(1)
মৈনাক সরকার নামটি এখন সব আমেরিকান চেনে। খারাপ লাগলেও এটাই সত্য, যে বাঙালীকে আমেরিকানরা চিনে গেল আধুনিক মিডিয়ার দৌলতে তিনি বিবেকানন্দও নন, রবীন্দ্রনাথ ও নন। মৈনাক সরকার নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন প্রতিভাবান ছাত্র।
কিন্ত মৈনাককে কি আমরা চিনি ? আলবৎ ।
ভেবে দেখুন কি ধরনের “প্রতিভাবান” কেরিয়ারিস্টদের আমরা তৈরী করি সমাজে। ছোটবেলা থেকে তারা বাবা মা নিকট “বন্ধুরা” শেখাচ্ছে-স্বার্থপর হতে। শেয়ারিং এর কনসেপ্ট নেই। আমি যা জানি, যা শিখছি-সব আমার! কেউ যেন কেড়ে নিয়ে যেতে না পারে!! সেখানে জ্ঞানের প্রতি প্যাশন, সৃষ্টির আনন্দের স্থান নেই। শুধুই হিসাব, আমি এগোলাম না পেছোলাম। আর এমন বিচ্ছিরি জাঁতাকল, ষাট বছরেও শেষ হয় না। আচ্ছা রিয়াটারত করলে? কতটাকা জমাতে পারলে? কোন পজিশনে রিটায়ার করলে? কেউ বলবে ন-আর কদিনই ত আছে। খাতায় নাম উঠে গেছে-এবার নতুন কি ভাবছ?
ইনফ্যক্ট আই আই টি খরগপুরের দীর্ঘ একদশক জীবনে এত মৈনাক দেখেছি-হলফ করে বলতে পারি ক্যাম্পাসে বন্দুক সহজলভ্য বলে, এমন ঘটনা অনেক ঘটত। হবেই না বা কেন? গান, কবিতা, চিত্রকলা-জীবনের যার কিছু সুন্দর-কিছুইত এরা শেখে না। জীবন মানে এদের কাছে ম্যারাথন-আর সার্থকতা হচ্ছে সাইডলাইনে দাঁড়ানো পরিবারের লোকেদের হাততালি-যা তুই ওর ছেলেটাকে বিট করে দিয়েছিস ম্যারাথনে!! টোট্যালি একটা সিক সমাজ এবং পারিবারিক কালচারের মধ্যে দিয়ে আসে অধিকাংশ ছাত্ররা- যেখানে জ্ঞানের পিপাসা আর সৃষ্টির আনন্দের কোন স্থান নেই।
অনেকে বলছেন গাইড-পিএইচডি ছাত্র সমস্যা। হতে পারে। পিএইচডি গাইড ছাত্র সব থেকে কঠিন সম্পর্কের একটি। কারন এখানে ছাত্রটি সম্পূর্ন ভাবে তার শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল। প্রচুর ছাত্র মানসিক ভারসাম্য হারায় পি এইচ ডি করতে গিয়ে। একসময় আই আই টি সেনেটে পি এই চ ডি প্রতিনিধি ছিলাম। প্রায় ৩০% ছাত্রই মানসিক সমস্যায় ভুগত গাইডের জ্বালায়। উলটো দিকে ভাল গাইড ও প্রচুর আছে।
কিন্ত এখানেই সেই লাইভ বম্ব। পি এই চ ডিই হৌক বা চাকরি-সবর্ত্রই লোকে পেছনে লাগবে। কেউ তোমার জন্য গোলাপ নিয়ে বসে নেই। তার মানে কি এই প্রত্যেকের পেছনে বন্দুক নিয়ে লাগতে হবে? কোন লাভ নেই। যারা আপনার জীবনে কাঠি করছে- আপনি রেগে আছেন? জ্বলন্ত কাঠকয়লা ধরে বসে থাকলে তাতে হাতই পোড়ে।
গোটা জীবনটাই কুরুক্ষেত্র। অথবা ফুটবল মাঠ। পাস দিচ্ছেন, গোল খাচ্ছেন, গোল দিচ্ছেন-লোকে ল্যাং মারছে। পাস ধরছেন, ডজ করেছেন-সব কিছু মিলিয়েই ফুটবল! কিন্ত কোন স্কুল, কোন ফ্যামিলি শেখায় সেটা? সবাই ভাবে হেঁটে হেঁটে গোল দেবে! মাঠে নেমেছ, অথচ ল্যাং খাবে না, হয় না কি!
