২০১৫ সালটি ছিল বীভিষিকাময়। অথচ শুরু করেছিলাম সম্ভাবনা দিয়ে। একসাথে দুটো ডকুমেন্টারির কাজ শুরু করেছিলাম, একটি পরিবেশ- প্রতিবেশ আরেকটি আদিবাসী ইস্যুতে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ থেকে দুঃস্বপ্ন তাড়া করে গেছে। সমস্ত কাজ বন্ধ করে, লেখালেখি বন্ধ করে- ধীরে ধীরে ঘরের চার দেয়ালের বন্দীজীবন বেছে নিতে বাধ্য হই। অভিজিৎ রায়কে দিয়ে শুরু, তারপরে একে একে ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নিলয় নীল আর সর্বশেষ ফয়সাল আরেফিন দীপনকে আমাদের মাঝ থেকে হারাই। ব্লগার হত্যার মহোৎসবের মাঝে কুকড়ে যাওয়া জীবন, অনেকটা কীট পতঙ্গের মত, ভয়ে- ক্রোধে- অক্ষম ঘৃণায়- দিন যাপন, আর পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের উৎকণ্ঠার মাঝে নিজেকে আরো স্বেচ্ছাবন্দী করে ফেলা, নিজের উপরে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করা আর কন্ঠে, বুকে, চোখে ও মগজে বিশমনি পাথরের বোঝা চাপিয়ে দেয়া অক্ষম জীবন কাটানো- এই ছিল ২০১৫ সালের জীবন যাপন। পরিবার- সন্তানদের অযুহাত সামনে এনে- এবং আগে প্রাণে বাঁচতে পারলে দূরে থেকেও সংগ্রাম চালানো সম্ভব- এরকম কাপুরুষোচিত আত্মসান্ত্বনা মাথায় নিয়ে- শ্বাপদ হায়েনাদের হাতে দেশটাকে আরো অরক্ষিত করে- দেশত্যাগী যাযাবর জীবন বেছে নেয়া এবং আপাত নিরাপত্তার আস্বাদে কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ফেলা … এই তো ছিল, চলছিল! পরাজয়ের মনোভাব, বেদনা, দেশের চিরচেনা আবহাওয়া- সংস্কৃতিকে হারিয়ে খুজে ফেরা জীবনে- ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে যাওয়া সংস্কৃতি, আবহাওয়া, ঘুনে ধরা- পচন ধরা- বোবা- মগজহীন প্রজন্ম, কলুষিত রাজনীতি- কোন কিছুই দেশত্যাগের সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়ায় না, বরং ফেলে আসা দেশটার, প্রিয় মাতৃভূমির এমন অচেনা, কিম্ভূত পরিণতি প্রতি মুহুর্তে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে; ‘পারিনি’, ‘পারবোনা’, ‘কিছুই হলো না’, ইত্যকার ব্যর্থতাসূচক শব্দগুলো দেশটার অনিশ্চিত ও নিরাশাজনক ভবিষ্যতের জন্যে নিজেকে অপরাধী করে তোলে …

