এ বছর ২৬ মার্চ তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে সর্বত্র সরব আলোচনায় মুখর ছিল।তিন ঘটনার প্রধানটি  অবশ্যই আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে শ্রীলংকার মাটিতে শ্রীলংকাকে পরাজিত করে ক্রিকেটের একটি মাইল ফলক স্থাপন আর তৃতীয় ঘটনাটি চিরাচরিত আর তা হলো বাংলাদেশের আধ্যাত্বিক রাজধানী বলে খ্যাত সিলেটের শহরতলীর ‘আতিয়া ভবন’ নামের এক বাড়িতে কতিপয় চরমপন্থী মুসলমানকে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং শেষে যথারিতি ক’জনের লাশ উদ্ধার করা। এরকম ঘটনা বেশ ক’দিন পর পরই ঘটছে। কিছুদিন আগে যেহেতু বাণিজ্যিক রাজধানীতেও এ ধরণের একাধিক ঘটনা ঘটে গেছে  সুতরাং নামের মাহাত্য প্রমাণ করতেই যেন সিলেট হঠাৎ করেই খবরের শিরোনাম হয়ে গেল। সিলেটের ঘটনার ব্যাপকতা এবং গুরুত্ব অবশ্য একটু বেশী কেননা এখানে জঙ্গি আস্তানায় সেনা বাহিনীর প্যারা কমান্ডো আক্রমন পরিচালনার মাঝেই জঙ্গিরা পাল্টা বোমা বিষ্ফোরণ করে অনেককে হতাহত করেছে।আতিয়া ভবন কান্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই খবর পাওয়া গেল মোলভীবাজারের দুটি বাড়ি জঙ্গি আস্থানা সন্দেহে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঘিরে রেখেছে এবং ইতোমধ্যে দু’টিতেই বেশ ক’জন জঙ্গির ছিন্ন বিচ্ছিন লাশ আবিষ্কারের মাধ্যমে অভিযা্নের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।বিষ্ময়কর ভাবে এ যাবতকাল নিরব থাকার পর আধ্যাত্নিক রাজধানী যেন আক্ষরিক অর্থেই আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছে।

স্বাধীনতা দিবস, ক্রিকেটের বিজয় বা জঙ্গি আস্থানায় অভিযানের মুখরোচক আলোচনা আর সংবাদের পাশাপাশি একটি অতি সাধারণ  অতি আটপৌরে  ঘটনা ম্রিয়মাণ  তুচ্ছতায় পত্রিকার অগুরুত্বপূর্ণ অংশে  ছাপা হয়েছে যা আমাকে কিছুটা আলোড়িত করেছে ।ঘটনাটি ঢাকার মীরপুরের।স্বাধীনতা দিবসের একটি অনুষ্টানে ক’টি বাচ্চা মেয়ে নৃত্য পরিবেশন করছিল।নাচতে হলে বাজনার বা গানের প্রয়োজন।গানের সুরে সুরে মেয়েগুলি নাচছিল। আয়োজকরা এখানেই ভুলটি করে বসলেন।সাধারনতঃ এ ধরণের ভুল হয়না বা হতে নেই।গান বাজনা মজলিশ মাহফিল সভা সমাবেশ ইত্যাদি  আয়োজকদের ঘড়ি দেখে দেখে  পরিচালনা করতে হয়।কেননা কখন আজানের সময় হয়ে যায় বলাতো যায়না। কিন্তু উল্লেখিত অনুষ্টান আয়োজকরা এই অতি পালনীয় দায়িত্বটিই বিস্মৃত হয়ে গেলেন। বলাই বাহুল্য ক্ষণটি ছিল  নামাযের সময়।একদল ক্ষ্যাপা উন্মত্ত কম বয়সী মুসল্লি পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে ছুটে আসলেন অনুষ্টানস্থলে। তারপর আয়োজক অংশগ্রহণকারী এবং দর্শকদের উদ্দেশ্যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে মাইকের তার ছিঁড়ে তথা অনুষ্টানকে পন্ড করে দিয়ে যথারিতি তাদের পূণ্যার্জনে চলে যান।বহু বিচিত্র ঘটনার দেশেএটা আসলে কোনো ঘটনাই নয়।এ রকম অসাবধানতার প্রতিক্রিয়া এমনই হয় বা হওয়ার কথা।গত বছর সিলেটের ইস্কন মন্দিরের হিন্দুরাও এমন অসাবধানতা দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী মসজিদের মুসল্লিদের চন্ডরূপ দেখেছেন।এটাই দস্তুর।শতকরা নব্বইভাগ মুসলমানের দেশে নামাজের সময়ে নামাজে বিঘ্ন ঘটে এমন কাজ করা যাবেনা।হোক তা রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অনুষ্টান বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্টান নামাজের সময় হলেই মাইক বন্ধ আওয়াজ বন্ধ ঢোল করতাল নিথর স্তব্ধ। ভিন্নতা হলে শান্তির ধর্মের  সাদা নিশান রং বদলাতে এক মুহুর্তও লাগেনা।