কিন্ত জীবনে মারাদোনা সেই হতে পারে-যে হাজার ল্যাং খেয়েও, মারমারি পালটা মার না দিয়েই ডজ করে গোলটা দিয়ে আসতে পারে! সেই আসল প্রতিভাবান!! সেই শিক্ষাটার অভাব চারিদিকে। আর হ্যাঁ সেই মারাদোনা হতে পারে, যে সৃষ্টির আনন্দে ভেসে যেতে পেরেছে।
জীবনের সবথেকে বড় রহস্য-জীবনের উদ্দেশ্য নেই-কিন্ত আবার উদ্দেশ্য বা গোল না থাকলে একটা দিন ও বাঁচা সম্ভব না। কারন আমাদের প্রতিটা একশনের পেছনেই ইঞ্জিন হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য। এটা খুব গভীরভাবে না ভাবলে লোকে বোঝে না।
(2)
জীবনের একটা গোল, এবং তারজন্য কম্পিটীশন থাকবেই। না হলে আবার জীবনটা একটা উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে হবে। সেটা খুব বাজে কিছু না-যদি তার থেকে কবি সাহিত্যিকের জন্ম হয়। কিন্ত বাস্তব হচ্ছে, এদের অধিকাংশরই জীবন শেষ হয় ড্রাগে এবং আত্মহত্যায়। সেটাও কাম্য না।
এই জন্য সুস্থজীবনের জন্য সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ন-সামনে একটা গোল ঠিক করা। মুশকিল হচ্ছে অধিকাংশের সামনেই সেটা নেই। সবাই জানে প্রোগ্রামার থেকে সিনিয়ার প্রোগ্রামার, সেখান থেকে ডিরেক্টর, ভিপি-চাকরিতে প্রমোশন। গাড়ীর মডেল আপগ্রেড, বাড়ির সাইজ। এসব বস্তুবাদি লক্ষ্যেই ছুটে চলেছে সবাই।
বস্তুবাদি সাফল্যকে জীবনে উদ্দেশ্য করার কারন নিরাপত্তা। সবাই চাইছে খাদ্য,সেক্স, মেডিক্যাল, বাসস্থানের নিরাপত্তা। এই ক্যাপিটালিস্ট সমাজে টাকা ছাড়া কিছুইত মেলে না!!
একটা লেভেলে এই নিরাপত্তার দরকারকে অস্বীকার করি না-কিন্ত এগুলোকে জীবনের উদ্দেশ্য করলে মুশকিল। সুস্থ খাদ্যের দরকার সবারই-কিন্ত খাবার নামে দামী রেস্টুরেন্টের পেছনে টাকা ওড়ানো মানে আস্তে আস্তে জীবনের উদ্দেশ্যটাকে সেই বস্তুবাদি বস্তার বান্ডিলে ঠেলা।
যা মৃত্যুতেই শেষ। অনেক ডাক্তারই এটা জানেন। একজন লোক মরার আগে, প্রথমে সেই একটা অবিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে যায়-যে সত্যিই মরতে চলেছে? একটা প্যানিকিং লেগে থাকে মৃত্যপথযাত্রীর চোখে মুখে। আস্তে আস্তে যখন আর মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে পারে না-তখন ছেড়ে দেয়। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে বোঝে ওটাই আসল নিয়তি! সবাইত আর রবীন্দ্রনাথ হয় না-যে গীতাঞ্জলী লিখে অপেক্ষা করে সেই নিশ্চিত নিয়তির দিকে।
