমনি যৌনতার বহুমুখীতাও যে সরাসরি শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বাজারে সন্নিবেশিত হয়েছে, ব্যাপারটা তা না। সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিষয়ের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার শুক্ষ বিচার বিশ্লেষণ না করে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে, এমন ভাবা হলে তা মারাত্মক ভুল হবে। যৌনতার বহুমুখীকরণের সামাজিক প্রভাব জানার আগে জেনে নেয়া যেতে পারে, এই বহুমুখীকরণের বিষয়ে আমরা আসলে কতটা বুঝি।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, যার অর্থ করলে অনেকটা এমন দাড়ায়- যৌনতার জন্যে যে বিয়ে করে, সে আসলে মরেছে। এই বহুল প্রচারিত প্রবাদ থেকে নিজে যতটা বুঝি- বিয়ে শুধু যৌনতা নয়। বিয়ে একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ধ্রুপদী প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে সমাজ-সংসারের বহুমুখী উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। বিয়ের যে অংশটা যৌনতার ভাগে পড়ে, তার দ্বারা মানুষের চিত্ত বিনোদিত হয়। এটা বিবাহের একটা আকর্ষণীয় অংশ। এই অংশটা আমাদের প্রলুব্ধ, উৎসাহিত, উত্তেজিত করে। যৌনতার প্রাচীরে ঘেরা এই বিনোদন যদি মানুষের চিত্তবিনোদনের একটা প্রধান ও একমাত্র মাধ্যম হয়, তাহলে কি ঘটবে সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে। এই অভিজ্ঞতা কিছুটা মনোবৈজ্ঞানিক, কিছুটা পর্যবেক্ষণ সঞ্জাত। কোন বিষয় যত আকর্ষণীয়ই হোক, তা এক নাগাড়ে ব্যবহারের ফলে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবে, যদি তার বহুমুখী পথ বা ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায়। বিয়ের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। একঘেয়েমি থেকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, গৃহবিবাদ থেকে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি। বৈবাহিক যৌনতার এই অর্থোডক্সি ব্যবস্থায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে পড়ে, সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই বহুমুখীকরণের কোন বিকল্প আছে কি? না, বিবাহকে বহুমুখী করার কথা বলছি না, বলছি বিবাহের ভিতরে যৌনতার যে অংশটা তাকে বহুমুখী করার কথা। দুইজন মানুষ বিবাহ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, নানান বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সেই চুক্তিতে এও থাকে যে, তাদের যৌনতা দুইজনের ভিতরে সীমাবদ্ধ থাকবে। সেখানে যৌনতার বহুমুখী ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? পারে, বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা বাদ দিয়ে তারা তাদের যৌনতাকে ডাইভার্সিফাই করতে পারে পর্ণগ্রাফী, সেক্সশপ ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে। অনেক শুদ্ধবাদী মনে করেন পর্ণগ্রাফী সাহিত্যের উপাদান হতে পারে না। ভিন্ন মাত্রা ও অনুপানে পর্ণগ্রাফী সাহিত্যের উপকরণ হতে পারে। তার প্রমাণ নির্মলেন্দু গুনের কাব্যজগত। তিনি ভিন্ন মাত্রায় যৌনতা কবিতায় সঞ্চারিত করে দেখিয়েছেন যৌনতা সাহিত্যের উপকরণ হতে পারে। আর পর্ণগ্রাফী যৌনতারই অংশ। পর্ণগ্রাফী ভিন্ন মাত্রায় সিনেমা ও ড্রামায় পশ্চিমারা ব্যবহার করে প্রমাণ করেছে যে, পর্নগ্রাফী শর্তসাপেক্ষে সাহিত্য ও শিল্পের উপাদান হতে পারে।


