লেখকঃ জাহানারা নুরী

বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের অতীত ও বর্তমান

দু’দিন আগে ড. আহমদ শরীফের জীবন মঞ্চ থেকে প্রস্থান দিবস নিরবে পার হয়ে গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারীর ২৬ তারিখে নব প্রজন্মের বিজ্ঞান মনস্ক ও যুক্তিবাদী লেখক ড. অভিজিত রায়কে হত্যা করা হয়েছে। আজ ২৭ তারিখ। আজকের দিনেই ২০০৪ সালে আমার শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে মৌলবাদীরা তার মুখে চাপাতি চালিয়ে স্থায়িভাবে তার মুখাকৃতি বিকৃত করে দেয়। সে আঘাতের পর আর বেশি দিন তিনি বাঁচেন নি। বুদ্ধির মুক্তিকামী বাংলাদেশের সকল লেখক ও চিন্তাশীল বোদ্ধা আর সাধারণ মানুষ এবং বাংলার জ্ঞান চর্চার ও চিন্তা জগতের যুক্তিবাদী, সত্যমনষ্ক মানুষগুলোকে স্মরণ করেই এ লেখার সূত্রপাত করছি।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এ দেশে জাতীয়তা, ধর্ম, লোক জীবন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির নানা প্রবণতা নিয়ে নানামুখী বাস্তব ভিত্তিক প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন আহমদ শরীফ স্যার এবং আমাদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছেন তিনি। আমাদের মফস্বল থেকে আসা মনটাকে ঝাঁকিয়ে, কাঁপিয়ে দিয়ে আহমদ শরীফ স্যার তার নিজের উচ্চারিত প্রশ্নাবলীর যে সব উত্তর নিজেই আমাদের অবোধ মনে প্রোথিত কজে দিতে চেয়েছেন তা আর কারু কাছ থেকে পাওয়ার উপায় ছিল না। বঙ্গভাষাভাষীদের মনন ও আবেগের এমন নিরাবেগ বিশ্লেষণ দিয়ে শ্রোতাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়া আর কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পাশাপাশি হুমায়ুন আজাদ ছিলেন তিব্র তীক্ষ্ণ। নির্বুদ্ধিতাকে কেটে বেরিয়ে যেতেন। তাকে সহ্য করার ক্ষমতা সবার ছিল না আজ নেই। ক্ষুদ্র বুদ্ধির মীথ বিশ্বাসী মৌলবাদীদের কলজে কাঁপিয়ে দিতেন তিনি। বাংলার পক্ষে এরা সবাই বেশী। তার সমাজের ধারণ ক্ষমতার বাইরে। বাঙ্গালীর সইছে না এখনও। এটা স্পষ্ট এখন।
অভিজিৎ, তার সমসাময়িক ও তার অনুজরা যাদের বাংলার অগ্রজ বুদ্ধিজীবি হিসেবে চিনতেন এবং এখন যারা সেই প্রজন্মের বলে চিনহিত তাদের ক্রম বিকাশশীল ধারাটি জাতীয়তাবাদের এক বা একাধিক ধারার ক্রমাগত দ্বন্দ্বের ক্রমগতির সাথে বিকশিত ও পুষ্ট হয়েছে। ১৯৭১ সালের ভৌগোলিক স্বাধিকার অর্জনের সাথে সাথেই যে এদের এই ক্রমবিকাশশীল ধারার সংগ্রাম চূড়ান্ত হয়েছে তা নয়। বরং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা রাজনীতি, তাতে তাদের অধিকাংশের প্রয়োজনমত সবাক অথবা নির্বাক যোগ, ক্রমক্ষীয়মাণ বামপন্থীদের কারু কারু ডান ধারার প্রধান দলের সাথে মার্চ করে ক্ষমতা ভাগ করে নেয়া, এবং কারিগরি উৎকর্ষের যুগের হাতিয়ার হাতে ধরা তারুণ্যের পথ অগ্রজ বুদ্ধিজীবিদের এই চরিত্রের, মত ও পথের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে এই জাতীয়তার ধারার সংঘর্ষ চলতি সময়ে তীব্র হয়ে উঠেছে।
