লিখেছেনঃ সাত্যকি দত্ত

অভিজিতের জন্ম হয়েছিল কলকাতায় । জন্মের প্রথম বার যখন সে শান্তিনিকেতনে আসলো , রবীন্দ্রনাথ তাকে স্নেহভরে কোলে তুলে নিয়ে বললেন – এর নাম রইল ‘ অভিজিত ‘ ।

শান্তিনিকেতনে তখন অভিজিতই একমাত্র শিশু – সকলের কোলে কোলে সে খুব আদরে বাড়তে লাগলো । একদিন দু পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা পা ফেলে চলতেও শিখল ।এই শিশুটিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কত আগ্রহ , তার সমস্তটাই তাঁকে মুগ্ধ করে রাখে । অভিজিত যখন টলমল পায়ে ওনার দিকে এগিয়ে আসে , তিনি বলেন – এই কচি পা একদিন কত শক্ত হবে , কত দৃঢ় হবে – এর উপরেই ভর রেখে জীবন সংগ্রামে জয়ী হবে ।

অভিজিতকে রবীন্দ্রনাথ আদর করে ডাকতেন " যুবরাজ "

অভিজিতকে রবীন্দ্রনাথ আদর করে ডাকতেন ” যুবরাজ ”

জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই অভিজিত চিনেছে রবীন্দ্রনাথকে । চলতে যখন শেখেনি , তখন থেকেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে চোখমুখ ধুয়ে মায়ের কোলে চড়ে বাইরে এসে যার মুখ আগে দেখত সে , তিনি রবীন্দ্রনাথ । তখন থেকেই তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল – ভোরে উঠে সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের কাছে আসা । মাঝে মাঝে যখন রবীন্দ্রনাথ থাকতেন না , সেই রবি হারা সকাল গুলিতে এই শিশুটি দু চোখ অশ্রুতে ভাসিয়ে প্রকৃতির আর সকল দৃশ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করত ।

একটু ভালো করে চলতে শেখার পর , সে একাই যখন তখন চলে আসত রবীন্দ্রনাথের কাছে – কোনোদিন তো বিছানা থেকে নেমেই ছুট দিত সে দিকে । তখন ওর মা তাড়াতাড়ি ছুটে পাকড়াও করে বাসিমুখ ধুয়ে জামাকাপর পরিয়ে নিজেই কোলে করে দিয়ে আসত রবীন্দ্রনাথের কাছে । অভিজত রবীন্দ্রনাথের এসে দাঁড়ালেই , রবীন্দ্রনাথ লেখার টেবিলের উপরে রাখা কাঁচের বৈয়াম থেকে তিনটি লজেন্স দিত ওর হাতে ; এই ভাবে অভিজিতের দিন শুরু হত ।

কি যে হিসাব ছিল ছোট্ট অভিজিতের – তিনটের বেশি লজেন্স সে কোনোদিনই নিত না । এক – এক দিন রবীন্দ্রনাথ বইয়ামের মুখ খুলে অভিজিতের সামনে ধরতেন , অভিজিত হাত ডুবিয়ে এক মুঠো লজেন্স তুলে নিত , নিয়ে হাতের তেলোয় সেগুলো মেলে ধরে গুনত – ‘ বাপ , মানি , খোকন ‘ – এই তিনটে রেখে বাকি লজেন্সগুলো বৈয়ামে ফেলে দিত । রবীন্দ্রনাথের তখন খুব আনন্দ হত , তিনি সব্বাইকে ডেকে বলতেন – এমন নির্লোভ ছেলে আমি দেখি নি । লজেন্স তিনটি কিন্তু অভিজিত নিজেই খেত । ‘ বাপ , মানি , খোকন ‘ – এই ছিল তার গণনার পদ্ধতি – আর এটা ওরই সৃষ্টি । সবাই ওর গোনা দেখে হাসত , মজা পেত । প্রতিদিন ভোরে এই তিনটি লজেন্স তার চাই , রবীন্দ্রনাথও খেয়াল রাখতেন বৈয়ামে ঠিকমত লজেন্স ভরা আছে কিনা ।

