আগেই বলে রাখি এটা নির্ভেজাল আড্ডা।

আমরা ম্যামল বা স্তন্যপায়ী। ম্যামলদের মায়েদের প্রায় সবাই জলজ্যান্ত আস্ত বাচ্চা জন্ম দেয়, এই আস্ত জন্ম দেয়া প্রক্রিয়াকে বলে ভিভিপ্যারিটি। ‘প্রায় সবাই’ কেন বললাম? যারা আস্ত বাচ্চা জন্ম দেয় না এরা কী করে তাহলে? এরা আসলে ডিম পাড়ে, বাচ্চাদের আবার দুধও খাওয়ায়! অদ্ভূত, তাই না? যাই হোক, মূল কথায় আসি।

ক্লাস ত্রিতে আমাদের ধারণা দেয়া হয়েছিল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সম্পর্কে। তখন স্যার বলেছিলেন তিমি নাকি মাছ না, স্তন্যপায়ী। কিন্তু বুঝলাম এরা মাছের মত ডিম না পেড়ে বাচ্চা জন্ম দেয়, তাই বলে পানিতে কিভাবে বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায় মানে পান করায় আর কতটুকু? সেটা স্যারকে জিজ্ঞেস না করলেও ডাঙর হওয়ার পর গুগল স্যারকে জিজ্ঞেস করে ভীমরি খেয়ে দেখলাম নীল তিমি প্রতিদিন বাচ্চাকে এমনকি ৫০০ লিটারের অধিক দুধ পান করায়, স্থন্যপায়ী বটে! এতটুকু পানি দিয়ে কয়েকদিনের নাওয়া-খাওয়া আমার দিব্যি চলে যাবে। আর বেচারা মানুষ কখনো দিনে এক লিটারের বেশি দুধ পান করেনা(অবশ্য শৈশবে)।

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মোটামুটি কয়েকটি বৈশিষ্ট্য একদম কমন। যেমন উনাদের সবার রক্ত গরম। তিমি পানিতে থাকলেও মাছের মত রক্ত ঠাণ্ডা না, ম্যামল বলে কথা! আরো যেসব বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে আছে ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস নেয়া বা ডাঙ্গায় বসবাসকারীদের দেহে লোম থাকা। আর অবশ্যই যা থাকতে হবে মানে মেরুদণ্ড যা ছাড়া মায়ের দুধ পান করা যায় না! স্তন্যপায়ীদের অসংখ্য প্রজাতির মধ্যে পাঁচ হাজারের কিছু অধিক এখনো টিকে আছে।

আমরা মানে গরু, ছাগল, মহিষ, মানুষ, ভেড়া, হাতি, ঘোড়া, ইদুর, ক্যাঙ্গারু, কোয়েলা ইত্যাদি। কী, গরু ছাগলের ভিড়ে মানুষের নাম দেখে অনুভূতিতে আঘাত পেলেন? বলি, আমি নিজেও পেয়েছিলাম। ছোটবেলায় এক লোক আমাকে দেখিয়ে আব্বুকে বলেছিল, এ আপনার বাচ্চা। আমি রাগ করে আব্বুকে বললাম, লোকটি আমাকে ‘বাচ্চা’ বলেছে! আব্বু বললেন, বাচ্চা না বলে কী বলবে? আমি অনুযোগের সুরে বললাম, শিশু! কিন্তু ক্লাস সিক্সে উঠে দেখলাম, কবিগুরু কী সুন্দর ছাগলের বাচ্চাকে ‘পশুশিশু’ বলে মানুষের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন

‘পশুশিশু, নরশিশু,—দিদি মাঝে পড়ে’
দোহারে বাধিয়া দিল পরিচয়-ডোরে’

যাই হোক মানুষ সহ উক্ত পশুদের কথা বলছি। তেনারা সবাই বিস্ময়করভাবে খুবই কাছাকাছি পদ্ধতিতে বাচ্চা ধারণ করে এবং জন্ম দেয়। ঐ যে বিবর্তনগত মিল, সবার শেকড় এক জায়গায়। এই লিংকে ক্লিক দিয়ে তাদের বিবর্তনচিত্র বড় করে দেখেন।

