পুঁজিবাদের এখন বয়স হয়েছে। এই বার্ধক্যের মধ্যে সে যৌবনের ভাব করছে। এর আরো অধপতন হবে।




ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী – আমার ক্যামেরায়, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫

অধ্যাপক ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ২৩শে জুন (২০১৬) আশিতে পা দিয়েছেন। আমার সরাসরি শিক্ষক নন। তবুও আমার স্যার। সাক্ষাত পরিচয় হয় নি আমার সাথে ২০১৩-র আগে।

সেই বছরেই ফেব্রুয়ারিতে আমার লেখা ‘আমার চোখে একাত্তর’ প্রকাশিত হয়। স্যারকে পান্ডুলিপিটা পড়তে দিয়েছিলেন চার্বাকের প্রকাশক ফাহমিদা শিল্পী। স্যার শুধু পড়েনইনি, বিশাল একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। আমি তো অভিভূত। আমার কল্পনারও বাইরে ছিল আমার লেখা পান্ডুলিপিটাকে স্যার এতটা গুরুত্ব দেবেন। যাকে চেনেন না, যার সাথে কোনদিন দেখা হয় নি, লেখক হিসেবে যার কোন পরিচিতি নেই, তার লেখার এমন উচ্ছসিত প্রশংসা করবেন। মনে হলো অপরিমেয় পান্ডিত্যের অধিকারী হলেও স্যার একজন অহমিকাহীন মানুষ। এমন একজন বিশাল হৃদয়ের মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার, কথা বলার সুযোগলাভ – এমন একজন জ্ঞানী ব্যাক্তির সান্নিধ্যলাভ – আমার জন্য ছিল এক অবিস্মরণীয় বিরল অভিজ্ঞতা।

স্যারের লেখার সাথে আমার পরিচয় সেই আশির দশক থেকে। পড়তাম না বলে গোগ্রাসে গিলতাম, বলা উচিত। তখন থেকেই তিনি আমার শিক্ষক। কিভাবে চিন্তা করতে হয়, কিভাবে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে হয়, আর তা লেখায় প্রকাশ করতে হয় – আমি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে পড়তাম আর জানতে চেষ্টা করতাম।

আমাদের সৌভাগ্য একাত্তরের ঘাতকেরা তাঁকে খুঁজে পায় নি। তাঁর নাম ছিল হত্যার জন্য নির্ধারিতদের লিস্টে।


হত্যার জন্য নির্ধারিতদের লিস্ট

স্যারকে ধন্যবাদ জানাতে দেখা করতে গিয়েছিলাম ২০১৩-র গ্রীষ্মে। এবং আবারো ২০১৫-র ফেব্রুয়ারিতে। সেবারে তাঁর সাথে আলাপচারিতা রেকর্ড করেছিলাম। সাথে ছিলেন তাঁর সম্পাদিত ম্যাগাজিন নতুন দিগন্তে’র তরুণ কর্মী পাভেল। নিচের প্রতিবেদনটা সেই আলাপচারিতার ভিত্তিতে। একটু দেরিতে হলেও, কিছুটা খাপছাড়া হলেও নানা বিষয়ে তাঁর প্রাসঙ্গিক মন্তব্যগুলো প্রকাশ করছি।

গণজাগরণ মঞ্চ প্রসঙ্গে

আমাদের তরুণরা পুঁজিবাদ বিরোধী। মৌলবাদ বিরোধী, এরা পথ খুঁজছে। শাহবাগের কথা ধর। এদের গণজাগরণ হলো, সরকার বিরোধী, মৌলবাদ বিরোধী। সংগঠন ছিল না। আওয়ামি লিগ এদেরকে ব্যবহার করতে চাইলো ভোটের জন্য, আওয়ামি লিগ ভাবলো এদেরকে দিয়ে ভোট পাওয়া যাবে। সিপিবি ভাবলো এদের ওপরে ভর করবে। (সিপিবির আবার সবসময়ই একটা ভর করার প্রবণতা।) সিপিবির নিজস্ব সংগঠন তেমন শক্তিশালী নয়।

গণজাগরণ মঞ্চ তাই এখন দুই ভাগ হয়ে গেছে – একভাগ চলে গেছে আওয়ামি লিগের দিকে আরেক ভাগ সিপিবির দিকে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে এদের নিজেদের সংগঠন না থাকা। ইজিপ্টের যে সমস্যা আমাদেরো তাই। মানুষ অল্টারনেটিভ চাচ্ছে, পাচ্ছে না। লেফট অল্টারনেটিভ দিতে পারছেনা, তাই তারা রাইটের দিকে যাচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতায় তারা পুঁজিবাদ বিরোধী। কিন্তু তারা যাবে কোথায়?


মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতা ফিরে পাওয়া প্রসঙ্গে

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপরে মানুষের আস্থা নেই। গত তেতাল্লিস বছরে মানুষ এদের কাছ থেকে কিছু পায় নি। এরা দূর্নীতির সাথে যুক্ত, লুন্ঠনের সাথে যুক্ত। এরা যতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে – ততই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দূর্বল হচ্ছে আমাদের দেশে।

স্বাধীনতার পরে সব সরকারই ফ্যাসিস্ট ছিল। কম আর বেশি। এখনতো সবচেয়ে বেশি। কণ্ঠরোধ করছে, মত প্রকাশের কোন সুযোগ রাখছে না। কিন্তু প্রযুক্তির মাধ্যমে মত মানুষ প্রকাশ করে যাচ্ছে, ব্যাঙ্গোক্তি করছে। এই যোগাযোগটাতো হচ্ছে। প্রযুক্তি এখানে আনুকূল্য দিচ্ছে। কিন্তু অসুবিধাটা হচ্ছে, আমরা যাকে সাবজেক্টিভ ইলেমেন্ট বলি, সেই সাংগঠনিক অবস্থাটা নেই। আমরা সেই সংগঠনটা গড়ে তুলতে পারি নি।

বামপন্থীরা যে সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, এটা জনগণের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা এটাই তারা বুঝতে পারছে না।

উপমহাদেশের বামপন্থি আন্দোলন প্রসঙ্গে

এদেশে বাম আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অসুবিধা করেছে কম্যুনিস্ট পার্টি। বিপ্লব করতে পারে নাই, কেন পারে নাই। তারা বিভ্রান্ত ছিল। দুটো বিরাট বিভ্রান্তি তাদের ছিল। প্রথমত, তারা কৃষককে বুঝতে পারে নাই। একবারে বই পড়ে অস্পষ্ট বিভ্রান্ত ধারনা নিয়ে তারা বিপ্লব করতে নেমেছিল।

দ্বিতীয়ত, পরনির্ভরতা। মধ্যবিত্ত ভীষনরকমের পরনির্ভর। তাই বিরাট একটা সুযোগ বা বিপর্যয় (সুযোগও হতে পারতো, বিপর্যয়ও হতে পারতো) এর সম্ভাবনা থাকা সত্বেও বিশ্বযুদ্ধ্বের সময় – ১৯৪২-তে সুভাষ বসু এবং গান্ধীর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের সময় বিরাট একটা সুযোগ কম্যুনিস্টদের ছিল। তখনই তারা মস্তবড় ভুলটা করলো।

ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি কখনো বিপ্লব করবে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে, এই স্বপ্ন দেখে নাই। ক্রিটিকাল মুহূর্তে, ভারত ভাগ হচ্ছে, তখন তাদের কোন ভূমিকা নাই। তাত্বিক ভাবে তারা বুঝেছিল, যে এই উপমহাদেশে সতেরটি জাতি আছে। কিন্তু এই উপলদ্ধিকে তারা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে নাই।