সকাল ছাড়াও যখন তখন ছুটে ছুটে রবি দাদুর কাছে যাওয়া চাই অভিজিতের । পথে যেতে তলায় পড়ে থাকা সোনাঝুরির শুকনো পাতাটি হয়ত তার নজরে আসলো ,অমনি তুলে নিয়ে এলো দাদুর কাছে – দাদু । এই দেখো কেমন চাঁদ । রঙ তুলি নিয়ে কাগজে হিজিবিজি দাগ কাটল – তাই নিয়ে ছুটে গেলে দাদুর কাছে – দাদু এই নাও ছবি । এটা হল মাছ , এটা চাঁদের মা বুড়ি বসে বসে সুতো কাটছে , আর এটা হল শিমুল ফুল – তলায় পড়ে আছে । রবীন্দ্রনাথ খুব আনন্দ পেয়ে অভিজিতের মা-কে ডেকে বলতেন , ” তোর ছেলের ছবি আঁকা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে জাই । এরই মধ্যে কেমন একটা রূপ দিতে শিখেছে । ”

এমনি করে দিনে কতবার যে তার যাওয়া চাই রবি দাদুর কাছে তার শেষ ছিল না । শিশু অভিজিৎ আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠেছিল দিনে দিনে । অভিজিতকে রবীন্দ্রনাথ আদর করে ডাকতেন ” যুবরাজ ” । বলতেন রানীর
ছেলে ‘রাজপুত্তর’ ।

রবীন্দ্রনাথ সেদিন খুব অসুস্থ – যে মানুষটা আপন খুশিতে কথা বলে যান , সে মানুষটা আজ থেমেই আছেন – বার বার চেষ্টা করেও কথা সমাপ্ত করতে পারছেন না । রথীন্দ্রনাথ , প্রতিমা দেবী সহ অনেকেই গভীর উদ্বেগে ঘিরে আছে রবীন্দ্রনাথকে। অভিজিৎএর বয়স তখন চার – খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরছে ওই মাঠের পথ ধরে – তাকে দেখেই সবাই ফিসফিসিয়ে উঠলো – অভিজিৎ কে ধর ।

ধরতে হল না অভিজিৎ কে । সে তার দাদুকে বাইরে দেখেই ছুটে এসে একেবারে দাদুর গা ঘেঁষে দাঁড়াল , বললে , জানো দাদু , তোমার সব কবিতা আমি মুখস্ত করে ফেলেছি । আর একটাও বাকি নেই ।

রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ বললেন , সত্যি নাকি ? সব শিখে ফেলেছ ?

– হ্যা দাদু । স —- ব । সত্যি বলছি ।

– তা হলে তোমার জন্য আবার আমার ন্তুন করে কবিতা লিখতে হবে দেখছি ।

রবীন্দ্রনাথ আর অভিজিতের এই আলাপে বাকি দের তখন নিশ্বাস একটু হালকা ভাবে পড়তে শুরু করেছে ।

রবীন্দ্রনাথ আর অভিজিতের কথা জমে উঠল । উচ্ছ্বাসের ধাক্কায় অভিজিৎ ডান হাঁটু রবীন্দ্রনাথের কোলের উপর তুলে দিয়েছে কখন , বলছে – জানো দাদু আজ কোন কবিতাটা শিখেছি ? শোনো –

পাঠানেরা যবে বাঁধিয়া আনিল
বন্দী শিখের দল –
সুহিদ্গঞ্জে রক্তবরন
হইল ধরণীতল ।

কবিতার মধ্যে ‘ পাঠা ‘ আর ‘ রক্ত ‘ এই দুটোই বুঝেছিল অভিজিৎ – তাই সে বললে , এর মানে কী তুমি জানো দাদু ?

