এক
ভারতবর্ষ মহান দেশ, সকলকে আশ্রয় দেয়, অতীত কাল হতে বহু শরণাগত, ভ্রমণপিয়াসু কিংবা অাক্রমণকারী ভারতে জায়গা পেয়েছে, ভিসা পাই না শুধু একালের অভাগা অামরা, বাংলাদেশীরা। দালালচক্র আর হাইকমিশনের সামনের লাইন পর হয়ে সাড়ে সাত ঘন্টা রোদ আর বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে যখন ভিসা ফর্ম জমা দেয়া গেলো, তখন জানলাম পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যাবে ২০ তারিখের দিকে (জুন)। আতিফের ভাগ্য খারাপ, ভিসা ক্যাম্প কোন কাজে আসলো না। অগত্যা আতিফ কে ছাড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই হলো, জুলাই এর সু’দিন হারানো ঠিক হবে না বিবেচনা করে। শুরুর প্ল্যান ছিল লাদাখ, মূল পরিকল্পনা মানালি-লেহ’র জগদ্বিখ্যাত রাস্তা নেয়ার। প্ল্যান ছিল আতিফের, কোন ট্যুরে আতিফ বা উত্তম থাকলে প্ল্যানিং এর চিন্তা মাথায় আর না রাখলেও চলে। আতিফের অনুপস্থিতিতে আমরা ব্লগ, লোনলি প্ল্যানেট, ট্রিপ এডভাইসর ইত্যাদি দেখে নিজেদের শারীরিক বা অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে একটু একটু সন্দেহ হতে শুরু করলো। বিকল্প প্ল্যান ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স – উত্তরাখন্ড। আমার ভ্রমণ সঙ্গী ডাক্তার তার বন্ধুর মারফত খোঁজ নিয়ে দেখলো ৯-১০ দিন ঐ অঞ্চলে শুধু গাড়ি বাবদ খরচ হবে ৫৫ হাজার রুপি। এদিকে উত্তরাখণ্ডের প্যাকেজ ও ট্রেকিং এর খরচ ও ধকল ভালোই। তার সাথে কোলকাতা থেকে হৃষিকেশ এর ট্রেন ইত্যাদি কোনো কিছু ঠিক করার মতন সময়ও নেই হাতে। ফলে আগের প্ল্যানই ঠিক থাকলো: লাদাখ। দুইটা ওয়েব সাইট খুব কাজের ছিল: ট্রিপ এডভাইসর ফোরাম (https://www.tripadvisor.com/ForumHome) আর ডেভিল অন হুইলস (http://devilonwheels.com/)। এই দুই জায়গাতে শুরু করার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তরই পেয়ে গেলাম। কিছু অনিশ্চয়তা ছিল, সেগুলি না থাকলে ট্যুর মজার হয় না।
প্ল্যান শুরু কলকাতা-ঢাকা রিটার্ন ফ্লাইট দিয়ে। ৩০ জুন বিকেল প্রস্থান ও ১২ জুলাই সকাল প্রত্যাবর্তন। খুঁজে দেখি শ্রীনগর (ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর এর রাজধানী ) এর জন্য কোলকাতা থেকে উড়াল পরের দিন খুব ভোরে, ১০ টা নাগাদ পৌঁছে যাবে। এর আগে বাবা-মার কাছ থেকে শুনেছিলাম জম্মু থেকে বাইরোডেও যাওয়া যায় কিন্তু রাস্তা ভালো না। আর তাতে সময়ও বেশি লাগে। অন্যদিকে মানালি হয়ে গেলে দুটো সমস্যা: এক কোলকাতা থেকে মানালি পৌছতে অতিরিক্ত একদিন সময়ের দরকার উড়ে গেলেও, দুই মানালি – লেহর সুন্দর-ভয়ংকর রাস্তায় চড়াই এত বেশি যে আগে যারা ভ্রমণ করেছেন সবার মতে acclimatization বা পার্বত্য স্থানে অভিযোজনের জন্য মুশকিল। মানালি-লেহর রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে পাঁচশো কিলোমিটার। প্রথম চার ভাগের একভাগ দূরে লাহুলের কেলঙ। এখানেই রাতে থাকতে বলে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা কম থাকার কারণে, কিন্তু এটা করলে পরের দিন ১৭-১৮ ঘন্টা টানা ছুটতে হবে। সব বিবেচনায় শ্রীনগর যাওয়াই ঠিক হলো। রাহুল সাংকৃত্যায়ণও ঐ পথই নিয়েছিলেন। তবে সেটা উড়াল দিয়ে না, সীমান্ত প্রদেশ থেকে কাশ্মীরের দিকে এসেছিলেন। বাংলাদেশীদের অনুমতি নিতে হয় এমন কিছু ঝামেলার কথা শুনেছিলাম, আমরা নিজেরা একবার অরুণাচলের অনুমতি চাইতে গিয়ে পাইনি, এক বন্ধুর কাছে শুনলাম দেখারও তেমন কিছু নেই, উল্টো নাকে রক্ত উঠে যেতে পারে অতি উচ্চতা ও অনার্দ্র আবহাওয়ার কারণে, গুচ্ছের যদি-কিন্তু নিয়েই শুরু করে দিলাম, কোথাও ঠেকে গেলে সাথে সাথে কোলকাতা বা ঢাকা দৌড় দিব এরকম বিকল্প ভেবে নিয়ে।
