শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০ এ ‘পূর্বদেশ’ এ পূর্ব পাকিস্থানের নাম ‘বাঙলাদেশ’ প্রস্তাব করেন। যদি তিঁনি জানতেন ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দে এসে তাঁর স্বপ্নের রাষ্ট্রটি বাঙলাস্থান এ পরিণত হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে তাহলে তাঁর অনুভূতি কেমন হতো তা আজ আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। জানতে ইচ্ছা করে ক্র্যাক প্লাটুনের রুমি, বদি, জুয়েল, আজাদসহ সব শহীদদের অনুভূতির কথা। Time is the greatest enemy of truth. রাষ্ট্র আবেগ দিয়ে চলে না। রাষ্ট্র চলে প্রয়োজনের উপর। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই সময়ে সময়ে তার আদর্শ ঠিক করে। ১৯৭১ এ বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিও তার আদর্শ ঠিক করে। গত কয়েক হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে যদি গর্ব করার কিছু থেকে থাকে তবে তা অবশ্যই ১৯৭১ এবং এই সময়টিই ছিল বাঙালি জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বলতম সময়। এই প্রথম বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় স্বাধীনতা নামক হাজার বছরের আরাধনার ধনের জন্য। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যারা স্বাধীনতার জন্য এতটা মূল্য দিয়েছে, এতো বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছে, এত নারী তার সম্ভ্রম হারিয়েছে। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাঙলাদেশ রাষ্ট্রটি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যথার্থই শহীদদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন মাত্র ১০ মাসে পৃথিবী সেরা সংবিধান কিংবা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে। যেখানে সংবিধান প্রণয়নে ভারতের প্রায় ৩ বছর সময় লাগে, আর পাকিস্থানের লাগে প্রায় ২৭ বছর আর নেপালের লাগে প্রায় ৩৫ বছর সময়।

একটি রাষ্ট্র যখন সদ্য স্বাধীন হয় তখন রাষ্ট্রটির নাগরিকদের আকাঙ্খা থাকে আকাশ সমান উঁচু। একটি নবীন রাষ্ট্রের পক্ষে সেই পরিমাণ আকাঙ্খা একসাথে পূরণ সম্ভব হয় না। বাঙলাদেশেও তাই হয়েছে, এবং এর পুরো সুবিধা তুলে নিয়েছে স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীরা।

গত কয়েকদিন আগে আমাদের উচ্চবিচারালয় ২৪বছর আগে দায়ের করা একটি রীট খারিজ করেন। রীটের বিষয়বস্তু ছিল আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক’র মাধ্যমে সামরিক শাসক হু.মু.এরশাদের ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে। আমাদের উচ্চবিচারালয়ের যেখানে দায়িত্ব আমাদের পবিত্র সংবিধানকে রক্ষা করা, সেখানে গত ৪৫ বছরে এ প্রতিষ্ঠানটির মেরুদন্ডহীন চরিত্র বার বার আমাকে হতাশ করেছে। আমার এ লেখাটির মূলত: পরিধি থাকবে রাষ্ট্রীয় চেতনা, রাষ্ট্র ধর্ম ও ১৯৭১ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী রাজনীতি ও বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে।

