লেখক: ফাহিম আহমেদ
সম্মান হত্যাকান্ড বা Honor Killing মানবিক আচরণগত সহিংসতার সবচেয়ে তীব্র একটি ধরণ। কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়াই সম্মান হত্যাকান্ড স্বাভাবিকভাবে এবং সকল ক্ষেত্রে নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। একজন নারী কর্তৃক নিজ পরিবারের তথাকথিত সম্মান হানির কারণে সে সম্মান ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নারীকে হত্যা করার নামই সম্মান হত্যাকান্ড। পরিবারের সম্মান হানির কারণে সবচেয়ে ঘৃণ্য শাস্তি সম্মান হত্যাকান্ড। পরিবারের সম্মান হানির ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সহিংস শাস্তির মাঝে রয়েছে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া অথবা অন্য় কোন প্রকার শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার। জাতিসংঘের মতে,”বর্তমান বিশ্বে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সবচেয়ে সাধারণ সহিংসতার ঘটনা। এ ধরণের সহিংসতার অন্যতম হল হত্যাকান্ড।”
Honor Based Violence Awareness Network (HBVA) এর মতে, “বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০০০ সম্মান হত্যাকান্ডের ঘটনা সংঘটিত হয়।“ এর মাঝে প্রতিবছর ১০০০ ভারতে, ১০০০ পাকিস্তানে এবং ১২ টি যুক্তরাজ্যে সংঘটিত হয়।” সম্মান হত্যাকান্ড মূলত মধ্য প্রাচ্য যেমন- জর্ডান, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান, ইরাক, মিসর, পশ্চিম তীর সংলগ্ন বিভিন্ন দেশ এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ যেমন- ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সংঘটিত হয়। এছাড়া এসকল দেশের বংশোদভূত নাগরিকদের দ্বারা পাশ্চাত্য়ের বিভিন্ন দেশে ক্রমেই সম্মান হত্য়াকান্ডের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন করার ক্ষেত্রে যে কর্মকান্ডগুলোতে নারীর লিপ্ত হওয়াকে দায়ী করা হয় তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হল অবৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক, বিবাহপূর্ব কোন সম্পর্ক অথবা ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার সন্দেহ। অবৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াও সম্মান হত্যাকান্ড নানা কারণে সংঘটিত হতে পারে। যেমন- অপরিচিত কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলা, পারিবারিকভাবে আয়োজিত বিবাহে অস্বীকৃতি, বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়া, পিতা কিংবা স্বামীর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া ইত্যাদি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোতে সম্মান সংক্রান্ত আইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্মান হত্যাকান্ড বিভিন্ন অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তুরস্কের কিছু সম্প্রদায় সম্মান হত্যাকান্ডের দায় এড়াতে অভিযুক্ত নারীকে আত্মহননে বাধ্য করে। জর্ডানের পেনাল কোড আর্টিকেল ৩৪০ সে সকল পুরুষদের রক্ষা করে যারা নিজ স্ত্রীদের ব্যভিচারের সন্দেহে হত্যা করে। পশ্চিম তীর সংলগ্ন বিভিন্ন দেশে অনুরূপ আইন লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে ইরানের আইন ব্যবস্থা ইসলামী শরিয়াভিত্তিক এবং সেদেশের পেনাল কোড আর্টিকেল ৬৩০ মোতাবেক একজন পুরুষ নিজ স্ত্রীকে অবৈধ বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার সন্দেহে হত্যা করতে পারবেন।
