০০

শিরোনামটা লেখার পর মনে হলো আমাদের বাংলাভাষায় কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলো ধর্ম-নিরপেক্ষ নয়। দিদিমা, ঠাকুরমা, ঠাকুরদিদি, ঠানদি, ঠাকুরদা, মাসি, পিসি, দাদা, দিদি, বৌদি ইত্যাদি সম্পর্কসূচক শব্দগুলো বাংলাভাষী মুসলমানরা দৈনন্দিন ব্যবহার করেন না। তেমনি নানা, নানি, দাদি, খালা, খালু, ফুফু, ফুফা, ভাবী ইত্যাদি শব্দগুলো বাংলাভাষী হিন্দু বা বৌদ্ধরা ব্যবহার করেন না। এরকম আরো কিছু ধর্ম-অনিরপেক্ষ শব্দ আছে আমাদের বাংলা ভাষায়। ইংরেজি ভাষা সেই তুলনায় অনেক বেশি সেক্যুলার। সমস্যাটা শুরু হয় অনুবাদের ক্ষেত্রে। গ্র্যান্ডমাদার শব্দের বাংলা পরিভাষা কী হবে? সেক্ষেত্রে পাঠকের কথা ভাববো, নাকি লেখকের? লেখক হিন্দু হলে হিন্দু শব্দ, মুসলমান হলে মুসলমান শব্দ? লেখক যদি খ্রিস্টান বা ইহুদি বা নাস্তিক হন?

শব্দের ব্যবচ্ছেদ করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, সে যোগ্যতাও আমার নেই। আমি আসলে একটি গল্পের বইয়ের গল্প বলতে চাচ্ছি। আর কে নারায়নের ‘দি গ্র্যান্ডমাদারস টেল’ – দিদিমার গল্প।

০১

ইংরেজি সাহিত্যে ভারতীয় লেখক অনেকেই আছেন। অনেকের বইই এখন কয়েক লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায় প্রকাশিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু এঁদের সবার চেয়ে স্বতন্ত্র বলে যাঁকে মনে হয় – তিনি আর কে নারায়ণ। সাহিত্য যে আমি খুব পড়েছি তা নয়, ইংরেজি সাহিত্য তো আরো নয়। এক পৃষ্ঠা পড়তে কয়েকবার ইংলিশ টু বেংগলি ডিকশনারি উল্টাতে হলে পড়বো কীভাবে! তারপরও কীভাবে কীভাবে যেন আর কে নারায়ণের কিছু কিছু বই পড়া হয়ে গেছে।

r-k-narayan

১০ অক্টোবর ১৯০৬ থেকে ১৩ মে ২০০১ – প্রায় পঁচানব্বই বছরের দীর্ঘ জীবন আর কে নারায়ণের। নামটাও অনেক লম্বা – রাশিপূরম কৃষ্ণস্বামী আয়ার নারায়ণস্বামী। জন্ম মাদ্রাজে। হেডমাস্টারের ছেলে। কিন্তু তাঁর ছোটবেলা কেটেছে তাঁর দিদিমা অর্থাৎ মায়ের মা পার্বতীর কাছে। ১৯৩০ সালে চব্বিশ বছর বয়সে লেখেন প্রথম উপন্যাস “সোয়ামি অ্যান্ড হিজ ফ্রেন্ডস”। সেখানেই তিনি রচনা করেন কাল্পনিক শহর মালগুদি। যে শহরটি হয়ে ওঠে তাঁর পরবর্তী সবগুলো উপন্যাসের কেন্দ্রস্থল। তাঁর শেষ বই “গ্র্যান্ডমাদার্স টেল” প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৩ সালে। ১৯৩০ থেকে ১৯৯৩ – দীর্ঘ ৬৩ বছরের সাহিত্যচর্চা। তাঁর প্রথম বইটি কোন প্রকাশকই প্রকাশ করতে রাজি হননি। ইংল্যান্ডে তাঁর যে বন্ধুর কাছে উপন্যাসটি পাঠিয়েছিলেন প্রকাশকদের রাজি করানোর জন্য, বার বার ব্যর্থ হয়ে নারায়ণ বন্ধুকে বলেছিলেন পান্ডুলিপিটি যেন পাথরের সাথে বেঁধে টেম্‌স নদীতে ডুবিয়ে দেয়। সেটা অবশ্য করতে হয়নি। তারপর তাঁর অনেকগুলি উপন্যাস ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে।

সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের জন্য বেশ কয়েকবার আর কে নারায়ণের নাম প্রস্তাবিত হয়েছে। নোবেল পুরষ্কার তিনি পাননি, কিন্তু তাঁর লেখা তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল এক সময়। তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলোর প্রধান যে বৈশিষ্ট্য – তা হলো কোনটারই মুখ্য বিষয় প্রেম-ভালোবাসা নয়। যে দিদিমার কাছে তাঁর ছোটবেলা কেটেছে – সেই দিদিমার কথাই তিনি লিখেছেন তাঁর জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে; তাঁর শেষ গল্পে। সেই গল্পই বলছি আজ।