জাসদ এবং তখনকার রাজনীতি প্রসঙ্গে

জাসদ ছিল শেখ মুজিবের ওপরে নির্ভরশীল, তাই শেখ মুজিবের মৃত্যুর সাথে সাথে জাসদের রাজনীতিও শেষ হয়ে যায়। জাসদ কি? জাসদ মুজিব বাহিনীরই একটা উত্তরাধিকারী, অনুসারী একটা অংশ। মনে রাখা দরকার, মুজিব বাহিনী কেন গঠন করা হয়েছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নয়, মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল বামপন্থীদের দমন করার জন্য। ‘র’ই ওটা করেছিল, ঐ উদ্দেশ্যেই। ওরা কোথায়ও যুদ্ধ করে নি। ওরা হত্যা করেছে, হত্যা করেছে বামপন্থীদের। বামপন্থী নিধনের প্রস্তুতি তারা নেয় একটা আতঙ্ক থেকে, একটা আশঙ্কা থেকে। তা হলো, শেখ মুজিব নাও ফিরতে পারেন। যদি না ফেরেন, বা যদি বিলম্বে ফেরেন, তাহলে কি হবে। তা হলে নেতৃত্ব চলে যাবে বামের হাতে।

মুজিব বাহিনী বামপন্থীদের নিধনের জন্য মুক্তিবাহিনীর বিকল্প।

ঐতিহাসিকভাবে তাকালে দেখতে পাই পঁচিশে মার্চের রাতে আমাদের দেশে বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতা, তার দেউলিয়াত্বের উন্মোচন ঘটে তখন। তার পর থেকে তারা আর নেতৃত্বে নেই। তারা একটা কর্তৃত্বের মধ্যে আছে। কর্তৃত্বের তিনটে কারণ আমি দেখতে পাই। একটা হচ্ছে, ইন্ডিয়ান সাপোর্ট, দ্বিতীয় হচ্ছে বামপন্থীদের কার্যকর অনুপস্থিতি, আর তৃতীয় হচ্ছে, আওয়ামি লিগ একটা সংগঠিত শক্তি, তার লোকজন আছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মুজিব বাহিনী দেশে এসে দুই ভাগ হলো, একটা সিরাজুল আলম খানের আরেকটা শেখ মনির নেতৃত্বে। সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবের কাছে যেতে পারছেন না, বা শেখ মুজিব তাকে সে ভাবে মূল্য দিচ্ছেন না। তার ইচ্ছে তিনি পার্টির সেক্রেটারি হবেন। যখন তা পারছেন না, তখন শক্তি দেখানোর জন্য, জাসদ সংগঠন করেন। দাম বাড়ানোর জন্য। কিন্তু শেখ ডাকলেই তিনি চলে যাবেন, শেখের ডাকের জন্য অপেক্ষা করছেন। মুজিব বাহিনী কিন্তু দুটোই। সিরাজুল আলম খান কোন স্লোগান পাচ্ছেন না খুঁজে। মুজিববাদতো মনিরা নিয়ে নিয়েছে। অন্য কোন স্লোগান নেই। তখন যা আমরা কোনদিন এদের কাছ থেকে শুনিনাই, সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান শুনলাম। শুধু সমাজতন্ত্র নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। ছাত্রলীগের ছেলেরা বলছে। এই স্লোগান দিয়ে তারা শক্তি সঞ্চয় করছে।

এই ডাকটা আসার কথা ছিল সিপিবির কাছ থেকে। আসে নি।

ডাকসু নির্বাচনের কথা ধরো। বাহাত্তরে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমরা জিতলো। তিয়াত্তরে তারা আর দাঁড়াতে পারছে না। সেলিমের জ্য় আর পরাজয় দিয়ে তখনকার বাংলাদেশের রাজনীতিকে বেশ ভালো বোঝা যায়। তিয়াত্তরে সেলিমরা মুজিববাদীদের সাথে যৌথ নির্বাচনে যায়। কিন্তু তারা ছাত্রদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। ব্যালট ছিনতাই করে জাসদসমর্থিত ছাত্রলীগের জ্য় ঠেকানোর প্রচেষ্টা তারা (মুজিববাদী আর ছাত্র ইউনিয়ন) চালায়। আজ এত বছর পরে সেলিম সেদিন (ঈদ সংখ্যা সাপ্তাহিক, ২০১৪) স্বীকার করলো, মুজিববাদীরাই ব্যালট ছিনতাই করেছিল তিয়াত্তরে, জাসদ ছাত্রলীগ নয়। তখন সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবী করেছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের ছেলেরা ব্যলট ছিনতাই করে। নিজের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় বললেন এই ঘটনাটাকে সেলিম। আমরাতো চোখের সামনেই দেখেছিলাম কি ঘটেছিল।