একজন নারী সমাজের নানা রীতিনীতি সম্পর্কে তার মতামত অথবা ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে অথবা মা কিংবা গৃহিনী হিসেবে কোন নারী যদি নিজ জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট না থাকে তাহলে এর ফলে তিনি সম্মান হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারেন। অনেক বেশী রক্ষণশীল সমাজে এসকল আচরণ থেকেই সন্দেহ করা হয় যে নারী অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। পরিবার থেকে আশা করা হয় যে নারী তার পিতার কিংবা স্বামীর সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলবে এবং নিজ চিন্তাধারার প্রয়োগ ঘটাবে না। সম্মান হত্যাকান্ডের আরেকটি কারণ হল নারীদের নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী জীবনযাপন করা অথবা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে অথবা উচ্চ শিক্ষা লাভে গৃহ ত্যাগ করার চিন্তা। নারীদের স্বাধীন হওয়ার এ চিন্তা সামাজিক কাঠামোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এর ফলে সম্মান হত্যাকান্ড সমাধান হিসেবে গৃহীত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর তথাকথিত “শারীরিক” বিশুদ্ধতা সম্মান হত্যাকান্ডকে প্রভাবিত করে। নানা ক্ষেত্রে ব্যভিচারের গুজব নারীকে সম্মান হত্যাকান্ডের দিকে ঠেলে দেয়। জর্ডানের ৮০ ভাগ সম্মান হত্যাকান্ড এ ধরণের সন্দেহের ভিত্তিতে হয় যেখানে ব্যভিচেরের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সম্মান হত্যাকান্ডের বাস্তবায়নকারী কিছু ক্ষেত্রে সামান্য শাস্তি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন প্রকার শাস্তিরই সম্মুখীন হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্মান হত্যাকান্ড পরিবারের পুরুষদের দ্বারা সম্পাদন করা হয়। ভাই, পিতা অথবা স্বামী কর্তৃক এ হত্যাকান্ড সম্পাদন করা হয়। অন্যদিকে সম্মান হত্যাকান্ড সম্পাদনকারী ঘাতক সমাজের সাধারণ সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য হয় না। সমাজের অভ্যন্তরে সত্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে তিনি গণ্য হন। সম্মান হত্যাকান্ডের কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের মাঝে রয়েছে- পারিবারিক আদালত কর্তৃক বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড দেয়া, হত্যাকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মীয় হওয়া, নাবালকদেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে হত্যাকান্ড সম্পাদনে পছন্দ করা যেন তাদের শাস্তি কম হয়, হত্যাকারীর সামাজিক নায়ক হিসেবে আবির্ভুত হওয়া, হত্যা সংঘটনের পূর্বে নারীকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মাধ্যমে তার “হুশ” ফিরিয়ে আনা, হত্যাকান্ডটিকে পরিবারের সম্মান ফিরিয়ে আনার উপায় হিসেবে গণ্য করা এবং ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে মেনে নেয়া। সম্মান হত্যাকান্ডের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় বিষপ্রয়োগ, বন্দুকের গুলি, ছুরিকাঘাত অথবা শ্বাসরোধ করে হত্যার মাধ্যমে। অন্যান্য ক্ষেত্রে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা উল্লেখযোগ্য।
সম্মান হত্যাকান্ডের একটি সমসাময়িক ও আলোচিত ঘটনা ছিল এ বছরের ১৫ জুলাই পাকিস্তানি মডেল কান্দিল বেলুচ (প্রকৃত নাম ফাউজিয়া আজিম) হত্যাকান্ড। বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তার অশালীন কার্যক্রম নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না তার পরিবার। কয়েকবার হুমকি দেয়ার পর আপন ভাই ওয়াসিম আজিম তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে এবং এই হত্য়াকে তার “দায়িত্ব” হিসেবে ঘোষণা করে। এ হত্যার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন অনার কিলিং’ এর ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য চলতি বছর অস্কারজয়ী পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নির্মাতা শারমিন ওবায়েদ চিনয়। তিনি বলেন, “বেলুচ হত্যাকান্ডকে পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতার ‘মহামারী’র এক উপসর্গ বলা যায়। এই হত্যাকান্ড নারীরা নিজেকে আরও নিরাপত্তাহীন ভাবা শুরু করবেন।“ লক্ষ্যণীয় বিষয় হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সম্মান হত্যাকান্ডটিকে (পাকিস্তানে স্থানীয়ভাবে “কারোকারি” নামে পরিচিত) পাকিস্তানসহ বিশ্বের নানা দেশের মুসলিম নর-নারী সমর্থন দেন এবং করণীয় হিসেবে দাবি করেন।