২০১৩ এর পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জাতীয়তার সাথে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে কি থাকবে না, ধর্মের মূল চরিত্র কি, জাতীয়তার সাথে ভাষার যোগ, সাহিত্যের সংযোগ এমন হাজারো বিষয় ঘিরে আজ আমাদের মন ও মনন যেমন ঘুরপাক খাচ্ছে, উনবিংশ শতকে তার শুরু। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এক দীর্ঘকাল বুদ্ধিজীবিদের দেখা গেছে তিন ধারায়; (১) সামন্ত সমাজ উদ্ভূত ইসলাম ধরমভিত্তিক, (২)নব্য বুর্জোয়া জাতীয়তাবোধ;(৩) সমাজতান্ত্রিক ও মানবতার প্রশ্নে সম্মিলিত গণ। রাজনীতিও এ তিন ধারায় চালিত হয়েছে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের এক মান রূপ তৈরির প্রয়াস ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ভেতরে দিয়ে লাভ করা ১৯৭১ এর স্বাধীনতা, মাটির মুক্তি, স্বদেশ এর চালচিত্র কল্পনা ধারণকারী সংবিধান রচনার মাধ্যমে, এবং তার ভেতরে উচ্চারিত বুর্জোয়া এবং উদার নৈতিক মানবতা ও সমাজতন্ত্র ধারণকারী রাষ্ট্রের চেতনা সংরক্ষন ও বিকাশ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে। যা তখনকার জীবিত বুদ্ধিজীবিদের অধিকাংশই গ্রহণ করেছিলেন। আমরা দেখতে পাই প্রায় একই ধরণের এক জাতীয় ঐক্য যুক্তফ্রন্টের আমলেও হয়েছিল এবং পাকিস্তানি শাসকদের কূট ষড়যন্ত্রে ঐক্য ভেঙ্গে যায়। তাদের ভেতর সুপ্ত অনৈক্যের ফাটল দিয়ে নির্বিঘ্নে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। সংস্কৃতির বহমানতার পথ তারা চিহ্নিত করতে সমর্থ হয় ও দ্বি-জাতিতত্ত্বের উদরে জাত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বুদ্ধিজীবিদের একাংশ প্রথমে ভাষা তারপর রাজনৈতিক মুক্তির পথে দায়বদ্ধ থাকেন।এই যাত্রাপথে তৎকালীন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা প্রকাশ্যে মৌখিকভাবে সরব ছিলেন। কিন্তু জলে কাদায় নেমে লড়াইয়ের ময়দানে না থাকলে যা হয়, তাদের রচনায় তাদের ভূমিকা প্রতিফলনে তারা সফল হন কমই।
দীর্ঘ দুই শতাব্দীর পথ পরিক্রমার অন্তরালের যে কঠিন বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই তার একদিকে রয়েছে, সমাজে ও বুদ্ধিজীবিদের নিজ নিজ শ্রেণী চরিত্রের মূলগত অপরিবর্তন। অপরদিকে দেখা যাচ্ছে শাসকদের চিন্তা হচ্ছে শাসিতরা ভেড়ার পালের মত তাদের অনুগমন করবে এবং সে চিন্তা থেকেই জনগণ সরকারের সব কথায় হা বলবে, তাদের চিন্তাকে অনুসরণ করবে, নিজ থেকে চিন্তা করবে না, এমন প্রবণতাকে ধরে রাখার প্রয়াসের বাস্তবতাও আমরা দেখেছি।
