তনু হত্যাকান্ডের পুরো বাংলাদেশ ফুসে উঠেছিল। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হোক, যেকোন মূল্যে এই হত্যার পেছনের ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হক-এটা ছিল পাবলিক ভারডিক্ট। শিশু রাজন হত্যার ক্ষেত্রেও একই প্রতিক্রিয়া এসেছিল। এরকম সাগর-রুনি হত্যাকান্ড, হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ আরও নানা বিষয়ে আমাদের পাবলিক ভারডিক্ট এইরকমই। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকা এটাকের পর ২০ জন মানুষকে জবাই করে যে ৫-৬ জন জংগি এনকাউন্টারে নিহত হল তাদের ব্যাপারে আমাদের সামাজিক মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। Please don’t blame them, they were brain-washed, ওরা ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, ওরা সঠিক গাইডেন্স পায়নি-এরকম সফট-কর্নারযুক্ত পোস্ট-কমেন্ট প্রচুর দেখা যাচ্ছে। বিশিষ্ট ফেসবুল সেলিব্রিটিরাও জঙ্গিদের প্রতি একধরণের সফট-কর্নার দেখিয়েই লেখালেখি করছেন।

অন্য যেকোন অন্যায়ের ক্ষেত্রে অন্যায়কারীকে যেকোন মূল্যে সাজা দিতে হবে, আর জংগি মরলে ‘ওরা নিষ্পাপ ছিল, সঠিক নির্দেশনার অভাবে এমন হয়েছে, আসুন আমরা ওদের গালাগালি না করি’- এই ধরণের প্রতিক্রিয়ার কারণ কি? তনুর ধর্ষণকারী জীবনে তার প্রিয়তমার কাছে ভালোবাসা পেয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন তো কেউ করেনি; সাগর রুনির হত্যাকারীর শৈশব কেমন ছিল সেটাও তো কেউ জানতে চায় নি, কিংবা একজন ডাকাতের ডাকাত হওয়ার পেছনের কাহিনী নিয়েও তো কারও খুব একটা মাথাব্যাথা দেখা যায় না, তাহলে এই আইসিসের জংগিদের বেলাতেই ‘ওরা ভালোবাসা পায়নি, ওরা পরিস্থিতির শিকার’ এই ধরণের বক্তব্য কেন আসছে?

এর মূল কারণ দুটো। প্রথমত, এই ছেলেদের প্রোফাইল। এরা স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান, ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছে। এদের লাইফ-স্টাইল দেশের আর দশটা মডারেট মুসলমানের লাইফস্টাইলের সাথে মারাত্মকভাবে মিলে যায়। এদের একজনের হিজাবী গার্লফ্রেন্ড ছিল, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে আবার লোকদেখানো ধর্ম কর্মও করেছে। প্রেম করা, লিটনের ফ্ল্যাটে যাওয়া, হিন্দি মুভি দেখা আর সামাজিক অনুষ্ঠানে আইটেম সং এ নাচানাচি করার পাশাপাশি এরা নিয়মিত ধর্ম কর্মও করেছে, জুম্মাবারে মসজিদে গেছে, ফেসবুকে মাঝে মধ্যে কোরান-হাদিসের বাণী শেয়ার দিয়ে ধর্মীয় স্ট্যটাস রক্ষা করেছে, মানুষের বাহবা কুড়িয়েছে। এই প্রত্যেকটা জিনিসই দেশের আর দশটা মডারেট মুসলমানের লাইফস্টাইলের সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। এই ছেলেপেলেকে যখন এদেশের মানুষ দেখেছে আদতে আসলে তাদের মধ্যে তারা তাদের নিজেদেরই ছায়া খুজে পেয়েছে। ফলে, ‘আরে এরা তো আমরাই’ এই ধরণের চিন্তাধারা থেকে মনের মধ্যে এক ধরণের সফট কর্নার চলে এসেছে। বাবুল আক্তারের স্ত্রীর খুনীদের প্রতি এই সফট কর্নার আসে নাই, দারিদ্র্যের কারণে যে শিশুটি ছোট থেকেই চুরি ডাকাতি আর খুন খারাপির জগতে ঢুকে গেছে তার প্রতিও সফট কর্নার আসে নাই। এসেছে এই ভাল পরিবারের নিষ্পাপ ভাল ছেলে জঙ্গিগুলোর প্রতি। কারণ এরা আসলে আমাদের এই তথাকথিত নিরপেক্ষ প্রজন্মেরই ছায়া। মডারেট মুসলমানরা আয়নায় দাঁড়িয়ে এই ছেলেদের চেহারাই দেখতে পায়।

