লেখক: ঘুণপোকা

বাঙালি কি একই সাথে বাঙালি এবং মুসলিম? নাকি যে কোন একটা, নাকি উভয়ই তার পরিচয়? এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগাটা বাঙালি-মুসলমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মনে হয় না পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন জাতি আছে যারা এ ধরণের মনোজাগতিক সঙ্কটে ভোগে এবং এটা নিয়ে এতো বেশি আলোচনা হয়।

এই সঙ্কটের শেকড়টা যে খুব বেশী গভীর, তা কিন্তু নয়। মধ্যযুগ থেকেই এখানে মুসলিম ধর্মমত টিকে আছে, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আছে। সঙ্কট তখনো ছিল, কিন্তু এখনকার মত এতো তীব্র নয়। এখানে একটা বিষয় পরিস্কার করা প্রয়োজন, বাঙালি মুসলিম হওয়ার আগে তার ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব ছিলনা, কারণ বাঙালির আদি ধর্মবিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত ছিল তারই শত শত বছরের লালিত জীবনযাত্রার বিভিন্ন উপাদান। ধর্ম এখানে কখনো কখনো সংস্কৃতি হিসেবেই লালিত হয়েছে। কারণ বাঙালির প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতি একই মাটি হতে উদ্ভুত। তাই এখানে ধর্ম এবং জাতিসত্তার পরিচয় কখনো মুখোমুখি দাঁড়ায়নি বরং পরিপূরক হিসেবেই পাশাপাশি এগিয়েছে।

যেহেতু এখানকার মানুষের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, জলবায়ুগত সুবিধা-অসুবিধা আরবের মরুচারীদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই এই জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা, এই মাটির সন্তানদের যাপিত জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসলামকে প্রবেশ করতে হয়েছে, টিকে থাকার প্রয়োজনে এখানকার ইসলাম প্রচারকদের নমনীয় হতে হয়েছে। মনে রাখা দরকার আরবের মুসলিমরা এখানে কিন্তু ব্যাপক আকারে মাইগ্রেট করেনি, হিন্দু কিংবা অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস থেকে কনভার্ট করিয়ে আরবের মুসলিম দর্শন এখানে গেলানো হয়েছে। ইসলাম এবং আরব সংস্কৃতিও যেহেতু একই মাটি হতে উদ্ভূত এবং ইসলামে যা কিছু নিয়ম-কানুন তার প্রায় সব কিছুই আরব সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, তাই আরবের ইসলাম মোটেই বিশ্বায়নের যোগ্য ছিল না; বিশেষকরে উপমহাদেশের মত এলাকায় । তাই এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুফি ঘারানার যে সকল মুসলিম সাধক এসেছিলেন, তারাও এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই কাজ করেছিলেন। তাদের মরমী সুফি দর্শনের সাথে এখানকার মানুষের উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় বলেই তারা এখানে ধর্ম প্রচারে সফল হয়েছেন।

পাশাপাশি যেহেতু আরব অঞ্চলের সাথে আমাদের ভৌগলিক দূরত্ব অনেক বেশি তাই এখানকার হিন্দু বা বৌদ্ধদের কিন্তু কোরআন-হাদিস পড়ে কিংবা কাবা-রওজা দেখে ভক্তিতে বা বিশ্বাসে গদগদ হয়ে মুসলিম হওয়ার সুযোগ ছিল না এবং যেহেতু আরবি ভাষা যেহেতু এখানকার মানুষের ভাষা নয়, তাই সে ভাষার ধর্মগ্রন্থ পড়ে-বুঝে ঈমান আনাও সহজ ছিলনা। অর্থাৎ ইসলাম-আল্লাহ-নবীদের বিভিন্ন কেরামতি এই বিষয়গুলো সুফি-দরবেশদের মুখে মুখে বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনি হিসেবে বর্ণিত হয়েই এখানে ইসলামে ঢুকেছে। সেই কেচ্ছা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তাদের স্থানীয় কিছু উপাদানও যোগ করতে হয়েছে। খোয়াজ-খিজির, কারবালার কাহিনি এখানকার ফ্লেভার মিশিয়ে পরিবেশিত হয়েছে, মানুষ গ্রহণ করেছে। তারা জাতপাতহীন উদার মানবিকতার গল্প শুনিয়েছেন, সেটাও মানুষ গ্রহণ করেছে। শুধু দোজখের ভয় বা বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে অমুসলিমদের আকৃষ্ট করা সম্ভব ছিল না, তাই এসব কেচ্ছা-কাহিনি আর উদার জীবনযাত্রার কথাই মানুষকে আগ্রহী করেছে।

এর ফলেই আস্তে আস্তে সৃষ্টি হয়েছে একধরণের সমন্বয়। মনে রাখতে হবে এখানকার নিন্মবর্ণের হিন্দুরা কিন্তু বর্ণবাদ কিংবা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছে বলে ইসলামে এসেছে, কেউ কেউ অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় নিজের আদি ধর্ম ছেড়েছে, তাদের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে মুক্তি চাইতে কিন্তু নয়। বহু শতাব্দী থেকে এখানে আর্য-অনার্য আচার-সংস্কৃতি লালন করেছে সাধারণ মানুষ, ফলে হাজার মাইল দূরের ধর্মবিশ্বাস, জীবনযাত্রা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। এর ফলে আমরা দেখেতে পাই মাজার-খানকাভিত্তিক একধরণের প্রতিষ্ঠান, যেখানে সকল ধর্মের মানুষের অবাধ যাতায়াত। অন্যদিকে মনসা-সরস্বতী সহ বিভিন্ন পুজায় মুসলিমদের অবাধ অংশগ্রহণ। এই সমন্বয়ের ফলে ইসলাম ধর্ম এই জলবায়ুতে এক ভিন্ন রূপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়, যাকে বর্তমান কট্টরপন্থী সালাফি-ওহাবিরা আসল ইসলাম বলে মানতে নারাজ।

