আজ ৬ ই অক্টোবর অনন্ত বিজয় দাশের ৩৪ তম জন্মবার্ষিকী। তার জন্ম-মৃত্যু নিয়ে কোনকালেই হা-হুতাশ, আড়ম্বর বা আহামরি কোন ভাবের অতিপ্রবল প্রকাশ দেখি নি। তার জন্মদিন উপলক্ষ এলে সেটার তেমন সে গুরুত্ব দিত না; বলতো, জন্মদিন দিয়ে কী আসে যায়! বরং দু:খময় এ জীবনের জন্মের ঋণ শোধ করতেতো হবে মৃত্যু দিয়েই। আর মনে করি অকস্মাৎ জন্মের মূল কথাই হলো জীবন- জগতের অন্তরনিহীত গহীনের রহস্যময় বস্তু স্বমন্ধে জানা, যে জানা আমার কাছে জন্মদিন পালনের চেয়ে বেশি গুরুত্ববহ। সেজন্য আমি আমার জন্মদিনকে একটি গুরুত্বহীন দিন হিসাবেই দেখি যা আমার কাছে অন্যান্য দিনের মতোই। তবে কেউ যদি আজ এদিনে আমাকে এক পেগ হুইস্কি বা জিন ও টনিক উপহার দেয় তা আমি সাদরে গ্রহণ করব। আমার প্রিয় পানীয় হচ্ছে জিন ও টনিক।

অনন্ত আমার খুব কাছের একজন মানুষ হওয়া স্বত্বেও কোনদিন দেখিনি নিজের প্রচার বা সবজান্তা ভাব প্রকাশ করতে, উদাহরণসরূপ তাকে জঙ্গি-খুনি গ্রুপের চাপাতিওয়ালারা খুন করার পর তার খুব নিকটতম বন্ধুর কাছ থেকে কথা-প্রসঙ্গে জানতে পারি যে সে না-কি সিলেট শহরের একটি বিখ্যাত লাইব্রেরির সব বই পড়ে শেষ করেছিল, আমি তার ঐ বন্ধুকে বললাম আপনি কি আমার সাথে ঠাট্রা করছেন? এটা কি সম্ভব এক লাইব্রেরির সব বই এক জীবনে পড়ে শেষ করা? উনি আমাকে বলল দাদা আমি আপনার সাথে ঠাট্টা কেন করব? আমরা তাকে তো খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং প্রায় একসাথে বেড়ে উঠেছি। অথচ আমিও তার একজন ভাল বন্ধু হওয়ার পরেও কোনদিন তা জানতে পারি নি। সে শুধু বলত এ বই টা পড়েছেন? অমুক বইটা কিনেছেন? না পড়লে বা না কিনে থাকলে পড়ে নিয়েন। ২০০৭ সালের বইমেলায় সে আমাকে জোসেফ ক্যাম্পবেল এর লেখা “মিথের শক্তি” বইটি উপহার দেয়।

ananta1
বইটি দেওয়ার সময় তার নিজের অটোগ্রাফ দেয়। যে অটোগ্রাফটি ইংরেজি শব্দের এ বি ডি দ্বারা চিত্রিত যার মধ্যে ‘এ’ কে মানুষের মূখমন্ডলের মতো করে আকা, তার মধ্যে দুটি চোখ যে চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে এবং একটি নাক, ‘বি’ ও ‘ডি’ অংকিত চিত্রগুলির মানে আমি ধরতে পারি না শত চেষ্টা করেও। পাঠক, এখানে তার অটোগ্রাফের সাইনটি যুক্ত করা হলো। আপনাদের এ নিয়ে কি মতামত বা এর মানে জানা থাকলে জানালে খুশি হবো।