এরকমই একটি প্রেক্ষাপটে- ‘রেজর’স এজ’ ডকুমেন্টারির জন্ম। অনেকদিন ধরেই আমি লেখতে পারছি না, কিছু বানাতে পারছি না … আমার আগ্রহের জায়গা- সেই ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, শিল্প- এসব নিয়ে মনোসংযোগ করতে পারি না, শুরুতে অভিজিৎ রায়, অনন্ত, নীলয় নীলদের নিয়েও কিছু লেখতে পারতাম না- লেখতে গেলেই- বীভৎস ছবিগুলো মাথায় এসে ভর করতো, বোবা কান্না কলম বা কিবোর্ডকে আটকে ধরতো। তারপরেও এ সময়কালে যতখানি যা লিখেছি- তা এই বর্তমান পরিস্থিতি, জঙ্গীবাদের উত্থান, সরকার ও রাজনীতির ভূমিকা! এর বাইরে কিছু লেখতে পারি না, চিন্তাও করতে পারি না! ফলে- ফিল্ম মেকিং এর কথাও যখন মাথায় এসেছে- এই প্রসঙ্গ বা ইস্যুর বাইরে অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারিনি! স্বভাবতই, ‘রেজর’স এজ’ নাস্তিক ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চলমান কথিত ‘জিহাদ’ এর রোজনামচা! আক্রান্ত হওয়া ব্লগাররা, আক্রান্ত হওয়ার ভয়ের সাথে দিনকাটানো ব্লগাররা, খুন হয়ে যাওয়া ব্লগারদের স্বজনেরা, বন্ধুরা কেমন আছে? এই পলিমাটির দেশটি কিভাবে সামান্য কজন লেখকের জন্যে অবাসযোগ্য হয়ে উঠলো, তার অনুসন্ধান করা, মৌলবাদের উত্থানকে সমসাময়িক ফ্রেম থেকে ধরা, এবং দায় খোজা- রাজনীতির, গণমানুষের ও বুদ্ধিজীবি- সংস্কৃতিকর্মীদের দায় খোজা! নদীগুলো যেমন করে শুকিয়ে গেল, আমাদের সংস্কৃতিও শুকিয়ে মরলো, মৌলবাদী- জঙ্গীবাদী শক্তিগুলো বন্যার মতো করে উপচে পড়লো! ভেসে উড়ে কোথায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম আমরা … তারই গল্প এই ‘রেজর’স এজ’ …

এটি একটি চলমান প্রজেক্ট। এখন পর্যন্ত- ৬০ মিনিটের একটি ভার্সন তৈরি করতে পেরেছি। শুরুতে ১০ মিনিটের একটি ভার্সন এবং পরে ৪০ মিনিটের আরেকটি ভার্সনের দুটো শো হয়েছে- ইউরোপে। ৬০ মিনিটের ভার্সনের একটা মিনি অনলাইন ভার্সন মুক্তমনার জন্যে তৈরি করলাম। মিনি ভার্সন বললেও- এটাও ১৮ মিনিটের। সঙ্গত কারণেই- যারা এখনো বিপদের আশঙ্কা করেন এবং নিজ চেহারা ও পরিচয় উন্মুক্ত করতে চান না- তাদের সাক্ষাৎকার চেহারার বদলে- ‘এনোনিমাস’ মুখোশ বা অবয়বের আদলে দিয়েছি। কারোরই নামধাম ও ঠিকানা এখানে বলা হয়নি।

ছোট করে- এই ডকুমেন্টারির দুএকটি বিষয়ে আমার ব্যাখ্যাটি দেই। অনেকেই আপত্তি তুলেছেন- এক ওয়াজে বলা হুজুরের বয়ানঃ “ইসলাম বলেছে এদের টুকরো টুকরো করতে হবে”- এই লাইনটির পুনঃ পুনঃ ব্যবহারে। আমি কি ইসলামকে ডেমোনাইজিং করতে চেয়েছি? আমার জবাব হচ্ছে- না! আমার পুরো ডকুমেন্টারিতে কোথাও আমি জানাই নি বা আর্গুমেন্ট করিনি- আসলেই ইসলাম কি বলে? মুহাম্মদ সা এর কটুক্তকারীকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করতে চাওয়া ইসলাম সমর্থন করে কি করে না- সেটার অনুসন্ধানও আমার আগ্রহের বিষয় ছিল না! আমি কেবল দেখাতে চেয়েছি- আজ যে হত্যার মহোৎসব শুরু হয়েছে- সেটা ইসলামের নাম করে হচ্ছে এবং দেশের আইন শৃংখলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এরকম প্রকাশ্য হত্যার হুমকির চাইতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে অধিক গুরুতর অপরাধ! এখানে নাস্তিক লেখক- প্রকাশকদের খুন করা- একটা বাস্তবতা, তার চাইতেও বড় বাস্তবতা হচ্ছে- এর বিরুদ্ধে বেশিরভাগ জনগণের নিশ্চুপ থাকা। লাখ লাখ মানুষ যখন নাস্তিকদের ফাসীর দাবিতে রাস্তায় নামে, সমস্ত রাজনৈতিক দল যখন এই ইসলামবাদীদের তোয়াজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে- সেই প্রেক্ষাপটে দেশের আনাচে কানাচে- ইসলামের কটুক্তকারীকে হত্যার নির্দেশ দেয়াটা – একটা নৈমত্তিক ব্যাপার এই দেশে! সেই বাস্তবতাটাকে আমি অস্বীকার করতে পারি না, যারা দিনরাতে এই টুকরো টুকরো করার বয়ান দেয়- তাদের সেই বয়ানে যে- অসংখ্য জিহাদী বান্দা চাপাতি শান দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ হবে- সেটাই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতাকে আমি অস্বীকার করতে পারি না- প্রতিটা হত্যাকান্ডেই, হত্যাকান্ডের বীভৎসতার ধরণে, আমার মাথায় এই টুকরো টুকরো করতে চাওয়া কানে বাজে! ঢাকার রাস্তায় কদাচ বের হলেও মুহুর্তে মুহুর্তে ভয়ে কেপে ওঠা- সেটাও ঐ টুকরো টুকরো করে ফেলার আতঙ্কেই! এই লাইন কটি আমার ব্যক্তিগত জীবনে- চলতে ফিরতে যে ট্রমা আমাকে উপহার দিয়েছে- সেটাই আমি ব্যবহার করেছি- এই ডকুমেন্টারিতে। এবং- যখনই কেউ তা সে রাজনীতির নেতাই হন আর মিলন- জাকির তালুকদার- তুষাড় টাইপের বুদ্ধি(প্রতিবন্ধী)জীবিই হন- তারা যখন- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপরাধকে সামনে এনে এই হত্যার মহোৎসবকে জায়েজ করেন- আমার মনে হয়- তাদের সেই আলাপ বা যুক্তির পাশে আসল অনুচ্চারিত কথাটাই হচ্ছে এই “টুকরো টুকরো করতে হবে” কথাতা। সেটাই আমি উল্লেখ করেছি- আমার ডকুমেন্টারিতে।