০২

তিনটি ছোট ছোট উপন্যাসের সংকলন – দি গ্র্যান্ডমাদার্স টেল।

grandmothers-tale-cover

(ক) প্রথম গল্প: দি গ্র্যান্ডমাদার্স টেল

এই গল্পে নারায়ণ তাঁর দিদিমার মা-বাবার জীবনের কিছু কাহিনি বর্ণনা করেছেন দিদিমার জবানীতে। এই দিদিমার কাছেই তাঁর নিজের ছোটবেলা কেটেছে। নারায়ণের বয়স যখন তিন বছর তখন থেকেই তিনি মাদ্রাজে তাঁর দিদিমার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। কারণ তাঁর মা তখন ব্যাংগালোরে ছোটছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। দিদিমার মায়ের নাম বালা। বালার বিয়ে হয়েছিলো আট বছর বয়সে। বালার স্বামী বিশ্বনাথের বয়স তখন তেরো। বিয়ের পর মেয়ে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাপের বাড়িতে থাকার নিয়ম। বালার সাথে বিশ্বনাথের ভালো করে পরিচয়ও হয়নি তখন। বিশ্বনাথ কয়েকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে বালার সাথে দেখা করতে চেষ্টা করেছে। । তারপর একদিন কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায় বিশ্বনাথ। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না বিশ্বনাথকে। গ্রামে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। সবাই বলতে শুরু করলো বালা বিধবা হয়েছে।

কেটে যায় অনেক বছর। বালা যুবতী হয়ে ওঠে। গ্রামে কানাঘুষা বেড়ে যায়। একদিন বালা নিজেই বেরিয়ে পড়ে স্বামীর খোঁজে। অনেক পথ পেরিয়ে, অনেক বছর পথে পথে কাটিয়ে শেষে পুনায় এসে বিশ্বনাথের দেখা পায় বালা। বিশ্বনাথ তখন পুনায় প্রতিষ্ঠিত হীরার ব্যবসায়ী। সুরমা নামে তার স্ত্রীও আছে। কিন্তু বালা নানা কৌশলে বিশ্বনাথকে গ্রামে নিয়ে আসে। প্রায় পনেরো বছর পরে এই ফিরে আসা। গ্রামে এসে তারা দেখে তাদের ভিটেমাটিও হাতছাড়া হয়ে গেছে।

এবার বিশ্বনাথ ও বালার আরেকটি অধ্যায় শুরু হয়। আরেকটি শহরে তারা নতুন করে ব্যবসা শুরু করে। ক্রমে সংসার, ক্রমে দুই মেয়ে, এক ছেলে। (দুই মেয়ের একজন পরবর্তীতে লেখকের দিদিমা)। ছেলেটা ডাক্তার হয়। আলাদা থাকে। অনেক পসার। বেশ বড় ঘরে বিয়ে হয় তার। ছেলের সুখ দেখতে দেখতে সুখী-মৃত্যু হয় বালার। বিশ্বনাথ একা হয়ে যান; তাকে দেখার কেউ নেই। ছেলে বাবাকে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে। প্রথম প্রথম বাবাকে খুশি করার জন্য ছেলে তার উপার্জনের কিছু টাকা এনে তুলে দিতো বাবার হাতে। বিশ্বনাথ ভীষণ খুশি তাতে। ছেলের বৌকে ডেকে নিজের হাতে টাকা তুলে দিতে বেশ গর্ববোধ করতেন বিশ্বনাথ। কিন্তু এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটতে লাগলো আস্তে আস্তে। ছেলের পসার, দায়িত্ব, ব্যস্ততা বাড়ে। উপার্জনের টাকা এখন ছেলের কাছ থেকে সরাসরি চলে যায় ছেলের বৌয়ের কাছে। মন ভেঙে যায় বিশ্বনাথের। নিজেকে খুব অপ্রয়োজনীয় মনে হয় তার। একদিন কাউকে কিছু না বলে গ্রামের বাড়িতে চলে যান বিশ্বনাথ।

সেখানে কাজের লোকের যুবতী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে পঁচাত্তর বছর বয়সী বিশ্বনাথ। মনে মনে ভাবে ছেলে আর ছেলের বৌকে বেশ একটা উচিত শিক্ষা দেয়া হলো। কিন্তু মোহ কাটতে দেরি হলো না। বিশ্বনাথের নতুন বৌ আর শাশুড়ি চায় বিশ্বনাথ যেন সবকিছু তাদের নামে লিখে দেয়। কিন্তু বিশ্বনাথ দানপত্রে সই করতে অস্বীকার করে। বিশ্বনাথের শাশুড়ি গ্রামের কবিরাজ বৈদ্য থেকে বিষ এনে গোপনে খাইয়ে দেয় বিশ্বনাথকে। তারপর ছেলের কাছে খবর পাঠায় বিশ্বনাথের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

এখানেই শেষ দিদিমার গল্প। অতি পরিচিত সহজসরল গল্প। একেবারে জীবন থেকে নেয়া বলেই তো মনে হয়।