এই সমন্বয়বাদী উদারপন্থী ইসলামের উপর নতুন করে তাহলে চরমপন্থার প্রলেপ পড়ল কিভাবে? এই সঙ্কট যে শুরু থেকেই ছিল না তা কিন্তু নয়, তবে এই অঞ্চলে মৌলবাদী ইসলামের প্রসার ঘটে আঠারো শতকের দিকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সুযোগে, যাতে প্রভাব ছিল ওহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব (১৭০৩-১৭৯২ খ্রি.)। ওহাবী মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে ‘সে যুগে যে ব্যাপকভাবে পীরপূজা, গোরপূজা, ব্যক্তিপূজা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তুর্কী সুলতানরা ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে যেভাবে আয়েশী রাজা-বাদশাহর জীবন যাত্রা শুরু করেছিলেন।’ ফলে মুসলিমদের এ ধরণের ‘বেদাতি কাজ’ থেকে বাঁচানোর জন্য হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং তিতুমীর সহ অনেক সমাজ সংস্কারকদের হাত ধরে মৌলবাদীরা এখানে শিকড় গেড়ে বসে।

হাজী শরিয়তউল্লাহ ১৭৯৯ সালে হজ পালনে মক্কায় যান এবং ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ওহাবী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত এবং দীক্ষিত হন, দেশে ফিরে তিনি ওহাবী আন্দোলনের অনুরূপ ইসলামি সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। যা পরবর্তীকালে ফরায়েজী আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়। এখানকার সমন্বয়বাদী দর্শনের প্রবল বিরোধিতা করেন শরিয়তুল্লাহ। ‘হেদায়া’তে উল্লিখিত মুসলিম আলেমদের শরীয়া অনুসারে তিনি ব্রিটিশ ভারতকে ‘দারুল হারব’ (শত্রুরাষ্ট্র) হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এখানকার মুসলিমরা। একদিকে তাদের ধর্মবিশ্বাস অন্যদিকে হাজার বছরে লালিত সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ফলে স্পষ্টতই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে মুসলিম সমাজ।

এই বিভাজন চূড়ান্ত রূপ নেয় ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে। ভাষা, খাদ্যভ্যাস, সংস্কৃতি সহ কোন মিল না থাকা সত্ত্বেও যখন শুধুমাত্র ধর্মের খাতিরে হাজার মাইল ব্যবধানে থাকা দুটি ভূখণ্ডকে এক করে একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র জন্ম নেয়; পাকিস্তান। একদিকে পাকিস্তানী শাসকদের এই বাঙলায় সাংস্কৃতিক দমন-পীড়ন, অপরদিকে ওহাবী-মউদুদিবাদের প্রসারে ক্ষত-বিক্ষত বাঙলা তেইশ বছর পর যখন নিজস্ব রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেল, ততদিনে বাঙালির নিজস্ব স্বকীয়তা যেটুকু ছিল সেটাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। যদিও বাহাত্তরের সংবিধানে জোড়াতালি দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদকে দমনের চেষ্টা করা হয়েছিল সেটাও সফল হয়নি।

এই মৌলবাদী ইসলামের পাশাপাশি এই ভূখণ্ডে উদার মতবাদে বিশ্বাসীদের অবস্থানও ছিল। চিরায়ত বাউল-সহজিয়াদের পাশাপাশি পীর-দরবেশ, সূফী-মাজারপন্থীগণও তাঁদের দর্শন প্রচার করে গেছেন। সমস্যাটা হয়েছে আসলে এখানেই। বাঙালি কি শুধুই ‘বাঙালি’, নাকি ‘মুসলিম’, নাকি দুটোর সমন্বয়?

সালাফি মোল্লা ঘোষণা দেয় গান হারাম, বাজনা হারাম, ছবি তোলা হারাম, ছবি, পহেলা বৈশাখ হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ, ভাস্কর্য রাখা যাবে না, নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া হারাম, চাকরি করা হারাম, হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ বুকিশ ইসলাম। ধর্মীয় বইয়ে যা লেখা আছে অক্ষরে অক্ষরে সেটা মানা এবং অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। অন্য অর্থে দেড় হাজার বছর আগেকার আরব্য সংস্কৃতি আনকোরা টিকিয়ে রাখা। একদিন দুইদিন না, বছরের পর বছর ওয়াজ-মাহফিল, জুমার খুতবায়, আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘হিন্দুয়ানি’ নাম দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলে গেছে ওহাবি মোল্লারা। কেউ বাধা দেয়নি।

অবস্থাটা এমন জায়গায় গেছে যে কেউ মুসলিম হলে সে আর বাঙালি হতে পারে না, আর বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাকারী কখনো ‘সহিহ মুসলিম’ হতে পারে না। এসব প্রচার-প্রচারণার ফলাফল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনেই। এমন একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে যারা না হতে পেরেছে আরবি মুসলিম, না হতে পেরেছে বাঙালি। শেষ কথা হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক অভীপ্সা পূরণের লক্ষ্যেই সংঘটিত হয়নি বরং বাঙালির স্বকীয় সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যেও পরিচালিত হয়েছে। সেই লক্ষ্য থেকে যত দূরে সরে যাবে, বাঙালির এই সঙ্কট ততবেশি ঘনীভূত হবে বলেই আশঙ্কা করি।