সনটার কথা মনে পড়ছে না এখন। বেশ কয়েক বছর আগে মাদ্রাসার সাচ্চা মোসলমান ছেলেরা হুংকার ছাড়তে ছাড়তে বলেছিল, সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে, শিখা অনির্বাণ নিভিয়ে দেওয়া হবে। ওরা ভেঙেওছিল লালন সাঁইয়ের মূর্তিসহ আরো কিছু ভাস্কর্য। এ বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব?’ শিরোনামে। তিনি লিখেছেন,
” আমাদের মহানবী সঃ কাবা শরিফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বললেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে, যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা। নবীজি সঃ সেখানে হাত রখলেন এবং বললেন, ‘এই ছবিটা তোমরা নষ্ট করো না।’ কাজটি তিনি করলেন সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অসীম মমতা থেকে। মহানবী সঃ এর ইন্তেকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরিফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিল, এতে কাবা শরিফের পবিত্রতা ও শালীনতা ক্ষুণ্ন হয় নি।”
– মক্কা জয় করেই মোহাম্মদ কাবার ভেতরে অবস্থিত ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের। ওরা উৎসবের সহিত ভেঙেছিল ওসব শত বছরের পুরোনো ভাস্কর্য। মোহাম্মদ নিজেও সেই ভাস্কর্য-ভাঙ্গা যজ্ঞে অংশ নিয়েছিল। মাদার মেরির মূর্তিটি তার বিশেষ পছন্দ হয়েছিল বলে তা সে না ভাঙার কথা বলেছিল। আর এতেই আমাদের হুমায়ূন আহমেদ অভিভূত হয়ে গেলেন? শুধু একটা ছবি নষ্ট না করার জন্য মোহাম্মদ তাঁর কাছে অতিমানব বনে গেল? বাকি ৩৫৯টি মূর্তি যে মোহাম্মদের নির্দেশে ওর সাহাবারা চুরমার করে ফেললো, মোহাম্মদ নিজেও চুরমার করলো অনেকগুলি মূর্তি, সে ব্যাপারে হুমায়ূনের কোনোই সমস্যা নেই? একটা ছবি নষ্ট না করাতেই মোহাম্মদ অসীম সৌন্দর্যবোদ্ধা হয়ে গেল তাঁর কাছে? বাকি ভাস্কর্যগুলি যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, দেয়ালের সব ফ্রেসকো যে ধ্বংস করা হলো তার হিসেব কী? মেরির ছবিটি সে গণিমতের মাল হিসেবে নিয়েছিল। আর এটাই হয়ে গেল এক দস্যুসর্দার ধর্ষক খুনি লুটেরর মাহাত্ম হুমায়ূনের কাছে? সে গণিমতের মাল হিসেবে মেরির ছবিটি নিয়েছিল বলেই?
তিনি আরো লিখেছেন,
” আমরা সবাই জানি, হজরত আয়েশা রাঃ নয় বছর বয়েসে নবীজি সঃ এর সহধর্মিণী হন। তিনি পুতুল নিয়ে খেলতেন। নবীজির তাতে কোনো আপত্তি ছিল না; বরং তিনিও মজা পেতেন এবং কৌতূহল প্রদর্শন করতেন।”
– ৫৫ বছরের বুইড়া নবীর নয় বছরের শিশু বিবি আয়েশা যদি পুতুল নিয়ে না খেলতো এবং খেললেও যদি নবী তা পছন্দ না করতো তাহলে কি পৃথিবীর আর কেউ পুতুল নিয়ে খেলতে পারতো না, পৃথিবীর সকল পুতুল কি তবে ধ্বংস করে ফেলা জায়েজ হয়ে যেতো শিশু-সহবাসকারী নবীর অনুসারীদের জন্য হুমায়ূনের যুক্তিতে?
তিনি আরো লিখেছেন –
“৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হজরত ওমর রাঃ জেরুজালেম জয় করেন। প্রাণীর ছবিসহ একটি ধূপদানি তাঁর হাতে আসে। তিনি সেটি মসজিদ-ই-নববিতে ব্যবহারের জন্য আদেশ দেন।”
– কোনো দেশ বা রাজ্য জয় মানে হচ্ছে সেই জায়গার পুরুষদের হত্যা করে, নারীদের গণধর্ষণ করে, তাদের সব স্থাপনা শিল্প ইত্যাদি ধ্বংস করে জোরপূর্বক সে স্থান দখল করে নেওয়া। ওমরও তেমনিভাবেই জেরুজালেমের জনসাধারণের উপর গণহত্যা ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। একটি ধূপদানি তার পছন্দ হয়েছিল বলে সেটি সে মসজিদে নববিতে ব্যবহারের নির্দেশ করেছিল। ধূপদানিটিকে সে গণিমতের মাল হিসেবে মসজিদে ব্যবহার করেছিল। আর এতেই আমাদের হুমায়ূন আহমেদ অভিভূত হয়ে গেলেন? রাজ্য দখলকারী ডাকাতদলের সর্দার খুনী ধর্ষক ধূপদানিকে গণিমতের মাল হিসেবে ব্যবহারকারী ওমর হয়ে গেলো তাঁর কাছে শিল্পবোদ্ধা? ধূপদানিটি যদি ওমর ধ্বংস করে ফেলতো তবে কি মোসলমান কর্তৃক পৃথিবীর আর সকল শিল্প ধ্বংস করে ফেলাও জায়েজ হয়ে যেতো হুমায়ূনের যুক্তিতে?