জাসদের প্রতি যে সমর্থনটা আমরা তখন দেখেছি, তা ছিল বামের প্রতি সমর্থন। বামের আওয়াজটা তখন কে দিচ্ছে? এককালীন মুজিব বাহিনীর একটা অংশ। দুই ভাবে তখন বামপন্থীদের কোণঠাসা করা হয়েছে। মুজিব বাহিনীর লোকেরা দুইভাবে বামপন্থীদের পর্যুদস্ত করেছে। একটা প্রত্যক্ষভাবে, রক্ষীবাহিনী দিয়ে, গ্রামেগঞ্জে অত্যাচার করে, মেরে। আর এদিকে, যে তরুণরা বামপন্থী হবে তাদের নিয়ে নিচ্ছে। ঠেলে দিচ্ছে তাদের সামনে। এক্সপোজ করে দিচ্ছে। ভবিষ্যতের বামপন্থীদের, তরুণদের তুলে ধরছে যাতে রক্ষীবাহিনী এদের মারতে পারে অনায়াসে। সরাসরি, এবং অপ্রত্যক্ষভাবে, দু’ভাবেই। মুজিব বাহিনী আর জাসদ একই। ষড়যন্ত্রটা পরিষ্কার ছিল না, এখন এটা ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছে। তাই বলছিলাম, যেই মুহূর্তে শেখ মুজিব মারা গেলেন, জাসদের রাজনীতিও শেষ।

গণতন্ত্র কী? আমেরিকা ভারতেও কি গণতন্ত্র আছে? একটাকে বলা হয়, সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্র, আরেকটাকে সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্র। আসলে কি গণতন্ত্র আছে এই সব দেশে?

উত্তরটা স্থুলভাবে দেই। শর্ত কয়েকটা।

প্রথম শর্ত – সেই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক যেখানে সব মানুষের মধ্যে অধিকার এবং সুযোগ এ দু’য়ের সাম্য থাকবে। কেবল অধিকার না, বিধিবদ্ধ অধিকার না, সব মানুষ সমান হবে না। কিন্তু সুযোগ থাকবে। সে তার মেধা অনুযায়ী একটা সুযোগ পাবে।

দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে – ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রির হাতে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতে তাকে স্বৈরাচারী বানানো হয়েছে। এটাতো প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির চেয়েও খারাপ স্বৈরাচার।

উন্নত দেশগুলোতে (এবং ভারতেও) বুর্জোয়ারা একটা সমঝোতার মধ্যে এসেছে, ক্ষমতা ভাগাভাগি করার জন্য। নিজেদের স্বার্থে, ধরো আমেরিকায়, ওবামার মতো একজন লোককেও দাঁড় করিয়ে দিল। যাকে তারা ঘৃণা করে। ভড়ং (ধরন) টা আছে এই জন্য যে তা নইলে সাজসজ্জাটা ভেঙ্গে পড়বে।

ভারতে কি হচ্ছে? (ভারতের দিল্লিতে আম আদমির উত্থান প্রসঙ্গে।)

ইতিবাচক কিছুই নেই। বরং নেতিবাচকই বলা যায়। কেন?
ওর (কেজরিওয়ালের) কোন পরিকল্পনাই নেই। পানি দেবে, বিদ্যুৎ দেবে – এই সমস্ত আওয়াজ দিয়ে সে জিতে গেছে। এই চাহিদাগুলোও মেটানোর ক্ষমতা তার নেই। বুর্জোয়াদের সমর্থনেই, তাদের পাব্লিসিটি অর্গানের সাপোর্টেই সে জিতেছে। সমর্থন না দিলে পাছে এই ব্যাবস্থাটা ভেঙ্গে পড়ে। পাছে বামপন্থীরা এসে পড়ে। আতঙ্ক বামপন্থীদের নিয়ে।