(খ) দ্বিতীয় গল্প: গুরু

গুরুমূর্তি নামে একজন স্বার্থপর কঞ্জুষ লোকের গল্প। গুরু খুব ছোট অবস্থা থেকে অনেক কষ্টে তহশিলদারের চাকরি জোগাড় করে। ঘুষ খাওয়াটাকে সে নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে এবং নিষ্ঠার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করে। তার দুই মেয়ে। বিনাখরচে কীভাবে মেয়েদের বিয়ে দেয়া যায় সে চেষ্টা করতে থাকে সে। নানারকম মুখরোচক কথাবার্তা বলে নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে মেয়েদের পার করে। কিন্তু বিয়ের পর তা আর পালন করে না। তখন সুন্দর সুন্দর যৌতুকবিরোধী কথাবার্তা বলে সে। বড়মেয়েকে স্টেশনে বিদায় জানাতে গিয়ে প্রচুর কান্নাকাটি করে, আবার ফিরে আসার ভাড়াটা মেয়ের কাছ থেকে আদায় করে নেয়। খরচ কমানোর নামে বাড়িতে চা কফি চিনি সব একে একে বন্ধ করে দেয়।

একদিন দুর্নীতির দায়ে চাকরি চলে যায় গুরুর। আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। ছেলে থাকলে ছেলের রোজগার খেতে পারতো এই চিন্তা করে নিজের ভাইয়ের ছেলেকে দত্তক নেয় সে। এতে বিরক্ত হয়ে গুরুর স্ত্রী চলে যায় তার মেয়ের কাছে। তাতে খুশিই হয় গুরু। দত্তক ছেলেটি কিছুদিন পরেই বিরক্ত হয়ে নিজের মা-বাবার কাছে চলে যায়। তাতে আরো খুশি হয় গুরু। কিছুদিন পর গুরু জানতে পারে যে তার মৃত্যুর পর বিষয়-সম্পত্তি যা আছে সবই পাবে তার দত্তক ছেলেটি। শুনে খুবই খারাপ লাগে তার। তার এত কষ্টে উপার্জিত সম্পত্তি আর কেউ ভোগ করবে তা সে ভাবতেও পারে না। মনে মনে সে বুদ্ধি করে যে তার মৃত্যুর খবর সে কাউকেই জানাবে না।

আবারো পরিচিত মানুষের গল্প। স্যাটায়ার কি?

(গ) তৃতীয় গল্প: সল্ট অ্যান্ড স ডাস্ট

স্বামী ও বীনা – স্বামী-স্ত্রী। নিঃসন্তান। বীনা উচ্চশিক্ষিত; ইংরেজিতে বিএ। স্বামীর পড়াশোনা তেমন না। তাই স্বামী বীনাকে খুব ভয় করে, সম্মান করে, এবং ভালোও বাসে। তারা উভয়েই সত্যিকারের ভালো মানুষ। বীনা রান্নাবান্না করতে পারে না। লেখাপড়া ছাড়া সংসারের আর কোন কাজই ধরতে গেলে সে করতে জানে না। সংসারের সব কাজ, রান্নাবান্না থেকে কেরানিগিরি সবই করে স্বামী। বীনার লেখক হবার বড় শখ। একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করে সে। কিছুদূর লেখা হলেই সে পড়ে শোনায় স্বামীকে।

তার উপন্যাসের নায়ক একজন ডাক্তার – দাঁতের ডাক্তার। নায়িকা হলো ডাক্তারের রোগী – যার একটি দাঁতও নেই। রোগীনির হা করা মুখ দেখতে তার প্রেমে পড়ে যায় ডাক্তার।

স্বামীর প্র্যাকটিক্যাল সেন্স খুবই কড়া। সে বলে, “এটা অসম্ভব। যার একটা দাঁতও নেই তার প্রেমে পড়বে কেন একজন ডাক্তার?”

স্বামীর কথা শুনে রেগে যায় বীনা। “আমার দাঁত না থাকলে তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে না? তোমার ভালোবাসা কি শুধু দাঁত-সর্বস্ব?” কেঁদেকেটে অস্থির হয় বীনা। তাকে শান্ত করে স্বামী।

বীনার অবাস্তব কল্পনাকে বাস্তবে টেনে আনতে স্বামী খুব সাহায্য করে। এক সময় উপন্যাস শেষ হয়। এবার প্রকাশের পালা। উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার বিয়ের ভোজের বর্ণনাকে বাস্তবসম্মত করার জন্য স্বামী সেখানে অনেক খাদ্যের বর্ণনা যোগ করে দিয়েছিল রন্ধন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণসহ। এক প্রকাশক বীনার উপন্যাসটি প্রকাশ করতে রাজি হয়, তবে উপন্যাস হিসেবে নয়, উপন্যাসের গল্পটুকু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রান্নার বিবরণটুকু নিয়ে রান্নার বই হিসেবে। রান্নার বইয়ের লেখক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যায় শেফ বীনা।

ঘটনা পরিচিত মনে হচ্ছে না?