এবার একটু পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। পৃথিবীতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার শুরু থেকেই মিশর, ব্যবিলন এবং ভারতে যে প্রাচীন ধারাটি ছিল তা হলো দেবতারা হলেন শাসকের ক্ষমতার উৎস। এদিকে ঈহুদী ধর্মমতে তাদের মোসেজ সমস্ত আইনকানুন পেয়েছিলেন ঈশ্বরের কাছ থেকে এবং ঈশ্বর সমস্ত ঈহুদীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। এ থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্র চিন্তা ও আইনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক প্রথম থেকেই (রাজনৈতিক মতবাদের ইতিহাস-গ্রাৎসিয়ানস্কি, ন.দেয়েভ, ভ.লাজুরেঙ্কো, ল.মামুত, প্রমুখ)। ভারত, মিশর, ঈহুদী সম্প্রদায়, রোম ও গ্রীসে মূলত: পুরোহিতরা জ্ঞানচর্চার আত্মবদ্ধ সম্প্রদায় ছিলেন। ব্যতিক্রম শুধু চীনে, সেখানে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন রাজপুরুষরা নিজেরাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় এসব পুরোহিতদের প্রভাব এতোটাই বেশী ছিল যে রাষ্ট্র পরিচালক কে হবেন তা মূলত: নির্ধারিত হতো পুরোহিতদের দ্বারাই। উদাহরণস্বরূপ উ্ল্লেখ করা যেতে পারে মিশর ও ভারতের কথা। মিশরে ফেরাওকে নির্বাচন করত পুরোহিতরা নিজেরাই এবং প্রাচীন ভারতে পুরোহিতরা ব্রাক্ষণরা ছিল রাজারও উপরে কারন রাজারা মূলত: ছিল ক্ষত্রিয় জাতভূক্ত এবং ব্রাক্ষণদের কঠিণ আইনদ্বারা ঐ সময়ের রাজারা আষ্টেপৃষ্টে বাধা থাকত। হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মনুসংহিতা থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরা যাক-‘ব্রাক্ষনের জন্মই হলো ধর্মের শাশ্বত আবির্ভাব, কেননা সে জন্মেছে ধর্মের জন্য…..বিশ্বে যা কিছু বিদ্যমান তা ব্রাক্ষণের সম্পত্তি, জন্মের শ্রেষ্ঠত্ব হেতু এই সবকিছুর উপর ব্রাক্ষণের অধিকার’ (মনুসংহিতা-অনুশাসন এক, ৯৮-১০০)। মনুসংহিতায় (সাত-৩৯-৪৬) রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে ব্রাক্ষনের প্রতি বিনয়ী হতে এবং ভয় দেখানো হয়েছে এর বিপরীতে রাজা তার ঐশ্বর্য, ধর্ম এমনকি তার আত্মাও তাকে ত্যাগ করে যাবে।

এতে ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় রাষ্ট্র ধারণাটির সাথে ধর্মের সম্পর্ক ওতোপ্রতভাবে জড়িত এবং পৃথিবীর রাষ্ট্র চিন্তার প্রাথমিক যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। প্লেটো তো রাষ্ট্রের সব নাগরিকদের পক্ষে ধর্মকে বাধ্যতামূলকই করেছিলেন। এবং এর ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের রাজনৈতিক মতবাদ যেখানে সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল মূলত: ঈশ্বরতত্ত্বীয় ভাবাদর্শের উপর ভিত্তি করে। ১৩ ও ১৪ শতাব্দীতে ধর্মভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বিরূদ্ধে এবং বিবেকের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন ঐ সময়ের বেশ কিছু দার্শনিক, তাদের মধ্যে পাদুয়ার মার্সিলিয়াস এবং দান্তে আলগয়েরি অন্যতম। এসব দার্শনিকই প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক রাজতন্ত্রের কথা বলেন যা পরবর্তীতে রুশো ‘সামাজিক চুক্তি’তে চূড়ান্ত রূপ পায়। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন যাজক সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে সমালোচনা করেন। যাজক বসসুইয়ের ও ফিলমার যাদের অন্যতম ছিলেন সামাজির চুক্তি সমালোচনাকারীদের মধ্যে। এদিকে চীনের কনফুসিয়াসের রাষ্ট্র দর্শনেরও হিন্দু ধর্মের এবং প্লেটো দর্শনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এ তত্ত্ব অনুযায়ী সমগ্র রাষ্ট্রকে একটি শরীরের সাথে তুলনা করা হয় এবং এক একটি অংশের কাজের মতো রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও কর্তব্য নিদির্ষ্ট।

