এক
বইয়ের সাথে পেশাগত কারণেই পুলিশের খুব একটা সম্পর্ক নেই।তবে মুসলমানপ্রধান দেশগুলিতে বইমেলার মতো জ্ঞান আর বিনোদন মুলক অনুষ্ঠান করতে হলে পুলিশের সাহায্য নেয়া অপরিহার্য কারণ শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোরান হাদিস ছাড়া জ্ঞান বিজ্ঞান বিনোদনের সব ধরণের বইকে শুধু অপ্রয়োজনীই মনে করেনা বরং মুসলমানের ঈমান হরণকারী চরম ক্ষতিকারক উপাদান বলেই বিশ্বাস করে এবং এসব ক্ষতিকারক বইকে ধ্বংস করে দেয়া তাদের ঈমানী দায়িত্ব বলেও মনে করে।সুতরাং একটি মেলাজাতীয় কিছু অনুষ্টিত করতে পুলিশের সাহায্য নেয়া ছাড়া বিকল্প থাকেনা।কিন্তু এবার বইমেলার শুরুতে যখন শুনা গেল শুধু পাহারা দেয়াই নয় পুলিশ এবার বই পড়বেও তখন কিছুটা খটকা লেগেছিল। পুলিশের নীতিমালায় কি বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন আসন্ন হয়ে পড়েছে ?পুলিশ কি নিজেদের পেটোয়া অপবাদ গুছিয়ে এবার পড়ুয়া সুনাম গায়ে সেঁটে দেয়ার পরিকল্পনা করছে? কিন্তু না, যখন শুনা গেল পুলিশ বই পড়বে এর ভেতর উপাদান খুঁজতে তখন শানেনজুল পরিষ্কার হয়।তাই্তো, এমনটিইতো হওয়ার কথা।ক’দিন আগেই না আমপাড়া পড়া মোল্লাদের আরজি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে স্কুলের পাঠ্যসুচিতে তুলকালাম কান্ড ঘটানো হয়েছে।ইসলামীকরণের প্রাথমিক পর্বটি অতি কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করার পর দ্বিতীয় পর্বটি ঘটাতো কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল যাই হোক এটাও সম্পন্ন হতে চলেছে।
দুই
এমন একটা সময়ে আমরা উপনীত হয়েছি যখন মাদ্রাসা পড়া মোল্লারা নিয়ন্ত্রন করে স্কুলের সিলেবাস আর পুলিশ নির্ধারণ করে দেয় কোন বই প্রকাশযোগ্য আর কোনটি নয়।মনে হয় সত্যি অদ্ভুত আঁধারেই আমরা ঢাকা পড়তে যাচ্ছি। আর এই আঁধারটি এমনি এক সময়ে নামছে যখন তূলনামুলক ভালো গণতান্ত্রিক তূলনামুলক ভালো প্রগতিশীল তূলনামুলক ভালো অসাম্প্রদায়িক এবং তূলনারহিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী দলটি ক্ষমতায়।এই তূলনার মাফকাঠিতেই যারা বিপুল সংখ্যক সুইং নাগরিকের এবং সংখ্যালঘুদের ভোটে বার বার ক্ষমতায় যায় আর ক্ষমতায় গিয়ে প্রতিবারই তারা স্বমূর্তিতে আভির্ভুত হয়।এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ প্রফেসর আনিসুজ্জামানের মূল্যায়নটি স্মরণযোগ্য যিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন ‘আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন তারা আমাদের উপদেশ নেয় আর যখন ক্ষমতায় থাকে তখন আমাদের উপদেশ দেয়।এটাই বাস্তবতা।বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদটির উচ্চতা বোধ হয় অপরিমেয় কেননা এখানে আরোহন করলে জনগণকে আর চোখে দেখা যায়না তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘশ্বাস এত উচ্চতায় কখনো পৌঁছোতে পারেনা।ফলে শাসক আর জনগণের মাঝে কল্পনাতীত এক দুরত্ব তৈরি হয়ে যায়।
শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় সুকর্মটি যদি হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা তবে বড় অপকর্মটি হলো কট্টর পাকিস্তানপন্থী মোল্লদের প্ররোচনায় পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসে যুদ্ধাপরাধীদের আদর্শকে ধারণ করা।পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে যে অদ্ভুত পাঠ্যক্রম দাঁড় করানো হয়েছে তা ঈষ্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সবোর্ডের পাঠক্রম থেকেও ঘোর সাম্প্রদায়িক।সরকারের জঙ্গী দমনে গৃহিত জিরো টলারেন্স নীতিকে যদি আরেকটি সাফল্য ধরা হয় তবে এর উল্টো পিঠে বই মেলায় পুলিশ কর্তৃক বইয়ের প্রকাশযোগ্যতা যাচাইয়ের ঘটনা আরেকটি বড় কলংক হিসেবে বিবেচিত হবে।এটা লেখক প্রকাশকের স্বাধীনতায় শুধু হস্তক্ষেপই নয় সবচেয়ে বড় অপমানও।এই অপমানের প্রতিবাদ যেমন হওয়ার ছিল তেমন হচ্ছেনা।লেখক প্রকাশক যদি সমস্বরে গর্জে উঠে প্রশ্ন করত-তোমারা কে হে ? আমরা কী লিখব কী প্রকাশ করব তা নির্ধারণ করার তোমরা কে ? ডঃ আহমদ শরীফ ও ডঃ হুমায়ুন আজাদের মতো ব্যক্তিত্ববান সাহসী লেখকের বড়ই অভাব আমাদের।যে দেশের কবি সাহিত্যিকরা ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দিয়ে পুরষ্কার ভিক্ষা করেন সেইসব রাজকবিদের কাছ থেকে প্রতিবাদ আশা করা অন্যায্য।
তিন
ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের অদ্ভুত ইউ-টার্ন দেখে মনে হয় তারা ক্ষমতাকে ধরে রাখতে এখন মরিয়া।এজন্য মোল্লাদের ভোটব্যাংক দখল করতে যত প্রকারের ছাড় দিতে হয় তা তারা অবাধে দিতে প্রস্তুত।এই ছাড়ই হচ্ছে সিলেবাসে তুঘলকি কান্ড বই মেলায় পুলিশের পৌরহিত্য।স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে যে দলটি প্রতিটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নের্তৃত্ত দিয়েছে বা সক্রীয় অংশ গ্রহণ করেছে যারা পাকিস্তানের কট্টর সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার ডাক দিয়ে জাতীকে এককাট্টা করতে সমর্থ হয়েছিল তাদের কাছ থেকে এরচেয়ে বড় ছাড় স্বাধীনতা বিরোধীরা আর কি আশা করতে পারে? ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর আমল আকিদা নিয়ে আল্লামা শফির সার্টিফিকেট বা সম্প্রতি সিলেবাস সম্বন্ধে চরমোনাইর পীরের তৃপ্তির ঢেঁকুর থেকেই তাদের সন্তুষ্টির ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।ঘটনা পরম্পরায় মনে হচ্ছে আওয়ামীলীগ ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধীকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিপজ্জনক মনে করলেও এদের আদর্শের সাথে তাদের কোনো বি্রোধ আছে তা তারা মনে করেনা।সরকারের এইসব নেতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে জঙ্গীবাদ দমনে সরকারের ভূমিকারও।