লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ

স্টকহোম সিন্ড্রোম বলতে এমন কতগুলো মানবিক আচরণকে বোঝায় যা একজন ব্যক্তির মাঝে বন্দী অথবা জিম্মি অবস্থায় লক্ষ্য করা যায়। এটি একটি মানসিক অবস্থা যার মধ্য দিয়ে একজন বন্দী ও তাকে বন্দীকারীর মাঝে একটি সহানুভূতিশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্টকহোম সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে দুজন মানুষের মাঝে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে ওঠে যেখানে একজন সাময়িকভাবে অন্যজনকে হয়রানি, প্রহার, হুমকি, কটুক্তি অথবা ভয় প্রদর্শন করে। FBI এর Hostage Barricade Database System অনুযায়ী, “বন্দী দশা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষের আট শতাংশ স্টকহোম সিন্ড্রোমে ভোগে।” “স্টকহোম সিন্ড্রোম” কথাটি ১৯৭৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে ঘটে যাওয়া একটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবির্ভুত হয়।

স্টকহোম সিন্ড্রোমকে সর্বপ্রথম চিহ্নিত করেন সুইডিশ মনোস্তত্ববিদ ও অপরাধ বিজ্ঞানী নিলস বেজেরট। FBI ও Scotland Yard এর জন্য স্টকহোম সিন্ড্রোমের সংজ্ঞা দেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. ফ্র্যাঙ্ক অকবার্গ। তার মতে, “স্টকহোম সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে ভয়ংকর কিছু আকস্মিকভাবে প্রত্যক্ষ করে। মৃত্যু তাদের সন্নিকটে জেনে তারা ভীত হতে থাকে। পরবর্তীতে তারা এক ধরণের শিশুসুলভ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যেখানে শিশুদের মতোই অনুমতি ছাড়া তাদের পক্ষে আহার গ্রহণ, কথা বলা অথবা টয়লেট ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসময়ে সামান্য দয়াপূর্বক আচারণ (যেমন- খাবার এনে দেয়া) তাদের কাছে জীবন দানের আদি কৃতজ্ঞতা হিসেবে গৃহীত হয়। এক্ষেত্রে বন্দী ব্যক্তি তার বন্দীকারীর প্রতি ইতিবাচক ধারণায় আবর্তীত হয় এবং তার অবস্থার জন্য সে বন্দীকারীকে দোষারোপ করতে অস্বীকৃতি জানায়।”

১৯৭৩ সালের ২৩শে আগস্ট স্টকহোমে ৩২ বছর বয়সী পলাতক অপরাধী জ্যান এরিক ওলসন সুইডেনের অন্যতম বৃহত্ ব্যাংক “ক্রেডিটব্যানকেন” এ ডাকাতি করার জন্য সেখানকার চারজন (তিনজন নারী ও একজন পুরুষ) কর্মকর্তাকে ব্যাংকের ভল্টে ছয় দিন জিম্মি করে রাখে। ব্যাংকের এ ঘটনায় ওলসনের একজন সাবেক জেল সঙ্গীও যোগ দিয়েছিল। এসময় ওলসন তাদের গলায় দড়ি পড়িয়ে দেয় এবং ডিনামাইট দিয়ে তাদের ভয় দেখায়।


জ্যান এরিক ওলসন কর্তৃক বন্দীকৃত ব্যাংক কর্মকর্তারা

বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তির পর তাদের একজন জানায় যে ওলসন তাকে গলায় দড়ি পড়ে ব্যাংকের ভেতর হাটার অনুমতি দেয় যা তার কাছে খুবই দয়ালু একটি আচরণ বলে মনে হয়। আরেকজন বলেন যে ওলসন তাদের সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করেছিল যা তাদের কাছে সঙ্কটে ঈশ্বরের মতোই প্রতিয়মান হয়েছিল। মুক্তির পর ঐ কর্মকর্তাদের সবাই ওলসনের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ভল্টে বন্দী থাকা ক্রিস্টিন এহনমার্কের সাথে ওলসনের বিয়ে হয়েছে। ব্যাংক ডাকাতি চলাকালীন ভল্টের ভিতর থেকে সুইডেনের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ওলোফ পালমের সাথে ফোনে কথা বলার সময় এহনমার্ক অপরাধীদের সাথে চলে যাওয়ার অনুমতি চান।


জ্যান এরিক ওলসনকে গ্যাস মাস্ক পরিহিত পুলিশেরা আটক করে নিয়ে যাচ্ছে

এহনমার্ক পালমকে আরো বলেন,”আমার মনে হয় আপনি ওখানে বসে আমাদের জীবনের সাথে জুয়া খেলছেন। আমি ক্লার্ক ও ডাকাতটিকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আমি অস্থির নই। তারা আমাদের কিছুই করেননি। অন্যদিকে তারা আমাদের সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ওলোফ, আমি ভয় পাচ্ছি যে পুলিশ আক্রমণ করে আমাদের মৃত্যু ডেকে আনবে।” ২০০৯ সালে দেয়া সুইডেনের একটি রেডিও ইন্টারভিউতে ক্রিস্টিন এহনমার্ক বলেন,”এটি হলো এমন একটি অবস্থা যার মধ্যে একজন মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা দ্রুত পরিবর্তিত হয়।”

মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল ল্যাং এই ঘটনাটি ঘটার এক বছর পর এতে জড়িত সবার সাক্ষাত্কার গ্রহণ করেন। বন্দী ও বন্দীকারীদের মাঝে সম্পর্ক অনুধাবনের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ইন্টারভিউতে সেদিনের ডাকাতির মূল হোতা ওলসন স্বীকার করে যে তিনি ডাকাতি চলাকালীন সময়ে অনেক পরিবর্তিত হয়েছিলেন। ওলসন খুবই কর্কশভাবে বলে,”এটি ঐ বন্দীদেরই দোষ। আমি তাদের যা যা করতে বলেছিলাম তারা তাই করেছিলো। তারা যদি অন্যথা করতো তাহলে আমি আজ এখানে থাকতাম না। তারা কেন আমাকে আক্রমণ করে নি? তারা হত্যার কাজটিকে কঠিন করে ফেলেছিলো। তারা আমাদের নর্দমার গাধার মতো দিনের পর দিন একসাথে থাকতে বাধ্য করে। একে অপরকে জানা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।”

স্টকহোম সিন্ড্রোমের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ছিলো ১৯৭৪ সালে বিখ্যাত প্রকাশক উইলিয়াম র্যান্ডলফ হ্যারেস্টের নাতি প্যাট্রিসিয়া (প্যাটি) হ্যারেস্ট এর ঘটনা। Symbionese Liberation Army (SLA) নামক একটি নগরভিত্তিক গেরিলা গ্রুপ প্যাটিকে ১৯৭৪ সালে অপহরণ করে। SLA তাকে “তানিয়া” নাম দেয় এবং তাদের সহযোগী হিসেবে প্যাটি তার পরিবার ও পুলিশের সমালোচনা শুরু করে।


SLA এর সাথে ব্যাংক ডাকাতিতে প্যাট্রিসিয়া (প্যাটি) হ্যারেস্ট

প্যাটিকে পরবর্তীতে SLA এর সাথে মিলে স্যান ফ্রান্সিসকোর বিভিন্ন কর্পোরেট ব্যাংক ডাকাতি করতে দেখা যায়। জনসম্মুখে SLA এর প্রতি সে তার সহানুভূতির কথা স্বীকার করেছিল। গ্রেপ্তারের পর প্যাটির সাত বছরের জেল হয়। তিন বছর কারাভোগের পর যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন ওভাল অফিসে নিজের শেষ দিনে (২০শে জানুয়ারী, ২০০১) প্যাটিকে সাধারণ ক্ষমা করেন।

বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীর মতে স্টকহোম সিন্ড্রোমের আবির্ভাব নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিশ্লেষক জেনিফার ওয়াইল্ড বলেন, “এর একটি ক্লাসিক উদাহরণ হতে পারে পারিবারিক নির্যাতন যেখানে সাধারণত একজন নারী তার স্বামীর শত অত্যাচার সহ্য করেও তার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে একসাথে বসবাস করে। ক্রোধের বিপরীতে সে নারীর সহানুভূতি অনুভূত হতে পারে। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে শিশু নির্যাতন। বাবা-মা শিশুটিকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করতে পারে কিন্তু তাদের প্রতি নির্ভরশীলতার কারণে শিশুটি এ কথা স্বীকার করতে রাজি হয় না অথবা মিথ্যা বলে।“

স্টকহোম সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে প্রধান ভুমিকা পালন করে দুষ্কৃতিকারীদের ইতিবাচক আচরণ যা অপরাধীদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দরকষাকষির সুযোগ বৃদ্ধি করে। ২০০৭ সালে FBI এর Law Enforcement Bulletin অনুযায়ী স্টকহোম সিন্ড্রম জিম্মিদের জীবিত উদ্ধার করার ক্ষেত্রে ভুমিকা পালন করে।

স্টকহোম সিন্ড্রোম Terror Bonding বা Trauma Bonding নামে পরিচিত হলেও এটি Diagnostic এবং Statistical Manuel of Mental Disorder নামক মনোবিশ্লেষণ তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়।
স্টকহোম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা Post-Traumatic Stress Disorder (PSTD) এর লক্ষণগুলোর কথাই বলেন। এগুলো হলোঃ অনিদ্রা, নিয়মিত দুঃস্বপ্ন, সাধারণ বিরক্তি, মনযোগে সমস্যা, অল্পতে চমকে ওঠা, পূর্বের আনন্দঘন অভিজ্ঞতাগুলোকে পুনরায় আনন্দের সাথে উপভোগ করা, অন্যদের ওপর অত্যাধিক অবিশ্বাস ইত্যাদি। স্টকহোম সিন্ড্রোমের চিকিত্সাও তাই PSTD এর মতোই যা স্বল্প স্থায়ী লক্ষণের ক্ষেত্রে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে এবং দীর্ঘস্থায়ী লক্ষণের ক্ষেত্রে মনঃসমীক্ষণ দ্বারা সম্পাদন করা হয়।

বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠীও স্টকহোম সিন্ড্রোমের মতো অবস্থাকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করে চলেছে। এ গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়ে নিজেদের ওপর জনগণের আস্থা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। আর এর ফলে একটি দেশের নিরাপত্তাদানকারী জনবলের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা খর্ব করা সম্ভব হয়।