একইভাবে আরবীয় ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার উদ্ভব ও প্রখর বিকাশ হয়। মূলত: এর প্রধানতম আত্মিক উৎস ছিল রোমক-বাইজেন্টাইন ও ইরানীয় সাহিত্যিক ঐতিহ্য। ইসলামের প্রশ্রয়ে যে রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে উঠে তার বৈশিষ্ঠ্য হলো রাজার শাসনের ঐশ্বরিক চরিত্র প্রতিপাদন। আল ফারাবী, ইবন সিনা, ইবন তুফাইল, ইবনে রুশদসহ অন্যান্য ইসলামিক পন্ডিতগণ যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকল্প দেন তা মূলত: রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও লক্ষ্য বিষয়ে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রভাবের প্রতিফলন। উপরের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্র তত্ত্বের প্রাথমিক যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের উপর ধর্মের প্রভাব কেমন প্রকট ছিল।

এরপর পৃথিবীর ইতিহাসের পানি অনেক দূর এগোল, বিশেষত ফরাসী বিপ্লবের পর। মানুষ চিন্তা চেতনায় আধুনিক হতে শুরু করে মূলত: এই সময়ের পর থেকে। ফরাসী বিপ্লবের পরই মূলত মানুষের বিজয়ের ইতিহাস শুরু হয়। এই প্রথম রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি মানুষ অধিক হয়ে উঠে এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ মানুষের মধ্যে স্থায়ী রূপ পেতে শুরু করে। শুরু হয় মানবতার বিজয় (যদিও গত শতাব্দীর তিনটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ এবং এক বিংশ শতাব্দীর মার্কিনী আগ্রাসন মানব ইতিহাসে লজ্জাজনক ইতিহাস হয়ে থাকবে)। যার ফলাফল আজকের পশ্চিমী বিশ্ব তথা আধুনিক বিশ্ব।

এদিকে ১৯৪৭ সালে যেভাবে ভারতবর্ষকে বিভাজিত করা হয় তার মূলে ছিল ধর্মভিত্তিক চেতনা, যা দ্বিজাতি তত্ত্ব নামে অধিক পরিচিত। এক সময় সব মুসলমান ভাই ভাই শ্লোগান দিয়ে মুসলমানেরা যে পাকিস্থানের জন্য আন্দোলন করেছিল তারাই আবার ২৩ বছর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্থানের বিরূদ্ধে আন্দোলন করে বাঙলাদেশ নামক আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটায়। বাঙলার দার্শনিক আহমদ ছফার মতে ১৯৭১ এ বাঙলাদেশ রাষ্ট্রটি রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র এবং এর দর্শনও আধুনিক। বাঙলাদেশ রাষ্ট্রটি উদ্ভবের কারণও ছিল একটি বৈষম্যহীন, আধুনিক, অসম্প্রদায়িক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। এর জন্য বাঙলাদেশের জনগন ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত মূল্য দেয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমানদের যেমন অংশগ্রহণ ছিল তেমনি ভাবে এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, পাহাড়ী,উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রায় সকলেরই সমান অংশগ্রহন ছিল। এই চেতনার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মূলত: ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির স্বপ্নের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ১২ই অক্টোবর ১৯৭২ এ খসড়া সংবিধানের উপর যে বক্তৃতা দেন তা হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্নের প্রতিফলন মাত্র। এ প্রসঙ্গে একটি বলা দরকার, কাকতালীয় হলেও সত্যি, যে কক্ষটিকে স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রথম সংসদ হিসেবে ব্যবহার করা হয় তা ১৯৭১ এ পাকিস্থানের টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সংসদ কক্ষটির দেয়ালের প্রায় সব জায়গাতেই লেপ্টে ছিল অসংখ্য নির্যাতিত শহীদ বাঙালির রক্ত এবং তা পরিষ্কার করেই কক্ষটিকে সংসদের উপযুক্ত করা হয়। মূলত: কক্ষটি স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকারকে ৩০ লক্ষ বাঙালির রক্তের ঋণের কথায় মনে করিয়ে দেয় যা বঙ্গবন্ধুও ৪ নভেম্বর ১৯৭২ যেদিন সংবিধান বিল গৃহীত হয় সে কথা স্মরন করতে ভুলেননি।