——–মোঘল হেরেমের একটা যৌন তৈলচিত্র——-

এমন অনেক দম্পতিকে জানি, যারা তাদের যৌন জীবনের এরাউজালের জন্যে যৌনঘন সাহিত্য ও পর্ণগ্রাফি সফলতার সাথে ব্যবহার করেন। এতে তাদের বৈবাহিক চুক্তির ইণ্টিগ্রিটিতে কোন ফাটল ধরে না। এখন যদি কোন বিবাহিত দম্পতি চুক্তি ভেঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতায় নিয়োজিত হয় আপসে, তাহলে এই চুক্তির রক্ষাকারীর দায়িত্ব কে নেবে, কে করবে নালিশ। এমন লক্ষ লক্ষ চুক্তির পাহারাদারের দায়িত্ব একটা ইহলৌকিক রাষ্ট্র নিতে পারে না। নিতে পারে প্রতারক ধর্মবাদী দেশ, যে দেশে দাড়ি না রাখায় মৃত্যুদণ্ড, খুন করায় অর্থদণ্ডের ঐশ্বরিক বিধান রয়েছে। সুতারং বিবাহের প্রহরার সব নৈতিক দায় বিবাহিত যুগলের।

দুইটা বিপরীত লিঙ্গের প্রাণী তথা মানুষকে এক করে তাদের মাধ্যমে প্রজাতি সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষাই প্রকৃতির কাজ। সে এর থেকে বেশী কিছু বোঝে না। আমরা মানুষেরা এর ভিতরে অনেক কিছু আবিষ্কার করে নিয়েছি- প্রেম, ভালবাসা, বিবাহ, আরও কত কি! সেন্ট আগষ্টিনের যুগ ছিল খ্রিষ্টদের একটা অন্ধকার সময়। যখন মনে করা হতো বিবাহ শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্যে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। অন্য কোন উদ্দেশ্যে নারী-পুরুষের যৌন সম্মিলন অনৈতিক।


———বৌদ্ধ-নরকে যৌন অপরাধের শাস্তি———

এও মনে করা হতো, একমাত্র বিয়ে ছাড়া আর কোন উপায়ে এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে না। খ্রিষ্ট সমাজে অনেক আগেই এই ট্যবু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থার বিবর্তনের ফলে। অনেকে মনে করে মুসলমান সমাজের অন্ধকার পর্ব শুরু হয়েছিল ইমাম গাজ্জালী নামক এক পশ্চাৎপদ সংস্কারকের উদয়ে। এই দুই ব্যক্তির ভিতরে বিবাহ, যৌনতা ও সমাজ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনায় অনেক মিল পাওয়া যায়। অনেক দম্পতি প্রকৃতিগতভাবে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। তাহলে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম দম্পতিদের একসাথে থাকাটা কি অনৈতিক হয়ে যাবে? তাই যদি না হয়ে, তবে বিবাহিত নরনারী যারা স্বেচ্ছায় সন্তান উৎপাদনে আগ্রহী নয়, তাদের সম্মিনলও অনৈতিক নয়। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, বিবাহ, অথবা যে উপায়েই মানুষ যৌন সম্মিলন ঘটাক না কেন, তার একমাত্র উদ্দেশ্য সন্তান উৎপাদন নয়। অন্তত: মানুষের মতন একটা বহুমাত্রিক প্রাণীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটার কোন সুযোগ নেই। মানুষ কি এইসব নীতি-অনীতিতে আটকে আছে। পশ্চিমা সমাজ বহু আগে এই বেড়া ভেঙ্গে ফেলেছে। ধর্মের প্রভাবে আজও গাজ্জালীয় ভাবধারা থেকে পশ্চাৎপদ জনপদের মানুষ বেরিয়ে আসতে পারেনি।


———নারীদের অতীতের সতীরক্ষা বেল্ট—–

আগে বহুবার শুনে শুনে বড় হয়েছি- ঘুমের ভিতরে স্খলন হলো স্বপ্নদোষ। এটা একটা পাপ, কারণ এতে কোটি কোটি শুক্রাণু মারা পড়ে, যা অনেক অনেক মানব শিশুর পৃথিবীতে আগমন-ইচ্ছার মৃত্যু ঘটায়। আজও সন্তানহীন দম্পতিদের আঁটকুড়ো ও বাজা বলে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এগুলো সবই বড় বড় পশ্চাৎধাবনকারী মানুষদের জ্ঞানহীন চিন্তাচর্চার ফলাফল।