দুই
কোলকাতা ফ্লাইট ভালোই ছিল, আমার প্রথম কোলকাতা ভ্রমণ। এর আগে শিলিগুড়ি দিয়ে ঢুকেছিলাম, এদিকে আসা হয় নি। মাত্র ৪০ মিনিটের মতন উড়াল। এয়ারপোর্টে নামার আগে নিচটা দেখে মনে হলো, ঢাকার তুলনায় গাছপালা একটু বেশি, বড় কোন নদী চোখে পড়ল না, ঢাকায় তুরাগ-বুড়িগঙ্গা-পদ্মা দেখলাম ফুলে ফেঁপে অস্থির। কোলকাতা এয়ারপোর্ট দারুন, চকচকে নতুন। ব্রিসবেন বা এডিলেইড এয়ারপোর্টের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিদেশী জায়গায় বাংলা লেখা দেখলে ভালোই লাগে। অভিবাসন (immigration) কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাবো, কোথায় থাকবো ইত্যাদি। আমাদের নতুন পাসপোর্টে কান্তজীর মন্দিরের ছবি আছে, ওটা দেখেই বুঝি জিজ্ঞেস করলেন, কান্তজী কোথায়, কোন দিক দিয়ে যেতে হয়? বললাম ঢাকা থেকে ৪০০ কিলোমিটারের মতন দূরে, আপনাদের শিলিগুড়ির দিক থেকে কাছে হয়। ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে এলাম। পরের দিন সকাল ৫ টায় ফ্লাইট। রাতটা ভেবেছিলাম এয়ারপোর্টে বা আসে পাশের হোটেলে কাটিয়ে দিব, মিনু মাসি বাদ সাধলেন। মিনু সোদপুরে থাকে, গুগলে দেখেছিলাম ওখানে যেতে ও ফেরত আসতে বেশ ভালোই সময় দরকার, তাই অনুৎসাহী ছিলাম। মিনু কোনো কথা শুনবে না, বাংলাদেশে আর কোনো দিন না আসার হুমকি-ধামকি দিয়ে আমাদের নিতে চলে এলো তার গাড়ি নিয়ে, এক গাদা খাবার দাবার, সাথে বাপ্পা দা, মিনুর বন্ধু।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই একটা উড়াল সড়ক (ওরা বলে উড়াল পুল), তার পরেই যশোর রোডের শুরু। অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি। আমাদের গন্তব্য বারাসাত, এয়ারপোর্ট থেকে কাছেই। বারাসাতে আমাদের আরেক আত্মীয়ের বাসা। রীনা মাসি, তার দুই ছেলে শুভ্র ও অঙ্কন কে নিয়ে অনেক দিন ধরে আছেন এখানে। শুভ্রর সাথে অনেক দিন যোগাযোগ ছিল না। মধ্যমগ্রাম থেকে ওকে গাড়িতে তুলে নেয়া হলো। বারাসাত জায়গাটা আমাদের আব্দুল্লাহপুর বা টঙ্গীর মতন। স্টপেজে নেমে গেলাম ডলার ভাঙানোর জন্য। দোকানে দেখলাম আরো কয়েকজন বাংলাদেশি, সবুজ পাসপোর্ট, চেহারাও অস্ট্রিক। শুভ্রর একটা বাঁধা রিক্সা আছে, ড্রাইভার এর সাথে সম্পর্ক বেশ। এলাকার ছেলেরা সন্ধ্যায় সময় কাটায় বারে বসে কাবাব-কাটলেট, বিয়ার ইত্যাদিতে। পায়ে টানা রিকশা, তবে বসার জায়গা প্রশস্ত। বারাসাতের মেইন রোডটাই ন্যাশনাল হাইওয়ের অংশ, সোজা গেছে যশোর রোড থেকে বেরিয়ে শিলিগুড়ির দিকে। শুভ্রদের বাড়িটা বেশ ভেতরের দিকে, রাস্তার কোলাহল নেই, আশেপাশের লোকজন যারা বাড়ি করেছে তারাও অবসর প্রাপ্ত সরকারি সরকারি চাকরিজীবী ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু পর অঙ্কন ফিরে এলো, জিজ্ঞেস করে জানলাম, সেই সকালে বের হয়, স্কুল এর পর কোন এক শিক্ষকের বাসায় কোচিং সেরে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা, ঢাকার মতোই অবস্থা। অঙ্কনের লক্ষ্য সাংবাদিক হওয়া শুনে অবশ্য ভালো লাগলো। এখানে ঢাকার ছেলেদের সাথে একটু পৃথক, ঢাকায় সব হতে চায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার।