২য় কারণটা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর। প্রথমত বললাম যে, জঙ্গি ছেলেগুলো জংগি হওয়ার আগ পর্যন্ত লাইফ স্টাইল ও চিন্তাধারায় অধিকাংশ মডারেট মুসলিমকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এখন এই প্রতিনিধিত্বের ২য় ধাপে আসি। আমার স্কুলে হিন্দুধর্ম শিক্ষক ছিল না। আমি প্রায় ৬ বছর ইসলাম শিক্ষা ক্লাস করেছি। যেকোন ইস্যুতে হুজুর স্যারের মূল বক্তব্য এমন থাকতো যে, ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ, অন্য সব ধর্ম ভুয়া। এইটা ইসলামিক শিক্ষা অন্যতম মুখ্য stepping stone. ধরুন প্রশ্ন আসলো ইসলামে নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা কর, এরা শুরুই করবে এভাবে- ‘পৃথিবী আর কোন ধর্মে’ নারীদের এতো অধিকার দেয়া হয় নাই। অর্থাৎ আলোচনার শুরুটাই হচ্ছে ‘আর কোন ধর্ম’ দিয়ে, মানে অন্য সকল ধর্মকে অসম্মান করে। এইটা প্রত্যেকটা ইসলামিক স্কলার করে, প্রত্যেকটা ইসলামিক টিভি শো তে বক্তা এইভাবে তার বক্তব্য শুরু করে। অর্থাৎ ছোট থেকেই একজন মুসলমান অন্য ধর্ম সম্পর্কে চরম নেতিবাচক ও অশ্রদ্ধামূলক ধারণা নিয়ে বড় হয়। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা শুরু করে। এটা একটা সাংঘাতিক রেসিজম এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এই রেসিজম মুসলমানদের একটা বড় অংশ মনে প্রাণে ধারণ করে। এই Jingoistic মনোভাব, এই অহমিকা, এই রেসিস্ট চিন্তাধারা আইসিস এবং মডারেট মুসলিমদের মধ্যে কমন। পার্থক্য হচ্ছে আইসিস মানুষ খুন করে, মডারেট মুসলিমরা সেটা করে না। কিন্তু যে চিন্তাধারা থেকে আইসিস মানুষ জবাই করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে সেই একই চিন্তাভাবনা আরেকজন মডারেট মুসলমানের অন্তরে সুপ্তাবস্থায় থাকে। এই জিনিসটা অবচেতন মনেই এইসব জঙ্গিদের জন্য এক ধরণের সফট কর্নার তৈরি করে ফেলে। কারণ বিশ্বাসের ভাইরাসটা তো সবাই মধ্যেই আছে, ঢাকা এটাকের জঙ্গিরা সেই ভাইরাস সংক্রমণের উপযুক্ত পরিবেশের মধ্যে আসতে পেরেছে, আর যারা তাদের জন্য এখন ভালোবাসার বার্তা দিচ্ছে তাদের সাথে এই জঙ্গিদের পার্থক্য একটাই, তার এখনও সেই পরিবেশ/ক্যাটালিস্টের সংস্পর্শে আসে নাই। এটা আমাদের এই মডারেট প্রজন্ম খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছে, আর সেটা থেকেই এই ছেলেপেলেগুলোর জন্য তাদের মধ্যে এক ধরণের ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম হয়েছে। এজন্য ২০ জনকে জবাই করা নিষ্টুর খুনিদের জন্য মায়া মমতা পূর্ণ স্ট্যাটাস দিচ্ছে- Please don’t hate them. They are not killers, they are the victims. ওরা পরিবার থেকে ভালোবাসা পায়নি, ওরা ভুল নির্দেশনার শিকার ব্লা ব্লা ব্লা।

খুনি জঙ্গিদের প্রতি এমন দরদ ওঠা দেখেই বুঝা যায় এই মানুষগুলো আসলে দিন শেষে এই জঙ্গিদের মতই চিন্তা করে, প্রকাশ্যে সেটা বলতে পারে না, তাই আহা উহু করে মনের ভাব প্রকাশ করছে। আগামীতে এই দরদীদের মধ্যেই কেউ না কেউ জংগি হবে, ‘বিপথগামী’ হয়ে মানুষ খুন করবে।