সেদিনের ভাষণে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে যে ভাষণটি দেন তা হুবহু তুলে দিচ্ছি-

“ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নাই। বৌদ্ধরাও তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নাই। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।…. ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না”।
আমি আইনের একজন ছাত্র হিসেবে জানি, সংবিধানকে যখন ব্যাখ্যা করতে হয় তখন তার প্রতিটি লাইন ব্যাখ্যা করতে হবে আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্য এবং এর চেতনা-কে মাথায় রেখে। এক্ষেত্রে সংসদের Minutes কেই ব্যবহার করা যায় আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্যকে বুঝার জন্য।

স্বাধীন বাঙলাদেশের স্বাভাবিক যাত্রা মূলত: থমকে যায় ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট এ। শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি, পাশ হয় ইমডেমনিটি অর্ডিনেন্স। শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতির কদর্য রাজনীতি। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মূলত: বাঙলাদেশ রাষ্ট্রটি তার স্থপতিকে একভাবে অস্বীকারই করে। ১৯৭৫’র পর থেকে মূলত বাঙলাদেশ রাষ্ট্রটি যোগ্য মানুষের নেতৃত্বহীনতায় ভুগতে থাকে যা এখনও আমরা লক্ষ্য করছি প্রকটভাবে।

খুব কূট বুদ্ধিমত্তার সাথেই মেজর জিয়া ধর্মকে রাজনীতিতে প্রবেশ করান ১৯৭৯ সালে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে। অসম্প্রদায়িক বাঙালির সংবিধানে যোগ করা হয় ধর্মীয় বাণী। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি কেটে ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’ শব্দটি যোগ করা হয়। মূলত: জিয়ার এই সাংবিধানিক রাজনীতির পেছনে ছিল না কোন ধার্মিকতা, ছিল ধর্মীয় কপটতা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের একটি হাতিয়ার হিসেবে। (আরো একটি গোপন কারন ছিল হলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর আর্থিক সাহায্যের হাতছানি। যা পরবর্তীতে আমলাদের ধনভান্ডার বাড়াতেই সাহায্য করে, কিন্তু জনগনের জন্য রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কোন সুফলই আনেননি) যা সম্পূর্ণ অবৈধ আমাদের সংবিধান মতে। শুধুমাত্র সামরিক ফরমান জারী করে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (Basic Structure of the Constitution)কে পরিবর্তন করা য়ায় না। এমনকি অনু্চ্ছেদ ১৪২ ও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এখানে মনে রাখা দরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামো কোন আইন নয়, এটি একটি আদর্শ, যা থেকে আইন তৈরী হয়। আইনের মূল ভিত্তিই হলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, যা একটি আদর্শ থেকে উদ্ভুত। অনেক দেরীতে হলেও ৫ম সংশোধনীর মামলায় (যা মুন সিনেমা হল মামলা নামে অধিক পরিচিত) মহামান্য হাই কোর্ট এটি বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয় যা ২০১০ সালে আপীল বিভাগ এর পক্ষে চূড়ান্ত রায় দেন, যা ছিল সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে বাঙলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের যথাযথ পদক্ষেপ। পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে ২০১১ সালে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১২ পুনরায় স্থাপন করেন কিন্তু অনুচ্ছেদ ২ক তে সরকার রাষ্ট্র ধর্মকে বহাল রেখেই এবং অনুচ্ছেদ ৩৮ এর আংশিক পরিবর্তন করে ১৯৭২র মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার একটি হাস্যকর তামাশা এবং সমন্বয় করার চেষ্টা করেন।

