“সবার কাছে প্রিয় হওয়ার লোভ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি।”-ড. আহমদ শরীফ
সময়টি ছিল ৯২-্এর অক্টোবর মাস। ২২ অক্টোবর ডানপন্থী পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবের মাধ্যমে বাজারে রটে যায়, ২১ অক্টোবর ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র এক সেমিনারে আহমদ শরীফ বলেন, “ইসলাম টিকে আছে ইতরদের মধ্যে।” এই কথাটাকে উদ্ধৃত করে জামাত উন্মত্তের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন বদরুদ্দীন উমর! তিনি দৈনিক আজকের কাগজে ‘নাস্তিকতার আস্ফালন’ নামে একখানা লেখা লিখে ফেললেন। আহমদ শরীফের শাস্তির দাবীতে জামাতসহ প্রতিটি ইসলামিক দল রাস্তায় নেমে আসে। নিজামীর নেতৃত্বে জামাত সংসদে ওয়াক আউট করে। সংসদে নিজামী বক্তব্য দেওয়ার সময় বদরুদ্দীন উমরের লেখার কথা উল্লেখ করে আহমদ শরীফের শাস্তি দাবী করে। শোনা যায়, জামাত-শিবির বদরুদ্দীন উমরের লেখাটি নাকি সংসদেও জমা দেয়। বদরুদ্দীন উমর নাস্তিকতার বিরুদ্ধে কিংবা আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে লেখার অধিকার রাখেন না, কিংবা তিনি প্রতিক্রিয়াশীল এমনটি বলার যৌক্তিকতা নেই। তবে সময় জ্ঞান বিচারে কোন লেখা কখন লিখতে হবে এই বিবেচনা বোধ একজন বুদ্ধিজীবীর বা বামতাত্ত্বিকের কাছে আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। বদরুদ্দীন উমরের লেখা তৎকালীন সময়ে যে ডানপন্থীদের আগুনে ঘি হিসেবে কাজ করেছে তা বললে অন্যায় হবে না। সে সময় আহমদ শরীফের বাড়িতে ইসলামপন্থীরা বোমা নিক্ষেপ করে। সৌভাগ্যবশত কেউ আহত হয়নি। বদরুদ্দীন উমর হয়তো ডানপন্থীদের খুশি করার জন্যে লেখাটি লেখেননি কিন্তু ওনার লেখার কারণে আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের আন্দোলন ও হুংকার আরও উস্কে দেয়। যেমনটি আমরা দেখেছি অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার পর। নাস্তিকরা যখন হত্যার শিকার হচ্ছে তখন এই হত্যাকে থামানোর চাইতে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মাথাব্যথা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনলাইনের নাস্তিকতা। কোন সময়ে কোন লেখা কোন বক্তব্য মৌলবাদীদের উৎসাহিত করে কিংবা তাদের হত্যা, আক্রমণের বৈধতা দান করে এই বোধটুকু বুদ্ধিজীবীদের থেকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করে। যদিও বেশির ভাগ সময় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয় না। যেমন-হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার ৪ বছর পর ১৮ জুলাই, ২০০৮ এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ; হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণকে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
“:বাংলাদেশের লেখকরা কী স্বাধীন?
-হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন।
:তাহলে ড. হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেন?
– কারণ যে বইটি (পাকসার জমিন সাদবাদ) তিনি লিখেছেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জনে মৌলবাদী হতে হয় না।” (সূত্র-দৈনিক সমকালের প্রকাশিত হুমায়ূন আহমদের সাক্ষাৎকার)
আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে জামাত ও ইসলামপন্থীদের রাজনীতির ইতিহাস বোঝার জন্যে সবার আগে সেই সময়টি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। সময়টি ১৯৯২ সাল, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে; জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত করে গোলাম আজমের বিচারের আন্দোলন, ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা ও উত্তেজনা, স্বৈরাচার বিদায়ের পর বিএনপির ক্ষমতার এক বছর, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে যখন রাজনৈতিক আঁতাত স্পষ্ট, ঠিক সেই সময় আহমদ শরীফের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জামাত ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাঠে নেমে পড়ে। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আহমদ শরীফ জাহানারা ইমামের গণ-আদালতের একজন বিচারক ছিলেন। এবং তৎকালীন সরকার গণ-আদালতের যাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে তাদের মধ্যে আহমদ শরীফের নামটিও ছিল। যদিও আহমদ শরীফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী বিরোধী দলের শিক্ষক ছিলেন। যারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করে না তাদের অনেকে গণ-আদালতে সম্পৃক্ত ছিলেন। আওয়ামী-বিএনপির রাজনৈতিক যুদ্ধে আহমদ শরীফের মতন যারা আওয়ামী লীগ সমর্থক নন তারা গণ-আদালত ও নির্মূল কিমটি থেকে ছিটকে যান।
