আমরা, বাংলাদেশের পুরুষশাসিত সমাজের অধিবাসীরা মায়ের আবেগ সংরক্ষণে, মেয়ের অধিকার লালনে নিজেকে উজার করে দিতে পারি। বোনের বেলায় শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক লালনে ও পালনে আবেগে মথিত হই, স্ত্রীর অধিকারে একটু রেখে ঢেকে নিজেকে উন্মুখ করি কিছুটা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে আর বেশির ভাগটা ধর্মীয় প্রথার সমর্থনে। আর মা, বোন, মেয়ে ও স্ত্রীর ছাড়া বাকী সব নারী সমাজ সভ্যতার আদি অবস্থানে থাকলেও উঃ আঃ করে নিজেকে আধুনিক হিসেবে প্রতিভাত ছাড়া কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ হাতেগোণা কয়েকজন বাঙালী পুরুষই নিয়েছেন। এ কয়েকজনের মধ্যে কি আরজ আলী মাতব্বর সাহেব পড়েন ? এরই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁর লেখায় ইতিবাচিক সাড়াই পেয়ে আসছিলাম। কিন্তু! হ্যাঁ, আজ ‘কিন্তু’ দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে।

একজন পুরুষ বিজ্ঞান মনস্ক,নাস্তিক, অলৌকিক শক্তিতে সন্দিহান,নারী অধিকারে বিশ্বাসী আর নারী মুক্তির জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ সমার্থক নয়।

আরজ আলী মাতুব্বর নারী মুক্তির জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলেই বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়। স্মরণিকা’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায় ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’ অংশে তিনি লামচারি গ্রামের শিক্ষিত লোকের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন যেখানে সাক্ষর বা স্বাক্ষর কিংবা শিক্ষিত নারীর কোন তথ্য নেই। ছেলে আর পুরুষদের তথ্য দিয়েই উপসংহার টেনেছেন যে “যদিও এ গ্রামের জনসংখ্যার অনুপাতে আলোচ্য সংখ্যাগুলো অতি নগণ্য, তথাপি আশাব্যঞ্জক এ জন্য যে, এ গ্রামের অন্তত স্থবিরতা দূর হচ্ছে।’’ এ গ্রামের নিরক্ষর — অশিক্ষিত নারী সমাজ যে জড় পদার্থের মত স্থবির হয়ে আছে তা কি তাঁর চিন্তা চেতনায় ঘা দেয়নি? এ নিয়ে তাঁর কোন আফসোস পর্যন্ত নেই! কোন প্রতিক্রিয়া নেই! বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈ কি।

১৯৮১ সালের ২৬ জানুয়ারি লামচারি গ্রামে লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রশাসনের লোক, সাংবাদিক, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক মিলিয়ে আরও সাতজনের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন যেখানে কোন নারীর নাম ছিল না। কোন নারীকে যে রাখতে পারেননি, বা পাননি বা নিমন্ত্রণ পেয়ে আসেনি এমন কোন তথ্য এখানে নেই। এর অর্থ তো কি এই দাঁড়ায় যে এমন একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে নারীর অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁর মনে কোন রেখাপাত করেনি !

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তিনি নিজ ভাষণে বলেছেন “ আজ আমার জীবন ধন্য হলো, তা দুটি কারণে। প্রথমটি হলো, জেলা প্রশাসক সাহেবের হাতে আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটির দ্বারোদঘটন দেখতে পেরে; দ্বিতীয়টি হলো আমার চিরপ্রিয় পাঠশালার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সুকোমল হস্তে সর্বপ্রথমবার বৃত্তিপ্রদান করতে পেরে।’’ এখানে একটূ খটকা আছে। যদিও বৃত্তিপ্রদান নিয়ে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীদের কথাও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আগে পিছের তথ্য পর্যালোচনায় এমন ধারণা করা কি অমূলক হবে যে ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানে তাঁর কোন উদ্যোগ বা পদক্ষেপ ছিল না? অহেতুক বা অসচেতনভাবে ছাত্রী শব্দটি যোগ হয়েছে! অথবা এটা কি জেলা প্রশাসনের নিজস্ব কোন পরিকল্পনার ফলাফল?যদিও এমন কোন তথ্য নেই।