আমি যদি পেছনে তাকিয়ে দেখি। ঐতিহাসিক ভাবে এখানে (স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে) কম্যুনিস্ট পার্টি কত দূর্বল ছিল, তবুও বৃটিশ, এবং লিগ (মুসলিম লিগ তো বটেই), কংগ্রেস সকলেই কিন্তু লাল-আতঙ্কে ভুগতো। ওরা এসে পড়বে, এই ভয়ে একে অপরের সাথ কম্প্রোমাইজ করে ফেলতো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও দেখেছি, যুদ্ধটাকে (মুক্তিযুদ্ধ) তাড়াতাড়ি শেষ করার একটা তাগিদ সবার মধ্যেই (আওয়ামি লিগ, ভারত এবং আমেরিকা) কাজ করেছে – যাতে কর্তৃত্বটা কম্যুনিস্টদের হাতে চলে না যায়।

ভারততো ভীষণভাবে আতঙ্কিত ছিল। দুইদেশের নক্সালরা যদি এক হয় তাহলে তো শেষ। আমেরিকা ভাবছে, এটাতো বিপজ্জনক জায়গা। যেভাবেই পারা যায় তাড়াতাড়ি থামাতে হবে।

আইএস প্রসঙ্গে

আইএস – এর উত্থান গ্লোবাল। এই দৃষ্টিকোণটা অরথডক্স। কিন্তু এভাবেই এটাকে দেখতে হবে। ক্রাইসিসটা পূঁজিবাদের। পুঁজিবাদ মানুষের সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না।

ইজিপ্টে কি হলো দেখো। ইজিপ্টের গণঅভ্যুত্থানকে ধারণ করার মতো কোন বাম গণতান্ত্রিক শক্তি বা সংগঠন ছিল না। তাতে কি হলো নেতৃত্ব চলে গেল মুসলিম ব্রাদারহূডের কাছে, তার পর আর্মির কাছে। মার্কিনপন্থীদের কাছে। পুঁজিবাদীরা বিক্ষোভটাকে প্রকাশের রাস্তা দিচ্ছেনা।

বামেরা নেই। তাই ডানে চলে যাচ্ছে মানুষ। আইসিসরা পুঁজিবাদের বিপক্ষে নয়। লেফট নাই তাই রাইটে চলে যাচ্ছে। ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভটা আসছে ক্যাপিটালিজমের সমর্থকদের কাছ থেকেও।

করুণ ঘটনাটা কি! যে ইরাককে তারা (সাম্রাজ্যবাদী শক্তি) সর্বশেষ করে দিল, আইএস সেখান থেকেই উঠলো। সিরিয়ার যে প্রধান শত্রু আসাদকে তারা উচ্ছেদ করবে, সেই আসাদের বিরোধীদের মধ্য থেকে আইএস উঠে এলো।

পারবেনা তো পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের চরম ব্যর্থতা আমরা দেখছি এসবের মধ্যে।


পুঁজিবাদের ‘সভ্যতা’ যদি শেষই হয়, সম্ভাবনা কি ভবিষ্যতের? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আমলাতন্ত্রের দূর্নীতির কারণে – চীনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারওতো অধপতন ঘটলো, এগুলোকে ঠেকানোর উপায় কি?

পুঁজিবাদের এখন বয়স হয়েছে। এই বার্ধক্যের মধ্যে সে যৌবনের ভাব করছে। এর আরো অধপতন হবে।
সম্ভাবনা – ঐ যে আমরা গণতন্ত্রের কথা বলছিলাম, যার সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করলাম, ঐ গণতন্ত্র আসতে হবে। সাম্যের ভিত্তিতে গণতন্ত্র, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের গণতন্ত্র।