নিষ্ফলা সুদ্ধিবাদীদের দৃষ্টিতে পর্ণগ্রাফী, সেক্সশপ, প্রস্টিটিউশন অবক্ষয় ও সমাজ বিধ্বংসী। এলকোহল, হেরোইন, তামাক, মারিজোয়ানা ইত্যাদি মাদক ভয়ংকর জনস্বাস্থ্যের জন্যে। কিন্তু তাদের নানামুখী সদ্ব্যবহার মানুষের অশেষ কল্যানদায়ী, একথা অস্বীকার করা কি চরম মূর্খতা নয়? পর্ণগ্রাফী, গণিকালয়, সেক্সশপ কি পুরোটাই অসার? একমাত্র পরিশুদ্ধ ও নিরপেক্ষ কমনসেন্স বা কাণ্ডজ্ঞানই পারে এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে।

যৌনতার বহুমুখী প্রকাশ স্বাভাবিক যৌনতারই অংশ। সেই স্বাভাবিকতা কখনও কখনও অস্বাভাবিকও হয়ে উঠতে পারে। তার জন্যে রয়েছে আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অতন্দ্র প্রহরা। যেমন আঠারো বছরের আগে কেউ দোকান থেকে এলকাহোলিক পানীয় কিনতে পারবে না। পারবে না মানে একেবারেই পারবে না। আইন দিয়ে এই ‘না’কে কঠিনভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। এবার আসা যাক যৌনতার বহুমাত্রিক ব্যবস্থায়। পর্ণগ্রাফি, প্রস্টিটিউশন, এসকর্ট সার্ভিস, এডাল্ট ক্লাব, সেক্সশপ, এইসবই যৌনতার বহুমাত্রিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাসমূহ আঠারো বছরের ঊর্ধ্বে নারী-পুরুষ-বৃহন্নলা, সকল লিঙ্গের মানুষের জন্যে উন্মুক্ত করা আছে। বিভিন্ন আইন কানুন দিয়ে তারা বাঁধা, যার বাইরে একচুল নড়ার সাধ্য নেই তাদের। একটা উদার সেকুলার গণতান্ত্রিক পশ্চিমা দেশে এইসবই একটা শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে। আর এই শিল্প থেকে রাষ্ট্রের কর বাবদ আয় উল্লেখ করার মতন। তার মানে এই নয়, এইসব দেশে ধর্ম, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ উঠে গেছে। এইসব দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের সাথে দার্শনিকরাও সমাজ গঠনে অবদান রেখেছে সমান। তারা মনে করেন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের স্বাভাবিক যৌনাচার পালন করার ব্যাপারে স্বাধীন এবং এই রাষ্ট্রের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নৈতিকতার পাহারাদারও যার যার ব্যক্তিগত সত্ত্বা। প্রকৃতির ব্যবস্থা হচ্ছে- সাপ থাকবে, ওঝাও থাকবে। সাপ সাপের কাজ করবে, ওঝা ওঝারটা। তাছাড়া সাপের কাজ শুধুমাত্র মানুষকে ছোবল মারা নয়। প্রাণীজগতের আরও বহুবিধ কাজ সে করে থাকে। মানুষের মঙ্গলের জন্যে সব বিষাক্ত সাপ মেরে ফেলাটা মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ। মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা যেমন যুক্তিহীনতার চরম অবস্থা। ঠিক একই ভাবে বিবাহের শুদ্ধতার কারণে যৌনতার বহুমুখী প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়াও এক ধরণের বালখিল্যতা।