আরজ আলী মাতুব্বর ঐ অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, “করা হচ্ছে ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক বৃত্তিদানের ব্যবস্থা” — এ বৃত্তিতে ছাত্রীদের কোন কোটা বা এ বিষয়ক কোন কথাই বলেননি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সচেতন ছিলেন যে দেশের অন্য সব ছাত্রদের সাথে ছাত্রীরাও আছে। যেমনঃ “দারিদ্র নিবন্ধন কোনো স্কুল-কলেছে গিয়ে পয়সা দিয়ে বিদ্যা কিনতে পারিনি আমি দেশের অন্যসব ছাত্র-ছাত্রীদের মতো।” অর্থাৎ অন্য এলাকার বিষয়টি এসেছে বাইরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাবে। কারণ তাঁর কচিমন শিশু ছাত্রদের সাহচর্য প্রার্থী — ছাত্রী নয়। নিজেই তাঁর ভাষণে বলেছেন, “মনের সরলতায় আমি যে আজো একজন শিশু তা কেউ বুঝবে না,বোঝবার কথাও নয়। তাই আমি স্থির করেছি যে, ছাত্ররা আমাকে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, আমি তাদের ভালোবাসবো। শৈশবকাল থেকেই আমার মনেবাসা বেঁধেছে পাঠশালাপ্রীতি ও ছাত্রপ্রীতি। ………… আর আমার সেই পাঠশালা ও ছাত্রপ্রীতির নিদর্শন হলো ’ছাত্রদের বৃত্তিদান” অর্থাৎ আরজ ফান্ড থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অনন্তকাল স্থায়ী প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক বৃত্তি প্রদান।” কিন্তু স্থায়ী ‘প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক বৃত্তি’ প্রদানে পিছিয়ে পড়া ছাত্রী সমাজের জন্য ন্যয্যতা (equity)ভিত্তিক বৃত্তি বিভাজন নিয়ে তার তেমন কোন উচ্চ বাচ্য নেই। অর্থাৎ মেয়ে শিশুর প্রতি কোন ইতিবাচক পক্ষপাতিত্ব নেই।

আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষ্য অনুযায়ী লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে,“ অনুষ্ঠানের শেষপর্বে মাননীয় জেলা প্রশাসক সাহেব আমার পরিকল্পনা মোতাবেক উত্তর লামচরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ লামচরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালইয়ের ১৯৭৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্র-ছাত্রীদের “আরজ ফান্ড’ থেকে মং ২০০.০০ টাকা বৃত্তিপ্রদান করেন। এ সময়ে উক্ত বিদ্যালয়ের ১৯৮০ সালের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেও তার ফলাফল প্রকাশিত না হওয়ায় উক্ত বৃত্তিদান স্থগিত থাকে।” আমাদের কাছেও ছাত্রী বিষয়ে, ব্যাখ্যা করে বললে নারী শিক্ষা বিষয়ে তাঁর মতামত ও তখনকার লমচরি গ্রামে নারী শিক্ষার অবস্থা ও নারীদের অবস্থান জানাও স্থগিত হয়ে যায়।

পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠানে কে কে উপস্থিত ছিলেন, দুটির পরিবর্তে একটি বিদ্যালয় বাড়িয়ে তিনটি বিদ্যালয়ের নামসহ এ বৃত্তির কথা উল্লেখ করলেও কে কে বৃত্তি পেল বা এতে ছাত্রী কয়জন ছিল তা অজানাই থেকে যায়। শুধু উল্লেখ আছে,“মাননীয় সভাপতি সাহেব স্বহস্থে ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তিপ্রদান করেন।” বিষয়টি ব্যাকরণের বিভিন্ন কারক ও বিভক্তির উদাহরণ হয়েই থাকলো।
আরজ আলী মাতুব্বরের সমাজ চিন্তা, বিভিন্ন দিকে তাঁর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তিনি একজন শ্রদ্ধার্ঘ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর মননে নারী উন্নয়ন তেমন নাড়া দেয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁর পাঠাভ্যাসে নারী বিষয়টি স্থান পায়নি বলেই হয়তো এ ফাঁক। আর পাঠাভ্যাসে নারী বিষয়টির শুন্যতার কারণ তাঁর পরিচিত বলয়, যেমন যাদের নামে বই আনতেন লাইব্রেরী থেকে তারা। তিনি সে বলয়কে অতিক্রম করতে পারেননি বা করার তাগিদও অনুভব করেননি।অর্থাৎ তাগিদ অনুভব করার মতো পরিমন্ডলে তাঁর অবস্থান ছিল না।
(চলবে)