লেখকঃ শিফা সালেহীন শুভ, ব্লগার, ফ্রীলেন্স গবেষক, অনলাইন এক্টিভিস্ট
শিশুর যৌন-শিক্ষা বা সেক্স এডুকেশন নিয়ে আমরা খুবই অনুৎসাহী। শিশুকে সঠিক বয়সে সঠিক যৌন শিক্ষা না দিলে যে তারা নানবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয় এমনকি যৌন নিগ্রহের স্বীকার হয় তা অভিবাবকদের বোঝা উচিত এবং এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার আপনি এখন আপনার শিশুকে যা জানাতে সংকোচ বোধ করছেন একদিন তা সে অন্যের কাছ থেকে জানবে, তার মধ্যে থাকবে ভুল, ভ্রান্তি, অভিনয়, কুসংস্কার এবং মিথ্যাও, অনেক সময় জানতে জানতে অনেক বেশী দেরী হয়ে যাবে, তাই আপনার উচিত নিজ দায়িত্বে সঠিক কাজটি, সঠিক উপায়ে, সঠিক সময়ে নিঃসঙ্কোচে করা। শিশুকে কখন, কিভাবে, কি যৌন শিক্ষা দেবেন তার একটা রুপরেখা বিভিন্ন গবেষণার আলোকে নীচে তুলে ধরলামঃ
যৌনশক্ষা কিঃ যৌনশিক্ষা হলো যৌন অঙ্গ, যৌন প্রজনন, যৌনাচার, প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক সম্পর্ক, প্রজনন অধিকার এবং দায়িত্বসমূহ, বিরতি এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি মানব যৌনতা সম্পর্কিত বিষয়ের নির্দেশনা। যৌন শিক্ষার জন্য প্রচলিত পন্থার মধ্যে রয়েছে, পিতা-মাতা বা অভিভাবক, বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিকতা, এবং জনস্বাস্থ্য প্রচারণা।(সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)
কোন বয়সে কি জানাবেনঃ
১-২ বছরঃ শরীরের সব অঙ্গের সঠিক নাম শেখান। যৌনাঙ্গের জন্য ছদ্মনাম একদম ই ব্যাবহার করবেন না। প্রয়োজনে মেডিকেল টার্ম ব্যাবহার করুন।
২-৫ বছরঃ এই বয়সে শিশুরা বাচ্চা কিভাবে হয় এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে, প্রশ্ন করে।আপনি এসময়য় সন্তান জন্মের সহজ ব্যাখ্যা দিন। বলুন বাবা আর মায়ের ভালোবাসায় সন্তান হয়। মায়ের ভেতরে পেটের ভেতর সন্তান থাকে পরে তারা ভ্যাজাইনা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
এছাড়াও দেখবেন এসময়য় তারা উলঙ্গ থাকার সময় অথবা ডায়পার পরিবর্তনের সময়, গোসল করানোর সময় তাদের নিজেদের যৌনাঙ্গে হাত হিচ্ছে, অন্য শিশুর যৌনাঙ্গে হাত দিয়ে পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করছে। তাদের ধমক দেবেন না এতে নিজের শরীরের প্রতি বিরূপ ধারনা জন্মায়। একান্তে আলোচনা করুন, শরীর তাদের ব্যাক্তিগত সম্পদ এটা বোঝান, শরীরের কিছু কিছু স্থান একান্তই ব্যাক্তিগত, এসব অন্যদের সামনে দেখাতে হয় না এটা বোঝান, নিজের ব্যাক্তিগত স্থানে হাত দেয়া অন্যায় বা লজ্জাজনক নয় তবে অন্যের সামনে করা অশোভন এটা বোঝান। অন্য কেউ এমন কি পরিবারের কারও কোন অধিকার নেই তার ব্যাক্তিগত স্থানে হাত দেয়ার এটা জোর দিয়ে বলুন এবং কেউ এমন করতে চাইলে তা যেন অবশ্যই আপনাকে জানায় এটা বলবেন। ভাল এবং খারাপ স্পর্শের, আদরের পার্থক্য বোঝান।
৫-৮ বছরঃ এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারী-পুরুষের সমাজে সমান অধিকার সেটা বোঝান।এসময়য় পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের ভেতরে খোলামেলা আচরণ পরিহার করুন যেমন শিশুর সামনে পোশাক পরিবর্তন, প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের মাধ্যম ইত্যাদি। শিশুরা এসময়য় উদ্ভট প্রশ্ন করে আপনাকে অপ্রস্তুত করে ফেলতে পারে কিন্তু তাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন, প্রয়োজনে একান্ত বৈঠকে।
শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে ধারনা দিন। হরমোনের ধারনা দিন। নারীপুরুষের শরীর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বেড়ে উঠে এই ধারনা দিন। নারী-নারী, পুরুষ-পুরুষ এবং নারী-পুরুষ এইসব বিন্যাসেও সম্পর্ক গড়ে উঠে এই ধারনা দিন। বয়ঃসন্ধির লক্ষন গুলো বলুন এবং শারীরিক পরিবর্তন কে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়, কিভাবে প্রস্তুত হতে হয় সেই ধারনা দিন।