বরং জীবনের উদ্দেশ্য বা গোল হোক-কে কত সমাজকে ফিরিয়ে দিতে পারে-তার প্রতিযোগিতায়। কে কজন গরীব ছাত্রকে স্পনসর করতে পারল। কে কজন বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দেখাশোনা করতে পারল। এনজিও খুলে রাস্তা পরিস্কার করার প্রতিযোগিতা হৌক পাড়ায় পাড়ায়। কে কটা মিস্টি প্রেম করতে পারল, তার প্রতিযোগিতা হৌক।
বলবেন চ্যারিটিতেও প্রতিযোগিতা? নিশ্চয় দরকার। এই একটা প্রতিযোগিতায় যদি বন্ধু বা অন্যের কাছে হেরেও যাই-কি ভীষন ভাল লাগে বোঝাতে পারব না। এই একটাই প্রতিযোগিতা আছে-ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা-যেখানে হেরেও আনন্দ।
সৌদিতে তখন তেল পাওয়া যায়, ওটা তখনও একটা রাষ্ট্র হয় নি-নানান ট্রাইবাল গোষ্টি-নানান রাজ্যে রাজত্ব করত। এমন এক গোষ্টিসর্দারের আধুনিক ছেলে, তার সেকেলে বাবাকে বোঝাচ্ছে-কেন তেলের লিজ আমেরিকান কোম্পানীদের দেওয়া উচিত।
সর্দারপুত্র শুরু করছে এই ভাবে- এই ” অমূল্য” তেল…।
ছেলে আর কিছু বলার আগেই, সর্দার তাকে কেটে দিয়ে বললো-হে পুত্র, তুমি তেলকে অমূল্য বলছ কেন? তেল ত কেনা যায়। যা কিছু কেনা যায়-তা কি করে অমূল্য হয়? ভালোবাসা, স্নেহ অমূল্য -কারন তা কেনা যায় না।
গাড়ী কেনা যায়। বাড়ী কেনা যায়। ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কেনা যায়।
কিন্ত মানুষের স্নেহ আশীর্বাদ কেনা যায় না। মানুষের ভালবাসা কেনা যায় না। মানুষ অমৃতের সন্তান-তাই আমাদের লক্ষ্য বলে যদি কিছু থাকে- তা হৌক সেই অমূল্য রতনের সন্ধান। সাধারন মানুষের ভালোবাসা। যা কেনা যায় না-তাই অমূল্য ।
আমি প্রায় সাড়ে চার বছর আগে চাকরি ছেড়েছিলাম। জীবনের গোলটা বদলানোর দরকার ছিল। কর্পরেট লাইফের উদ্দেশ্যহীন অর্থহীন চাকরি করাটা মানসিক অত্যাচারেরর পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। তখন একটা গোল ঠিক করেছিলাম- ভারতে ১০০ জনের জন্য চাকরি তৈরী করব। ব্যাবসা করার থেকেও সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এগিয়েছি বেশী। আমি এখন অনেক বেশী চাপে থাকি-অনেক বেশী কাজ-কিন্ত মানসিক দিয়ে অনেক বেশী সুখী।
জীবনকে উপভোগ করতে গেলে, বস্তুবাদি গোল থেকে দূরে থাকতেই হবে।
আমি আপনার রেগুলার পাঠক, আপনি আমার আইডিয়েল, আপনার থেকে অনেক শিখেছি তবে আজ যা শিখলাম কখনই ভুলবনা !
