লেখকঃ সুমন চৌকিদার

ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে যেমন বহু মহামানব আছে, তেমনি বহু মহাদানবও আছে। অবিশ্বাসীদের মধ্যেও প্রচুর মহামানব আছে, তবে মহাদানব কিংবা পাতিদানব থাকার ঘটনা বিরল। অর্থাৎ যারা ধর্ম পালন করে না, তাদের মধ্যে দানব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু ধার্মিকদের মধ্যে দানবই শুধু নয়, এখন মহাদানবেরও অভাব নেই। এর প্রকৃত কারণ না খুঁজে, বিজ্ঞজনেরা (প্রায় সকলেই) নানা উপদেশ ও পরামর্শের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। তাদের পরামর্শ যে একেবারে ফালতু, তা নয়, তবে মূল কারণ এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন।

ধর্ম যদি এতো ভালো জিনিসিই হবে, তাহলে ধর্মপালনকারীদের মধ্যে একটি দানবও থাকার কথা নয়। অথচ আমরা কী দেখছি? ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মের নামে, যে পরিমাণ ঘৃণা মানুষের মনে (সবাই নয়) সৃষ্টি করা হচ্ছে, এর ১%ও কী অন্য কোন দর্শন বা মতবাদ দ্বারা সৃষ্টি করা সম্ভব? তথাপিও ধর্মই সকলের কাছে কীভাবে যে প্রিয় ও মহান, এ মূর্খের বোধগম্য নয়। সাধারণ ধার্মিক থেকে শুরু করে বিদ্বান ধার্মিকগণ প্রায় সব হত্যাযজ্ঞের পরেই বলেন, এরা ধার্মিক না, এরা ধর্মকে অপব্যবহার করছে… ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে, যে জিনিসের সৃষ্টি হয়েছে অপব্যবহৃত হতে, মানবতা ধ্বংসের জন্য, তা অপব্যবহৃত হবে না তো, কী হবে? যা সত্য, যা খাঁটি তা কখনোই, কোনোভাবেই অপব্যবহার হতে পারে কী? অতএব, কোনো ধার্মিক কখনোই ধর্মকে খারাপ বলে না, যদিও এটিকে ব্যবহারে করেই বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি নারকীয় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। তারা একথাও স্বীকার করতে নারাজ যে, ধর্মের মধ্যেই সন্ত্রাসের বীজ রয়েছে। তাই যদি না-ই হবে, তাহলে কীভাবে ধর্মের নামে, ধর্মের শ্লোগান দিয়ে, এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটে এবং যারা এসব ঘটায় তারা কোনো না কোনো ধার্মিক পিতা-মাতার সন্তান, কোনো না কোনো ধর্মজীবিই তাদের দীক্ষাগুরু। পিতা-মাতা, ধর্মগুরু কিংবা সমাজ যদি তাদের শিশুকালে ভুল ধর্মশিক্ষা না-ই দিতো, তাহলে তারা এতোবড় মাপের দানব হতো কী? হলে, ব্যাখ্যা করুন। শিশুকালে যদি দানবীয় ধর্মশিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে তার কাছ থেকে ভালো ফল পাওয়ার চিন্তা বৃথা। কারণ প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে ধর্মশিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো, extremism বা চরমপন্থা। যেমন, শিশুকালেই গুরুজনেরা (ধর্মশিক্ষকসহ) নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে, বজায় রাখতে, অন্য ধর্মের প্রতি শিশুকে অশ্রদ্ধাশীল করে তোলে। যা কখনোই ভোলা যায় না। অতএব ধর্ম ও ঘৃণা গলাগালি করেই থাকে। তবে ধর্ম পালিত হয় প্রকাশ্যে, পক্ষান্তরে ঘৃণা এবং কট্টোরবাদিতা থাকে নিরবে। যখন কেউ তা উষ্কে দেয়, তখই গুলশান ম্যাসাকারের ন্যায় প্রকাশ পায়, নতুবা নয়।