গল্পের মধ্যে হঠাৎ করে একটা গোলমেলে ছবি দিয়ে বসেছি। যারা নবীন তাদেরকে একটু বুঝিয়ে বলি। বিবর্তনের সরল চিত্র যেমন বানরের মত একটা প্রাণী থেকে কয়েক ধাপ পরেই দাঁড়িয়ে মানুষ হয়ে গেছে এরকম ছবি দেখে যারা অভ্যস্ত তাদের খটকা লাগতে বাধ্য। আসলে যেকোনো প্রাণীর বিবর্তনের চিত্রটা মোটামুটি জটিল। বর্তমান সময়ে প্রস্তুতকৃত জীবন-বৃক্ষের ছবির লিংক দিলাম। এটা নিয়ে ঘাটাতে পারেন, এই সাইটেও হালকা দেখতে পারেন।

যাই হোক, আমরা এখানে কারো বিবর্তনের ইতিহাস দেখতে চাচ্ছি না। আমরা চাচ্ছি বর্তমান কালে যেসব স্তন্যপায়ী আছে তারা কিভাবে বাচ্চা দেয় সেটা সম্পর্কে জানতে। তো জিওলজি এর মতে বর্তমানে কিন্তু কলির যুগ চলছে না, যেটা চলছে এর নাম সিনাজোয়িক যুগ যা সাড়ে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগ শুরু হয়েছে। উপরে দেয়া ছবির সব শেষে দেখেন আছে সিনাজোয়িক যুগ, এর ডানে মাত্র তিন ধরণের প্রাণী আছে। মনোট্রিমাটা, প্লাসেন্টালিয়া, মারসুপিয়ালিয়া। চমৎকার সব জটিল শব্দ। এরা তিনটাই স্তন্যপায়ী এবং এদের বাচ্চা জন্মদান প্রক্রিয়ার মধ্যে যেমন মিল আছে তেমনি আছে কিছুটা ভিন্নতা। একদম শুরুতে যাদের কথা বলেছি মানে ডিম দেয় আবার বাচ্চাকে দুধও পান করায় এরা হচ্ছে মনোট্রিম। একটা মনোট্রিম প্রাণীর নাম বলেন তো; শিওর, আপনি জানেন। হ্যাঁ পেরেছেন, প্লাটিপাস! আবার যেমন ক্যাঙ্গারু, এরা অপরিণত বাচ্চা জন্ম দিয়ে একটা থলিতে বাচ্চা রেখে দুধ পান করিয়ে, যত্ন করে বড় করে তোলে- এরা হচ্ছে মারসুপিয়াল। এই দুই ধরণের স্তন্যপায়ীদের গল্পটা একটু বেশি মজাদার এবং বড়সর, তাই তাদের জন্য আরেকটি পর্ব বরাদ্দ করে দিলাম। এ পর্বে শুধু প্লাসেন্টালদের নিয়ে বলি, মানে আমাদের গল্প। আর আমরা মানেই তো মানুষ, বিড়াল, বানর, ছাগল, ইদুর ইত্যাদি।

প্রথমে একটি স্ত্রী প্রজনতন্ত্রের ছবি দেই
.