যেহেতু বুদ্ধিজীবিদের যে ধারা একভাবে এই আত্মতৃপ্তিতে পৌঁছে গেছে যে তারা যে কারণে আগে কথা বলেছে সে কারণ (বাঙ্গালি মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা) অর্জিত হয়ে গেছে তার পর থেকে তার আর অরজনের কিছু নেই ফলে তার কথা বলার ও কিছু নেই। আমরা দেখেছি ১৯৭১ এর পর থেকে দীর্ঘকাল বুদ্ধিজীবিদের অধিকাংশের কি সামরিক কি গণতান্ত্রিক কি স্বৈরাচার আমলের দীর্ঘ নীরবতা ও সৃষ্টিহীনতা। এই বাংলা সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় চোরাবালির ভেতর পা দিয়েছে, দিচ্ছে, এবং রাজনীতি তার সাথে গাঁটছড়া বেধেছে বারংবার। তাদের উদারনৈতিক ফাটল এখন চওড়া হতে শুরু করে খাদে পরিণত হতে শুরু করেছে। আগাগোড়া এই বুসশিজিবি শ্রেণী নীরবতা পালন করেছে। এমনকি ২০১৩ এর এক বৈপ্লবিক পত পরিবর্তনের কালে ও তাদের নিজ শ্রেণী চরিত্র একসময়ে উদ্ঘাটিতো হয়ে পড়ে। এর পর অগ্রজ বুদ্ধিজীবিদের পুরনো অনৈক্যের ঐক্য চোখে পড়ার মতো।
অতিত স্মৃতি রোমন্থন করলে দেখা যায় পাকিস্তানি শাসকেরা তমদ্দুনপন্থি, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের সাথে লড়াই লাগিয়ে দিয়েছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের। হাল আমলের বিজ্ঞাননিষ্ঠদের লাগাতার হত্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আর মনে পড়ছে বুদ্ধিজীবিরা কিন্তু ১৯৭২ এর পর আর তেমন করে নিজেদের সেই জায়গা নিয়ে লড়ে নি, যেমন লড়াই তারা করেছে ১৯৭১ এর আগে। তাদের মধ্যে রাজনীতি থেকে উন্মূলিত মধ্যশ্রেণী হয়েছে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী। যাদের দায়বদ্ধতার স্থানে বিকশিত হয়েছে ধূর্ততা ও কর্মহীণ আত্মপ্রচার। আর যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত তারা মেরুদণ্ড ও হাঁটু দুইই খুইয়েছে। এরা না পারে দাঁড়াতে, না পারে ঘাড় গর্দান খাড়া রাখতে।
এগুলো পরিবর্তন হতে গেলে যে জনতা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের সচেতন প্রয়াস প্রয়োজন, সে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ বলতে চাই, এ প্রেক্ষিতে আমাদের অন্তর্গত পুরনো সেকুলার জাতিসত্তার আদি প্রশ্নাবলীর উচ্চারণ এবং ক্রম উচ্চারণ এখন আরও বেশী জরুরী। সমাজ ভাঙ্গনের মুখে, তারুণ্য আবারও সেই একই যুদ্ধে যা গত আট দশকেও শেষ করা যায় নি, বরং বিগত চার দশকে তাকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ প্রায় পুণঃস্থাপন করতে চলেছে, এবং বর্তমানের বিজ্ঞান ও যুক্তিনিষ্ঠ, ধর্ম সমালোচক বুদ্ধিজীবীদের লড়াইকে করে দিয়েছে আরও কঠিন। যুদ্ধকাল নয় কিন্তু তাদের হত্যা করা হচ্ছে। একালে স্বাধীন বাংলার অগ্রজ বুদ্ধিজীবিদের দৃশ্যমান অনড় শ্রেণী চরিত্রের বাইরে গিয়ে যে উজ্জ্বল দু’ এক ব্যক্তি শ্রেণী শক্তির বিন্যাস নিয়ে কথা বলেছেন, এবং এখনো বলতেন, ড. আহমদ শরিফ তাদের মধ্যে সরবাগ্র সর্বাগ্রগণ্য। তাদের অভাব অনুভব করি।