গুলশান ম্যাসাকারের খবর নিয়ে বাইরে কোনো আলোচনা শুনি না। এ হৃদয়বিদারক ঘটনার পর ইচ্ছে করে এবং অভক্তি, অতি ঘৃণা, অতি দুঃখে-কষ্টে, হতাশায়… টিভি দেখি না। তারপরও যতোটুকু জেনেছি, এসব সন্ত্রাসীরা সব উচ্চ বংশের এবং উচ্চশিক্ষিত (কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)। এর পূর্বের ঘটনাগুলোতেও প্রায় একই শ্রেণির যুবকরা জড়িত ছিলো। এ নিয়ে বিদ্বানদের মুখে অনেক ব্যাখ্যা শুনেছি, পত্রিকায় অনেক কিছু পড়েছি (এখন আর পড়ি না), কারণ “খাড়া বড়ি থোর, থোর বড়ি খাড়া।”গুণিজানেরা প্রধানত এর জন্য দায়ী করছেন, একক পরিবার এবং পিতামাতার ব্যস্ততা/অবহেলা ও উদাসীনতাসহ অনেক কিছু। যা অস্বীকার করি না। তবে মূল যে বিষয়টি সকলেই এড়িয়ে যাচ্ছেন, তাহলে ধর্মশিক্ষা। অর্থাৎ আমাদের ধর্মশিক্ষার মধ্যেই যে সবচেয়ে বড় ভূতটা রয়েছে এর ধারেকাছেও কেউ যাচ্ছেন না। এ ভূতের ব্যাপারে যদি খোলামেলা আলোচনা না-ই করতে পারেন, এ ভূতটাকে যদি প্রকাশ্যে আনতে না-ই পারেন, আপনাদের সব আলোচনাই বৃথা যাবে-ই যাবে। কারণ আপনাদের এতোদিনের আলোচনা যে বৃথা গেছে, তা তো প্রত্যক্ষ করলেনই, ভবিষ্যতে আরো করতে হবে। উচ্চশিক্ষিত ভার্সিটির ছাত্ররা কেনো দলে দলে সন্ত্রাসী হচ্ছে, এ নিয়ে বিজ্ঞজনদের মাথা ব্যাথা বহুদিনের হলেও গোড়ায় হাত দিচ্ছেন না। একজনকে বলতে শুনলাম, “মাদ্রাসাকে দোষ দেয়া হচ্ছে, কই এরা তো মাদ্রাসায় পড়েনি।” এরা মাদ্রাসায় পড়েছে, কি পড়েনি, তার কী জানেন? ১৮-২৮ বছর পূর্বে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিলো, তাকে কী আপনি ১৮ বছর পূর্ব থেকেই চিনতেন? ১৮ বছর পূর্বের শিশুটি যদি ১ বছরের জন্যও মাদ্রাসায় পড়ে থাকে, তাহলে সেই শিক্ষা তার হৃদয়ে, মগজে যে আজো জমা নেই, সে কথা কে বলতে পারে? ধরে নিলাম, এসব সন্ত্রাসীরা কেউই কোনেদিনও মাদ্রাসায় পড়েনি, তাহলে এখন এরা কেনো এ পথে এলো? কারণ মাদ্রাসা শিক্ষার বাইরে থাকলেও, পরিবার এবং সমাজের ধর্মশিক্ষার বাইরে এরা কেউই ছিলো না। পরিবার ও সমাজে যে কট্টোরপন্থি নেই তা তো নয়, প্রচুর আছে। তাই এদের সংশোধন না করে, কীভাবে আপনার শিশুকে রক্ষা করবেন? শুধু ধর্মজীবি বা ধর্মপ্রতিষ্ঠানই যে ভুল ধর্মশিক্ষা দিচ্ছে তা নয়, পরিবার ও সমাজও একই প্রক্রিয়ায় ভুল শিক্ষা দিচ্ছে। অতএব, উচ্চশিক্ষিতদের সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে যেসব পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা থাকুক না কেনো, ভুল ধর্মশিক্ষাই সর্বপ্রধান সমস্যা, যা নিয়ে কারো মুখে রা নেই।

