লিখেছেন: রাজেশ পাল

উত্তাল মার্চ, ১৯৭১ সাল। ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ের পর হতেই বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা উঠে গেছে তুঙ্গে। সারা দেশ প্রকম্পিত হচ্ছে মিছিল আর শ্লোগানের গর্জনে।আর সমানতালে চলছে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার। অবশেষে এলো সেই অগ্নিঝরা দিন। ৭ই মার্চ, ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত লাখো জনতার সামনে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ ঘোষণা করলো বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ।

“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো,
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

সেই ভাষণে যেন নবপ্রাণের সঞ্চার হলো টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। রাজপথে নেমে এলো মানুষের ঢল।শহরগুলো পরিণত হলো এক একটি মিছিলের নগরীতে। গগনবিদারী শ্লোগান উঠলো , “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা” “বাঁশের লাঠি তৈরী করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। যেন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে এলো চেপে রাখা ক্ষোভের উন্মত্ত লাভার উচ্ছ্বাস। শৃংখলমোচনের দূর্ণিবার আকাঙ্খা থেকে সৃষ্টি হলো গণজোয়ার। সে জোয়ারের ঢেউ এসে ধাক্কা দিলো সম্মানীপুরেও। সম্মানীপুর ঢাকা শহর থেকে ৩১৬ কিলোমিটার দূরে রংপুর জেলার কোতোয়ালী থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। একেবারে অজ পাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায়, সম্মানীপুর ছিলো অনেকটা তারই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু স্বাধিকারের ঢেউয়ের দোলা এসে ধাক্কা দিয়েছে এখানেও।

এই গ্রামেরই এক দরিদ্র কসাই শাহেদ আলী।নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ।অল্পবয়সেই পিতৃহারা হয়ে স্কুলের পড়াশোনার ইতি টানতে বাধ্য হন। আর পরিবর্তে ছয় সদস্যের পরিবারের মুখের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। পেশা হিসেবে বেছে নেন কসাইয়ের কাজ। রাজনীতির মানুষ ছিলেননা কোনোদিন। ধারণা ছিলোনা ইতিহাস আর দর্শনের মোটা মোটা গ্রন্থের দাঁতভাঙা তত্বকথা নিয়েও। কিন্তু তাঁর মনেও এসে বাসা বেঁধেছিল স্বাধীনতার দূর্ণিবার আকাঙ্খা।

সম্মানীপুর গ্রাম থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট। ৭ই মার্চের পর থেকেই সেখানে অবস্থিত ২৯ ক্যাভলারী রেজিমেন্টের সৈনিকেরা খানাতল্লাশির নামে আশেপাশের গ্রামগুলোর উপরে শুরু করেছিলো ব্যাপক নির্যাতন, লুটপাট আর জ্বালাও পোড়াও। এসব দেখে রাগে আর ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন শাহেদ আলী। সিদ্ধান্ত নেন বদলা নেয়ার। দলে জুটে গেলো আরো ১০ জন মুক্তিপাগল দামাল তরুণ।অত্যাধুনিক হাতিয়ার তাঁদের নেই, নেই কোনপ্রকার সামরিক প্রশিক্ষণও। শুধু রয়েছে বুকভরা দুর্জয় সাহস আর দেশপ্রমে উজ্জীবিত বিপ্লবী হৃদয়।

২৩ শে মার্চ, ১৯৭১। ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটি জীপ আর ৫ জন পাকসেনা এগিয়ে যাচ্ছিলো লেঃ আব্বাসের নেতৃত্বে পার্শ্ববর্তী দামোদরপুর গ্রামের দিকে। উদ্দেশ্য গ্রামবাসীদের গরু ছাগল পেলে লুটপাট করা। শাহেদ আলী আর তাঁর সাথীরা লুকিয়ে পজিশন নিলেন রাস্তার দুপাশের ঘন ঝোপঝাড়ের আড়ালে। হাতিয়ার বলতে কসাইয়ের দোকানের ছুরি, দা আর বাঁশের লাঠি। নীরবে লুঙ্গিতে কাছা আর মাথায় গামছা বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা। পাকবাহিনীর জীপটি নাগালের মধ্যে আসতেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই উল্কার বেগে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে রাইফেল হাতে নেয়ার সময়টুকুও পেলোনা পাকসেনারা।ছুরি আর দায়ের আঘাতে জর্জরিত হয়ে লুটিয়ে পড়লো সবাই। শুধুমাত্র ড্রাইভার নুরুল ইসলাম বাঙালী বলে তাঁকে ছেড়ে দেন গেরিলারা। সৈন্যদের সাথে থাকা হাতিয়ারগুলো নিজেদের কুক্ষিগত করেন তাঁরা। এরপর জীপসহ পাকসেনাদের লাশগুলো দানজীরপাড় গ্রামের কাছে এক জলাভূমিতে ডুবিয়ে দেন। দানজীরপার গ্রামটি ছিলো সম্মানীপুর গ্রাম থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে।