সামারসেট ম’মের উপন্যাস ‘রেজর’স এজ’ (https://en.wikipedia.org/wiki/File:The_Razor’s_Edge_1st_ed.jpg) থেকে আমার ডকুমেন্টারির নাম নিয়েছি। কমন জায়গাটা হচ্ছে- ট্রমা। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত এক পাইলটের ট্রমা- সেটা আমার এখানে- চাপাতীর আক্রমণের মুখে লেখকদের ট্রমা, দেশের গণতন্ত্রকামী- মুক্তিকামী সেক্যুলার মানুষদের ট্রমা। চাপাতি বা খুরের ধার বনাম কলমের কালি- কোনটি শক্তিশালী- এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- কোনটির প্রভাব কি? যদি মনে করি একটি সভ্যতা- মনুষ্যত্বকে পিছিয়ে নেয়, অপরটি এগিয়ে নেয়, তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে, চাপাতির ধারকে পরাস্ত করার আর কোন বিকল্প নাই- মনুষ্যত্বকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে।

ডকুমেন্টারি দেখে আপনাদের মতামত, মূল্যায়ন জানাবেন আশা করি। কাজটি আমাদের জন্যে মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। ভয়ানক, প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগুতে হয়েছে। ভীষণ রিস্কের মধ্যে এর শ্যুটিং করা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে শ্যুট করা সেই ফুটেজগুলোর একটা বড় অংশ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ১০ মিনিটের প্রাথমিক একটি ভার্সন উদ্ধার করতে পেরে- প্রাথমিক শককে পেছনে ফেলে আবার কাজ শুরু করা। এবং একটা কাঠামো দেয়ার মত অবস্থায় যাওয়া। এবং এই ডকুমেন্টারিটি- হুমায়ুন আজাদ, আহমেদ রাজীব হায়দার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলয় নীল ও ফয়সাল আরেফিন দীপনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমও বটে।

প্রিয় অভিজিৎ রায়ের হত্যার এক বছর- কিংবা প্রিয় হুমায়ুন আজাদের উপরের আক্রমণের এক যুগ- এরকম একটি ক্ষণেই ডকুমেন্টারিটির একটি ভার্সন পাবলিকলি প্রকাশ্য করার জন্যে যথার্থ। বন্যা আপার ভাষায় বলি- সভ্যতা আগায়, মানুষ আগায়, সমস্ত প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে আমরাও এগুবো নিশ্চয়ই …