মনে রাখবেন, মানুষ যতোক্ষণ নিজেকে চালায় ততোক্ষণ সে মানুষ থাকে, যখন ভাইরাস (ধর্মভাইরাস) মানুষকে চালায়, তখন আর মানুষ থাকে না। অর্থাৎ মানুষ যখন নিজের বুদ্ধি-বিবেক সব ভাইরাসের হাতে সমর্পণ করে, তখন ওটার দ্বারাই চালিত হতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় কোনো পথ থাকে না। এ ভাইরাস প্রকৃতিগত ভাইরাসের মতো নয়। আমরা এতে আক্রান্ত হই মাতৃগর্ভেই এবং এটা স্বয়ং ঈশ্বর প্রদত্ত। ‘জিকা’ ভাইরাসে শিশু মাতৃগর্ভেই আক্রান্ত হয়, তথাপিও এর প্রতিরোধ করা যায়। যেমন, গর্ভধারণ না করে। তবে ঈশ্বর প্রদত্ত ভাইরাসের আক্রমণ থেকে শিশুদের নিস্তার নেই। তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই, ধর্মশিক্ষার আমূল পরিবর্তন। বিশ্বাস না হলে- পশ্চিমের দিকে তাকান, দেখুন, ধর্মশিক্ষা পরিবর্তন করার ফলেই আজ তারা এ ভাইরাস থেকে প্রায় মুক্ত।

ওরা আর ক্রুসেড করে না, অক্সফোর্ড-ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্ট… ইত্যাদি মতবাদ নিয়ে আর যুদ্ধ করে না। ধর্র্মীয় গোষ্ঠি বলে প্রায় কিছুই নেই, ধর্মে ধর্মে বিবাদ নেই বললেই চলে। যতোটুকু আছে তাও নিভু নিভু। অথচ আমরা কী করছি? একই ধর্মালম্বী হয়েও প্রতিদিন একে মারছি, ওকে মারছি, নিজেও মরছি…! ওরা বায়োডাটাতে ধর্ম উল্লেখ করে না, আমরা বাধ্যতামূলকভাবে তা করি। ওরা ধর্মকে বড় মনে করে না, বরং মানবতাকেই বড় মনে করে। এটা একদিনেই তো আর হয়নি। বহুদিনের প্রাক্টিসের ফসল। অথচ আমরা প্রায় সকলেই মনে করি, মানুষের জীবনে অবশ্যই ধর্ম থাকতেই হবে। ধর্মহীন জীবন বা ধর্ম ছাড়া মানুষ থাকতে পারে। কারণ আমাদের মগজের গভীরে অতিযত্নে লালিত-পালিত ভাইরাসটিই সর্বক্ষণ ভয় দেখাচ্ছে, তুই ধর্মহীন হলে নির্ঘাত নরকে যাবি! তোর বাপদাদারা কেউ আমাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, তোর কত্তো সাহস… ইত্যাদি। ওর কথার বাইরে মানুষ যেন না যেতে পারে, সে বিষয়ে মগজখেকো এ মারাত্মক, অপ্রতিরোধ্য ভাইরাসটি সদা জাগ্রত।

বহু বছর ধরেই লক্ষ্য করছি, সন্ত্রাস সম্পর্কে বিদ্বানগণ অনেক পরামর্শ দিলেও এ ভাইরাসমুক্ত হওয়ার পরামর্শ কেউই দিচ্ছেন না। জানি, আমার মতো মূর্খের তোলা প্রশ্নে কেউই একমত হবেন না, তবুও বলছি, ধর্মশিক্ষার আমূল পরিবর্তন ব্যতিত, দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। কারণ মানুষ অভ্যেসের দাস এবং মানুষ যা জন্মগতভাবে লাভ করে, তা ভালো কিংবা মন্দ বিচার করার ক্ষমতা এবং ইচ্ছা দুটোই হারিয়ে ফেলে। আবার বিচার করতে গেলেও যেহেতু ধর্মসন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয় (যেমন আমরা, বাইরে তো বটেই, কারো কারো ঘরেও নিরাপত্তা নেই)। তাছাড়া এ ভারাইস আক্রান্তরা ঈশ্বর ভয়ে যেমন ভীত ও সদা আতঙ্কগ্রস্ত থাকে, তেমনি ঈশ্বর রক্ষার নামে মরিয়া থাকে, ফলে কেউ প্রশ্ন তুলতেই সাহস পায় না। যারা তুলেন, তারা অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ বলেই, তা পারেন। অতএব অতি সহজে এ ভাইরাস ত্যাগ করা যেমন সম্ভব নয়, বরং ত্যাগ করতে গেলে বা চেষ্টা করলে, আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। অতএব এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং সেটা শুরু করতে হবে প্রথমত পরিবার, সমাজ ও ধর্মালয় বিশেষ করে ধর্মজীবিদের মধ্যে।

আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানের অধিকারী, অতএব আমার পরামর্শে ও ভাবনায় ভুল থাকতেই পারে। তবে বৃহৎ জ্ঞানের অধিকারীদের (বিদ্বানদের) পরামর্শ ও ভাবনায় ভুল হওয়ার কথা নয়। কারণ বিদ্বানদের বক্তব্য আমরা সাধারণেরা বিনা প্রশ্নে মেনে নেই। গুলশান কিলিং চলাকালীন (সারারাত) এবং পরবর্তীতে (চলমান) সন্ত্রাস বিশারদ, বিদ্বান, বুদ্ধিজীবিসহ রাষ্ট্রের নানা উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের প্রায় একই কথা বলতে শুনছি। এসব গুণিজনদের মধ্যে অন্যতম, জনাব আলী রিয়াজ (ইউএসএ), মেজর আব্দুর রশিদ (অবঃ), মেজর সাখাওয়াত হোসেন (অবঃ), নাম মনে রাখিনি, এমন সমাজবিজ্ঞানী, সমাজপতি ও রাষ্ট্রের কর্ণধারসহ অনেকেই আছেন। যাদের বক্তব্যের সারমর্ম প্রায় এক (যেগুলো সকলেই শুনছেন, তাই ব্যাখ্যা নিসপ্রয়োজন)। কিন্তু কাউকেই (কোনোদিনও না) এটা বলতে শুনলাম না যে, ধর্মশিক্ষার আমূল সংস্কার বা পরিবর্তন ছাড়া ধর্মসন্ত্রাস বন্ধ করা অসম্ভব। এ মূর্খের দাবি, সংস্কার ছাড়া, বোমা-বন্দুক চালিয়ে, শতসহস্র বছরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন এ জাতিকে উদ্ধার করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ কোটি কোটি সন্ত্রাসের বীজ (যা প্রায় সব ধার্মিকদের মনের গভীরে সুপ্ত) ধ্বংস না করে, দু-একটা ছোট গাছ কেটে লাভ কী? যে বীজ হাজার হাজার বছর ধরে রোপিত হয়ে আসছে, সেই বীজ ধ্বংস করতে যে শতশত বছর লাগবে না, তাও মনে করি না। তবে একাজ শুরু করা অতীব জরুরি। কারণ এমনিতেই বহু দেরি হয়ে গেছে, যতো দেরি করবেন ততো ভুগবেন। আজ আপনি মরছেন, কাল আমি, পরশু তিনি…। তাই দয়া করে, ভন্ডামি রেখে, জরুরি ভিত্তিতে মূল বা শেকড়ে হাত দিন, আসল কাজটি কীভাবে করা যায় সেই পরামর্শ দিন।

