রবীন্দ্রনাথের পরে জীবনানন্দ দাশই বাংলা কবিতার একমাত্র কবি যাঁর প্রভাবমুক্ত হ’তে গলদঘর্ম হ’তে হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের। কেউ কেউ সচেতন ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উৎরে যেতে পেরেছেন কিছুটা কিন্তু প্রায় সবাই ওই জীবনানন্দীয় কাব্যকথা ও কাব্যভাবনার জালেই জড়িয়ে পড়েছেন।

একমাত্র বুদ্ধদেব বসু ছাড়া জীবনানন্দ দাশের জীবনকালে কেউ জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন ব’লে জানা যায় না। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন কালের বিচারে এমনি দূরবর্তী এক কবি। বাঙালির জীবনানন্দ নিয়ে এতো মাতামাতি , জীবনানন্দের কাব্যভাষা ও কাব্যভাবনার এমন অনুকরণ-অনুসরণ, কবিতাচর্চা করতে গিয়ে জীবনানন্দ-মধ্যাকর্ষণের এতো প্রবল টান; এসব কিছু বাঙালির বোধগম্য হয়েছে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর অনেক পরে।

অনেকেই যেমন বলেন –আমিও তাঁদের সাথেই বলি, রবীন্দ্রনাথের পরে জীবনানন্দ দাশই একমাত্র কবি-যাঁর কবিতাচর্চা বাংলা সাহিত্যে অনিবার্য ও অপরিহার্য ছিল। বাংলা সাহিত্যে কয়েক হাজার কবি ও কবিযশপ্রার্থীর সম্মিলিত কাব্যচর্চা আজও সেই “রবি-জীবনানন্দ” বৃত্তাবর্তেই ঘুরছে।

বাঙালির এই “জীবনানন্দ-নির্ভরতা”, বাংলা কবিতায় এই “ জীবনানন্দ-প্রাসংগিকতা” কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর মৃত্যুর ( অক্টোবর ২২,১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ) আগে জেনে যেতে পারেননি। জীবনানন্দ দাশ নিজেই বলেছিলেন সে কথা “সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবু কবিতাটি হয়ত অনেকে বুঝবে না”। না-বোঝা কিংবা বুঝেও না-বোঝার মতো ব্যর্থতা বাঙালির কপাল লিখন; বাঙালির স্বভাবজাত উত্তরাধিকার।

অথচ কী আশ্চর্য! কবিতা পড়ার প্রতি আগ্রহই থাকতো না যদি জীবনানন্দের কবিতা না-পড়তাম। সেই সাথে যদি না পেতাম আরেক আধুনিক মানুষ ও কবি-সাহিত্যিকের কিছুকালের সান্নিধ্য; তিনি হুমায়ুন আজাদ। কবি ও লেখক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ কতদিন পঠিত হবেন সেটা আগামীই বলে দেবে, তবে কবিতাবোদ্ধা হিসেবে তিনি আমার মতে অদ্বিতীয়। তাঁর আগ্রহেই বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও পাঁচ-মহৎ আধুনিক কবির কবিতার অতল সমুদ্র থেকে জল-কণা মাথায় তুলে নিতে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা বললে নিজের প্রতি সপ্রশংস মিথ্যাচার করা হবে; দূর থেকে ব্যর্থ প্রয়াসে অবলোকন করেছি মাত্র।

বাংলা কবিতার পাঁচ মহৎ আধুনিক কবির মধ্যে জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় “মহত্তম”; সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বলা হয় ” শ্রেষ্ঠ”; বুদ্ধদেব বসুকে বলা হয় “আধুনিক কবিতার প্রধান পুরোহিত” ; অমীয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে -কে বলা হয় “অন্যতম প্রধান”।

রচনার ব্যাপ্তি ও পরিমানের (??) দিক থেকে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন সবচেয়ে বেশী; ক্রমানুসারে তারপর বিষ্ণু দে,জীবনানন্দ দাশ, অমীয় চক্রবর্তী এবং সবচেয়ে কম লিখেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।

জীবনের ব্যাপ্তিতে স্বল্পায়ু হয়েছেন জীবনানন্দ দাশ, মৃত্যুবরণ করেছেন মাত্র ৫৫ বৎসর বয়সে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বেঁচেছেন ৫৯ বছর; বুদ্ধদেব বসু বেঁচেছেন ৬৬ বছর; বিষ্ণু দে জীবিত ছিলেন ৭১ বছর আর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু ছিলেন অমীয় চক্রবর্তী, মৃত্যুবরণ করেছেন ৮৫ বৎসর বয়সে।

১৯৫৪ সালে ১৪ অক্টোবর ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শম্ভুনাথ হাসপাতালে ২২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরে আবিষ্কৃত হয় তাঁর কথাসাহিত্যের বিষ্ময়কর সম্ভার। তাঁর রচিত উপন্যাসসমূহ বাংলাসাহিত্যনুরাগীদের বিস্মিত ও স্তম্ভিত করেছে।

কাব্যগ্রন্থঃ ঝরা পালক ( ১৯১৮), ধূসরপান্ডুলিপি ( ১৯৩৬),বনলতা সেন ( ১৯৪২),মহাপৃথিবী ( ১৯৪৪),সাতটি তারার তিমির ( ১৯৪৯), রূপসী বাংলা ( ১৯৫৭) অন্যতম।
উপন্যাসঃ সুতীর্থ, মাল্যবান,জলপাইহাটি,কারুবাসনা, জীবনপ্রনালী, প্রেতিনীর রূপকথা, বাসমতীর উপাখ্যান, বিভা।

জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুদিবসে তাঁর রচনাসমূহ পাঠ ও স্মরণ করাই হবে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

“ তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে “

প্রতিদিনের জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রকৃতির মধ্যেই শুয়ে আছেন প্রতিদিন কিংবা এক চিল হয়ে “উড়িতেছেন” ধানসিড়ি নদীটির পাশে এই ভিজে মেঘের দুপুরে; ” হায় চিল…”