রবীন্দ্রনাথ তো খুব করে দু পাশে মাথা নাড়ালেন ।

অভিজিৎ তখন রবীন্দ্রনাথের মুখের কাছে হাত নেড়ে নেড়ে বোঝাতে শুরু করে দিল , ” এর মানে হল – পাঁঠাগুলোকে বেঁধে নিয়ে এল – কাটল , আর রক্ত – রক্ত ” – বলার সাথে সাথে তাঁর হাতখানি যতটা পারল সামনে বাড়িয়ে দিল । দু – চোখ বড়ো বড়ো করে ভাবখানা এমন করল যেন অতি বিস্ময়কর একটা ব্যাপার দেখাচ্ছে সে তার দাদুকে ।

রবীন্দ্রনাথ তো প্রান খুলে হেসে উঠলেন । বললেন , তাই গো , এমন মানে তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও জানে না গো । বাকিরাও একটু জোর রবে হেসে ফেলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ।

শেষবার – যেবার অপারেশন হবে , শান্তিনিকেতনকে কান্নায় ভাসিয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসা হল কলকাতায় – পরদিন ভোরে যথানিয়মে অভিজিৎ রবীন্দ্রনাথের ঘরে গেল । রবীন্দ্রনাথ বিছানায় শুয়ে আছে , অনন্তে তাঁর দৃষ্টি – অভিজিতের উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালেন খাটের পাশে রাখা টেবিলের দিকে – লজন্সের বৈয়াম সেখানে নেই । অভিজিৎ এর সেদিন খালি হাতে ফিরতে হল । রবীন্দ্রনাথের বুকে বড়ো বাজলো , সবাইকে ডেকে ধমকের সুরে বললেন , এরা জানে আমার সাথে সাথে থাকে লজন্সের শিশি , সেই জিনিসেই এদের যত ভুল । সঙ্গে সঙ্গেই বৈয়াম ভরা লজেন্স কিনে এনে রাখা হল ।

অপারেশানের পরের কয়েকটা দিন , এই লজেন্স পাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল অভিজিতের , তবুও সে রোজ একটা বার অন্তত সকলের হাত ছিটকে আসত তার দাদুর ঘরে , তারপর এক গভীর মগ্নতায় শুয়ে থাকা তার দাদুর দিকে চেয়ে থাকতো কিছু সময় শান্ত হয়ে , একসময় আপনা থেকেই অনেক খানি মন খারাপ করে বেরিয়ে আসত ।

সেদিন বাইশে শ্রাবণ – রবীন্দ্রনাথ সবটুকু জাগতিক বন্ধন ছিঁড়ে পাড়ি দিয়েছেন অমৃতলোকে – ঘরে ভিড় উপছে পড়ছে , অভিজিতের কথা কারো মনে নেই , অভিজিৎ ওই ভিড়ের ভিতরই একটু ফাঁক করে পথ করে নিয়ে বিদ্যুতের মত এসে দাঁড়ালো ঘরে । একটি কথা নেই মুখে তার – সাদা চাদরে আবক্ষ ঢাকা গুরুদেব – দাদুকে দেখল স্তব্ধ হয়ে । তারপর যখন ফুলে ফুলে ঢাকা গুরুদেবের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নীচে – ওই হাজার লোকের ভিড়ের মাঝে একটি শিশু কণ্ঠ চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল – দাদুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা – অমন করে নিয়ে যাচ্ছে কেন – দাদুর যে কষ্ট হবে –

বাইশে শ্রাবণের , সেই দিন থেকে অভিজিত আর কোনোদিনই কারও কাছ থেকে লজেন্স নেয় নি আর কেউ কোনোদিনই আর তাকে তার দাদুর মতো করে ‘যুবরাজ’ বলে ডাকেনি ।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – শ্রীরানী চন্দ