১৯৮৮ তে যখন এরশাদ সরকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রণয়ন করেন তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন তার ক্ষমতায় আসলে রাষ্ট্রধর্মের অনুচ্ছেদটি বাতিল করবেন। কিন্তু ৯১ পরবর্তী কোন গনতান্ত্রিক সরকারই এর বিরূদ্ধে যেতে সাহস করেননি। বরঞ্চ সবাই ধর্মকে ব্যবহার করেছেন তাদের রাজনীতিতে নানানভাবে। আইনের ছাত্র হিসেবে সবচেয়ে বেশী দু:খিত হই এজন্য যে, আমাদের উচ্চ আদালতও তার দুর্বল মেরুদন্ডের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করেছেন নানানভাবে।

এবার আসি মূল কথায়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিলটি পাস করে সামরিক শাসক এরশাদ আসলে জিয়ার পথই অনুসরণ করেন। রাষ্ট্র ধর্ম করার ফলে আদৌ সার্বিকভাবে জনগনের কোন উপকার সাধন হয়েছে কিনা? এ প্রসঙ্গ বাঙালি মুসলমান দার্শনিক ছফার বক্তব্যই সরাসরি তুলে ধরা যাক-

“রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম রাষ্ট্রে কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তা আমার সামান্য জ্ঞানবুদ্ধিতে হদিশ করতে পারছিনা। এর একটি হতে পারে বাঙলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বর্তমান মুহুর্তে সরাসরি ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষণা করলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে কথা চিন্তা করে শুধু ইসলামকে আপাতত রাষ্ট্র ধর্মে পরিণত করা হলো”।

ছফার এই ধারণাটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে বাঙলাদেশের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।

এ প্রসঙ্গে একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞাতার কথা বলি। গত কয়েকদিন আগে হাইকোর্ট বিভাগে অনুচ্ছেদ ২ক কে চ্যালেঞ্জ করা রীটটি খারিজ করে (যদিও কোর্টের ভাষ্য মতে রীটটি খারিজ করা হয় Locus Standi না থাকার কারনে, মেরিট এর অভাবে নয়)। ঐ রাতে সংবাদ দেখার জন্য টিভি অন করি। শুরুতেই সংবাদটি হচ্ছে রাষ্ট্রধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রীটটি হাইকোর্টের খারিজ, সবচেয়ে মজার কথা হলো সংবাদটি পরিবেশন করা হচ্ছে দুটি শিশুর কোলাকুলির দৃশ্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। হয়ত সংবাদ পরিবেশক বেঝাতে চেয়েছেন শান্তির ধর্ম ইসলাম বহাল থাকল। এর পরের সংবাদটি হচ্ছে পাকিস্থানে বোমা হামলায় ৬৫ জন নিহত, তালেবানের দায় স্বীকার। এই অধম লেখক একটু হাসলেন, বুঝলাম ধর্ম সবসময় কোলাকুলির দৃশ্যে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশের মূল্য পাকিস্থান আজ প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে। ছফার ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে আমাদের যাত্রা হয়ত পাকিস্থানের পথেই।