জামাতের সহযোগিতায় অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলো জাহানারা ইমামের গণআদালতের মতন হুংকার দেয়, সরকার যদি আহমদ শরীফের বিচার না করে তাহলে ইসলামপন্থীরা গণআদালতে আহমদ শরীফের বিচার করবে। তবে তৎকালীন পত্রিকা ঘাঁটলে স্পষ্ট হয় যে, সেই সময় এসব ডানপন্থী বা ইসলামপন্থী দলগুলোর সংবাদ পত্রিকার পাতায় ছোট্ট একটি কলামে প্রকাশ হতো। বেশির ভাগ সময় তাদের কর্মসূচী গুরুত্বহীন পাতায় ছাপা হতো। যাদের অবস্থান একসময় পত্রিকার গুরুত্বহীন পাতায় স্থান পেত, তারাই এখন পত্রিকার পাতার হেড লাইন হচ্ছে। তাদের হুংকার ধমকিগুলো পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পাতায় ছাপা হচ্ছে। এই অবস্থানের মাধ্যমে আমরা তাদের অবস্থান ও শক্তি সম্পর্কেও ধারণা পাচ্ছি।
দৈনিক ইনকিলাব সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। স্বভাবসুলভ আচরণে বাবরি মসজিদের সময় পত্রিকাটি সংবাদ প্রকাশ করে-বাবরি মসজিদ ঘটনায় ঢাকার হিন্দুদের মিষ্টি বিতরণ! এই সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকায় হিন্দু পাড়াগুলোতে হামলা ও অগ্নি সংযোগ চলে। পরের দিন তারা এই ভুল সংবাদের জন্যে ক্ষমা চায়। যে উদ্দেশ্যে তারা এই খবর ছেপেছে তা ঐ রাতেই সম্পন্ন হয়েছে। “স্বদেশ চিন্তা সংঘ” এর সেমিনারের সংবাদ তৎকালীন প্রতিটি সংবাদ পত্র প্রকাশ করে। একমাত্র ইনকিলাব একটি উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে আহমদ শরীফের এক লাইনের এই বক্তব্যে কোট করে প্রকাশ করে। এর পেছনের উদ্দেশ্য পুরোটাই রাজনৈতিক। একই চিত্র আমরা দেখেছি, ২০১৩ সালে গণজাগরণ হওয়ার পর। গণজাগরণের পর ‘আমাদের দেশ’ পত্রিকা ব্লগারদের কিছু লেখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ছাপে। আর সেই ছাপার ভিত্তিতে নাস্তিকদের ফাঁসির দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে হেফাজত ইসলামের নেতৃত্বে ইসলামপন্থীরা। যার পেছনে নলকাঠি নাড়াচ্ছিল জামাতসহ অন্যরা।
নাস্তিকদের বিচারের দাবীতে যখন ইসলামপন্থীরা রাস্তায় নামে তারা নাস্তিকদের বিচারের পাশাপাশি আহমদিয়া মুসলিম গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার দাবীটিও সামনে নিয়ে আসে। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ এবং ২০১৩ সালে ব্লগারদের বিচার ও ফাঁসির দাবীতে একই চিত্র দেখা যায়। ২০১৩ সালে হেফাজতের ১৩ দফার ৬ নম্বর দাবীটি ছিল আহমদিয়া (অপমানজনক শব্দ হিসেবে কাদিয়ানী বলা হয়) গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের মতন রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। এই দাবীটি ১৯৯২ সালে খতমে নবুয়ত এই দাবী তোলে। খতমে নবুয়ত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে আহমদিয়াদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হামলা, নির্যাতন ও সুন্নি ইসলামে ধর্মান্তরিত করে আসছে। নাস্তিকতার সাথে আহমদিয়াদের সম্পর্কটি আসলে কোথায় তা এসব উগ্রবাদী ইসলামপন্থীরাই ভাল জানেন।
২৪ অক্টোবর ১৯৯২-দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংগঠন ও দলের অবস্থান:
তৎকালীন জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান আহমদ শরীফের শাস্তি দাবী করে (২৩ অক্টোবর) বলেন, কতিপয় মুখচেনা ব্যক্তি মাঝে মধ্যে এই দেশের জনগণের আকিদা, ইমান পরিপন্থী বক্তব্য প্রদান করে পরিবেশ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উল্টো এসব লোকদের একুশে পদক স্বাধীনতা পদক প্রদান করে ইসলাম বিরোধী কাজ উৎসাহিত করা হয়।ভবিষ্যতে যেন এমন কোন বক্তব্য কেউ দিতে সাহস না পায় তার জন্যে আহমদ শরীফের শাস্তি দাবী করে–ইত্তেফাক।
সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ. কে. এম নূরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন-ড. আহমদ শরীফ মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়েছে তা সাংবিধানিকভাবে অবশ্যই বিচারযোগ্য। তিনি আশা করেন সরকার তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন।
দাওয়াতী ইসলামী প্রধান ও বদরপুরের পীর মাওলানা আব্দুর রব আহমদ শরীফের ফাঁসি দাবী করে বলেন-তাহার মতন খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে।
১২ জন আলেম এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসলাম ত্যাগের কারণে আবার মুসলমান হইয়া তওবা করার জন্যে ড. আহমদ শরীফের প্রতি আহবান জানাইয়া বলেন, অন্যথায় তাহাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- মাও: এ কিউ এম সিফাতুল্লাহ, জয়নাল আবেদীন, হাফেজ মহবুবুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
কাছেমাবাদ দরবার শরীফের পীর ও আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মুসলেমীনের সভাপতি মাওলানা আ. ক. ম ওয়াহিদ ড. আহমদ শরীফের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাইয়া তাহার কঠোর বিচারের ব্যবস্থা কতিতে সরকারের প্রতি দাবী জানায়। বাদ আসর বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট থেকে ইসলাম শাসনতন্ত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাহার উদ্যোগে এক প্রতিবাদ মিছিল বাহির করা হয়। পরে প্রেস ক্লাবের সামনে কঠোর শাস্তি দাবী করা হয়। বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার মোঃ কোরবান আলী, বরগুনার পীর মাও: আব্দুর রশীদ প্রমুখ।
এছাড়া; জাগপার সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান জাতীয় ওলাম পার্টির সভাপতি আলহ্বাজ মাওলানা আনিসুর রহমানসহ অন্যান্য নেতা, জাতীয় জনতা পার্টির নেতা মুজিবুর রহমান হিরুসহ অন্যান্য নেতা, হিযবুল ফালাহ’র আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন ও দপ্তর সম্পাদক মাওলানা ফারুক আল মামুন, আহলে সুন্নত ওরাল জামাতের আলহাজ্ব মাও: বাকী বিল্লাহ, ইসলামী যুব সেনার কাজী সাইফুদ্দিন হোসেন, জাতীয় ছাত্র সমিতির মাহমুদ্দুজ্জামানসহ ২১ জন ছাত্রনেতা, ডেমোক্রেটিক লীগের (ছাত্তার-পাঠান) সভাপতি আ: ছাত্তার পাঠানসহ অন্যান্য নেতা, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মওলানা আ: সাত্তার ও যুগ্ম-সম্পাদক এডভোকেট ওবর আলী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা নেতা শামসুদ্দিন ভুঁইয়া ও আলী হোসেন কাজল, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে হেফাজতে ইসলামের আলহাজ্ব মাও: আবদুল আউয়াল, ইসলামিক লেবার অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান আশরাফউদ্দিন আহমদ মুজাহিদ ও সেক্রেটারি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার মোঃ: ইসতিয়াজ আলম, তাহরিক-ই-খেলাফতের নেতা জেহাদি হুজুর, বরিশালের মূলাদী থানার সমাজকল্যাণ পরিষদ ও ইসলামী পাঠাগারের সভাপতি মাও: মু: ইসমাইল হোসেন সিরাজীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের শেখ আনসার আলী এমপি ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ খান, ইত্তেহাদুল উম্মাহ’র মাওলানা মীর ফজলুর রহমান ও মাও: এ কে এম শামসুদ্দিন, ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টির এডভোকেট মোঃ: হাবিবুউল্লাহ চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতা ফকিরাপুলের ব্যবসায়ী আবদুল বাছেত মুন্সীসহ আরামবাগ ও মতিঝিল কলোনির এলাকার বিভিন্ন স্তরের ২৪ জন লোক, ওলামা পরিষদের সভাপতি আমীনুল ইসলাম ও সেক্রেটারি মাও: মাছুম হেলানী, দি ভোরাম অব ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড আর্কিটেক্টর সভাপতি প্রকৌশলী কাজী আবুল হাসনাত ও সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ: শহীদ খাজা হাসান এবং ফরিদাবাদ মাদ্রাসার শিক্ষক নুতিউর রহমানসহ এই লাইনের ১৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি গতকাল পৃথক-পৃথক সভা, সমাবেশে ও বিবৃতিতে ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির উপর আঘাতের জন্যে আহমদ শরীফের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেন। কেউ কেউ তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার কেউবা ফাঁসীর দাবী জানায়। এছাড়া সিলেটসহ সারাদেশে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে মিছিল সমাবেশ করে শাস্তির দাবী তোলে।
