আজ পয়লা মে। ফেসবুকে কমরেডদের লাল বিপ্লবের ডাক। আমি অবশ্য বহুদিন থেকেই লিখে আসছি ইহা আরেকটি পবিত্র কমিনিউস্ট তিথি- যাহা বাম শব সাধনার পুণ্যলগ্ন।
আজ সকালে ন্যাশানাল ইলেকট্রনিক্স মিউজিয়ামে রোবোটিক্স ফেয়ারে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য আমার ছেলে, ভাগ্নে ভাগ্নীরা যেতে অটোমেশন ব্যপারটা কি -একটু এক্সপোজার পায়। অটোমেশনের জন্য সেন্সর বানানো আমার পেশা-সেই সূত্রে কিভাবে আস্তে আস্তে শ্রমিক শ্রেনীর বিলোপ ঘটছে বা ঘটবে-সেটা আমার কাছে খুবই পরিস্কার। কিন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ বামপন্থীর বিদ্যে বইতেই সীমাবদ্ধ-ফলে তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল কিভাবে ১৯৮০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকাতে ফ্যাক্টরি শ্রমিক কমেছে ৯০% ( হ্যা, এখন ১৯৮০ সালের এক দশমাংশ শ্রমিকেই কাজ চলে যায় ), অথচ প্রোডাকশন বেড়েছে প্রায় আড়াইগুন।
কিছুদিন আগে জামসেদপুরে টাটা স্টীলে গিয়েছিলাম। সেখানেও এক গল্প। ১৯৯০ সালে টিসকোতে ছিল সত্তর হাজার শ্রমিক । আজকে প্রায় চোদ্দ হাজার। তার মধ্যেও দশ হাজার উদবৃত্ত।
তাও ত এখনো ফ্যক্টরিতে রোবটের ব্যবহার খুব কম-সবে শুরু হয়েছে। তাতেই এই হাল।
গুগল, আমাজনে সেলফ ড্রাইভিং কারের জন্য আগামী দুই দশকে চাকরি হারাবে প্রায় ৭০% ড্রাইভার। অবশ্য আমেরিকাতে। ভারতের রাস্তায় সেলফ ড্রাইভিং কার কাজ করবে কি না কে জানে।
ডোমেস্টিক রোবট-যা বাড়ির ঝাঁড়পোছ, রান্না করতে পারবে-মানে ডোমেস্টিক মেইড-সেটা ব্যাপক স্কেলে আসতে এখনো পনেরো কুড়ি বছর লাগবে। সেটা হলে রেস্টুরেন্ট, হোটেল ইত্যাদি ব্যবসায় যে কোটি কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়, তাদের অধিকাংশই বেকার বসে যাবে। আরো চল্লিশ বছর বাদে, ভারতেও সব ঘরে ঘরে কাজের মাসির বদলে ডোমেস্টিক রোবট থাকবে।
প্রশ্ন হচ্ছে ২০৫০ সালে বামপন্থীরা কি রোবটদের স্বার্থে মেদিবস পালন করবে? শিক্ষক, নার্স, উকিল , ডাক্তারদের চাকরি যাবার ভয় নেই । কিন্ত অটোমেশনের জন্য এই সব সেক্টরেও চাকরি কমবে। ইউটিউব এবং উইকির চেয়ে ভাল শিক্ষক হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব না।
আগের বার মে দিবসেও এই প্রশ্নই তুলেছিলাম। বাসু আমাকে একটা বই এর পিডিএফ দিয়েছিল। নামটা মনে নেই। তবে বইটার প্রতিপাদ্য ছিল এই যে–
প্রযুক্তি উন্নত হলে শ্রমিকের ডেজিগনেশন চেঞ্জ হয়। শোষনের বদল হয় না। যেমন আই টি কর্মীরা নাকি আরো বেশী শোষিত। তাদের কাজের ঘন্টার শেষ নেই। কিন্ত লেখক যেটা বেমালুম ভুলে গেলেন কোডিং এর ক্ষেত্রে দক্ষতার দাম ওপেন মার্কেটে খুব বেশী- দক্ষ কোডাররা কোন কোম্পানীর হয়ে কাজ করেন না সাধারনত-তারা নিজেদের মতন কনসাল্টিং করেন এবং সেক্ষেত্রে তারা যদি সপ্তাহে ষাট ঘন্টা খাটেন, তাহলে সেটাই বিল করবেন এবং তাদের স্টান্ডার্ড অব লিভিং মালিক শ্রেনীর কাছাকাছিই। কোন টপ কোডার এই সব ইনফোসিস টিসিএসের হয়ে কাজ করে না। কারন এসব কোম্পানীর মাইনে টপ কোডারদের থেকে অনেক অনেক কম। আই টি তে যেসব কর্মীদের ওপর শোষন হয়, তাদের অধিকাংশই আসলে গ্লোরিফায়েড ক্লার্ক। এবং আরো মুশকিল হচ্ছে, এই সব লো এন্ড আই টির কাজ ও অটোমেশনের দৌলতে উঠেই যাবে। আগামী দিনগুলিতে আই টিতেও লো এন্ড স্কিলের কর্মী ঊঠে যাবে-একমাত্র হাইলি পেইড টপ কোডার বা আর্ক্টিটেক্টদেরই চাকরি থাকবে।