চমৎকার লেখা। কর্পোরেট কালচার তার টিকে থাকার স্বার্থেই মানুষকে বস্তবাদী হতে শেখায়। আত্নিক সুখের চেয়ে যে কোন মুল্যে অর্থ উপার্জনই তখন তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এই বস্তুবাদই পরোক্ষ ভাবে পূঁজির নিরাপত্তা কাঠামো তৈরী করে। সমাজ, রাষ্ট্র , শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুই এখন এই কর্পোরেট কালচারের দখলে। ফলে আমরা দেখি এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নুতুন জ্ঞান শেখানোর চেয়ে কর্পোরেট উপযোগী কর্মী তৈরিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা বড় অংশের জীবনের লক্ষ্য এখন যে কোন মুল্যে একটা উচ্চ বেতনের স্যুটেড বুটেড কর্পোরেট চাকরী জোটানো এবং এই চাকরীর বদৌলতে আরাম আয়েশে জীবন পার করে দেওয়া। এই জাতীয় লেখার চর্চা ও প্রচার এখন অত্যন্ত জরুরী।
ভাল লেখাটি, কিন্ত যারা জেগে ঘুমোচ্ছে তাদের কি বলব নতুন করে ? বেহায়া নির্লজ্জ ভদ্র বর্বর এ ভরে গেছে চারিদিক। যে ভদ্রলোকের সমাজ দেখি তাদের sophisticated animal ছাড়া আর কি বলবেন ? কলেজ র্যাগিং, কর্পোরেট দুরনিতি, এসবে ভরে গেছে চারিদিক। একটা উপায় আমি জানি , এই রিসেশ্ন এর মার্কেটে অনেক ছোট মাঝারি কোম্পানি আছে যারা এক্সপিরিয়েন্স লোকেদের কে ভাল মাইনে দিয়ে নেয়। তাতে কি হয় একটা লোকের স্বচ্ছল ভাবে চলে যায় আর হাতে সময় থাকে পরিবারের জন্য। তথা কথিত বড় কোম্পানির থেকে ভাল এইগুলো। আমি কিছুদিন আগে আমার এবং আমার স্ত্রি এর সাফল্যের কাহিনি দিয়েছিলাম, আরেকজনের কথা বলি , আমার এক বন্ধু ডিসাইনার হিসাবে কাজ করত , সে নিজেই এখন ফ্রিলান্সিং ধরে কাজ করে , কোনো কর্পোরেট কোম্পানি তে কাজ করবার তার দরকার নেই এবং করেও না। সাইট টির নাম যখন মুক্ত মনা তখন এই রকম আধুনিক কুসংস্কার এর প্রতিবাদ আরো হোক ।
আমার চিন্তা ভাবনার সাথে খুব মিল আপনার চিন্তাভাবনার।বিপ্লব দা, এখন স্কুল ব্যাবস্থার যে অবস্থা প্রত্যক্ষ করছি তাতে করে শিক্ষার্থীরা যথার্থ সামাজিক হতে পারছে না।উপলব্ধি করতে পারছে না যে তারা সামাজিক জীব।এটার থেকে বের না হলে অগ্রগতি কিভাবে সম্ভাব?
খুব ভালো লেখা |
আমার প্রিয় অংশ |
নিশ্চয় |
খুব ভালো বলেছেন বিপ্লব। চমৎকার হয়েছে লেখাটা।
চমৎকার লেখা।
আমার তো মনে হয় জীবনের একটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- নিজেকে আনন্দিত করা এমন উপায়ে যাতে নিজের এবং অপরের কোন ক্ষতি না হয়। যে মানুষের সেবা করে আনন্দ পায়, তার সেটাই করা উচিত। যে জ্ঞানের মধ্যে সুখ পায়, তার জ্ঞানচর্চাই শ্রেয়। সুখ বা আনন্দ কর্ম করার থেকে পাওয়া উচিত, কর্মের ফল আমাদের ক্ষনিক আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু কর্ম করার মধ্যে সুখ খুজে নিতে পারলেই আমরা প্রকৃতপক্ষে অধিক সুখী হতে পারব।
আমাদের এমন কোন সমাজব্যবস্থা করা উচিত না, যেখানে সমাজ আমাকে বাধ্য করবে আমার নিজস্ব প্যাশন বাদ দিয়ে অর্থ, খ্যাতি , প্রতিষ্ঠার পেছনে ছুটতে।
অথচ আমরা আজ নিজেদের হারিয়ে অলীক এক উদ্দেশ্যের পেছনে ছুটছি।
সত্যি কি কেনা যায় না? আপনি পরিবারের সবাইকে সচ্ছলভাবে রাখেন সবাই আপনাকে ভালবাসবে , স্নেহ-আশীর্বাদ সবই পাবেন। আর অর্থাভাবে পরিবারকে সাহায্য করতে না পারলে, সেই পরিবারের অনেকেই আপনাকে কটুক্তি করতে ছাড়বে না।
সত্যি কথা বলতে কি আমরা আজ এরকম একটা সমাজ বানিয়ে ফেলেছি, যেখানের প্রিয়তমার ভালবাসাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকার সমানুপাতিক।