আমাদের শান্তির দূত, ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, “আমি ভাবতেই পারি না বাংলাদেশে এমন হামলা হয়েছে। …আমি সব সময় বিশ্বাস করি বাংলাদেশ একটি অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র হবে…।” ইউনুস সাহেব, শান্তি সকলেই চায় না যেমন ঠিক, তেমনি যারা চায়, তারা শুধু চায় কিন্তু শান্তির জন্য কাজ করে বলে মনে হয় না। যেমন আপনি, শান্তিতে নোবেল পেয়ে অশান্তিপূর্ণ এ দেশ ছেড়ে বিদেশেই পড়ে আছেন। এমন আরো শতসহস্র জ্ঞানীগুণিরা শান্তির আশাতেই এ অশান্তির দেশ ছেড়ে নিজেদের নিয়েই সুখে আছেন এবং এমন বর্বরতা ঘটলেই মিডিয়া তাদের দেখা মেলে, অন্যথায় নয়। ইউনুস সাহেব, বিশ্বাস করা ভালো, কিন্তু অন্ধবিশ্বাই সর্বনাশা! ধর্মকে নিরাপদে রেখে, কীভাবে যে আপনার অসামপ্রদায়িক রাষ্টের স্বপ্ন দেখছেন? সেটা এ মূর্খ কিছুতেই বোঝে না। যা নিজেই ভাইরাস, তা কীভাবে অন্যকে আক্রান্ত না করে শান্তিতে রাখতে পারে? আপনার মতো প্রায় সকলেই একই কথা বলেন, সন্ত্রাসীরা অমুকের-তমুকের শত্রু, মানবতার শত্রু, তারা ধর্মের গায়ে কালিমা লেপন করছে, তারা ধর্মিক নয়…। এসব বহুরকম তেনাপ্যাঁচানো কথাবার্তা, শুনতে শুনতে এখন ধৈর্যহারা এবং প্রচণ্ড অসহ্য লাগছে। অথচ এর প্রকৃত কারণটি বলছে না কেউই। এ কী আপনাদের অজ্ঞতা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া? জানি, আমার মতো গর্দভের অনুরোধ আপনারা শুনবেন না, তথাপিও বলছি, অনুগ্রহ করে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে, সবার আগে ধর্মকে প্রশ্ন করতে শিখুন। ধর্মপুস্তকগুলো পড়ারও অনুরোধ রইলো। বোধকরি আপনারা, যারা এসব বলেন, তারা কেউই, কোনোদিনও ধর্মপুস্তক পড়েননি, যা শুনেছেন তাই বিশ্বাস ও ধারন করেই আজীবন চলেছেন (এটাই অন্ধবিশ্বাস)।

এ মূর্খ মনে করে, সর্বপ্রথমেই পরিবার, সমাজ, ধর্মজীবিদের সাবধান করতে হবে। তাদের প্রতি কঠিন দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে তারা এরূপ ধর্মশিক্ষা না দেয়। যেমন, অন্য ধর্ম মিথ্যা-বানোয়াট, ঘৃণ্য-জঘন্য, নিজেদেরটা মহৎ, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বসত্য… এসব কোনো অবস্থাতেই, কোনো পরিসি’তেই শিশুকে শেখানো যাবে না। যারা শিখে ফেলেছে তাদের সংশোধন আর সম্ভব না, তবে যারা এখনো শিখেনি অর্থাৎ শিশুদের যেন কোনো অবস্থাতেই এসব শিক্ষা দেয়া না হয়। যেহেতু শিশুর এ শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবারে, পরবর্তীতে সমাজে ও ধর্মালয়ে, সেহেতু পরিবারগুলোর প্রধান এবং ধর্মীয় নেতাদের ট্রেনিং দিতে হবে, তারা ধর্মের কতোটুকু শিখাতে পারবে, কিংবা পারবে না। এ প্রাক্টিস না চালাতে পারলে যে কোনো চেষ্টাই বিফলে যাবে বলে এ মূর্খ মনে করে। কারণ যুগযুগান্তরের প্রশ্নহীন, অপ্রতিরোধ্য ধর্ম নামক ভাইরাসটি মানুষের প্রকৃতিগতভাবে স্থাপিত হার্ডডিস্কের সমস্ত সফটওয়্যার বহু আগেই ধ্বংস করে ফেলেছে এবং তার নিজস্ব সফটওয়্যার বসিয়ে তা ড্রাইভ করছে বা চালাচ্ছে। এ হার্ডডিস্ক এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যে, রিপিয়ার অযোগ্য। সুতরাং এসব সংক্রামিত সফটওয়্যার হার্ডডিস্কে রেখে, কী করে অসংক্রামিত জাতি কিংবা মানুষ আশা করছেন? অতএব ধর্মশিক্ষার পরিবর্তন ছাড়া সন্ত্রাস বন্ধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। (সন্ত্রাস বলতে ধর্মসংশ্লিষ্ট সন্ত্রাস বুঝতে হবে)।