পাশ্চাত্যের বৈচিত্রবান্ধব সমাজে দাবী উঠছে যৌনকর্মীদের সমাজকর্মী বা সোশাল-ওয়ার্কার ঘোষণা করা হোক। খাদ্যের ক্ষুধা দেহের একটা অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা, চিকিৎসাও দেহের একটা দাবী। সেসব নিয়ে যদি ব্যবসা করা যায়, সমাজকর্ম করে সমাজকর্মী নাম নেয়া যায়, তবে কেন যৌনকর্মীদের সোশালওয়ার্কার ঘোষণা করা হবে না। যৌনতাও তো দেহের একটা উচ্চকিত চাহিদা। এই যুক্তি ভঞ্জন করা বেশ কঠিন। বাংলাদেশের মতন একটা দেশে রাতারাতি পাশ্চাত্য উদারনৈতিক মানবিকতা এসে যাবে এটা কেউ আশা করে না। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া উটকো অনাচার অত্যাচার থেকে মানুষ কিছুটা অব্যাহতি তো পেতে পারে। যৌননির্যাতনকে ইভটিজিং অথবা বয়সের দোষ নাম দিয়ে ধর্ষণকে লঘু করে দেখা, দেশের অর্ধেক সক্রিয় জনশক্তিকে বস্তায় ভরে তাওহীদি জনতা সাজার তেতুলতত্ত্ব ও লালাবাজীসহ নানান ভণ্ডানুভূতি থেকে নিষ্কৃতির আশা তো দেশের মানুষ করতে পারে। কার কাছে সেই আশাটা মানুষ করবে? নিশ্চয়ই সেই রাজনীতির কাছে। সুতারং রাজনীতিতে সবকিছুর জন্যে স্পেস রাখতে হবে, রাখতে হবে যৌনতার জন্যেও।

যৌনতার বহুমাত্রিক ব্যবস্থায় আত্মরতি নামে আরও একটা উপকরণ এমনিতেই সন্নিবেশিত হয়ে যায়। আত্মরতি প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটুখানি ঘুরে আসা যাক পশ্চিমের কোন সেক্সশপ থেকে। শিক্ষার প্রয়োজনে, ভোগের জন্যে নয়। বিদ্যাশিক্ষার জন্যে দরকার হলে সুদূর


—————————-সৌদি এক ধর্মীয় নেতা কর্তৃক উদ্ভাবিত হালাল সেক্সশপ———————

আমাজনের জঙ্গলেও যেতে হয়। মানব সমাজের তিনটা প্রধান লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের জন্যেই পণ্যের সরবরাহ থাকে সেক্সশপে। সমকামী দম্পতি, হেট্রোসেক্স দম্পতি এবং যারা সিঙ্গেল বা ব্যাচেলর, এই তিন শ্রেণির জন্যে নানান পণ্য থাকে সেখানে। সাধারণত শপের উপকরণগুলো দম্পতিদের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক যৌনতাকে বর্ধনের কাজে যান্ত্রিক সহায়তা দিয়ে থাকে। অসমর্থ দম্পতিদের জন্যেও রয়েছে যান্ত্রিক উপকরণ। আবার সিঙ্গেল বা ব্যাচেলরদের জন্যেও রয়েছে নানান যান্ত্রিক প্রযুক্তিগত উপকরণ। কে না জানে, যে কোন যৌন কর্মকাণ্ডের গন্তব্য অর্গাজমের শেষ পরিণতিতে। একা পুরুষ বা একা নারী যেহেতু তাদের সেই গন্তব্যে পৌঁছে একাই, তাই তাদের এই যৌনক্রিয়াকে আত্মরতি বলা চলে। একা নারী-পুরুষের জন্যে এখানে রয়েছে কৃত্রিম শিশ্ন বা ডিল্ডো, মটোরাইজড শিশ্ন, ভাইব্রেটর, সেক্স ডলসহ নানান উপকরণ। এগুলো সব নিঃসঙ্গ নারী-পুরুষকে তাদের তাৎক্ষণিক অর্গাজম পেতে সহায়তা দিয়ে তাদের সাময়িক তীব্র উত্তেজনা, মানসিক অবসাদ, স্ট্রেস, যৌন অবদমন ইত্যাদির ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখে। যৌন মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আত্মরতি পেডোফাইল, ইভটিজিং বা যৌন-নির্যাতন, ধর্ষণসহ অনেক যৌন অপরাধ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে সহায়তা দেয়। পশ্চাৎপদ সমাজে যেখানে যৌনতার প্রকাশটাই ট্যবু, সেখানে আত্মরতির মতন একটা স্বাভাবিক যৌনকর্ম সোশাল নুইসেন্স, পাপ, এমন কি অপরাধও। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনাচারের সাথে জড়িয়ে থাকা আত্মরতির কথা প্রকাশ করেছেন অকপটে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের আলোকিত দার্শনিক ডায়জিনিস মনে করতেন- যা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে, তাকে গোপন করা মূর্খতা। তিনি তার সাইনিষ্ট দর্শনকে সত্য ও সুন্দরের প্রকাশ বলে ভাবতেন। তিনি প্রকাশ্য চরাচরে আত্মরতির মাধ্যমে মানবিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করতেন। জ্ঞানীদের জন্যে তার এই জীবনাচারে শিক্ষণীয় থাকলেও, মূর্খরা এসব নিয়ে সেইসব দিনে বেশী উল্লম্ফন দিতে পারেনি, তাদের কাছে ডায়জিনিসের বদনাম ছিল অঢেল। তার আত্মরতির ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর করতেন- তার এই দেহের সঙ্গে লেগে থাকা এই সুন্দর ও স্বাধীন অনুভূতিটুকু তিনি উপভোগ করেন অপার। একজন নির্ভীক ও সত্যভাষী