সরকার কি সত্যি জঙ্গীদের প্রতি এতটা কঠোর হতে পারত যদিনা জঙ্গীরা সরকারের অস্থিত্ত্বের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠতো? হলি আর্টিজানের ঘটনা না ঘটলে কি পুলিশ জঙ্গীদের ব্যাপারে এতটা ইতিবাচক হতে পারত? এর আগে যখন জঙ্গীরা একের পর এক সেক্যুলার লেখকদেরকে প্রকাশ্যে হত্যা করছিল সরকারের তখনকার ভূমিকাতো আমরা দেখেছি।আজকের এই আই জি সেদিন প্রকাশ্যে বলেছিলেন কেউ যদি ধর্মকে আঘাত করে কিছু লিখে তবে তাদের হত্যা না করে পুলিশকে জানাবেন।জুলহাস মান্নানকে হত্যার পর এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন-জুলহাস মান্নান ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখেছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।পহেলা বৈশাখের ভাষণে এই প্রধামমন্ত্রীই বলেছিলেন-ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতকারীদের দায়িত্ব সরকার নেবেনা।অর্থাৎ জংগীরা সেদিন সরকারের পুলিশবাহিনীর সমান্তরালে অলিখিত তৃতীয় বাহিনী হিসেবে নাস্তিক হত্যা মিশনে নিয়োজিত ছিল সরকার তাদের দেখেও না দেখার ভান করেছে ।স্বাধীনতার চির বিরুধী এই মোল্লা আর তাদের সহযোগিরা সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।আওয়ামীলীগ হয়তো এই প্রশ্নে এখনই হাঁ বলার মতো দু’কুল হারানো সিদ্ধান্তে যাবেনা কিন্তু মোল্লারা অনুভূতি জর্জরিত এই সময়েও বেশ সাফল্যের সাথে নির্বিঘ্নে তাদের বিষবৃক্ষের চারাটি রোপন করে তার পরিচর্যা করতে পারছে তাতে রাষ্ট্রের অনুভূতিযন্ত্রে বিন্দুমাত্র সুড়সুড়িও অনুভুত হয়নি।ধর্মকে অথবা শেখ হাসিনাকে কটাক্ষ করে ষ্ট্যাটাস দিলে পুলিশ অস্বাভাবিক দ্রুততায় ব্যবস্থা নেয় অথচ জাতীয় সংগীতের মতো একটি সেন্সেটিভ ইস্যুতে বাক স্বাধীনতার এমন অবাধ প্রকাশ দেখে মনে হয় এ বিষয়ে সরকার ও তার পুলিশ বেশ নমনীয়।স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির শাসনামলেই যদি অবস্থা এই হয় তবে স্বাধীনতা বিরোধীপরিবেষ্টিত কোনো দল ক্ষমতায় আসলে এই বীজ অংকুরিত হয়ে গাছে পরিনত হলে তা কি অস্বাভাবিক কিছু হবে?
চার
আবার বইমেলা ও পুলিশ প্রসঙ্গে আসি।পুলিশ যদিও বলেছিল বাংলা একাডেমী এবং পুলিশের একটি বিশেষ টীম বইগুলি যাচাই বাছাই করে দেখবে তাতে সুড়সুড়িমুলক বা আঘাতকারী কোনো উপাদান আছে কি না।কিন্তু শামসুজ্জামান খানের মতো বাংলা একাডেমীর স্মরণকালের সবচেয়ে অযোগ্য এবং সাম্প্রদায়িক মহাপরিচালক এন্ড কোম্পানীতে প্রকৃত একটি পড়ুয়া টীম আছে তা বিশ্বাস করতে মন চায় না আর পুলিশের বই পড়ার ব্যাপারটিতো হাস্যকর ও প্রশ্নাতীত।আসল ঘটনা হলো এই পুরো প্রক্রিয়াটি রিমোর্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করছে হেফাজত।জামাত হেফাজতের অনলাইন এক্টিভিষ্টরা জানে তাদের আসল শত্রু কে? এছাড়া এদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে বিএনপি পন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীও।অতীতচারী কর্তাভজা কবি সাহিত্যিকে তাদের কোনো আপত্তি নেই কারণ তারা জানে এরা সেই অতীতের আবর্তেই ঘোরপাক খাচ্ছে।‘স্বাধীনতা তুমি সোনালী হাঁসের রুপালী ডিম’ অথবা ৭ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধুর অমর কবিতা’র চর্বিতচর্ব্য করাই এদের কাজ।এদের কোনো মিশন নেই ভিশনও নেই। এদেরকে ওরা কোনো প্রতিপক্ষই মনে করেনা।অশ্লীল অপ-সাহিত্যেও মৌলবাদীদের আপত্তি নেই কারণ যে বই মোল্লাদের গোপনাঙ্গকে সিক্ত এবং উদ্দিপ্ত করে সেসব বইয়ের বিরুদ্ধ্বে তাদের ক্ষোভ থাকার কথা নয়।আরেকদল লেখক আছেন যারা লেখক হিসেবে স্বীকৃত হলেও এদের অধিকাংশ সৃষ্টি হলো অলীক।পাঠককে একটি দিক নির্দেশনা দেয়ার মতো প্রতিভা আর পরিচিতি থাকা সত্ত্বেও এরা অনেকটা রূপকথা জাতীয় রচনার ভেতরেই নিজেকে বন্দী করে রাখেন।এরা অনেকটা ড্রাগ-ডিলারদের মতো।এরা নিজেদের প্রতিভার কারখানায় উৎপাদিত ড্রাগ দিয়ে জনগণ আর বাস্তবের মাঝে মায়াবী দেয়াল তুলে দিচ্ছেন এই অর্থে এরা জ্ঞানপাপী এবং অপরাধী।এদের সাথে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কোনো বিরোধ নেই থাকার কথাও নয় কারণ এদের পারষ্পরিক আদর্শে মৌলিক সাযুজ্য আছে। উক্ত দুই সম্প্রদায়ই অলীক এবং অবাস্তবের নেশায় নিজেরাই শুধু বুঁদ নয় পুরো সমাজের ভেতরেই এই অবাস্তব মোহ মায়া ছড়িয়ে দিতে নিবেদিত।জামাত হেফাজত জানে এরা নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ এরা কখনো তদের আদর্শের প্রতিপক্ষ হবেনা।প্রতিপক্ষ কারা হতে পারে তার নমূনা তারা দেখেছে যখন তাদের এক শীর্ষনেতা আইনের অকল্পনীয় ফাঁক গলিয়ে যুদ্ধাপরাধের মতো দায় থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলে জীবন দিতে বাধ্য হয় কিছু দুর্বিনীত তরুণের কারণে।এই তরুণদের কেউই বড় লেখক হিসেবে পরিচিত নয়।এদের চল্লিশটি পঞ্চাশটি প্রকাশনাও নেই।কিন্তু যৎ সামান্য যা তারা লিখে বা লিখছে তার ধার খুব বেশী।তথাকথিত বড় লেখকদের কোনো বড় লেখা হয়তো পাঠককে সাময়িক মোহে আচ্ছন্ন করতে পারে কিন্তু মানুষকে চুম্বকের মতো টেনে একেবারে রাস্তায় এনে দাঁড় করাতে পারেনা কিন্তু সেই তরুণদের লেখায় তেমন শক্তি আছে।এই তরুণদের যুক্তিনির্ভর শানিত লেখার সামনে মোল্লারা প্রমাদ গুণে।যেহেতু যুক্তিকে মোকাবেলা করার শক্তি মোল্লাদের নেই তাই তারা মৌলবাদের চিরাচরিত পথটিকেই বেছে নেয় অর্থাৎ কাপুরুষোচিত ভাবে এদেরকে সরিয়ে দেয়া।শুরু হয় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকদের হত্যা করার বর্বর এক মিশন। শাহবাগের গণ-জাগরণমঞ্চ সক্রীয় অবস্থাতেই খুন করা হয় তরুণ লেখক রাজীব হায়দারকে।তারপর একে একে নিলয় নীল ওয়াশিকুর রহমান বাবু অনন্ত বিজয় দাশ অভিজিৎ রায় সিরিয়েল কিলিং এর শিকার হন।