ananta2

মাঝে মাঝে অনেক প্রশ্ন মনে আসে তাহলো অভি কে হত্যা করার পর অনন্ত যখন ঢাকায় যায় বন্যা আহমেদ কে দেখতে তখন ঐরকম পরিস্থিতিতেও ড: অজয় রায় অনন্তকে বলেছিলেন তুমি পারলে দ্রুত দেশ ত্যাগ কর, অনন্ত তার বিষণ্ণমাখা হাসি দিয়ে ওনার দিকে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না। বন্যা অর্ধেক তার মৃত শরীর নিয়ে যখন আমেরিকায় যায় তার দু’তিন দিনের মাথায় অনন্তকে বলে, এখন তাদের টার্গেট হচ্ছো তুমি, তুমি ইন্ডিয়া চলে যাও, আমি তোমার সেখানের থাকা ও খাওয়ার সব ব্যবস্থা নিব। অনন্ত শুনে যায়। তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি রত, ঐ মুহূর্তে তাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সব বায়োডাটা এবং কাগজ-পত্র পাঠানোর জন্য বলতে বলতে হয়রান হয়ে যায়, এখানেও অনন্ত নির্বিকার থাকে। সে কোন কাগজ-পত্র পাঠায় না। দেশের এরকম আরো অনেক প্রথিতযশা লোকজন ও বন্ধু-বান্ধব তাকে দেখা-সাক্ষাতে বা টেলিফোন করে বলে আপনি দেশ ত্যাগ করেন আর যদি দেশ ত্যাগ না করতেই পারেন তাহলে অন্তত: আত্নগোপনে চলে যান, এমুহূর্তে আপনার জীবন রক্ষা করা বেশী জরুরী । এখানেও অনন্ত নির্লিপ্ত। যেদিন বাবুকে হত্যা করা হয় সেদিন এই প্রথম দেখলাম অনন্তের কিছুটা হুশ হইছে, যার জের ধরে ইউরোপিয়ান কয়েকটি দেশের হিউমানিটারিয়ান সংস্থায় মেইল করে। যার মধ্যে অন্যতম আশা ও ইচ্ছা ছিল নরওয়ে বা সুইডেনে যাওয়া। নরওয়ের ‘আইকরন’ সবকিছু যাচাই বাচাই করে তাকে নিয়ে আসার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু বাধ সাধে তাদের সিস্টেমে, সিস্টেম ছাড়া তারা একবিন্দুও নড়ে না। অনন্ত মনে হয় তাদেরকে ১৫ / ২০ টি মেইল পাঠিয়েছিল যেন তার কেইসটির তারা ভিন্ন গুরুত্ব দেয় এবং তাকে রক্ষা করে। এটা মার্চ এর শেষ বা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। যদি ‘আইকরন’ সেদিন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাকে রক্ষা করত তাহলে আমরা অনন্তকে অকালে হারাই না। তার থেকে আরো বড় ট্র্যাজেডির ইতিহাস হচ্ছে সুইডেনের এক আকাশসম হিটলারিপনায়। কারন সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল পেন ক্লাবের ইতিহাসে গত একশত বছরে এমন ন্যাক্কারজনক কোন ঘটনা আর ঘটেনি। পেন ক্লাবের ইনভাইটেশন কোন সুইডিশ এম্বাসেডর এর আগে কোনদিন কাউকে রিফিউজ করে নি। অনন্তকে তারা ৩০ শে এপ্রিল ভিসা দেওয়ার কথা ছিল। ঐদিন তাকে ভিসা দিলে অনন্ত আজ সুইডেনে থাকত। বেচে থাকলে বাংলাদেশ ও বিশ্বের মানুষের জন্য একটি সুস্থ্য, সুন্দর, মানবিক ও মানবতাবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরনের জন্য অনেক কিছু উপহার দিতে পারত। সে আর হলো না। বিশেষ করে বাংলাভাষীরা তার অভাবে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শনের উপর অনেক অনেক গভীর জ্ঞানগর্ভ লেখা এবং বই থেকে বঞ্চিত হলো। এর পরের ইতিহাসতো আমরা সবাই জানি।

অনন্তসহ অভি, বাবু, দীপনরা বাংলার সক্রেটিস আরজ আলী মাতুব্বর, সাহিত্যিক ও দার্শনিক আহমদ শরিফ, হুমায়ন আজাদের উত্তরসসূরী। অনন্তরা জন্মের মতোই মৃত্যুকে একটি জীবনের অতি স্বাভাবিক বিষয় মনে করত। এ নিয়ে তার-মধ্যে কোনদিন ভয় বা হাহাকার দেখা যায় নি। বলত জীবন হচ্ছে এই আছি তো একটু পর নাই; মহাকালের বিচারে এ যেন ভোরের সবুজ ঘাসের উপর শিশিরজল, কচুপাতার উপর টলটল পানি। তাই এ নিয়ে চিন্তা করি না। কিন্তু আমৃত্যু যেন ‘মানুষ’ হয়ে বাচি।

আজ এ দিনে মন বড়-ই ভারাক্রান্ত। কোনকিছুতেই মন বসে না। জীবনের পথচলার মাঝে এক অকৃত্রিম, মানবিক বন্ধুকে হারানোর কষ্ট-যাতনা যে কী তা যে হারিয়েছে সে-ই শুধু জানে।

আজ তার মা-বাবা ও ভাইবোনদের যেখানে তাকে নিয়ে আনন্দ ও খুশিতে নাচানাচি করত, ভূনাখিচুড়ি রান্না হত, একসাথে আনন্দ করে খেত, সেখানে কেবল আজ অশ্রু ঝরে পড়ছে। তাদের কাউকে আমাদের সান্তনা দেবার ভাষা নেই।

অনন্ত মনে হয় বুঝে গিয়েছিল বলেই তার নামের ‘A’ এর মধ্যে দু’চোখে অশ্রু দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে।

যেখানেই থাক বন্ধু ভাল থেক সবসময়। আর আমাদের দিকে আঁধারের জোনাকি-পোঁকার মত মিটমিট করে চেয়ে থেক।

লিখেছেন: বকশালিক