যৌন-মিলন কি, মাস্টারবেশন কি এসব প্রশ্ন করলে সঠিক জবাব দিন তবে সহজ ভাষায়, যেমন পুরুষের পেনিস নারীর ভ্যাজাইনায় দিয়ে যৌনমিলন হয়, প্রয়োজনে শিশু বান্ধব গ্রাফিক ব্যাবহার করুন। যৌন মিলনের ফলে কি হয় এবং নির্দিষ্ট বয়সের আগে কেন তা করা উচিত না বলুন। ভালবাসার ধারনা দিন। এই বয়সের জন্য এই সব শিক্ষাকে যদি আপনার বাড়াবাড়ি মনে হয় তাহলে নীচের বিষয়গুলো মাথায় রাখুনঃ
১। এসময় বয়ঃসন্ধির সময় ঘনিয়ে আসে।
২। আমাদের মত দেশে প্রচুর পরিমাণে মেয়ে বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়
৩। শিশু নিগ্রহকারীরা এই বয়সের ছেলেয়েদের বেছে নেয়। বাচ্চারা আগে থেকে ব্যাপারটা না বুঝলে কেউ নিগ্রহের সম্ভাবনা তৈরি করছে সেই ব্যাপারটা বুঝতেই পারবে না, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে পারবে না
৪। এই বয়সের বাচ্চারা যৌন প্রক্রিয়া বা মাস্টারবেশন সম্পর্কে অনাকাঙ্খিত প্রশ্ন করলে উত্তর দেবেন, অন্যথা স্বাভাবিক শিক্ষাপ্রকিয়াই যথেষ্ট, তবে ৯-১৩ এই বয়সীমায় অবশ্যই যৌনতা সম্পর্কে ভালভাবে জানাতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে সচেতনতা তৈরি না করে এবং যৌনতার প্রতি চরম কৌতুহল নিবারণ না করে এই হার কামানো যাবে না।তবে যেকোন শিক্ষা দেবার সময় ই শিশুর বিকাশ এবং পরিবেশ মাথায় রাখতে হবে।
৯-১৩ বছরঃ বয়ঃসন্ধির বিস্তারিত ধারনা দিন এবং শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন ও জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে অবগত ও প্রস্তুত করুন। শিশু কিভাবে জন্মায় তার বিস্তারিত ধারনা দিন, সন্তান জন্ম দেয়া এবং প্রতিপালন কতটা কস্টসাধ্য সেটা বোঝান। নিরাপদ যৌন আচরণ এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের ধারনা দিন। যৌনবাহিত রোগ সম্পর্কে ধারনা দিন। সম্পর্কের মধ্যে পারস্পারিক সম্মানের গুরুত্ব বোঝান, লিঙ্গ বৈষম্য খুব ই অন্যায় কাজ সেটা বোঝান। মিডিয়া প্রেসেন্টেশনে যৌনতার সাথে বাস্তব যৌনতার পার্থক্য বোঝান।
১৩-১৮ বছরঃ আপনার শিশু ইতমধ্যেই সচেতন তবে সমস্যার বাইরে নয়, তার সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনুন, উত্তেজিত হবেন না, ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে বোঝান। কোন ভুল তারা করে থাকলে সহযোগিতা করুন। বাস্তব আর ফ্যান্টাসির পার্থক্য বোঝান। যৌন সম্পর্ক গোপনীয় নয় তবে একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার ব্যাপার এটা বোঝান, এর প্রচার বা রেকর্ডিং সম্পূর্ণ নিরুৎসাহিত করুন, কুফল বোঝান। নিরাপদ যৌনতা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দিন।
১৮+ বছরঃ আপনার সন্তান আর শিশু নাই, তারা পরিণত এবং আপনার দেয়া সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা প্রযুক্তিতে আপনার চেয়েও উন্নত।আপনার কোন সমস্যা হলে আপনের সন্তানের সাথে আলোচনা করতে পারেন, তারা আপনার সমস্যার সমাধানের পথ দেখাতে পারবে।
এড়িয়ে যাবেন না, সংকোচ করবেন না। আপনার শিশুকে সুন্দর জীবনের জন্য প্রস্তুত করা আপনার দায়িত্ব। হঠাত ঋতুচক্র শুরু হওয়ায় ঘাবড়ে গিয়ে স্কুলের টয়লেটে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে আপনার মেয়ে আহত হোক, অযথা লজ্জা পাক, কিংবা আপনার শিশু কারও হাতে নিগ্রহের স্বীকার হোক, বা আপনার সন্তান লিঙ্গ বৈষম্য করুক কিংবা যৌননিপীড়িত হয়ে আত্মহত্যা করুক তা নিশ্চয়ই আপনি চাইবেন না। যৌনতা কোন অপরাধ নয়, লজ্জাজনক বিষয় নয়।
(মূলভাবনাঃ Today’s Parent ম্যাগাজিনে প্রকাশিত Age-by-age guide to talking to kids about sex প্রবন্ধ, লেখকঃ Cheryl Embrett)
খুবই গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট। আমার একটা ১৩+ ছেলে ও ৭+ মেয়ে আছে। আমি নিজেও বুঝতে পারছি বিষয়টা নিয়ে ওদের সাথে খুলামেলা আলোচনা করা দরকার। কিন্তু লজ্জাবোধ ও সঙ্কোচ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। এটাও জানি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শিশুদের সামনে পোশাক পরিবর্তনে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। আমাদের সমাজ থেকে আমরা শরীর নিয়ে সংকোচ ও লজ্জা বোধ করতে শিখি। শিশুদের সামনে পোশাক পরিবর্তন করলে ওরা শিখবে, শরীর নিয়ে লজ্জা বা সংকোচের কিছু নেই।