হিস্টোরিকালি দেখতে হবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপ্লবের আগে কি অবস্থায় ছিল? বিপ্লবের পরে কি হয়েছে, কোন জায়গায় চলে গিয়েছে! প্রত্যেকটা লোক ওখানে শিক্ষিত, প্রত্যেকটা লোকের থাকার জায়গা আছে, প্রস্টিটিউশন নেই, সমাজের যে ডিজিজগুলো ছিল, সেই ডিজিজগুলো যে কি ভাবে দূর করলো, কোথায় নিয়ে গেল একটা অধপতিত দেশকে। ওই দেশের বুর্জোয়ারা ফরাসী ভাষায় কথা বলতো, সেই জায়গাটাতে বিপ্লব করে কোথায় নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকটা মানুষ শিক্ষিত, প্রত্যেকটা মানুষের চাকরীর নিরাপত্তা আছে। প্রত্যেকটা মানুষের গৃহ আছে, নারীর অবাধ স্বাধীনতা আছে, যেটা কোনদিনও কল্পনা করা যেত না। সেই খানে নিয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু ওর পরে যে বিকাশটা হওয়ার কথা ছিল, সেটা হতে দেয়া হয় নি। কারা হতে দেয় নি? পুঁজিবাদীরা। প্রথম থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, এবং তাকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিয়ে এসেছে। সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট-এর জায়গা থেকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিয়ে এসেছে – মিসাইল, চাঁদে যাওয়া এসব নিয়ে ব্যস্ত করে রেখেছে। আত্মরক্ষার জায়গায় নিয়ে গেছে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, মিডিয়া, প্রচার করতে থাকলো, ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, দেখ আমরা কত স্বাধীন। তোমরা ভাল সাবান পাও না, তোমরা ভাল জুতো পাও না। আমরা কত বিলাসী জীবন যাপন করি। এই মিডিয়া তরুণকে প্রভাবিত করলো।

আর ভেতরে ভেতরে একটা আমলাতন্ত্র গড়ে উঠছিল। আমলাতন্ত্র কিন্ত স্টালিনের সময়েও ভীষণ শক্তিশালী ছিল। এমন কি স্টালিনের হাতেও পুরো ক্ষমতা ছিল না। উনি জানতেনও না কি কি হচ্ছে। এই আমলাতন্ত্রেরই প্রতিনিধি হচ্ছে ইয়লেতসিন এবং তারও আগে গর্বাচেভ, এরা কিন্তু ঐ আমলাতন্ত্রের লোক। পার্টির লোকেরাই এই আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিল। আমার ছেলে আমার জায়গায় আসবে, এই ধরনের ব্যাবস্থা হতে থাকলো। স্বজনপ্রীতি শুরু হয়ে গেল।

এই জন্যেই কিন্তু মাওসেতুং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আওয়াজটা তুলেছিলেন। বিপ্লব করতে হবে, আবর্জনা জমে যাচ্ছে। ক্লাস ইন্টারেস্ট, ক্লাস কনসলিডেশনের আবর্জনা জমে যাচ্ছিল। সেটাকে দূর করতে হবে। কিন্ত ওটাকেতো দূর করতে দিল না।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদী বিশ্বের যে উপকার করেছে। এই যে ওয়েলফেয়ার স্টেট, এই ধারণাটা কখনোই আসতো না, যদি (সোভিয়েত ইউনিয়নে) কম্যুনিস্ট বিপ্লব না হতো। ছাড় দিচ্ছে, ছাড় দিচ্ছে খালি। আমেরিকাওতো ছাড় দিচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। আমেরিক সারা পৃথিবী থেকে লুন্ঠন করে নিজেদের নাগরিকদের দিতে পারছে। ইংল্যান্ডতো একটা সোস্যালিস্ট দেশই করে ফেলেছে – রাইটস এবং প্রিভিলেজ-এর দিক থেকে। ফ্রি চিকিতসা, শিক্ষা ফ্রি, আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট, এগুলোত তারা চালু করেছে। এগুলোতো কখনোই হতো না, যদি সোভিয়েত বিপ্লব না হতো।

যাতে বিপ্লব না হয়, সে জন্য শ্রমিক শ্রেণীকে ছাড় দিতে হচ্ছে। এই ছাড়টা কখনোই দিত না। এই জিনিষটা মানুষ বুঝতে চায় না যে সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলে ক্যাপিটালিজম-এর রূপ আরো কত কদর্য হতো। সেদিক থেকে ভাবলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্যাপিটালিজমকে এডজাস্ট করে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।

না হলে গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়েই ভেঙ্গে পড়ছিল পুঁজিবাদ।