বক্তব্যটি বিকৃতি করে প্রচার করা হয়েছে:
লেখক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ ১৬ জন (দৈনিক বাংলা)/ ১৮ জন (ইত্তেফাক) বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, দৈনিক ইনকিলাব চিরায়ত স্বভাব অনুযায়ী বক্তব্য বিকৃতি করে প্রচার করেছে। তারা বলেন- গত বুধবার স্বদেশ চিন্তা-সংঘের সেমিনারে ড. আহমদ শরীফ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কোন কটূক্তি করেননি। পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় ঐ সেমিনার সম্পর্কিত খবর পড়লেই এ কথার সত্যতা প্রমাণ হবে। বিবৃতি-দাতারা হচ্ছেন-বশীর আল হেলাল, অধ্যাপক মনসুর মুসা, ড. সাঈদ উর রহমান, অধ্যাপক আবুল কাশেম, ফজলুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আবদুল মতিন খান, ড. নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, আজিজ মেহের, আব্দুল মান্না, শফিকুল হক স্বপন, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ, খ ম আব্দুল আউয়াল, কল্লোল রায়, ও ইসরাইল খান। সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় সদস্য নাজমুল হোসেন এক প্রতিবাদে বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্যেই ড. আহমদ শরীফের বক্তব্যকে বিকৃত করে ছাপা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য অন্য কোন সংবাদ পত্রে এই বিকৃত বক্তব্যটি পরিবেশিত হয়নি। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হাসান আজিজুল হক ও সাধারণ সম্পাদক আনু মুহাম্মদ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, যে বক্তব্যকে বিকৃতি করে ছাপিয়ে এবং যে বক্তব্যের রেশ ধরে সারাদেশে সন্ত্রাসী আবহওয়া তৈরি করা হয়েছে। ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটছে তাতে এটি যে একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত তা খুব স্পষ্ট। উক্ত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ৭১-এর ঘাতক দালালসহ জামাত-শিবিরের মতন অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শক্তিসমূহ ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টায় নেমেছে। সারাদেশে ঘাতক-দালাল ও জামাত-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যে যে এই অপচেষ্টা তাকে কোন সন্দেহ নেই।
সংসদে জামাতের ওয়াক আউট:
২৫ অক্টোবর জামাত সংসদে ওয়াক আউট করে। প্রফেসর ড. আহমদ শরীফের “ধর্ম ও ইসলাম বিরোধী” বক্তব্যের উপর সংসদে মুলতবী প্রস্তাব গ্রহণে স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী অসম্মতি জানাইলে নিজামীর নেতৃত্বে ১৬ জন জামাতে এমপি ওয়াক আউট করে। সংসদে নিজামী নিজের বক্তব্যে আজকের কাগজে বদরুদ্দীন ওমরের লেখায়- ‘ধর্ম বিরোধী নাস্তিকতাবাদের হাতে বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব প্রদান করা করার যে আহবান’ উল্লেখ করে আহমদ শরীফের অবস্থা দাউদ হায়দার ও সালমান রুশদির মতন হতে পারে বলে হুশিয়ার উচ্চারণ করে। সে সময় তার বক্তব্যের সমালোচনা করেন সুরঞ্জিত সেন-গুপ্তসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য প্রতিবাদ জানায়।
শিক্ষকদের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান:
আহমদ শরীফ যেন ক্ষমা প্রার্থনা করে তার জন্যে ১২২ জন শিক্ষক বিবৃতি প্রদান করে। এই শিক্ষকরা কিছু উপদেশ প্রদান করে আহমদ শরীফকে তাদের লাইনে আসার অনুরোধ জানান। তবে একই সময়ে ১৩০ জন তরুণ লেখক শিল্পী সাংবাদিক আহমদ শরীফের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, আহমদ শরীফের বক্তব্য বিকৃতি করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ইসলামপন্থীদের গণআদালত গঠন করে আহমদ শরীফের বিচারের হুমকি:
গণআদালত করে আহমদ শরীফের বিচার করবে বলে হুমকি দেয় ইসলামিক দলগুলো। জাহানারা ইমামের গণআদালতের ন্যায় তারাও গণআদালত করবে। ২০১৩ সালে শাহবাগের পর যেমন নাস্তিক ইস্যু সামনে চলে আসছে ঠিক তেমনি সেই সময় আহমদ শরীফের নাস্তিকতা সামনে নিয়ে আসে ইসলামিক দলগুলো। সমাবেশে তারা ঘোষণা দেয় তারা কোন নাস্তিকের জানাজা পড়াবে না।
আহমদিয়াদের অফিসে হামলা:
খতমে নবুয়ুত আহমদ শরীফের শাস্তির পাশাপাশি আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার দাবী জানায়। ৩০ নভেম্বর ১১৯৯২ সালে বকশি বাজারের আহমদিয়া জামাত অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালায় এতে আহত হয় ১২ জন।
তৎকালীন লেখক শিবির আহমদ শরীফের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি দান করে। যদিও ছফার ভাষায় বর্তমান লেখক শিবির বদরুদ্দীন উমরের ভ্যানেটি রক্ষা ছাড়া কিছুই না। ছফা একটি সাক্ষাৎকারে ষ্পষ্টভাবে বলেন, পাকিস্তান আমলে বদরুদ্দীন ওমর ‘লেখক শিবিরের’ বিরোধিতা করেছিলেন, ৭১ এ বদরুদ্দীন ওমরের অবস্থান স্পষ্ট ছিল না। বদরুদ্দীন ওমর ১৯৯২ সালে বুঝে কিংবা না বুঝে আগুনে ঘি ঢাললেও ১৯৯৪ সালে তিনি আবার ব্লাসফেমি এ্যাক্ট প্রবর্তনের চক্রান্ত প্রতিহতের জন্যে যে মিছিল লেখক শিবির বের করে তাতে বদরুদ্দীন ওমর অংশগ্রহণ করেন। নাস্তিকতার আস্ফালন লিখেও তিনি আহমদ শরীফের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারতেন। কিন্তু আহমদ শরীফের পক্ষে তিনি নিরব অবস্থানে ছিলেন। বদরুদ্দীন ওমরের এমন অবস্থান পরিবর্তন সম্ভবত ওনার কিছুটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যেমন- রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক করা রিট আবেদন করেন। বর্তমানে তাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন বেঁচে আছেন-অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ২০১৬ সালে সেই রিট শুনানি আবার হাইকোর্টে উঠলে সেখানে একমাত্র বদরুদ্দীন ওমর-ই নিজের নাম সরিয়ে নেন এবং পত্রিকায় বিবৃতি দান করেন।
আহমদ শরীফ রাজনীতি-সচেতন মানুষ ছিলেন। বামপন্থী মার্ক্সবাদী রাজনীতির ওপরে তাঁর আস্থা ছিল। তবে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন মুক্তমনা মানুষ, কাউকে কখন অন্ধভাবে পীর মানেননি। নাস্তিকতা সমর্পকে তিনি বলেন-“নাস্তিক্য কোন নতুন তত্ত্ব নয়,-সুপ্রাচীন, সবাই বলে সব কিছুরই স্রষ্টা আছে, গাড়ি-বাড়ির, জামা-কাপড়ের, বই-পত্রের যেমন নির্মাতা আছে, তেমনি জগতেরও স্রষ্টা থাকার কথা। এ কথাগুলো যুক্তিগর্ভ। কিন্তু তারা স্রষ্টাকে স্বয়ম্ভূ বলে। বিজ্ঞান বলে- সবকিছু একাধিক উপাদানে গঠিত। তাই যদি হয়, স্বয়ম্ভূ স্রষ্টায় সম্ভবত একাধিক উপাদানের সমষ্টি। তা হলে তার আগেও কিছু উপাদান ছিল, তা ছাড়া খালি-খোলা স্থান ও কাল পরিসরও ছিল নইলে স্রষ্টার স্ব হওয়ার ঠাঁই মিলত কোথায়! স্রষ্টার অস্তিত্ব লাভের আগেই যদি স্বয়ম্ভূ হবার প্রতিবেশ স্বয়ং তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কিছুরও স্বয়ম্ভূ হবার পথে বাধা কি! কাজেই স্রষ্টা তত্ত্ব টেকে না ”
যখন তসলিমা নাসরিনের পক্ষে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে কেউ নেই, সেদিনও স্যার ব্যক্তিগতভাবে তসলিমা নাসরিনের খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং বক্তব্য-বিবৃতিও দিয়েছেন।
১৯৯১-৯২ সালে সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের জন্য সাংবাদিক বিপ্লব পাল ড. আহমদ শরীফের একটি সাক্ষাতকার নেন। সেখানে বিপ্লব পাল জানতে চান; পশ্চিমবাংলার বাম নেতা আজিজুল হককে উদ্ধৃত করে আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কী ধর্মহীনতা? ধর্মের উৎখাত? জবাবে তিনি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছিলেন: তা কেনো হবে? আমি তোমাকে পছন্দ করছি না, তাই বলে কী তোমাকে চড় লাগিয়ে দিতে হবে?
তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, যাকে নিয়ে এতো রাজনীতি এতো আন্দোলন সেই ড. আহমদ শরীফ তার বক্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে কোন বিবৃতি পত্রিকায় দেননি (কিংবা আমার চোখে পড়েনি)। ১৯৯২ সালে মৌলবাদীরা সমাবেশে ঘোষণা করে, তারা আহমদ শরীফসহ কোন নাস্তিকের জানাজা পড়াবেন না। আহমদ শরীফও ধর্মীয় নেতাদের জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করেননি। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ শ্রদ্ধেয় মুরতাদ আহমদ শরীফ স্যার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি লিখে যান- আমার মৃত দেহ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের গবেষণার জন্য দান করবেন। মরণোত্তর দেহ দান করার দলিলে স্পষ্ট করে লিখে দেন-“আমার জানাজার প্রয়োজন নেই”।
শুধু খোদাদ্রোহী আহমদ শরীফই নন, প্রগতিশীল খোদা প্রেমী লেখকরাও ধর্মবাদীদের হাতে নাজেহাল হয়েছে। যেমন মীর মশাররফের গো-জীবন পবন্ধের ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদ তো করেইছে, ধর্মসভা ডেকে মীর মশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে কাফের ও তার স্ত্রী হারাম জারি করে। এছাড়া ধর্মবাদীদের হাতে আবুল হুসেনের অপমানিত এবং নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস আমাদের কারো অজানা নয়।
যে মানুষটিকে নিয়ে এতো কিছু সেই মানুষটি কখনো ধর্মীয় উন্মাদদের কাছে মাথা নত করেননি। জীবনের ভয়ে কিংবা ইহলোকিক কোন স্বার্থে নিজের অবস্থান থেকে দূরে সরে যাননি। লেখাটির শ্রদ্ধেয় মুরতাদ আহমদ শরীফের উক্তি দিয়েই শেষ করতে চাই-
“আমি সারাজীবন মোসাহেবি করে তোয়াজ-তোষামোদ-খোসামোদ করে, তদবির করে অপরের কৃপায় করুণায় তকদির তৈরির বা বদলানোর পন্থা মাত্রকেই ঘৃণা করেছি। বরং ক্ষতি স্বীকারের শক্তি অর্জনে ও রক্ষণে ছিলাম সদা সচেতন। তাই কোথাও কোন কৃপা-প্রসূন পদ-পদবি ছাড়াই আজো নিশ্চিত নিদ্রার, নিশ্চিত মনের অভীক চিত্তের অধিকারী হয়ে টিকে রয়েছি। তৃপ্ত-তুষ্ট-হৃষ্ট ও পুষ্ট হয়ে নিজের নীতি-আদর্শের মতে পথে সিদ্ধান্তে স্বাতন্ত্র্য রেখেও শরীরের অসুস্থতা নিয়েও সুখানন্দে আমার দিন কাটছে। পড়া-লেখা-আড্ডা আমার নিত্যদিনের কাজ।নাস্তিক বলে মৃত্যুভয়ও নেই” । – আহমদ শরীফ
সহায়তায়-
আহমদ শরীফ: এক দুর্বিনীত সক্রেটিসের প্রতিকৃতি
পত্রিকার কপির ঋণ স্বীকার: PID, Ministry of Information
মন্তব্য…এমন গবেষণা মূলক লেখা অারো চাই। লেখাটা চমৎকার হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ।
লেখাটি পড়ে বেশ প্রিত হলাম।ধন্যবাদ লেখককে।
ভালো লাগলো লেখাটা। বদরুদ্দীন উমরের লেখাটাও পড়ে দেখার ইচ্ছে রইলো। পরিবর্তিত সময়কে অনেক বিদ্বানই বুঝে উঠতে পারেননা। নিজের সময়কালটা পেরিয়ে গেলে দেখা যায় তাদের পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত সমাজে প্রগতিশীলতার পরিবর্তে বিপরীত পক্ষের শক্তি হয়ে ওঠে।
আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি কিন্তু মূল জায়গাগুলো এড়িয়ে গেলেন। উনি প্রফেসর আহমদ শরীফ স্যারের সমালোচনা করেছিলেন।কেন সেই প্রসঙ্গটি আনলেন না?