তিনি আরো লিখেছেন,
” পারস্যের কবি শেখ সাদির মাজারের সামনেই তাঁর একটি মর্মম পাথরের ভাস্কর্য আছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা তা ভাঙে নি।’
– শেখ সাদির ভাস্কর্যটি যদি ওখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা ভেঙে ফেলতো তাহলে পৃথিবীর অন্য সকল ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা মোসলমানদের জন্য জায়েজ হয়ে যেতো হুমায়ূনের যুক্তিতে?
তিনি আরো লিখেছেন,
“ইসলামের দুজন মহান সুফিসাধক, যাঁদের বাস ছিল পারস্যে, এদের একজনের নাম জালালুদ্দিন রুমি। অন্যজন ফরিদউদ্দিন আত্তার। তাঁর মাজারের সামনেও আবক্ষ মূর্তি আছে। কঠিন ইসলামিক দেশের একটির নাম লিবিয়া। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপালিতে বিশাল একটি মসজিদ আছে। মসজিদের সামনেই গ্রিকদের তৈরি একটি মূর্তি স্বমহিমায় শোভা পাচ্ছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা মূর্তিটি ভেঙে ফেলে নি।”
– ফরিদউদ্দিনের যদি মূর্তি না বানানো হতো অথবা তার মূর্তিটি যদি সেদেশের মোসলমানেরা ভেঙে ফেলতো তাহলে কি পৃথিবীর অন্য সকল মূর্তি ভেঙে ফেলা জায়েজ হয়ে যেতো মোসলমানদের জন্য? লিবিয়ার মসজিদের সামনে যদি কোনো ভাস্কর্য না থাকতো বা সে ভাস্কর্যটি যদি সেখানকার মোসলমানেরা ভেঙে ফেলতো তাহলে কি জগতের অন্য সকল ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা জায়েজ হয়ে যেতো মোসলমানদের জন্য?
তিনি আরো লিখেছেন,
“আফগানিস্তানের তালেবানরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তি (যা ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ) ভেঙে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাঙছি সাঁইজির মূর্তি, যাঁর জীবনের সাধনাই ছিল – আল্লাহর অনুসন্ধান।”
– সাঁইজির জীবনের সাধনা যদি আল্লাহর অনুসন্ধান না হতো তাহলে কি তাঁর মূর্তি ভেঙে ফেলে দেওয়া জায়েজ হতো হুমায়ূনের যুক্তিতে? অথবা যাঁরা রূপকথার ভিলেন আল্লাহকে নাকোচ করে দিয়েছেন তাঁদের কি মূর্তি বানানো যাবে না? বানালেও তা ভেঙে ফেলা জায়েজ মোসলমাদের জন্য হুমায়ূনের যুক্তিতে?
অমুসলিমদের উপাসনালয় ভাঙা, তাদের মূর্তি ভাঙা ও তাদের হত্যা করা আজ বাংলাদেশের মোসলমানদের জন্য ইদের চেয়ে অনেক বেশি বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে ধর্ম আরো কয়েক হাজার রয়েছে, রয়েছে কয়েক হাজার ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। সব ধর্মই বাজে, সব ধর্মগ্রন্থই বাজে। তবুও মোসলমানরাই কেন বিশ্বজুড়ে এমন তাণ্ডব করছে?
হুমায়ুন আহমেদ ইতিবাচকভাবেই খোঁড়া যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন বোধহীন, যুক্তিহীন, অতিভক্তি ইতর মানবদের জন্য। যদি এমন উদাহরণে তাদের থামানো যায়!
এহ হে, এইসব কি লিখো? হুমায়ুন পূজারীরা তো মরিচ পোড়া দিয়া তোমারে ছ্যাড়াব্যাড়া ভর্তা বানায়া ফেলবো।
আপনি পোড়া মরিচের কথা বলে আমার জিভে পানি এনে দিলেন, দাদা। তো আর কি করা! যেমন অবস্থা তেমনি ব্যবস্থা নিয়ে ফেললাম। মরিচ পুড়ে ভাত খেলাম আজ।
সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের ঘটনা। ২০০৭~০৮ সালে।
ধন্যবাদ সালটা মনে করিয়ে দেবার জন্য।
২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময় যতটুকু অগ্রসর হয়েছে তার চেয়ে শতগুণ অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশি মোসলমানদের ইসলামি তাণ্ডব। ভাস্কর্য ভাঙা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ভাঙা, অমুসলিমদের হত্যাসহ নানাভাবে নির্যাতন করা ইত্যাকার ইসলামি কর্মে বাংলাদেশের মোসলমানরা এগিয়ে গেছে সাত-আসমানের উচ্চতায়।