সমাজতন্ত্র একটা ধারণা, এর নানা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, হবে। উত্তর কোরিয়, কিউবা। এটার কোন নির্দিষ্ট ছক নেই। একেক দেশ সমাজতন্ত্র একেক রূপ ধারণ করবে।

চীন কোথায় ছিল, চন্ডু খেত, ওয়ারলর্ডদের হাতে ছিল দেশটা। কোথা থেকে কোথায় এসেছে। সমাজতন্ত্রের কারণেই।
কিউবা শিক্ষা, চিকিতসা, কৃষিতে অনেক উন্নত একটা দেশ। এই অর্জনগুলোর কথা আমরা খুব একটা শুনি না। পুঁজিবাদী মিডিয়ার কারণে।

চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে

অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্ম আর ১৯৮৪, স্টালিনের সমালোচনা করছে। কিন্তু বেচারা অরওয়েল বুঝতে পারছেন না, ওটা স্টালিন না, ওটা হিটলার। ১৯৪৮-এ লেখা উপন্যাস ১৯৮৪। সেখানে উনি দেখাচ্ছন যে, বিগ ব্রাদার মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করছে, মানুষের ভাষা বদলে দিচ্ছে। মানুষকে ভয়ের মধ্যে, সন্ত্রাসের মধ্যে রাখছে। সেইটে আজকে পুঁজিবাদী বিশ্বে দেখতে পাচ্ছি – প্রাইভেসি বলে কোন জিনিষ নাই। সমস্ত ইনফর্মেশন নিয়ে নিচ্ছে, আতঙ্কের মধ্যে মানুষ, কখন কি হবে, কোন কিছুর নিশ্চয়তা নেই। মানুষের চিন্তার যে স্বাধীনতা সেটা নাই। কি চিন্তা করতে হবে তা মিডিয়া ঠিক করে দিচ্ছে।

অরওয়েলের নাইটমেয়ারটা আসলে পুঁজিবাদী নাইটমেয়ার। ও বেচারা ভুল করে ওটাকে কম্যুনিস্ট নাইটমেয়ার মনে করেছিলেন।
পুঁজিবাদই যে ওই নাইটমেয়ারের জন্মদাতা সেটি উনি দেখতে পান নি।

আমার সাম্প্রতিক একটা লেখার প্রসঙ্গ একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার স্বাধীনতা যে নেই তা বোঝাতে আমি অরওয়েলকে নিয়ে এসেছি। বলতে চেয়েছি যে, ভাষার স্বাধীনতা পুঁজিবাদ দেবে না। চিন্তার স্বাধীনতা তো দেবেই না। চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে তো ভাষা বিকশিত হতে পারে না। কি চিন্তা করতে হবে তা ওরাই ঠিক করে দিচ্ছে। গোয়েবলসীয় প্রচারণা চলছে, বার বার মিথ্যা বলে বলে তাকে সত্য বানানো হচ্ছে।

রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া আপনারা, আপনি শুরু করেছেন। রূপান্তর তো চেতনার উন্নতি ছাড়া আসবে না। আপনার “নতুন দিগন্ত”, আপনার বই, এগুলোর কী ফিডব্যাক পাচ্ছেন?

আগে এইরকম ফিডব্যাক পাই নি। এখন বুঝতে পার ছি। আমি সংবাদে একটা কলাম লিখতাম, গাছপাথর নামে, চোদ্দ বছর ধরে লিখেছি। সময় বহিয়া যায়। তার যে ইম্প্যাক্ট পড়েছে তা তখন বুঝতে পারি নি। এখন শুনি অনেককে বলতে, আপনি যে লেখাগুলো তখন লিখতেন, এইযে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, এরশাদের স্বৈরাচার, সেগুলো আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। হতাশার কারণ নেই, মানুষ বিদ্রোহ করবে, ঐ কথাগুলো অন্য কেউ বলতো না। অন্য কোথায়ও পেতাম না, তখন আমরা তরুণ বয়সে ঐগুলো পড়তাম। আর কিছু পড়ার পেতাম না, সংবাদের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাদের চিন্তার ওপরে ওর প্রভাব পড়েছে।