মুক্তমনা বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের উপর তাদের অতিমাত্রায় ক্ষোভ থাকার কারণ তাঁর বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর লেখাগুলি তরুণদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছিল।ধর্মীয় কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখা মৌলবাদীদের বনেদী স্বার্থে আঘাত হানে।সুতরাং তাঁকে হত্যা করা তাদের জন্য ফরজ হয়ে যায়।শুধু মুসলমান মৌলবাদী নয় শিক্ষিত হিন্দুরাও তাঁর মৃত্যুতে অকল্পনীয় স্বস্থি লাভ করে।কারণ অভিজিতের ধারালো লেখনী তাদের জন্যও যথেষ্ট উষ্মা আর অস্বস্থির কারণ ছিল।অভিজিৎ তাদের যুগ যুগান্তের বিশ্বাসকে দুমড়ে মুচড়ে দেন। অভিজিৎকে হত্যা করেই এরা ক্ষান্ত হয়নি তাঁর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।ভবিষ্যতে অভিজিৎ বা মুক্তমনা লেখকদের কোনো বই যাতে প্রকাশ করার দুঃসাহস কেউ না করে তারই ম্যাসেজ ছিল দীপন হত্যাকান্ডে। একদিকে তারা হত্যাকান্ড চালায় আবার পর্দার অন্তরালে ক্ষমতাশীনদের সাথে তাদের গোপন সমঝোতাও চলতে থাকে। সরকারের কাছে প্রায় আশি জন লেখক ব্লগারের একটি তালিকা দেয়া হয়।এই তালিকা্র অন্তর্ভুক্ত ক’জনকে হত্যা করা হয় এবং বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়।একদিকে হত্যা অন্যদিকে গ্রেফতার আতংকে অনেক তরুণ লেখক প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেন।হলি আর্টিজানের হত্যাকান্ড জঙ্গী প্রশ্নে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় মৌলবাদীদের প্রেসক্রিপশনই সরকারের শিরোধার্য হয়ে যায়।গত বছরের বই মেলাতেই বদ্বীপ প্রকাশণীকে বন্ধ করে দেয়া ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামক গ্রন্থ সহ কয়েকটি প্রকাশণা নিষিদ্ধ করে দেয়া সহ এর স্বত্বাধিকারী লেখক প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকারের এই নতজানু নীতি পরিষ্কার হয়ে যায়।এখানে অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষণীয় অনলাইন এক্টিভিষ্টদের লেখালেখি বিষয়ে সরকারকে বাস্তবজ্ঞান দিয়েছিলেন বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান আর শামসুজ্জোহা মাণিকের বদ্বীপ প্রকাশণী বিষয়ে বাংলা একাডেমীকে অবহিত করেছিলেন আরেক বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবী ডঃ তুহীন মালিক। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয় জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরাই যেন আওয়ামী সরকারের প্রকাশণা বিষয়ক অবৈতনিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।শিখন্ডী মহা পরিচালক শামসুজ্জামান খানের বড় সাফল্য ছিল বদ্বীপ প্রকাশণীর ‘ইসলাম বিতর্ক’ বইয়ের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল লেখক হিসেবে পরিচিত জাফর ইকবালের কাছ থেকে একটি অশ্লীলতার সার্টিফিকেট জোগাড় করা।জাফর ইকবাল সতীর্থ এবং অগ্রজ এই লেখকের গ্রেফতারের প্রতিবাদ না করে তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার সার্টিফিকেট দিয়ে চাপাতি থেকে নিজের দুরত্ব যতটুকু বাড়িয়েছেন মুক্তবুদ্ধি মুক্তচিন্তার জগত থেকেও সে দুরত্ব তিনি আরো কয়েকগুণ বেশী বাড়িয়েছেন।