এখানে বলা আবশ্যক আমরা একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আওতাধীন ছিলাম। ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা খারিজ করে দিয়ে এদেশের জনগণ বাঙালি জাতিয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার দাবিতে মুক্তিযুদ্ধ করে। যার ফসল আজকের বাঙলাদেশ। এই দেশটিকে ইসলামীকরণের চেষ্টা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের রক্তের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর ছাড়া অন্য কিছু নয়। এবং ১৯৭১ এ জীবনদানকারী প্রতিটি ধর্মের মানুষের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতার সমান। আর যদি রাষ্ট্রধর্ম একান্তভাবে ঘোষণা করতেই হয় একের অধিক ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ ইন্দোনেশিয়ার কথা উল্লেখ করতে পারি। সেখানে ইসলাম ও হিন্দুধর্মসহ ৫টি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু জনসংখ্যা ৫লক্ষের উপরে নয় আর আমাদের দেশে দেড় কোটির উপর হিন্দু ধর্মালম্বী বসবাস করে। একইভাবে মালেশিয়াও একের অধিক ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তুর্কীও একের অধিক ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের রাষ্ট্রিক চরিত্র পরিষ্কার করেছে। এতে ঐসব দেশের বিন্দু মাত্র ক্ষতি হয়নি। বরঞ্চ লাভবান হয়ে রাষ্ট্র। ইসলামে যে সাম্যের কথা বলা হয়ে তা শুধু মসজিদের সাম্য নয়, বরং রাষ্ট্রের সর্বত্র সাম্যের কথা বলা হয়েছে। সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের ধর্মকে রাষ্ট্রীয় রাজনীতে ব্যবহার কোন ধর্মীয় অনুভূতি থেকে নয় বরং নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেয়ার একনায়ক হীন চরিত্রের প্রকাশ মাত্র। কারণ ব্যক্তি হিসেবে এই দুজন কেমন ধার্মিক ছিলেন তা রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন।
১৯৬৯ সাথে ইতালির বিখ্যাত দার্শনিক নিকোলো মাকিয়াভেলির ৫০০তম জন্ম বাষির্কী পালন করা হয়েছিল। ধর্ম বিষয়ক তার অবজারবেশন এখনও আমাদের দেশে প্রযোজ্য। মাকিয়াভেলির মতে-“রাষ্ট্রের উচিত ধর্মকে কিংবা জনগনের ধর্মীয় প্রবণাতাকে পৃষ্ঠপোষণ করা, কেননা ধর্মপ্রাণ লোকদের শাসন করা সহজ”। ধর্মকে তিনি দেখেছিলেন জনগণকে শাসন করার উত্তম অস্ত্র হিসেবে। আমাদের দেশেও দুই সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদ মাকিয়াভেলির এই ধূর্ত রাজনৈতিক কূট কৌশলকে ব্যবহার করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। দু:খ হয় যখন দেখি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দলটি যখন ক্ষমতায় তখন মৌলবাদীদের সাথে নতজানু দুর্বল সমঝোতা করে। এটি আসলে এক ধরনের ১৯৭১ র আদর্শিক পরাজয়। যার মূল্য বাঙলাদেশকে চরমভাবে দিতে হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজ দু:খ করে লিখেছিলেন বর্তমান সবকারের মৌলবাদীদের সাথে এমন দুর্বল আপোষ কেন করছেন তা তার কাছে বোধগম্য নয়। কেননা, বাঙলাদেশের জনগন মৌলবাদীদের সাথে নেই। এই প্রমাণস্বরূপ তিনি বলেছেন, ৯০ পরবর্তী যে চারটি নির্বাচন হয়েছে তার সবকটিতেই ধর্মভিত্তিক দলগুলো মোট ৮% শতাংশের বেশী ভোট পায়নি।

পরিশেষে বিচারপতি গোলাম রব্বানীর “বাংলাদেশের সংবিধানের বিকাশ, বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি” বই থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি- ঘটনাটি ২০০৮ সালের ৭ই অক্টোবর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের আত্মহত্যার সংবাদ। শিক্ষকের নাম ড.এন্ড্রু অলক কুমার দেওয়ারি। বয়স ৪৮। তার আত্মহত্যার চিককুটে লিখা-“আমার মৃত্যু জন্য কেউ দায়ী নয়। এদেশে জন্মগ্রহণ করাটাই অভিশাপ”। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না কেন তিনি এদেশে জন্মগ্রহন করাটা একটি অভিশাপ ভেবেছেন।

ব্যক্তি হিসেবে আমি আশাবাদী মানুষ। “মানুষের ইতিহাস শুধু মানুষের অগ্রযাত্রা নয়, মানব বিজয়”। আমি বিশ্বাস করি আজ, আগামীকাল কিংবা পরশু ১৯৭১ র কাছে আমাদের সবাইকে আবার ফিরে যেতে হবে। বাঙালির মুক্তির সনদ লেখা হয়ে গেছে ১৯৭১ এ, অন্য কোথাও নয়।