মিনুর কাছে শুনলাম শ্রীনগরে বাসে বোমা হামলা হয়েছে, আহত-নিহত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের যাওয়া অবশ্য স্থির, যা হবার তা দেখা যাবে। কোলকাতা ফেরার কোন তারিখ বলতে পারলাম না, যদিও মিনু আর বাপ্পা দা মিলে উড়িষ্যাতে দুদিনের প্ল্যান করতে চায় ১০-১১ তারিখের দিকে। সময় কুলাবে বলে মনে হচ্ছিলো না। বাকী রাতটা কেটে গেলো পান-ভোজন ও আড্ডায়, অল্প একটু শুয়ে নিলাম, ভোর সাড়ে তিনটায় গাড়ি হাজির। অল্প সময়ের মধ্যেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। ইন্ডিগোর দিল্লি ফ্লাইট – উড়াল সময় দুই ঘন্টা ১০ মিনিটের মতন। টিকেট ইফতি কেটে দিয়েছিলো, খুব ভাগ্য ভালো যে ওর ক্রেডিট কার্ডের একটা স্ক্যান কপি এনেছিলাম সাথে করে। কিউতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দুই বাংলাদেশীর সাথে পরিচয় হলো, ইভান ও কবীর। তাদেরও গন্তব্য শ্রীনগর, এর পর যেদিকে সুবিধা।
ঘুমের মধ্যে পৌঁছে গেলাম দিল্লি। বিরাট এয়ারপোর্ট। কোলকাতার মতনই চকচকে কিন্তু আকারে দশগুণ হবে।টয়লেটে ছেলে আর মেয়ে বোঝাতে বড় করে ছেলে আর মেয়ের পোস্টার লাগানো। মেয়েটা হিন্দুস্তানি পোশাকে আর ছেলেটা বোড়ো পোশাকে। আরেক জায়গায় রাজস্থানী পুরুষ ও শাড়ি পড়া মেয়ে। খাবার জলের ব্যবস্থা আছে, মিনুর দেয়া সিম কার্ডের কল্যানে মাগনা ওয়াই-ফাই ইন্টারনেটও পাওয়া যাচ্ছিলো। ভ্রমণসঙ্গী ডাক্তারের এক ছোটবোন কোলকাতায় থাকে তার সাথে কথাও হলো। শ্রীনগরের সংযোগের লাইনে দাঁড়াতেই দেখি আমরা কয়েকজন বাঙালি চেহারার বাদ দিলে বেশির ভাগ পাঞ্জাবি আর কাশ্মীরি। সালমান রুশদির কথা মনে পড়ে গেলো। মিডনাইটস চিলড্রেন এর শুরুর দিকের ডাল লেকের শহর সেই শ্রীনগর এর দিকেই যাচ্ছি।
(চলবে)
কলকাতার লেখকদের বিভিন্ন লেখনী পড়ে নাম জানা অথচ অদেখা স্থান গুলোয় ভ্রমনের পিপাসা ইচ্ছেতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হয় শুধু ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার জন্য
ভালো লেখা, যদিও আসল কাহিনী তো এখন শুরু হয়নি। তবে আপনার ঐ অঙ্কন ছেলেটি সত্যিই ব্যতিক্রমী, কেননা পশ্চিম বঙ্গেও ৯০% ছেলেই ডাক্তার ইন্জিনীয়ার হয়ে টাকা কামাতেই চায়, এক্ষেত্রে তাদেরকে ঢাকার ছেলেদের তুলনায় মহত্তর মনে করাটা ঠিক নয়।
দারুন লাগলো পড়তে স্বাক্ষর শতাব্দ। শুরুতেই বেশ মজা পেলাম। কলকাতায় কনফারেন্সে যাবার জন্য দুই দফা ভিসার আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছিলাম ২০১৪ তে। সেনজেন ভিসা ছিলো পাসপোর্টে তাও ভিসা দিলো না দেখে বেক্কল হয়ে গেছিলাম। কলকাতায় যাবো ভেবে খুব এক্সাইটেড লাগছিলো। যাই হোক, আমার আর সামিয়ার খুব ইচ্ছা, সোফিকে নিয়ে একসময় আবার চেষ্টা করতে হবে লাদাখ যাবার। তার আগে আপনার সাথে ঘুরে আসা যাক।
সুন্দর ভ্রমণ-বিবরণ। কতোদিন পর মুক্তমনায় আপনার লেখা পেলাম! এতোদিন পর পর এলে হয়?
ধন্যবাদ পড়ার জন্য, নিয়মিত হবার চেষ্টা থাকবে।
প্রতিবেশী দেশের ভিসা পাওয়া এমন দুঃসাধ্য কেন?
রাহুল সাংকৃত্যায়নের অনেক আগের দেখা লাদাখের সাথে স্বাক্ষর শতাব্দের এখনকার দেখা লাদাখ কেমন — পড়ে দেখি।