পাঁচ
জামাত এবং কতিপয় উন্মাদ জঙ্গী ছাড়া মৌলবাদীরা এখন স্মরণাতীত কালের সবচেয়ে অনুকূল সময় উপভোগ করছে।তাদের স্বপ্নের পাকিস্তান আমলেও তারা এরকম মধুচন্দ্রিমা ক্ষণ উপভোগ করতে পারেনি।রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে পুলিশ প্রধান এখন সমান তালে তাদের তোয়াজ করে যাচ্ছেন।তাদের আয় হুহু করে বাড়ছে।তাদের নটের গুরুদের ভিক্ষাবৃত্তির অপবাদ ঘুচেছে।এখন তারা হেলিকপ্টার করে বয়ান দিতে যান।তাদের কথায় সিলেবাস রচনা করা হয়।তাদের অঙ্গুলী নির্দেশে বইমেলা নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ।তাদের প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবীরা সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ আর আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীরা রাজতোষণ আর উঞ্ছবৃত্তিতে গলদঘর্ম।মৌলবাদের এই সুবর্ণ সময়ে মুক্তবুদ্ধি মুক্তচিন্তা মাথায় অলিখিত মৃত্যু বা গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে ছুটছে বিশ্ব মানচিত্রের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।আহা কি মধুরেণ সময় এখন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মৌলবাদের এই অশুভ ছায়া দিনে দিনে গাঢ় আর প্রলম্বিতই হবে।কেননা যে দলটির নাম দেশের স্বাধীনতার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সে দলটি স্বাধীনতার সকল স্বপ্ন প্রতিপক্ষের দাবীর কাছে সমর্পন করলেও দিনশেষে মোল্লাদের ভোট তাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে।আওয়ামীলীগ মাথায় যতই টুপি আর হিজাব চাপাক গৃহপালিত বামদের দিয়ে মক্কায় যতই শয়তানের প্রতিকৃতিতে ঢিল ছুড়ার প্রেক্টিস করাক মৌলবাদীদের একটি ভোটও ভুল করে নৌকার সওয়ারী হবে এটা অলীক প্রত্যাশা মাত্র।সুতরাং মুক্তচিন্তা মুক্তবুদ্ধির জন্য সামনে আরো কঠিন সময় অপেক্ষা করছে সেটা আওয়ামীলীগ কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকলেও যেমন সত্য আবার নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা হারালেও আরো ভয়াবহতম সত্য হিসেবেই প্রকাশিত হবে।অমীমাংসিত অন্ধকার থেকে মীমাংসিত অন্ধকারের দিকে যাত্রা হলো শুরু।
এসব কথা ব্লগে লিখে লাভ নেই। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ দেখবে না। এর চেয়ে ইউ টিউবে video বানিয়ে ছেড়ে দিন। হাজার হাজার মানুষের চোখে পড়বে। প্রধাণমন্ত্রীও দেখতে পারে। আর জীবনের ভয় থাকলে চেহারা ঝাপসা করে দিয়ে কথা বলুন। ব্যাস, হয়ে গেল। জঙ্গিরা আপনার চেহারাও দেখল না, অথচ আপনার বক্তব্য সহস্র মানুুষের কাছে পৌঁছে গেল। আইডিয়াটা ভাল নয় ?