সেই একরোখা ডাইজিনিস যে বলার সাহস দেখিয়েছিল, রোদ ছাড়ো, এটা দেয়ার ক্ষমতা তোমার নেই

মানুষের মুখে এমন বাণী মানায়, যার কাছ থেকে পৃথিবী নিতে পেরেছে খুব সামান্যই। কারণ তার দার্শনিক অভিসন্দর্ভগুলো আজ আর অবশিষ্ট নেই। এবার আমাদের এই বাংলার এক অনিন্দ্য সুন্দর কবির জীবনে আত্মরতির উপস্থিতির কথা বলবো। এই কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। আমার দৃষ্টিতে এত উচ্চমাত্রার একজন কবিপ্রতিভা বাংলা ভাষায় বিরল। কেন তা, সেই বিষয়ে এখানে এই পরিসরে বলার তেমন অবকাশ নেই। তারজন্যে প্রয়োজন সাহিত্য সমালোচনার সুদীর্ঘ প্রকাশ। কবি জীবনানন্দ নিজের আত্মজৈবনিক রোজনামচা লিখতেন ইংরেজি-বাংলার সংমিশ্রণে, অনেকটা সাংকেতিক আঙ্গিকে। একবার তিনি ভয়াবহ এক মানসিক স্ট্রেসে ভুগছেন। ভীষণ মানসিক চাপ ও হতাশা। ডাইরির পাতায় উঠে এলো তার সত্য-সুন্দর-স্বাধীন স্বীকারোক্তি- ‘Back aching after much night through corruption: so a morning!’ “Corruption মাস্টারবেশনের একটা প্রতিশব্দ। জীবনানন্দ তার অন্য আরও বেশ কিছু লেখায় মাস্টারবেশনকে করাপশান হিসেবেই লিখেছেন। ডাইরির এই এন্ট্রিতে দেখা যাচ্ছে, সারা রাত বেশ কয়েকবার হস্তমৈথুন করেছেন তিনি। তাতে সকালে পিঠে ব্যথা করছে তার। স্বমেহনের যৌন আনন্দের ভিতর দিয়ে তিনি বুঝি নিজেকে ভারমুক্ত করতে চাচ্ছিলেন তখন।“- সুলেখক শাহাদুজ্জামান তার ‘একজন কমলালেবু’ বইয়ে কবি জীবনানন্দের আত্মজৈবনিক স্বীকারোক্তিকে চিত্রিত করেছেন এইভাবে। লেখকের এই চরিত্র চিত্রণ বহুমাত্রিক একজন কবিকে পৌঁছে দিয়েছে অত্মউপলব্ধির এক অনন্য মাত্রায়। আত্মরতি যৌন স্বাধীনতার এক ভিন্ন ডিমেনশন, যা পশ্চিমা সমাজে স্বাভাবিক যৌনতার এক ভিন্ন ডাইভার্সিটি। উদারনৈতিক ও ইহলৌকিক দেশগুলো ডাইভার্সিটিকে সামাজিক শক্তি হিসাবে বিবেচনা করে। কারণ এই বৈচিত্র্য অন্য কোন ব্যক্তিকে জাগতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।