আপনার মত হয়ত দীর্ঘ বাম রাজনীতির অভিজ্ঞতা আমার নেই। কিন্ত আমিও নিজেকে একজন বামঘেঁষা এনার্কিস্ট হিসেবে মনে করি। সেই হিসেবে বামপন্থীদের একটা বিরাট অংশকে যখন সবকিছুকে সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদ দিয়ে বিচার করতে দেখি তখন কিছুটা হতাশ হই। ধর্ম একটা সম্পূর্ণ আলাদা এন্টিটি ,এই জিনিসটুকোই যদি উনারা একটু ধারণ করতেন তাহলেই অনেক বিষয় ক্লিয়ার হত। অনেক বিভ্রান্তির আর অবকাশ থাকত না।
আর দ্বিতীয়ত উনার ত্যাগ বা আপোসহীনতা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। এই ব্যাপারে আমি কিছু বলিওনি। আর আমি উনার কলাম অনেকদিন ধরেই ফলো করতাম। তবে প্রায় সবকিছুর মধ্যেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে খুঁজে পাওয়ার যে এক প্রবণতা তার জন্য এক পর্যায়ে এসে বিরক্তিই লাগত। যাক এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে তাই আর কথা বাড়াচ্ছি না । ভাল থাকবেন।
বদরুদ্দিন উমর তখনো বদ উমরই ছিলেন। দূর্ভাগ্য এই লোকটি বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক বামপন্থী কর্মীদের কাছে একজন আইকন।
সম্প্রতিকালে তার নানা উস্কানিমূলক লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে বামপন্থীদের হৃদয়ে যথেষ্ট রক্তক্ষরণ হয়েছে। অথচ তার এধরণের দ্বিচারিতা নতুন কিছু নয়।
আর দেশের স্বাধীনতার সময় তার রহস্যজনক আচরণের একটি কারণ হতে পারে তার পিতৃপরিচয়।
তার পিতা আবুল হাশিম পাকিস্তান আন্দোলনের একেবারে প্রথম সারির নেতা ছিলেন। সবকিছুতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ভারত বিরোধিতাকে টেনে আনার এটাও হয়ত একটা কারণ।
মান্যবর বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক ভূমিকা এবং ভাষা আন্দোলন ছাড়াও অন্যান্য লেখার সাথে পরিচয় না থাকলে যা হবার তাই হবে, অর্থাৎ তিনি বদরুদ্দীন উমর থেকে বদ উমর হয়ে যাবেন। এ ধরণের সিদ্ধান্ত টানা খুব সহজ, পেয়েছি অতীত থেকে। স্তুতি; অথবা, অভিশাপ যেখানে সহজলভ্য, সেখানে অবলোকনের খুব একটা দরকার হয় না। মূলতঃ আমরা নিন্দা করি, বিশ্বাসীদের; কিন্তু ভুলে যাই, আমরা নিজেরাও আচরণ করছি, বিশ্বাসীদের মতই , অর্থাৎ ১০০% ভাল; অথবা, খারাপ। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সবকিছুই চূড়ান্ত হতে হবে। অথচ বাঙ্গালের আগমন , যে বঙ্গী থেকে , সেই বাঁক বাহকের দুলকি চাল , অর্থাৎ দ্বন্দ্বময়য়তাই আমরা গেলাম ভুলে। কী আর করা?
বলছিলাম মান্যবর বদরুদ্দীন উমরের কথা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের সাথে কাজ করর সুবাদে খুব কাছ থেকেই দেখেছি, জেনেছি উনাকে। কখনও আপোষকামী , সুবিধাবাদী বলে মনে হয়নি। কিন্তু সব বিষয়েই যে একমত হতে পেরেছি, তা নয় । মূল জায়গায়, আমার ভাব-ভক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। সেটুকু বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে, এখনও আছে।
শুধু উনি নন, ঐ সময়ে ছাত্র ফেডারেশনের সহ সভাপতি ( খুব সম্ভবত ) সর্দার ফারুক ভাইয়ের সাথেও বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম, তসলিমা নাসরিনের প্রশ্নে। অর্থাৎ শুধু বদরুদ্দীন উমর নন , গণ সংগঠনসমূহের ভূমিকাও ছিল অভিন্ন, অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ আর পুঁজিবাদী সমাজের পার্থক্যটুকু না বুঝলে, সমস্যা হবার কথা, হয়েছিল , হচ্ছে আমাদের দেশে। যে কারণে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও খুব একটা উচ্চবাচ্চ করেন না। তারমানে এই নয়, কেউ করলে সেটা দূষণীয়; হয়ত বাস্তব সম্মত নয়, এইটুকু বলা যায়; কিন্তু বদ বলা যায় না। বদ বলতে হলে, যেটুকু পথ পাড়ি দেয়া দরকার, তা দিয়েই বলা যায়। বদরুদ্দীন উমর ভুলের ঊর্ধ্ব নন; সুতরাং পূজা নয়, নিন্দা নয়; আসুন যথার্থ আসনে বসিয়ে দেবার আয়োজন করি।