মীরপুরের ইয়াং মুসল্লীরা স্বাধীনতার সেই অনুষ্টানে কী ভাষায় গালাগাল করেছে জানা যায়নি।হয়তো আয়োজকদের ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদেরও গুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়েছে।স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করার অধিকার ও স্পর্ধা এ দু’টোই এদের রয়েছে আর বিষ্ময়কর সত্য হলো এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রও এদের পাশে এসে দাঁড়াবে।পুলিশের আই জি এসে অনুষ্টান আয়োজকদেরই উল্টো ভর্ৎসনা করবেন কেননা সব ধর্মের উপরে যেমন ইসলাম তেমনি সব অনুষ্টানের উপরে হলো নামাজ।

মীরপুরের মুসল্লিরা জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হলেও এদেরকে  জঙ্গি বলা যাবেনা বরং এরা ধর্মের সবচেয়ে অভিজাত সবচেয়ে অহংকারী অংশ।এরা যখন নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে আসেন তখন মসজিদে না যাওয়া নামাজ না পড়া মানুষের দিকে অবজ্ঞা আর ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকান।দেশটা পাপ আর পাপীতে আকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে এমনি হাবভাব তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে।এদের স্থান সাধারণ জনের অনেক উপরে।এরা ধর্মের আইকন।কিন্তু ধরুন সেই অনুষ্টান আয়োজকরা যদি অনুতপ্ত বিব্রত না হয়ে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করতেন বলতেন তোমাদের নামাজ যেমন চলবে আমাদের অনুষ্টানও চলবে।তোমাদের যেমন ধর্ম কর্ম করার  অধিকার আছে তেমনি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার অনুষ্টান করার অধিকার আমাদেরও আছে। আমরা যেমন তোমাদের ইবাদতে বাধা দিতে পারিনা তোমরাও আমাদের অনুষ্টানে বাঁধা দিতে পারনা,তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াতো? মুসল্লি নামধারী ধর্মের আইকন আর আতিয়া ভবনের জঙ্গিদের ভূমিকা এক রেখায় মিলতে খুব একটা সময় লাগতনা। জঙ্গিরা যা করছে মসজিদ থেকে ধেয়ে আসা মুসল্লিগণ যে একই কান্ড করতেন তা বলাই বাহুল্য। তার মানে এই মুসল্লিদের মাঝে সুপ্ত হয়ে আছে এক একটি মানসিক জঙ্গি আপাত নিরস্ত্র হলেও সময়ে এরাও সসস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। অনেক আগে পাঠ্য বইয়ের এক কবিতায় পড়েছিলাম “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে” তেমনি বেশীর ভাগ মুসল্লির অন্তরেই যদি এক একটি জঙ্গি ঘুমিয়ে থাকে তবে মেরে কেটে কি জঙ্গিবাদ  নির্মূল করা যাবে?