প্রজননতন্ত্র নিয়ে আলোচনার প্রথমেই একটা প্রশ্ন আসে,কেন জননাঙ্গের গঠন এমন জটিল, কিভাবে এগুলো বিবর্তিত হল। এটা এখানে আলোচ্য নয়। তবে একটি লিংক দিচ্ছি যেখানে দেখবেন জননাঙ্গ কিন্তু স্পার্ম প্রদান ও গ্রহণ ছাড়াও অনেক জটিল কাজ করে থাকে । একটি প্রাণী তো এমনকি শিশ্ন দিয়ে গান গায়! ভিডিও লিংক

কিভাবে গর্ভধারণ হয় ও এর পরবর্তী ধাপ কী কী সেটা নিয়ে পরে অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে। এখানো আমাদের যা জানা দরকার তা হচ্ছে, uterus বা জরায়ু- সেখানে ভ্রূণ অবস্থা থেকে পূর্ণাঙ্গ বাচ্চায় পরিণত হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। এই মাতৃগর্ভে অবস্থানকাল বা জেস্টেশন পিরিয়ড প্রাণীভেদে ভিন্ন হয়। ইঁদুর মাত্র ২২ দিন, মানুষ, গরু, ঘোড়া, সী লায়ন, ডলফিন নয় থেকে বারো মাস, জিরাফ পনের মাস, আফ্রিকান হাতি ২২ মাস আর কিছু কিছু হাঙর তো দুই বছরেরও অধিক মাতৃগর্ভে বাস করে।

মাতৃগর্ভে যত দিন ইচ্ছা বাস করুক, কিন্তু এদের নাম প্লাসেন্টালিয়া বা প্লাসেন্টাল ম্যামল হল কেন?

আমরা যখন মাতৃগর্ভে বাস করছিলাম তখন আমাদের নাভিরজ্জু দিয়ে মায়ের দেহ থেকে পুষ্টি শুষে নিতাম। এই নাভিরজ্জুর একপাশ আমাদের নাভীর সাথে আর অপর পাশ ছিল প্লাসেন্টার সাথে, এই প্লাসেন্টা জরায়ুর দেহে সংযুক্ত হয়ে অবস্থান করে। নিচের ছবি দেখেন

এই ছবি ক্লিক করে দেখেন একটা বাচ্চা জন্মের পর প্লাসেন্টার সাথে সংযুক্ত। স্বভাবতই প্লাসেন্টা থাকে খুবই রক্তসমৃদ্ধ।

এই প্লাসেন্টা নিয়ে আরো দুটি কথা বলা যাক। প্লাসেন্টা শব্দটি cake এর লাতিন রূপ থেকে এসেছে। তো প্লাসেন্টাকে বাংলায় কী বলা হয়? বাঙলায় বলা হয় গর্ভফুল বা অমরা। গর্ভফুল কেন হল তা বুঝলাম, কেক এর লাতিন থেকে কেন এসেছে তাও বুঝলাম। কিন্তু ‘অমরা’ কেন? আসলে আমার জানা নেই। অমরা শব্দের একটা অর্থ হচ্ছে স্বর্গ, এই যে আমরা বলি না অমরাবতী। কিন্তু মাতৃগর্ভে স্বর্গীয় কিছু ঘটেনা। বরং খুব ভয়ংকর কিছু ঘটনা ঘটে। উদাহরণ দেই

– যখন যমজ সন্তান হয় তখন অনেক সময় একটা অপরটার মৃত্যুর কারণ হয়।

– স্যান্ড টাইগার নামক হাঙর মাতৃগর্ভেই তার ভাই-বোনকে খেয়ে ফেলে, এম্ব্রিওনিক ক্যানিবেলিজম!

– গর্ভকালেই বিভিন্ন কারণে একটা বড়সড় সংখ্যক প্রাণী মরে যায়। গর্ভধারণ ও বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে অনেক মাও মরে যায়। (অমরা!)

– গর্ভাবস্থায় নাভি দিয়ে পুষ্টি গ্রহণ করেন। তো মুখ দিয়ে কী করেন জানেন? নিজের মূত্র নিজে পান করেন, ওয়াক!

এরপর মাতৃগর্ভ সম্পর্কিত কোনোকিছুর নামের সাথে স্বর্গীয় কিছু মেলাতে হলে কষ্টকল্পনা প্রয়োজন।

তো সব শেষে উত্তর না দিয়ে একটা মজার প্রশ্ন করি। এই যে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল সেটা কার দেহের অংশ, মা নাকি শিশু?