মানুষের যৌন-স্বাধীনতা ও প্রজননের স্বাধীনতা নিহিত তার স্বাভাবিক যৌনচেতনার ভিতরে। যে রাষ্ট্র যতবেশী এই চেতনার পৃষ্ঠপোষক তারা ততোবেশী মানবিক ও আধুনিক। রাষ্ট্রের এই চাওয়াকে অনুসরণ করে তার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এক্টোজেনেসিস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন এক শাখা যা প্রাণী তথা মানুষের পূর্ণাঙ্গ প্রজনন মার্তৃজরায়ুর বাহিরে ঘটানোর প্রচেষ্টায় নিরলস গবেষণায় রত। অনেক দূর এগিয়েছেও তারা। এর যেমন বিরাট এক বাণিজ্যিক দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানবিক দিক। মানুষের অনুক্রমিক স্বাধীনতার এ এক পর্যায় ধাপ, যা চলে গেছে জৈবনিক সীমাবদ্ধতাকে ছিন্ন করে এবসোলিউট স্বাধীনতার দিকে। অনেকেই হয়তো ইউটিউব ভিডিওতে সোফিয়া নামের এক রোবট কন্যার কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হয়েছেন। অবাক হবার মতন একটা বিষয় বটে। কারণ এই নারী রোবটে সীমিত আকারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে সে নিজের ভুল থেকে কিছু কিছু শিখতে পারে, মানুষের স্বভাব ও অনুভূতিতে সাড়া দেয়। ভবিষ্যতে যদি মানুষ যৌন অংশীদার হিসাবে রোবটকে বেঁছে নেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা তার একটা যৌন-স্বাধীনতা, যা তার ভবিষ্যতের পরিপূর্ণ সার্বিক স্বাধীনতারই অংশ।

কাম প্রথম রিপুর মর্যাদা পেয়েছে তার নিজস্ব ধারে ও ভারে, বিক্ষিপ্তভাবে নয়। আমাদের সব কাজের গোঁড়ায় মূল অণুপ্রেরণাদায়ী শক্তি কাম। ইয়ং, ফ্রয়েড থেকে শুরু করে জেফ্রি মিলার সবাই এক সাথে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন দিনশেষে। আমরা রেগে গেলে চেতনাভ্রষ্ট হয়ে কাম তথা যৌনতা মিশিয়ে গালাগাল ছুড়ে মারি। যে জিনিস আমাদের অস্তিত্বের সাথে, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যা আমাদের ছায়াসঙ্গী হিসাবে দেহ-মনে মিশে থাকে, তা গালি হয়ে গেল কেমন করে। যৌনতা বিষয়ে অজ্ঞতা মানুষকে ঠিক মানায় না। আমরা কালার ম্যাচ করে কাপড় পরতে ভালবাসি, কিন্তু ভিতরের বুদ্ধিবৃত্তিক পোশাকটা ম্যাচ করে পরি না।


——————ওমর খৈয়ামের কাব্যপ্রয়াসে আদিরসের স্বার্থক ধ্রুপদী প্রয়োগ—————

যৌনতার বিষয়ে না জানা মানবগোষ্ঠী উন্নত সমাজের অংশীদার হতে পারে না, সাবহিউম্যন লেভেলেই রয়ে যায়। তাই আমাদের চেতনা শুদ্ধি, কামশুদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। কিভাবে সেই শুদ্ধিধামে পৌঁছান যায়? উপায় একটা আছে- আমাদের যৌনতার ব্যাপারে খোলামেলা হতে হবে কথায়, চিন্তায়, সংস্কৃতিতে ও শিক্ষায়। যে জিনিস যত বেশী ঢেকে রাখা হয়, তার উপরে ততো বেশী কৌতূহল জমা হয়ে যায়। কৌতূহল নিবৃত্তিহীন ভাবে জমতে জমতে একসময় তাতে পচন ধরে। এই পচনই ব্যক্তিকে পচায়, সমাজকে পচায়।