পাকবাহিনীর উপরে এই হামলা ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে আশেপাশের গ্রামবাসীর মধ্যে। কারণ বিগত কিছুদিন ধরে পাকসেনাদের ক্রমাগত লুটপাটে একেবারেই অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করে ছিলো তাঁদের জন্য। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের পেট্রোল জীপটি ফিরে না আসায় তাদের সন্ধানে ২৯ ক্যাভলারী রেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল শাহ মোহাম্মদ সগীর একটি ফাইটিং পেট্রোল পাঠান। পেট্রোলটি জীপ আর মৃত পাকসেনাদের লাশগুলো খুঁজে পায়। লেঃ আব্বাস তখনো জীবিত ছিলেন। কিন্তু পরদিন ২৪ শে মার্চ হাসপাতালে মারা যান। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাকবাহিনী।

পরদিন ছিলো ইতিহাসের সেই ভয়ঙ্করতম কালোরাত্রি “ ২৫ শে মার্চ, ১৯৭১”। “অপারেশন সার্চ লাইটের” নামে বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপরে হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকবাহিনী। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, বাঙালী পুলিশ, ইপিআর ,বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের উপরে। সূচনা করে পৃথিবীর অন্যতম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের।

পাকবাহিনীর সহযোগী দালালেরাও শুরু করে তাদের কর্মকাণ্ড। কার ঘরের ছেলে মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে, কার ঘরে পাওয়া যাবে সুন্দরী তরুণী, কিশোরী, গৃহবধুদের, কোথায় কোথায় রয়েছে হিন্দু বসতি, কে কে জড়িত আওয়ামীলীগের সাথে সব খবর নিয়মমাফিক পৌঁছে দিতে শুরু করলো পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। এরকমই একজন ছিলো গাইট্টা আমজাদ। জাতিতে বিহারী এই লোকটি যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালীদের কাছে হয়ে উঠেছিলো মুর্তিমান আতংকের নাম।

আগে থেকে বিপদ আঁচ করতে পেরে শাহেদ আলী তখন সম্মানীপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন লালবাগহাটে। সেখানে তিনি কাজ করছিলেন কসাই হিসেবে। গাইট্টা আমজাদ পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয় সেদিনের জীপ আক্রমণের সাথে জড়িতদের নাম। আর সেই সাথে জানিয়ে দেয় শাহেদ আলীর বর্তমান অবস্থানও। ৭ই এপ্রিল, একদল খানসেনা নিয়ে গাইট্টা আমজাদ হাজির হয় লালবাগ হাটে শাহেদ আলীর কসাইয়ের দোকানে। শাহেদ আলী কিছু বুঝে ওঠার আগেই দোকানটি চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে খানসেনারা। পালাবার কোন পথ বাকি না থাকায় মনে মনে শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে নেন শাহেদ আলী। দুজন পাকসেনা দোকানে ঢুকতেই দোকানে টাঙিয়ে রাখা গরু ছাগলের মাংসের আড়াল থেকে নিজের একমাত্র সম্বল কসাইয়ের ছুরিটি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ছুরির আঘাতে ধরাশায়ী করেন দুজনকেই। কিন্তু তাদের পেছনে থাকা ওপর খানসেনা গুলি চালায় তাঁর উপরে। শরীরে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্যান্য পাকসেনারাও বেয়নেটের উপর্যুপুরি আঘাতে জর্জরিত করে ফেলে তাঁর দেহ। মায়ের শৃংখল মোচনের পথে শহীদের খাতায় নাম লেখান শাহেদ আলী।

কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। শাহেদ আলীর মৃতদেহ জীপের পেছনে বেঁধে গ্রামের পরে গ্রাম হেচড়িয়ে টেনে নিয়ে যায় পাকসেনারা।তাঁর স্বজনরা তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার করে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ির হাটের কাছে একটি পুকুর থেকে। সেখান থেকে যখন তাঁর লাশ তাঁর নিজ গ্রাম সম্মানীপুরে দাফন হচ্ছিলো তখন আবারো রাজাকার গাইট্টা আমজাদের সাথে খানসেনারা চড়াও হয় সম্মানীপুরে। পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাণ্ডব চালায় তারা। শাহেদ আলীর বাড়ীতে ঢুকে তাঁর প্রথম স্ত্রীর মাথায় রাইফেলের কুদো দিয়ে ভয়াবহ আঘাত করে তারা। বাদবাকি জীবনে সেই আঘাত থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। প্রথম স্ত্রীর সন্তান না থাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন শাহেদ আলী যুদ্ধ শুরুর মাত্র কিছুদিন পূর্বে। প্রথম স্ত্রী আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে ছুটে এসেছিলেন সেই দ্বিতীয় স্ত্রী। পাকসেনারা তাঁকে মাথার চুলে ধরে টানতে টানতে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যায় আর উপর্যুপরি গ্ণধর্ষণে মেতে ওঠে পৈশাচিক উল্লাসে। তাদের নির্মম নির্যাতনে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

শাহেদ আলীর মতো লাখো শহীদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এদেশের আকাশে উড়ছে পতপত করে লাল সবুজের বিজয় নিশান। বড় বড় মানুষের ভীড়ে তাঁর কথা কেউ মনে রাখবেনা, কোনো কবি তাঁকে নিয়ে লিখবেনা কালজয়ী কবিতা। কিন্তু এই বাংলার আকাশে বাতাসে চিরকালই মিশে রইবে এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের বীরত্বগাথা।

তথ্যসূত্রঃ
লেঃ কর্ণেল সাজ্জাদ আলী জহিরের “ First successful guerrilla leader: the story of Shahed ali” প্রবন্ধ থেকে।