আমার আরেকটা উপলদ্ধি, হুমায়ুন আহমেদের লেখা, জনপ্রিয় লেখা, খুব ক্ষতি করেছে আমাদের। মানুষকে তরুণদেরকে একটা আসক্তির মধ্যে নিয়ে গেছে, অনেকটা ড্রাগ আসক্তির মতো। এরা এর পরে আর সিরিয়াস চিন্তা করতে পারে না। অন্য বই পড়তে পারে না, কষ্ট লাগে, আরাম পায় না।

সহজ, ভুলিয়ে রাখা যায়, বাস্তবতা ধাক্কা দেয় না। স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়। হুমায়ুন নিজেও যে একজন ভিক্টিম ঐ ব্যাবস্থাটার, সেটা ও বোঝে নাই। জনপ্রিয় হয়েছে, টাকা উপার্জন করেছে।

এই বৈপরীত্যের মধ্যে আমাদের প্রবন্ধের বই, আমরা যে লিখতে পারছি এখনো, মানুষ যে পড়ছে, আমাদের পত্রিকা যেমন চলে যাচ্ছে, এতদিন চালাতে পারলাম, তের বছরে পড়লো। এ থেকে বোঝা যায়, আছে লোক, কিন্তু সংগঠিত হতে পারছে না।
আমাদের ব্যর্থতা, আমরা ছোট ছোট উপদলে, ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত। ক্ষমতাসীনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চিন্তা করতে পারছি না।

আমাদের বামপন্থীদের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা, বিপ্লব করতে হবে এই চিন্তাটা মাথায় ছিল না।

আমাদের বামপন্থীরা দুই ধরনের , এক গ্রুপ সুবিধাবাদী। পদলোভী। আরেক দল সন্যাসী, রামকৃষ্ণ মিশন ধরনের সন্যাসী। আত্নত্যাগ করছে, পারিবারিক জীবন নাই। কষ্টভোগ করছে, জেল খাটছে, কোন রকমের বিলাস নাই, কিন্তু বিপ্লবের কথা ভাবে না। অনেকটা সমাজ-সংস্কারকের মতো, বই পড়লো, মানুষজনের সাথে একটু আলাপ করলো, এই। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে – এই চিন্তা, এই উদ্দীপনাটা কখনোই তৈরি করতে পারে নাই আমাদের বামপন্থীরা।

সমাজ রূপান্তরের কাজ তো রাজনৈতিক কাজ। সেই কাজটা করতে হলে ঐ ধরনের সংগঠন দরকার হবে।, যারা রাষ্ট্রক্ষমতাটাকে নিজেদের হাতে নিতে চাইবে – সমাজ রূপান্তরের জন্য। রাষ্ট্রক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নাই।

আপনি বলে থাকেন আপনি আশাবাদী। আপনার আশাবাদের ভিত্তিটা কোথায়?

আশাবাদের ভিত্তি – প্রথমত, এদেশের মানুষ কখনো মৌলবাদী হবে না। মৌলবাদীরা নির্বাচনে দাঁড়ালে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয় (হাতে গোনা দু’একটা বাদে)। মানুষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌলানা-মৌলবীদের ভালো মানুষ মনে করলেও রাষ্ট্র-পরিচালনার দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিতে রাজী নয়। অভিজ্ঞতা আমাদের এই কথা বলে।

দ্বিতীয়ত, এই বিরাট সমস্যাসঙ্কুল জনগোষ্ঠিকে শান্ত রাখা পুঁজিবাদের পক্ষে সম্ভব না। পুঁজিবাদী ব্যাবস্থা এখানে কার্যকর হবে না। পুঁজিবাদের উন্নতির ফলে মানুষের বিক্ষোভ আরো বাড়বে। অন্যান্য দেশেতো বটেই তবে বিশেষ করে আমাদের দেশে পুঁজিবাদ যে ব্যর্থ হবে এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমাদের মতো খারাপ অবস্থাতো আর কোন দেশে নেই। পুঁজিবাদে আমাদের সমস্যার সমাধান নেই।

সাক্ষাতকার- ইরতিশাদ আহমদ
ফেব্রুয়ারি ২০১৫