মানুষের মুক্তিপ্রয়াস পৃথিবীতে দুই আর্থ-রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমে উৎসারিত হয়েছে- পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ। পুঁজিবাদ মানবিক যৌনতাকে যেভাবে সমাজে ক্রিয়াশীল দেখতে চায়, সাম্যবাদের ক্ষেত্রে সেখানে কিছু সাংগঠনিক পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, সমাজবাদ যৌনতাকে পণ্যবিবেচনায় নিয়ে এর ব্যবসায়ীক প্রসারের দিকে যায় না, কিন্তু ধনবাদীরা তেমন একটা অপশান খোলা রেখেছে। যৌনতাকে পণ্য হিসাবে নেয়ার পিছনে ধনতান্ত্রিক সমাজে যে শক্ত যুক্তিগুলো কাজ করে সেসব আগে উল্লেখ করেছি। তাদের ভিতরে যত পার্থক্যই থাক না কেন, এক জায়গায় তার একাকার, তা হলো- তারা বিশ্বাস করে মানবিক যৌনতা স্বতঃস্ফূর্ত, খোলামেলা ও বন্ধনহীন। এটা মানব চাহিদার একটা মৌলিক দাবী। তারা উভয়েই স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক যৌনতার ব্যাপারে অনেকটা একই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে। তবে ধর্মীয় নীতি ও অনুশাসন যৌনতার ব্যাপারে ধনবাদ বা সাম্যবাদ কোনদিকেই যেতে রাজী নয়। মানব যৌনতার স্বাভাবিক গতি ধর্ম দিতে ব্যর্থ। পুঁজিবাদ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে, তেমনি সমাজে মানবিক যৌনতার ধর্মনৈতিক প্রকাশকেও ব্যবহার করে। তবে উন্নত ধনবাদী দেশগুলো তা নিজের দেশের জন্যে সমর্থন করে না, করে অন্য উন্নয়নশীল দেশের জন্যে, যেখানে তার রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। সমাজবাদী রাষ্ট্রে যৌনতার রাজনৈতিক ব্যবহারের বদনাম নেই বললেই চলে।

স্বাভাবিক যৌনতা, অস্বাভাবিক যৌনতা, যৌনতার বহুমুখীতা ইত্যাদি বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশসহ বাংলাদেশী সমাজ ও রাষ্ট্র কোন অবস্থানে আছে সেই বিষয়ে আলোচনায় গিয়ে এই রচনাটিকে ভিন্ন এক সাংঘর্ষিক মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তারপরেও প্রচ্ছন্নভাবে কখনও কখনও যৌনতার ব্যাপারে বঙ্গীয় দৃষ্টিকোণের ব্যাপারটা চলে এসেছে। যেহেতু এই রচনার পাঠক বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, তাই এটা পড়ার সময় যৌনতার ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রের খুঁটিনাটি মনের পর্দায় ফুটে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক- আমাকে আর নতুন করে কিছু মনে করিয়ে দিতে হবে না। কাজেই অল্প কয়েকটা কথা বলে এই অলেখার উপসংহার টানতে চাই। সেটা হলো- পশ্চিমের কাছে আমাদের প্রাচ্যের এখনও অনেক কিছু জানার ও শেখার রয়ে গেছে। তবে এই জানাটা নিরবচ্ছিন্ন হতে হবে, কোথাও ছেদ পড়লে হবে না। ছেদ তো এমনি এমনি পড়ে না, কেউ না কেউ ছেদ ফেলে, ছেদ করে। সেই ছেদকারী শক্তির নাম রাজনীতি ও ধর্ম, বা ধর্মীয় রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি। বিচ্ছিন্ন মানুষ দুই বা তিনজন নয়, সংখ্যায় তারা কোটি কোটি হতে পারে। শুধু শুধু এইসব বিচ্ছিন্ন মানুষদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। একগুচ্ছ পঙ্গু রাজনীতিকই পারে কোটি কোটি মানুষকে শিক্ষার বিশ্বজনীন স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে অন্ধকার ডোবায় চুবিয়ে মারতে। তাই সবকিছুর আগে সুদ্ধ হতে হবে রাজনীতি। অসুখ সারাতে হবে পঙ্গু রাজনীতিকদের। মুক্তি তখন খুঁজে ফিরবে বিচ্ছিন্ন বন্দী মানুষদের।