১। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় অস্বাভাবিক পাশের হার। আমাদের সময় পাশের হার ৩০~৪০% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এই পাশের হার নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। গত কয়েকবছর থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। শিক্ষার্থিরা পড়াশুনা করছে এটা যেমন সত্য তেমনি সরকারের কিছু অলিখিত নীতি মালার বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারনে পাশের হার বাড়ছে এটাও সত্য। তবে এবারের এস এস সি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় বরিশাল বোর্ডে একটি স্কুলের হিন্দুধর্মের শিক্ষার্থীদের গনহারে ফেল। যদিও একই শিক্ষার্থী অন্যান্য সব বিষয়ে ভাল ফল করেছে কিন্তু হিন্দুধর্মে ফেল করার কারনে পুরো পরীক্ষাতেই ফেল। এই ফেল করা ছাত্রদের একজন স্কুলভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। আমার উদ্বেগ এবং মনোক্ষুন্নের কারন এখানেই।

ssc

২। হিন্দুধর্মে ফেল করা ছাত্রদের বলব- এই ফেলের কারনে অসম্মানের কিছুই হয়নি। ভারতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ধর্ম বিষয়টা নেই।গনিত ও বিজ্ঞানে A+ পাওয়া ছাত্র যদি হিন্দুধর্মে ফেল করে থাকে আমি তো মনে করি এটা তার জন্য গর্বের বিষয়। উচ্চতর শিক্ষায় ধর্মের গাজাখুরির কোন স্থান নেই। স্রষ্টার স্বরুপ বর্ননা কর-এ ধরনের প্রশ্নে যদি কেউ বিজ্ঞানের আলোকে লিখতে যায় সে তো শুন্য পাবেই। আবার বর্তমানে প্রচলিত বইতে যা লেখা আছে তা লিখতে গেলে হবে আত্মপ্রতারনা। তাহলে যারা ফেল করেছ তারা যে খুব একটা অসস্মানিত হয়েছ তা বলা যাবে না। এটা একবিংশ শতাব্দীর একজন নাগরিকের জন্য গর্বের।

৩। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মেট্রিকুলেশন পাশ করেনি। নজরুলও করেনি। কিন্তু আজ তাদের নিয়ে পি এইচডি করা হয়। গুরুদেব বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে এক অর্থে পড়াশুনার চাপ সইতে না পেরে ফেরত এসেছেন। যে এলাকায় এ ঘটনা সেই বরিশালের মুক্তমনা মানুষ আরজ আলী মতুব্বর প্রাথমিকের গন্ডিও পেরুতে পারেননি। কিন্তু তার লেখা বইগুলো আজ বহু শিক্ষিত মানুষের চিন্তার খোরাক। আমরা বহু শিক্ষিত মানুষরাও তার মত করে চিন্তা করতে পারব না বা পারছি না। তারা সকল সাটিফিকেট ডিগ্রির উর্ধে। “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে “ বিখ্যাত এই কবিতার লেখিকা বরিশালের কুসুমকুমারী দাশ কি এস এস সি পাশ করেছিলেন?

৪। গত তিন বছর ধরে দেশের শিক্ষাসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে নিজে নিজে একা একা কাজ করছি এবং দুয়েকটি দুর্নীতি উদঘাটনও করেছি। এ বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শিক্ষক মনোযোগ দিয়ে খাতা মুল্যায়ন করে না, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে নেই এমন প্রশ্নের জবাবে নম্বর প্রদান করা হয়, উত্তর সঠিকভাবে না পড়ার কারনে সঠিক উত্তরে খাতায় শুন্য দেয়া হয়, ভিতরের প্রাপ্ত নম্বর ঠিকভাবে যোগ করে খাতার উপরে বসানো হয় না। পরীক্ষকের ভুলগুলো নিরীক্ষকের হাতে ধরা পড়ে না। ফলে যা হবার তাই হয় , পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের উপর যার পুরস্কার পাওয়ার কথা সে পায় না, যার পাওয়ার কথা নয় সে পায়। Foul is fair , fair is Foul.
যেকোন ধরনের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় জয়ী বা পরাজয়ী প্রার্থীর আক্রোশের শিকার হয় হিন্দুসম্প্রদায়। জমি দখল, কিশোরী কন্যা লাভের হাতছানি ইত্যাদি নানা কারনে আজ হিন্দু শিক্ষিতরা দেশান্তরি। যে কারনে বহু স্কুলেই হিন্দুধর্মীয় শিক্ষক নেই। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও অনেকেই মনে করেন, হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষকের হাতে খাতা মুল্যায়ন-পুনঃনিরীক্ষন হয়নি।

৫। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এসএসসি পরীক্ষা জীবনের একটি গুরুত্বপুর্ন ধাপ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় এস এস এসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএর শতকরা হারের কিছু অংশ যোগ করা হয়। এ কারনে এই দুটি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ একজন শিক্ষার্থীর জীবনে আরো গুরুত্বপুর্ন হয়ে গেছে। এই দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএর গুরুত্ব যদি শিক্ষাবোর্ড না বুঝে তাহলে তা খুবই দুঃখজনক। একটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব শিক্ষাবোর্ডের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছেই। সঠিকভাবে খাতা মুল্যায়ন-নিরীক্ষন-পুনঃনিরীক্ষনের দায়িত্বও শিক্ষাবোর্ডের । এখানেও তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

৬। একজন ssc পরীক্ষার্থীর বয়স কতই বা, ১৪~১৮ এর মাঝে। এই বয়সের একজন বালকের মন অতি আবেগপ্রবন। ভালো পরীক্ষা দিয়েছে , সমবয়সী বন্ধুবান্ধব সবাই পাশ করেছে, নিজের পিছিয়ে পড়াটা মেনে নিতে পারেনি।নিজের কাছে নিজেকে প্রচন্ড অসস্মানীত মনে হয়েছে। নিজের প্রতি নিজের রাগ, ক্ষোভ, ঘৃনা নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি। ফলে যা হবার তাই হল, পরীক্ষার ফল শুনামাত্র স্কুলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগের দিনগুলোতে অভিভাবক ও আশেপাশের সহপাঠীদেরও অবশ্য পালনীয় কিছু কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। প্রতিযোগী মনোভাব ভালো কিন্তু এজন্য অন্যের সাথে তুলনা করে নিজের সন্তানকে গাল-মন্দ করা , বন্ধুবান্ধবদের কটুক্তি এসব সর্বাংশে পরিহার করতে হবে। এ আচরণগুলি একজন টিনেজ বয়সের শিক্ষার্থীর মনে চাপ বাড়িয়ে দেয়। যখন সে কাংক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হবে তখন আশেপাশের পারিপার্শ্বিক অনাকাংক্ষিত চাপ তার মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে, যেকোন উপায়ে আত্মহননের পথ বেছে নিবে।

failIfinal

৭। ফেল করলে আত্নহত্যা কোন সমাধান নয়।পুন:নিরীক্ষনের সুযোগ আছে। এরপর ও কাজ না হলে তথ্য অধিকার আইনে খাতা দেখার সুযোগ আছে।কিন্ত আত্মহত্যা কোনভাবেই কাম্য নয়। কারো যদি আত্মবিশ্বাস থাকে যে, পাশ করব কিন্তু কোন সমস্যা র কারনে ফেল রেজাল্ট এসেছে তাহলে প্রবেশপত্র ফটোকপি করে আমার কাছে পাঠান, আমি আপনার হয়ে লড়ব। আবার ও বলছি আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। এতে পিতামাতার অপুরনীয় ক্ষতি হয়ে যায়।

মেইলঃ [email protected]