আইডিয়াটি নিঃসন্দেহে ভাল।সবাইকে দিয়ে কি সব কাজ হয়? আপনিতো দেখছি কলা কৌশল সবই জানেন কীভাবে আড়াল থেকে ঢিল ছুঁড়ে কাজ সারতে হয়। তা আপনি করছেন না কেন? অন্যকে উপদেশ না দিয়ে নিজের জায়গা থেকে নিজের কাজটি করে ফেলাই ভাল নয় কি? মুক্তমনা লেখালেখির একটি উন্মুক্ত ফ্লাটফরম এখানে যারা প্রবেশ করেন তারা আসেন হয় লিখতে না হয় পড়তে ভিডিও দেখতে নয়।
অন্ধকারেই সূর্য হাসে।আতংকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।যুগে যুগেই আততায়ীর ঘাতক চাপাতি যুক্তি বিজ্ঞান আর মুক্তবুদ্ধির পিঠে আঘাত করেছে তা বলে কি মানুষের অগ্রগতি থেকে গেছে ?মানুষের মাথায় মগজ আছে বলে তার চর্চাও অব্যাহত থাকবে।দিনশেষে জয় হবে মানবতারই এজন্য হয়তো অসংখ্য মুক্তমনার বুকের রক্ত ঝরবে।মানবতার বৃহৎ স্বার্থে আত্মবলিদান হয়তো প্রাণময় জীবনের পরিসমাপ্তি কিন্তু মানুষ হিসেবে তার অমরত্ব প্রাপ্তিও।
আপনার লেখাটি যথেষ্ট পরিশীলীত ও বিশ্লেষণ মুলক।সামনের দিনগুলির কথা ভাবতে কিছুটা আতংকিতই হই।মুক্তমনা লেখকদের যারা ইতোমধ্যে দেশান্তরিত হয়ে গেছেন তারা হয়তো নিরাপদেই থাকবেন কিন্তু এরাতো হাতে গোনা ক’জন মাত্র।যে বিশাল সংখ্যক ভিন্নমতাদর্শী তরুণ দেশে আছেন তাদের কী হবে?মুক্তমনাদের অনাগত আগামী অন্ধকারকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে তা এখনই ভেবে নেয়া প্রয়োজন।আমরা চাইনা অভিজিৎ রায়ের মতো অসীম সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকেরা আবারও ঘাতক চাপাতির মুখোমুখী হন।
আমার মনে হয় না ,এদেশের নেতা মন্ত্রীরা শিক্ষার আদৌ কোন গুরুত্ব অনুভব করে ।আর না করাটাই তো স্বাভাবিক ।জনগণের অসচেতনতার ফসল এরা ।আর সচেতনভাবে তারা ভাববে তা আশা করা মোটেও ঠিক নয় ।আপনার বিশ্লেষণ খুব ভালো লাগল ।কিন্তু কি ভাবে উত্তরণ ঘটবে এই অবস্হা থেকে তা খুব দ্রুত ভাবতে হবে ।যে শিক্ষা তা তো ক্ষমতালোভীদের করায়াত্ত্বে এখনো ।
আমাদের চোখের সামনে দিয়েই দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে।আমাদের আগামী প্রজন্মের মগজে খাবলা বসিয়ে দিচ্ছে ধর্মের ধ্বজাধারী শকুনেরা।আমাদের মতপ্রকাশের সকল মাধ্যমে এখন প্রকাশ্যেই এদের থাবা চেপে বসতে শুরু করেছে অথচ আমরা প্রতিবাদ করতে পারছিনা।এই প্রতিবাদহীনতাই ওদের বিজয়।এ থেকে উত্তরনের একমাত্র পথ সমস্বরে প্রতিবাদ করা।ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া তাদের ক্ষমতার স্বার্থে জাতিকে বোধ বুদ্ধিহীন মানসিক প্রতিবন্ধীতে পরিনত করার কোনো অধিকার তাদের নেই। মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
বাংলাদেশের সমাজ থেকে রক্ষণশীলতার গাছ উপড়ে ফেলা এত সহজ নয় কারণ এ দেশে এখনো আছে সালাম প্রদানকারী, খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বলা, প্রতি শুক্রবারে এবং ঈদের নামাজ পড়া মধ্যমপন্থী মুসলমান, এদের কারণেই বাংলার সমাজে আজো টিকে আছে মোহাম্মাদের তৈরি করা সেই সপ্তম শতাব্দীর ধর্ম।