যখন পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি… দেখেন তাদের সন্তান খুব ধার্মিক হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া ঠিকমত করুক বা না করুক, ধর্মকর্মে ফাঁকি নেই। সন্তান তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে, কারণ সে এই বয়সেই খাঁটি ধার্মিক হয়ে গেছে, আর চিন্তা কী? এতে সকলেই অতি উৎসাহিত হন এবং খুশিতে বগলবাজান। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেন না যে, সন্তানটি তার পূর্বের বন্ধুদের সাথে কেনো খেলার মাঠে না গিয়ে ধর্মজীবির কাছে দৌঁড়াচ্ছে, তার অনুগত হয়ে এমনটা হয়ে যাচ্ছে যে, সে টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছে, পিতা-মাতা-ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনদের পোষাক ও আধুনিক আচার-ব্যবহারে দুঃখ পাচ্ছে, নিজের লোক বলে কিছু বলতেও পারে না, ফেলতেও পারে না, তাই সে আস্তে আস্তে তাদের এড়িয়ে দিন দিন একা হতে থাকে। সে কেবলমাত্র ধর্মজীবি এবং তার অন্য সাগরেদদের সাথেই কিছুটা মেলামেশা করে। ঘরে সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। (সব ক্ষেত্রে নয়)।

অন্যদিকে প্রায়ই দেখা যায়, যখন কারো সন্তান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে, তখন তার সাথে সংশ্লিষ্ট (পিতামাতা ও বন্ধুসহ) পরিচিত সকলেই জোর গলায় বলেন, এই ছেলে কতো ভালো ছেলে, এমনটি করতেই পারে না, সে সব সময় ধর্মকর্ম করে, চুপচাপ থাকে, একা একা চলে, কারো সাথে তেমন একটা মিশে না… ইত্যাদি। তাদের চোখ কপালে উঠিয়ে চিৎকার-চেঁচামেমি শুরু করেন। ষড়যন্ত্রের প্রশ্ন তোলেন, অথচ কখনোই ছেলের খোঁজ রাখেননি, কারণ ছেলে আর যা করুক, ধার্মিক ছেলে বলেই সমাজে পরিচিত ছিলো, অতএব নো চিন্তা। ধার্মিক বলেই যে পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন তার খোঁজ রাখেন না, অথচ এদেশে ধার্মিক তো সকলেই। কারণ দেশের প্রায় শতভাগ দুর্নীতিবাজ হলেও ধর্মকর্মে ফাঁকি দেয়া মানুষ ১০% খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। ৮/৯ বছরের এক দূরন্ত ছেলে লেখাপড়া করে না বিধায়, পিতা তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়। ছেলেটির পিতা সাধারণ প্রাইভেট চাকুরি করে, তিনি ধার্মিক তবে গোড়া ধার্মিক নয়। কিছুদিন পর ছেলে ছুটিতে বাসায় এসেই বলে, টিভি দেখছো কেনো, টিভি দেখা হারাম। এরপর আরো কিছু বিতর্কিত কথা বললে, কিছুদিন পর, এক শিক্ষিত লোকের পরামর্শে তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোনো ধর্মজীবি হয়তো শিক্ষা দেন যে, এটা দেখা, ওটা শোনা, সেটা করা হারাম… আবার একই কাজ অন্য ধর্মজীবি হয়তো বলবে, না এটা এভাবে বা ওভাবে দেখলে, করলে… হারাম না। এই যে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্তিকর শিক্ষা দেয়া হচ্ছে. এটা কী অস্বীকার করবেন? এতে সাধারণ মানুষ যে যার কাছে, যেমন শিক্ষা পায়, সে তেমনই আচরণ করবে বা তেমনই মানুষ কিংবা অমানুষই তো হবে, নয় কী? অতএব ধর্মশিক্ষাকে একই সমান্তরালে না এনে, ধর্মসন্ত্রাস দূর করা আর মন চাইলেই, হেঁটে মঙ্গলে গিয়ে ঘুরে আসা একই কথা।