ধন্যবাদ, দরকারী লেখা
যে জাতি তার নিজের কৃতীসন্তানদের সম্মান দিতে জানে না তাদের কপালে আরো অনেক দূর্ভোগ আছে, যার আলামত শুরু হয়েছে ।
তথ্যবহুল লেখা। ধন্যবাদ দাদা।
তখন বাংলাদেশের মোসলমানরা নাস্তিকদের ফাঁসি দাবি করতো সরকারের কাছে। এখন মোসলমনরা নিজেরাই নাস্তিকদের লোকালয়ে প্রকাশ্যে জবাই করে, বাসায় গিয়ে জবাই করে। সরকার তাদের এহেন কর্মে খুশি হয়ে আদর ভালোবাসা করে।
@নীলাঞ্জনা
এর মাধ্যমেই মৌলবাদীদের বর্তমান অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে। এদের খুশি করার জন্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের জমি, মিছিলে পানি সরবরাহ করে। যেসব মৌলবাদী দল পত্রিকার পাতায় জায়গা পেত না তারা আজ হেড লাইন হচ্ছে। আগে সরকারের কাছে বিচার দাবী করতো এখন নিজেরাই নিজস্ব মজলিসে রায় ঘোষণা করে লেখক হত্যায় নেমে পড়ছে।
প্রতি শুক্রবার আড্ডা হতো স্যারের বাসায় । আমি ননী দত্ত ( সাবেক অধ্যাপক নডরডেম কলেজ ) / অজয় দত্তকে ( এই নামে লিখতেন ) , ( প্রকাশ্যে নাজমুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, সাম্যবাদী দল ) অনুরোধ করলাম, আহমদ শরীফ স্যারের বাসায় যেতে । আমার উদ্দেশ্য ছিল, একটা বিবৃতি আদায় । আমি জানতাম, তর্ক করে কারও সাথে পারব না । তাই ননী দত্তের আশ্রয় নেই । উনি রাজী হলেন । হ্যাঁ, প্রায় দুই ঘন্টা বিতর্ক করার পর সবাই রাজী হলেন, একটা বিবৃতি দিতে । বিরুদ্ধ মত ছিল, এখন বিবৃতি দিলে আগুনে ঘি ঢালা হবে । আর ননী দত্তের তর্কের সারবস্তু ছিল, প্রতিরোধ, তা যত ক্ষুদ্র হোক না কেন, শত্রু-র মনে কিছুটা হলেও ভীতি সঞ্চার করবে ।
কার কার সাক্ষর সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম, মনে নেই । আব্দুল মতিন খান, আজিজ মেহেরের সাক্ষর সংগ্রহ করে, মনে আছে, আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম, উনি সাক্ষর দিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন টিএসসিতে । ওখানে ভাষার ঘরোয়া আলোচনা হচ্ছিল, কার কার সাক্ষর সংগ্রহ করেছিলাম, মনে নেই। বেরিয়ে আসার পর দেখা হয়েছিল , বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের কল্লোল দার সাথে । বলার সাথে সাথে সাক্ষর দিয়ে দিলেন । সন্ধ্যার আগেই কোনরকম পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দিয়েছিলাম সেই বিবৃতি । কোন কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, মনে নেই । খুব সম্ভবত আজকের কাগজে শিরোনাম ছিল, এগারজন বুদ্ধিজীবির বিবৃতি ।
আপনার লেখা পড়ে ভুলে যাওয়া নাম এবং পত্রিকার তালিকাটাও পেয়ে গেলাম। সংখ্যার তারতম্যের কারণ, খুব সম্ভবত শুক্রবার সবগুলো পত্রিকায় দিতে পারিনি। পরের দিন অর্থাৎ শনিবারও কিছু কিছু পত্রিকায় দিয়েছিলাম, বোধহয়।
লেখাটা পড়তে গিয়ে অনেককিছু মনে পড়ে গেল। তখন চারদিকে বিপদের ডংকা। তবুও উনি যাবেন, সেমিনারে। আব্দুল মান্নান ভাই ( আইনজীবি, মৃত ) এর সাথে পরামর্শ করে, স্যারের স্কুটারের আগে পিছে আরও দু’টো স্কুটারে, স্যারের অগোচরে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। তাদের উপর নির্দেশ ছিল, স্যারের উপর আঘাত এলে, কোন রকম দ্বিধা না করে, আক্রমণকারীদের যমের ঘরে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করার জন্য। নিজেরাও মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। মান্নান ভাইও ছিলেন, সেই অভিযানে।
@স্বপন মাঝি
আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। অনেক তথ্য জানলাম। 🙂