মোদ্দা কথা শ্রমিক বলে কিস্যু থাকবে না।
আরেকটা ট্রিভিয়া। হে মার্কেটের ঘটনা ঘটে ৪ঠা মে, ১৮৮৪। ওই সময়টা (১৮৮০-১৯১০) আমেরিকার শ্রমিক ইতিহাসের সব থেকে টার্বুলেন্ট অধ্যায়। অসংখ্য শ্রমিক-মালিক সংঘাত হয়েছে এই সময়। হে মার্কেটের ঘটনা খুব ছোট সেই স্কেলে। হোমস্টেড স্টিলের শ্রমিক মালিক সংঘাত এর থেকেও বড় ঘটনা ছিল -যেখানে শ্রমিকদের ওপর মেশিন গান দিয়ে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছে। এবং হোমস্টেড স্টিলে শ্রমিক নিধন, আমেরিকার ক্যাপিটালিজমের সব থেকে বড় কলঙ্ক। হে মার্কেটের ঘটনা , আমেরিকার শ্রম ইতিহাসে কেউ মনে রাখে নি । হোমস্টেড স্টীলের ঘটনা এখানে অনেক বেশী চর্চিত -কারন ওই ঘটনা পরবর্তীকালে অনেক শ্রম আইন নিয়ন্ত্রনে ব্যবহৃত।
ছোটবেলা থেকে মেদিবস নিয়ে আরেকটা রূপকথার গল্প ফেঁদেছে কমিনিউস্টরা। আমার বহুদিন ধারনা ছিল হে মার্কেটের ঘটনা থেকেই আট ঘন্টার কাজ বাধ্যতামূলক করতে বাধ্য হয় সরকার। এটা ডাঁহা মিথ্যে।
১৮৮০ সাল থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কাজের লোড বৃদ্ধি পেয়েছিল। কমে নি। মোদ্দা কথা শ্রমিক আন্দোলন ছিল গ্রসলি ইনএফেক্টিভ।
তাহলে দৈনিক আটঘন্টা কাজের আইন বা শ্রম সুরক্ষা আইনগুলোর উৎস কি?
আমেরিকাতে শ্রমিকদের রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন এফ ডি আর বা প্রেসিডেন্ট ফ্রাংলিন রুজভেল্ট (১৯৩৩-৪৫)। এবং তা করা হয়েছিল মূলত আন্টিট্রাস্ট আইনের মাধ্যমে মর্গ্যান বা রকাফেলারদের মনোপলি ভেঙে। বাজারে বড় কোম্পানীগুলোর মনোপলি ভেঙে, শ্রমিকদের নুন্যতম বেতন এবং সুরক্ষার নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হোন রুজভেল্ট। তার সাথে হে মার্কেটের কোন সম্পর্ক নেই। সেটা আরেকটা ইতিহাস। এবং সেই ইতিহাসের দাবী শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে দরকার রুজভেল্টের মতন দক্ষ রাজনৈতিক নেতা-যিনি মার্কেটের দক্ষতা বাড়িয়েও শ্রম সুরক্ষা দিতে পারবেন।
তবে হে মার্কেটের ঘটনা আমেরিকাতে কেউ মনে রাখে নি-লেবার ইউনিয়ানগুলোও এখানে পয়লা মে পালন করে না। এখানে অনেক বেশী আলোচিত হোমস্টেড স্টীলের শ্রমিক প্রতিরোধের ইতিহাস।
নতুন টাইপের কাজের সৃষ্টি হবে-যেমন আই টি এসে ক্লার্কদের কাজ খেয়ে নিয়েছে-কিন্ত তার থেকে অনেক বেশী নতুন কাজ তৈরী হয়েছে।
আচ্ছা, শ্রমিকের জায়গাগুলো যদি মেশিন কিংবা রোবটের দখলে চলে যায় তাহলে বাড়তি এই জনসংখ্যাগুলো কোন কাজে আসবে বা মানুষের বড় একটা অংশের জায়গা যদি মেশিন নিয়ে নেয় তাহলে ঐ মানুষগুলোর বেঁচে থাকার মাধ্যম কী হবে?