সম্মান হত্যাকান্ড এমন একটি ঘটনা যা দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পাশ্চাত্য়ের বিভিন্ন দেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে। অপমান, অত্যাচার ও হত্যার মাধ্যমে কিভাবে গোত্রের কিংবা পরিবারের সম্মান পুণরায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তার উত্তর সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা খুজে পাননি। এ ধরণের হত্যাকান্ড বন্ধ করতে সবার আগে স্বামীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনও আবশ্যক। তাছাড়া সমাজ অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নিয়ম নীতির সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজনীয়তাও এক্ষেত্রে অপরিসীম। সামন্তবাদী সামাজিক কিংবা গোষ্ঠিগত পরিবেশে সম্মান হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয় যেখানে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সম্মান হত্যাকান্ডগুলো খুবই কম আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই সম্মান ভিত্তিক হত্যাকান্ড নিরসনে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি চাই শিক্ষার প্রসার, সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
সম্মান হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় অবৈধতা যা Honor Killing কে উতসাহিত করে।
“লক্ষ্যণীয় বিষয় হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সম্মান হত্যাকান্ডটিকে (পাকিস্তানে স্থানীয়ভাবে “কারোকারি” নামে পরিচিত) পাকিস্তানসহ বিশ্বের নানা দেশের মুসলিম নর-নারী সমর্থন দেন এবং করণীয় হিসেবে দাবি করেন।”
আশংকার জায়গা এটিই।আইনটি মধ্যযুগীয় এবং চরমতম বর্বর তা বলাই বাহুল্য।এ আইনে নারীকে সামাজিক জীবনের অংশীদারতো দূরের কথা পোষা পশুরও মর্যাদা দেয়া হয়নি।মানুষ অরণ্যচারী জীবন থেকে প্রগতির সিড়ি বেয়ে বেয়ে এমন এক স্তরে এসে পৌঁছেছে যখন তার ব্যাপ্তি মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।কিন্তু নারী নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে হয় সেই বহু পুরনো বহু জীর্ণ স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে।আবার সেই আদিম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সাথে নারীও যখন সমর্থনের আওয়াজ তোলে তখন এতে একদিকে যেমন হতাশ হই সেসাথে এটাও উপলব্ধি করতে পারি যুগ যুগ ধরে শৃংখলিত এইসব নারী শৃংখলকেই মনে করছে নারীত্বের ভূষণ রুপে।কোড়া শিকারীগণ তাদের শিকার ধরেন পোষা কোড়া দিয়ে।পোষা হাতি দিয়ে খেদায় আটকানো বন্য হাতিকে পোষ মানানো হয়।পাকিস্তানী মডেল হত্যাকে যেসব নারী সমর্থন করেন তারা পোষ মানা কোড়া বা হাতি ছাড়া কিছু না।এমনকি ইদানীং যেসকল নারী জঙ্গী তৎপরতায় লিপ্ত থেকে সমাজের অন্য নারীদের মাঝে এর বিস্তারের চেষ্টা করছেন তাকেও পোষা হাতি দ্বারা খেদায় বন্দী হাতিকে পোষ মানানোর প্রচেষ্টার সাথে তূলনা করা যায়।তাই এসব বর্বর প্রথাকে উৎখাত করতে হলে বিশাল ঝাঁকুনির প্রয়োজন।আর এই ঝাঁকুনির ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য এ ধরণের লেখালেখি খুবই প্রয়োজন।বিষয়টির উপর আলোকপাত করার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখি যারা চরিত্রহীন তারই সন্মানের কথা বেশি বলে I প্রতিটা মানুষের ভাললাগা ,মনন আলাদা I আমাকে যা ভাল লাগে অন্যকে তা নাও ভাল লাগতে পারে I তাই তাকে খুন করা মানবতার খুন নয় কি ?আর সর্বপরি 1400 বছর আগের একটা বর্বর ,মূর্খ ,কামুক লোকের চিন্তানিয়ে থাকা অসম্ভব I মানুষ এই পচা মতবাদ ত্যাগ করে এগিয়ে যাচ্ছে এদের মতবাদ হেরে যাচ্ছে তাই এই কর্ম I জীবন জয়ী হচ্ছে তাই এই হত্যা I
আগে পড়ে যাচাই করুন। আসলেই কি এই সম্মান হত্যা ইসলামে আছে নাকি নাই? যদি থাকে তাহলে আপনার মূল্যবান বক্তব্য পেশ করুন।