যখন তথাকথিত একটি ঐশ্বী বাণী ভিন্ন ভিন্ন ধর্মজীবি ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজনের ব্যাখ্যা অন্যজন গ্রহণ করেন না। একটু খেয়াল করে দেখুন, আপনার সন্তান যে ধর্মজীবির কাছে যায়, যাকে শ্রদ্ধা করে, যার কথা ঐশ্বী বাণীরূপে মান্য করে, সেই ধর্মজীবির শিক্ষা এবং আপনি নিজে যে ধর্মজীবির মুরিদ, সেই ধর্মজীবির শিক্ষা প্রায় সময়ই ভিন্ন হয় (যদি পিতা ও পুত্রের ধর্মগুরু ভিন্ন হয়)। আরো লক্ষ্য করে দেখবেন, কারো ধর্মপ্রচার উগ্রতায় ভরা, কারোটা কম উগ্র, কেউ কিছুটা নমনীয়, আবার কেউ সম্পূর্ণ নমনীয়…। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কোন ধর্মজীবির শিক্ষা গ্রহণ করছেন? অতএব নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আপনি যে ধর্মজীবির অনুসারী হবেন, সেই প্রকৃতি, আচার-আচারণ আপনার মধ্যে প্রকাশিত হবেই হবে। এর বাইরে যাবার সাধ্য ধার্মিকদের নেই। একথা শুধু ধর্মজীবিদের দেয়া শিক্ষার বেলায় প্রযোজ্য নয়। একথা পরিবারেও ১০০% ঠিক। অর্থাৎ যার পিতা-মাতা যেমন কট্টোর, উগ্র, অসহনশীল অথবা সহনশীল, নম্র, ভদ্র… ইত্যাদি ধর্মশিক্ষা বা দীক্ষা পেয়েছেন, তার স্বভাবেও তা স্পষ্ট হতে বাধ্য (যা ৯০% ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)।

অতএব বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞ পণ্ডিত, উচ্চপদস্থ (বিশেষ করে রাষ্ট্রনায়কগণ) সকলেরই উচিত, সন্ত্রাসের ‘গোড়ায় গলদ’ বের করে কেবল সেখানেই ওষুধ প্রয়োগ করা, অন্যত্র নয়। অন্যত্র ওষুধ প্রয়োগ করলে, ভাইরাসটি আরো মারাত্মক, আরো শক্তিশালী হতে বাধ্য। অতএব উচিত, ধর্মশিক্ষার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া, এতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার যেমন কোনো বিকল্প নেই, ঠিক তেমনই প্রতিটি ধর্মীয় বাণীর একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে, যার বাইরে কোনো ধর্মজীবি যেতে পারবে না। অনেকটা (স্কুলের) সিলেবাসের মতো। সিলেবাসের বাইরে গেলে বা ভুল ব্যাখ্যা দিলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে (যদিও তা প্রায় অসম্ভব কিন্তু অসাধ্য নয়)! আরো ভালো হয় যদি, এই সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা শুধু দেশের ধর্মজীবিদের জন্য নয়, সমস্ত বিশ্বের জন্য প্রয়োগ করা যায়! কারণ একই ধর্মে দুই-তিন বা ততোধিক ব্যাখ্যা থাকা যেমন মারাত্মক অপরাধ, তেমনি থাকলে, খুনাখুনি বন্ধ করাও সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। অতএব, দেশের কর্ণধারসহ বিজ্ঞজনদের নিকট আকুল আবেদন, দয়া করে মূল বা শেকড়ের সমস্যার কথা বলুন। উল্টাপাল্টা বকে মানুষ বিভ্রান্ত বন্ধ করুন, নতুবা গুলশান ম্যাসাকারের ন্যায়, চিরকাল এভাবেই মরতে হবে!