মুসলমানগণ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন মীরপুরের স্বাধীনতা অনুষ্টানের উদ্যক্তরা যদি অনুষ্টান চালিয়ে যেতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতেন তাহলে একজন মুসল্লি হিসেবে আপনি কী করতেন? আপনার ইগো তথা ধর্মীয় অনুভুতি কি বারুদের মতো জ্বলে উঠতনা? কেননা জন্মের পর পরই অনুভুতি নামক এই বারুদ আপনার মগজে ঠেসে ভরা হয়েছে প্রথমে পরিবার থেকে তারপর মক্তব থেকে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে সমাজ থেকে রাষ্ট্র থেকে। এই ধর্মীয় ইগোই আবার ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রেরও ক্ষেত্র তৈরি করছে।এই স্বৈরতন্ত্র হলো ভিন্নমত ভিন্ন ধর্মের অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্টের ধর্মীয় আগ্রাসন। যেমন মুসলমানপ্রধান দেশে নামাজের সময় শব্দ করে অনুষ্টান করা যাবেনা গান বাজনা অথবা ভিন্ন ধর্মীয়দের ধর্মীয় অনুষ্টান করা যাবেনা কিন্তু তাদের নামাজের সময় লক্ষ লক্ষ মাইকের হাইড্রলিক সাউন্ডে মেদিনী প্রকম্পিত হলেও তার প্রতিবাদ করা যাবেনা। একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী বলতে পারবেননা এতে ভয়ানক শব্দ দূষণ হচ্ছে। একজন সঙ্গীত সাধক বলতে পারবেননা এই শব্দ আমার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বি বলতে পারবেননা আপনাদের শব্দ আগ্রাসনে আমার ধর্ম কর্মে বিঘ্ন ঘটছে কেননা আপনাদের যেমন প্রার্থনার সময় আছে আমাদেরও সে রকম নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। একজন হার্টের রুগী কাতর স্বরে বলতে পারবেননা এই শব্দে আমার হার্ট খাঁচা ছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়।কাঁচা টাকার খুঁচাখুঁচিতে অথবা চিত্তের বিকারে অথবা অসুস্থ স্বজনের আরোগ্য কামনায় সারারাত মাইকে তেলাওয়াত করলেও কেউ প্রতিবাদ করে বলতে পারবেননা এতে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে।রাষ্ট্রের নাগরিক ভয়ানক এই শব্দের আগ্রাসনে অসুস্থ হয়ে যাক উন্মাদ হয়ে যাক তাতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা হাইকোর্ট রুল জারি করতে পারবেনা কেননা রাষ্ট্র শরিয়া আইনে পরিচালিত না হলেও শরিয়া আইনের অনেক অলিখিত বিধান সমাজে সুপ্রতিষ্টিত হয়ে আছে।এই বিধানের কাছে সংবিধান অকার্যকর আইন অচল।এটাই ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র।যেমন পার্শবর্তি হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ট দেশ ভারত সেদেশে গরু খাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ কারণ গরু হিন্দু ধর্মমতে মাতৃস্থানীয়।মাকে হত্যা করা কোন মাতৃভক্ত সন্তান সহ্য করবে? এইতো ক’দিন আগেই শুধুমাত্র মাংস রান্নার গন্ধ পেয়েই সেটা গরুর না খাসির মাংস তা নিশ্চিত না হয়েই সেখানে গো-মাতার সন্তানেরা এক নিরীহ মুসলমানকে পিঠিয়ে হত্যা করে ফেলল। অতি সম্প্রতি গুজরাটে গরু জবাইয়ের শাস্থি যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রেখে আইন পাস হয়ে গেছে ।একটি  সাম্প্রদায়িক রাজ্যে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।যেহেতু ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট সুতরাং হিন্দুদের সংস্কার মেনে নিয়েই অন্য সকল ধর্মাবলম্বীর গো-রসনাকে সংযত করতে হবে।

ভারতে তবু এই ধর্মীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ হয়। মুসলমান খৃষ্টান নয় হিন্দু সেক্যুলার সমাজই উন্মুক্ত স্থানে গোমাংস রান্না করে খেয়ে এই অনাচারের প্রতিবাদ করেন বা তার চেয়েও বড় কথা প্রতিবাদ করতে পারেন কিন্তু আমাদের দেশে কি এই ধর্মীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করা যাবে ? প্রতিবাদ করার মানসিকতা এবং তা গ্রহণ করার মতো সহিষ্ণুতা না জন্মানো পর্যন্ত জঙ্গিবাদ নির্মূল আদৌ সম্ভব হবেনা। ধড় পাকড় বা হত্যা করে হয়তো উপদ্রব সাময়িক প্রশমন করা যাবে কিন্তু নির্মূল করা যাবেনা।এই জঙ্গিবাদ ক্যান্সারের কোষের মতো অতিদ্রুত তার এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। সুতরাং নির্মূল করতে হলে মূলে হাত দিতে হবে কিন্তু মুলে হাত দেবে কে? ভুত যে সর্ষের ভেতরেই  সংসার পেতে বসে আছে।